#প্রেমে_পড়া_বারণ পর্ব ৮
লেখা: জেসিয়া জান্নাত রিম
অবশেষে পাঁচ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে আফিফ আর তিথির এনগেজমেন্ট কিছুক্ষণ আগে সম্পন্ন হয়েছে। সবাইকে বেশ খুশি লাগছে। তবে সবথেকে বেশি খুশি হয়েছে আফিফ আর তিথি। আংটি বদলের পর সবাই বিয়ের বিষয়ে আলোচনা করছিল। এর মাঝেই তিন্নির ফোন বেজে ওঠায় আলোচনা ছেড়ে উঠতে হলো তিন্নিকে। ইফতেখারের নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। ঘন্টা দুই আগেই কথা হয়েছিল ইফতেখারের সাথে তিন্নির। এখন আবার কেন ফোন করছে ইফতেখার। এসব ভাবতে ভাবতেই ফোন রিসিভ করল তিন্নি। ওপাশ থেকে অপরিচিত একজনের কন্ঠ শোনা গেল। লোকটি বলল,
— এই ফোনের মালিক এক্সিডেন্ট করেছেন। আমরা তাকে মেডিকেলে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি কাইন্ডলি সেখানে চলে আসুন অথবা কাউকে পাঠিয়ে দিন।
হঠাৎ করে কথাটা হজম করতে পারলো না তিন্নি। সে প্রশ্ন করল,
— ইফতি ভাই এক্সিডেন্ট করেছে?
— ওনার নাম তো জানি না। তবে খুবই খারাপ অবস্থা ওনার। আপনি জলদি আসেন।
— আপনি একটু খেয়াল রাখুন আমি এক্ষুনি আসছি।
কথাটা বলেই ফোন রেখে দিল তিন্নি। একটা উবার ডেকে পর্যাপ্ত টাকা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো ও। ড্রয়িং রুমে সবাই বসে আছে। বের হওয়ার আগে শিরিন কে উদ্দেশ্য করে তিন্নি বলল,
— সরি আন্টি আমাকে এখনই বেরিয়ে যেতে হবে। বিয়ের বাকি আলোচনা করতে আমি নিজে আপনার সাথে দেখা করবো।
মেয়ের কথা শুনে শায়লা এগিয়ে এসে বললেন,
— আজ না তোর ছুটি ছিল? এখন কই যাস?
— ইফতি ভাই এক্সিডেন্ট করেছে মা। আমাকে যেতে হবে।
— তুই একা যাবি?
— একাই তো যাই সবসময় মা। চিন্তা করো না।
— ফোন করিস।
— ঠিক আছে মা। আমি আসি।
এই পর্যায়ে শিরিন বললেন,
— একা যেও আমাদের গাড়ি নিয়ে যাও। আবিদ যাক তোমার সাথে।
— প্রয়োজন নেই আন্টি। অলরেডি উবার ডেকে নিয়েছি। এক্ষুনি চলে আসবে।
বলতে বলতেই ফোন বেজে উঠলো তিন্নির। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ও বলল,
— দেখুন চলেও এসেছে।
আর কথা বাড়ালো না তিন্নি। দ্রুত নিচে চলে গেল। আবিদ তিথির পাশেই বসে ছিল। তিন্নি চলে গেলে কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
— ইফতি ভাইটা কে ভাবী?
— রেডিও গুনগুন এর ফাউন্ডার। তিন্নির সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক ওনার।
— উনি কোন ভাবে রিক্স আমার জন্য।
— বলতে পারছি না। তবে আমার মনে হয় না। নাহলে এতো বছরে বোঝা যেত।
শায়লা চিন্তিত হয়ে শিরিনের পাশে এসে বসলো। শিরিন সান্তনা দিতে শায়লার হাত দুটো নিজের হাতে নিল। শায়লা বলল,
— দেখুন তো এত ভালো একটা দিনেই এমনটা ঘটতে হলো। আল্লাহ ছেলেটাকে সুস্থ রাখুন। খুব ভালো ছেলে।
— চিন্তা করবেন না। তিন্নি ফোন করে জানাবে বলল তো।
— মেয়েটার চিন্তাও কি কম করি।
— তিন্নি খুবই রেসপনসেবল একটা মেয়ে। আসলে আমি আরেক টা প্রস্তাব ও দিতে চাইছিলাম। কিন্তু এখন সঠিক সময় কিনা বুঝতে পারছি না।
— আপনি বলুন না সমস্যা নেই।
— আমি চাইছিলাম তিন্নিকে আমার ছোট ছেলে আবিদের বউ করে নিতে চাই।
শায়লা শিরিনের হাতটা ছেড়ে দিলেন। সবাই মোটামুটি অবাক শিরিন যে এমন কিছু বলবেন এটা কেউই ধারণা করতে পারেনি। শায়লা নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
— এমনটা যদি হতো আমার থেকে খুশি কেউ হতো না। কিন্তু আমার হাতে কিছুই নেই। তিন্নির ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অনেক আগেই হারিয়েছি আমি। আল্লাহর কাছে একটা দোয়াই করি আমার মেয়েটার জীবনে এত ভালোবাসা আসুক যে ও সেটাকে কোনোভাবেই এড়াতে না পারে।
— আপনার দোয়া বোধহয় আল্লাহ শুনে নিয়েছেন।
— মানে?
