#মায়াবন_বিহারিণী পর্ব ১৯
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
৪৮.
খানিকটা অন্ধকার হলেও নদীর স্বচ্ছ পানি চিকচিক করছে। নদীর পাশে আসতে অনেকটাই বেগ পেতে হয়েছে উপমাকে। আবেগের বাসা থেকে একটু দূরেই বলা চলে নদীটাকে। এত পরিশ্রম তখনই পূর্ণতা পাবে যখন সে তার কাঙ্ক্ষিত প্রিয় মানুষটিকে স্বচক্ষে দেখতে পারবে। আর হলোও তাই। ঘাটে বাঁধানো নৌকার পাশেই পুরুষালী দেহের অবয়ব চোখে পড়ে তার এবং তাকে চিনতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব হয় না উপমার।
একটু আগেই যখন সায়ানকে আবেগের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার পর প্রত্যুত্তরে যখন সায়ান বলেছিল যে আবেগ বেরিয়ে পড়েছে তখন একটুর জন্য মাথা ঘুরে উঠে নি উপমার। তাকে এমন বিচলিত হতে দেখে সায়ান সশব্দে হেসে দিয়ে বলে দেয় আবেগ এই মুহূর্তে কোথায় আছে। নিজের স্বভাবে কিছুটা লজ্জা পেয়ে সায়ানকে ধন্যবাদ জানিয়ে সেখান থেকে দ্রুত প্রস্থান করে উপমা।
আবেগকে দূর থেকে দেখতে পেয়েই মুচকি হাসে উপমা। অতঃপর ধীর পায়ে এগিয়ে যায় আবেগের দিকে। অন্যদিকে বেশ খানিকক্ষণ হতে চললো আবেগ নদীর পাশেই বসে আছে এই ভেবে কখন উপমা আসবে। একটু পরেই তো চলে যেতে হবে তাকে। তাকে নিয়ে উপমার এমন বেখেয়ালীপনা ঠিক মেনে নিতে পারলো না আবেগ। হঠাৎ করেই তার মনে একঝাঁক অভিমান হানা দিল। সেই সুবাদে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বসা থেকে উঠে পড়ে। অতঃপর পেছনে ঘুরে তাকাতেই ভুত দেখার মতন চমকে উঠে কয়েক পা ছিটকে দূরে সরে দাঁড়ায় সে। আর সেটা পরিলক্ষিত হতেই না চাইতেও খিলখিল করে হেসে দেয় উপমা।
মৃদু আলোর ছিটেফোঁটা উপমার মুখশ্রী জুড়ে পড়তেই মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে আবেগ। মনে মনে সময় থেমে যাওয়ার মতো অদ্ভুত ইচ্ছে পোষণ করে বসে সে। অপরদিকে আবেগকে নিজের দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকতে দেখে হাসি থামিয়ে দেয় উপমা। গলা সামান্য খাঁকারি দিয়ে রসিকতার সুরেই বলে উঠে সে,
– “কি ব্যাপার ভ্যাবলা কান্ত মশাই; ভয় পেয়ে গিয়েছেন মনে হয়! কই আগে তো জানতাম না ডাক্তার মশাইয়েরাও ভীতু হয়।”
উপমার কথায় মাথা হালকা চুলকে নেয় আবেগ। প্রত্যুত্তরে কিছুই বলে না সে। মিনিট কয়েকের নিস্তব্ধতা। কারো ঠোঁটেই কোনোরূপ কথা নেই; যা হচ্ছে তা শুধু চোখের ভাষার বিনিময়। দুজনের চোখই দুজনের চোখে আবদ্ধ। এ নিশ্চুপতাই কত কথা বলে যাচ্ছে একে অপরের সাথে, আবার অভিযোগ ও শুনিয়ে দিচ্ছে মাঝেমধ্যে। মিনিট পাঁচেক বাদেই সেই নীরবতাকে ভেঙে দিয়ে সামনে এগিয়ে যেয়ে বসতে বলে উপমা। আবেগ ও তাই করে।
– “আচ্ছা আপনে ফের কবে আসবেন?”