— আমি আমার ছোট ছেলেকে খুব ভালো করে চিনি। ছোটবেলা থেকেই ওর যেটার ওপর মন চলে আসে সেটা ও নিজের বানিয়ে ছাড়বে। আর যে জিনিস বা তাকে ও ভালোবাসে সারাজীবন সেটা আগলে রাখতে জানে। এবার ও আপনার মেয়েকে ভালোবেসেছে। তাকেও নিজের বানিয়ে ছাড়বে ইনশাল্লাহ। আমি জানতে চাই এতে আপনার কোনো সমস্যা আছে।
— সত্যি বলছেন আপনি?
— অদ্ভুত কো ইনসিডেন্ট কিন্তু আপনার দুই মেয়েকেই আমার দুই ছেলে পছন্দ করেছে।
— কিন্তু তিন্নি কি রাজি হবে?
— আমার ছেলের উপর আমার পুরো কনফিডেন্স আছে।
এবার তিথি বলল,
— আমাদের ও তিন্নির ওপর পুরো কনফিডেন্স আছে।
শিরিন প্রশ্ন বোধক দৃষ্টিতে তিথির দিকে তাকালো। তিথি বলল,
— তিন্নি অনেক জেদি। সূর্য পশ্চিম দিকে উঠতে পারে কিন্তু তিন্নির না কে হ্যা তে পরিবর্তন.. উঁহু অসম্ভব।
— একটু বেশি বলছো না।
— আই উইশ। কিন্তু ও ছোট থেকেই প্রচন্ড জেদি। তিন্নির গানের গলা ছোট থেকেই প্রচন্ড ভালো। প্রাইমারি পর্যন্ত কত প্রাইজ জিতেছে গান গেয়ে। আব্বা ওর এত আগ্রহ দেখে ওকে ঢাকায় গানের স্কুলে ভর্তি করাতে চাইলেন। ওর কি হলো কে জানে। একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে ও বলল ও আর গান গাইবে না। আজ পর্যন্ত ওর গান আমরা শুনিনি। তারপর নাইনে গ্রুপ সিলেকশনের সময় আমরা সবাই ভেবেছিলাম ও সাইন্স নিবে। কিন্তু ও নিলো আর্স। আব্বা আর আমি এত বোঝালাম তবুও ও গ্রুপ চেঞ্জ করলো না। এগুলো আগের কাহিনী। আব্বা মারা যাওয়ার পর থেকে তো ওর জেদ দিগুন হয়ে গেছে। একদিন এসে বলল ও কোনোদিনই বিয়ে করবে না। এরপর থেকে বিয়ের কথাই ওর সামনে তোলা যায় না।
শিরিন কিছুক্ষণ চিন্তা করে আবিদ কে বললেন,
— বিষয়টা খুবই কঠিন হবে কিন্তু তুই পারবি অসম্ভব কে সম্ভব করতে।
— কঠিন হবে বলেই সম্ভব করতে পারবো। তবে তোমরা হেল্প করবে তো?
আবিদ সবার দিকে তাকালো। উপস্থিত সবাইই আবিদের কথায় সম্মতি জানালো।
ট্রাকের সাথে খুবই বাজে ভাবে ইফতেখারের বাইকের এক্সিডেন্ট হয়েছে। অবস্থা আশঙ্কাজনক। তিন্নি সমস্ত ফর্মালিটিজ পুরণ করে দিয়েছে। ইফতেখারের পরিবার কেও জানানো হয়েছে। তারা যেকোনো মুহূর্তে চলে আসবে। তিন্নি এখন অপারেশন কেবিনের বাইরে পায়চারি করছে। যতটা সম্ভব নিজের মনের নেগেটিভ ধারনা গুলো দমিয়ে রেখেছে ও। সাথে ভীষণ অসস্তি হচ্ছে। ওর বাবা মারা যাওয়ার পর এই তৃতীয় বারের মতো হসপিটালে এসেছে ও। প্রথমবার সানভির মাথা ফেটে যায় তখনই ও টের পায় হসপিটাল ওর আর সহ্য হচ্ছে না। দ্বিতীয় বার আবিদ কে নিয়ে এবং এই যে ইফতেখারের জন্য আসা। আজকের অনূভুতিটা অনেকটা ওর বাবার মৃত্যুর দিনের মতো। ওর এখনো মনে আছে। সেদিন শেষ পরিক্ষাটা দিয়ে সবে বাড়ি ফিরেছে ও। তখন ও দাদীর সাথে গ্রামে থাকে। বাড়ি ফিরেই সবার আগে বাবাকে ফোন দেওয়ার উদ্দেশ্যে ড্রয়ার থেকে ফোন বের করে যখনই অন করলো অপরিচিত নাম্বার থেকে অসংখ্য মিস কল দেখতে পেল। ফোন করবে কি না ভাবতে ভাবতে ঐ নাম্বার থেকে আবারো ফোন এলো। ও সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই ফোন রিসিভ করল। ওপাশ থেকে একজন জানালো ওর বাবা এক্সিডেন্ট করেছেন। মাথায় ভীষণ আঘাত পেয়েছেন। হসপিটালে খুবই ক্রিটিক্যাল অবস্থায় আছেন। যে ভদ্র লোক ফোন দিয়েছেন তিনি ওর বাবার কলিগ। হসপিটালে আনার সময় ওর বাবাই ভদ্র লোককে তিন্নির নাম্বার দিয়ে বলেছে কিছু হলে যেন একমাত্র তাকেই জানানো হয়। তিন্নি আর এক মুহূর্ত দেরি করে নি। গ্রামের এক ভাইয়ের গাড়ি নিয়ে তখনই রওনা দিয়েছে। তখনও তিন্নি টিউশনি করতো। বৃত্তি ও পেত। আর মাসে মাসে বাবাও কিছু হাত খরচ পাঠাতো। সমস্ত টাকাই তিন্নি অল্প কিছু খরচ করে জমিয়ে রাখতো। কত জমেছিল জানেনা তিন্নি। কিন্তু সেদিন ঠিক ঐ টাকা গুলোর সবটাই খরচ হয়েছিল। এর কম ও না বেশি ও না। তিন্নির মনে হয় হয়তো সেদিনের জন্যই ও টাকা গুলো জমিয়েছিল। সেদিন রাস্তাও শেষ হচ্ছিলো না। প্রায় চার ঘণ্টা জার্নি করে যখন হসপিটালে পৌঁছালো তখনও ওর বাবার জ্ঞান ফেরেনি। কিভাবে কি করতে হবে ও কিছুই বুঝতে পারলো না। শেষ পর্যন্ত ও রওনক কে ফোন দিয়েছিল। রওনকে সাথে নিয়ে সমস্ত ফর্মালিটিজ পুরণ করেছিল ও। সেদিনের প্রতিটি দৃশ্যই মানসপটে ভেসে উঠছে তিন্নির। তবে ইফতেখারের পরিবার এসে যাওয়ায় সেটা কে এড়ানোর উপায় পেয়ে গেল ও। ইফতেখারের পরিবার বলতে ওর বাবা মা আর ওর ছোট ভাই। ইফতেখার এর মা এসে তিন্নির দুহাতে ধরে বিচলিত কন্ঠে বললেন,
— আমার ছেলেটার কি অবস্থা? কই ও?
তিন্নি হঠাৎ কিছু বলতে পারলো না। তিন্নি কে চুপ থাকতে দেখে ইফতেখারের বাবা এগিয়ে এসে বললেন,
— চুপ করে থেকো না। বলো কিছু?
— আংকেল আপনাদের শক্ত হতে হবে। ডাক্তার বলেছেন অবস্থা আশঙ্কাজনক। যেকোনো কিছু হয়ে যেতে পারে। আল্লাহ কে ডাকুন। ইফতি ভাই যেন সুস্থ হয়ে উঠে।
— কিভাবে কি হলো? তুমি ছিলে ওর সাথে?
— না। আমি বাসায় ছিলাম। একজন ফোন করে আমাকে জানালো। ট্রাকের সাথে ইফতি ভাইয়ের বাইকের এক্সিডেন্ট হয়েছে। হেলমেট ভেঙে মাথায় ঢুকে গেছে। এজন্য অপারেশন করতে হচ্ছে।
তিন্নির কথা শুনে ইফতেখারের মা ফ্লোরে বসে পড়লেন। ইফতেখারের বাবা এগিয়ে স্ত্রীকে ধরলেন। তিন্নি ইফতেখারের ভাইয়ের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
— ইমতি তোর বাবা মাকে সামলা। তোকে শক্ত থাকতে হবে। আল্লাহর রহমতে ইফতি ভাইয়ের কিছু হবে না। সামনে খুবই কঠিন পরিস্থিতি আসবে তোকেই সব সামলাতে হবে।
— আপা ভাইয়া ঠিক হবে না?
তিন্নি কোনো কথা খুঁজে পেল না। ওর অসস্তি বাড়ছে। ও অপারেশন কেবিনের বাইরে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। হে আল্লাহ ইফতেখার ভাইকে তুমি সুস্থ করে দাও। বার বার এই দোয়াই করতে লাগলো ও।
চলবে………