উপমার বলা এ ছোট বাক্যেও যে রাজ্যের বিশাল কষ্ট লুকিয়ে আছে তা মুহূর্তেই বুঝে নেয় আবেগ এবং তা শুনে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে।
– “খুব শীঘ্রই আসব শ্যামবতী! আর তোমাকেও তোমার ডাক্তার মশাইয়ের কাছে চিরদিনের জন্য নিয়ে যাব; যাতে করে ডাক্তার মশাইয়ের বদ্ধ কুটির হতে আর ছুটে না যাও।”
বিনিময়ে মুচকি হাসে উপমা। এভাবেই কেটে যায় কিছুক্ষণ সময়। এ বিদায়ে হৃদয় ব্যাথিত হলেও এ সময়টা স্বরণীয় করে রাখার মতো। ভোরের আবছা আলোতে চারপাশ হালকা হালকা আলোকিত হতে শুরু করেছে। উপমা আর আবেগ দুজনেই উঠে দাঁড়ায়। বিদায় পালা ক্রমশ যে ঘনিয়ে আসছে। উপমা তার বিষন্ন হৃদয় নিয়েই হাতে থাকা রুমাল টা আবেগের দিকে এগিয়ে দেয়। প্রথমে ভ্রু কুঁচকে নিলেও পরবর্তীতে উপমার দেয়া সেই রুমাল টা হাতে নিয়েই আবেগ খেয়াল করে কেউ একজন খুব যত্ন করে তাতে কারুকাজ ফুটিয়ে তুলেছে। রঙিন সুতোয় গাঁথা আবেগের নাম ক্ষুদ্রাক্ষরে।
আবেগও খুব সযত্নে সেটা তার শার্টের পকেটে পুরে নেয়। চোখের ইশারায় উপমাকে তার চলে যাওয়ার কথা জানাতেই গুটি গুটি পায়ে আবেগের সামনে এসে দাঁড়ায় উপমা।
– “সাবধানে থাইকেন। আর জলদিই ফিরা আইসেন। এই ত্রিমোহিনী আর এই উপমা দুইজনই আপনার জন্য অপেক্ষা করব।”
মৃদু কন্ঠে উপমার আবেদন। আবেগ ও মৃদু হাসে তার প্রেয়সীর কথায়। হাত দুটো প্রসারিত করে উপমার চিবুক ছুঁয়ে দিতেই পিলে চমকে উঠে উপমা। পুরো শরীর জুড়ে এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যায়। মাথা তুলে তাকাতেই আবেগের চোখে চোখ পড়ে তার। সে চোখের ভাষা কি যে গভীর তা অনুভব করার ব্যর্থ চেষ্টা করে সে। অন্যদিকে উপমার কাজল রাঙা কৃষ্ণ চোখ দুটোর অতলে এক মুহূর্তের জন্য ডুবে যায় আবেগ।
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিন্তু কিছু ভুল বলেন নি,
‘প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস,
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ!’
এই কথার ভাবার্থ আমি এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।”
আবেগের কথায় লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়ার মতো অবস্থা উপমার। চোখ দুটোও তড়িৎ গতিতে নিচে নামিয়ে ফেলে সে। লজ্জা পেলেও যে কোনো রমণীকে অদ্ভুত সুন্দর লাগতে পারে তা আগে জানত না আবেগ। ঠোঁট দুটো কিঞ্চিত প্রসারিত করে ধীরে এগিয়ে গিয়ে উপমার কপালে নিজের ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়।
– “ভালোবাসি শ্যামবতী!”
উপমাও প্রত্যুত্তরে মাথা নিচু করে ধীর কন্ঠে বলে উঠে,
– “আমিও ভালোবাসি ডাক্তার মশাই।”
৪৯.
প্রিয় মানুষের কাছ থেকে দূরে যাওয়া বরাবরের মতই যথেষ্ট কষ্টকর। আর সেখানে যদি কেউ কারো প্রতি প্রবলভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে তাহলে তো কোনো কথাই নেই। উপমা আর আবেগের ক্ষেত্রে ও ঠিক একই ঘটনা ঘটছে। উপমা দু পায়ে এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর আবেগের অবয়বটাও ক্রমশ তার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। এইতো আরেকটু হলেই হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে তার অবয়ব। আর হলোও সেটাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবেগ আর তার মাঝে বিশাল এক দূরত্ব তৈরি হলো। উপমাও সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। অতঃপর নিজেই বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
– “আপনি আইবেন তো ডাক্তার মশাই? আপনার প্রেয়সীরে সত্যিই কি নিজের করে নিয়ে যাইতে পারবেন; নাকি তার আগেই সবটা কর্পূরের ন্যায় বাতাসে মিলাইয়া যাইব!”
এ কন্ঠে যেন অজানা এক আশংকা লুকায়িত। যা উপমার সুপ্ত হৃদয়ের সব রঙকে মুহুর্তেই ফ্যাকাশে করে ছেড়ে দিয়েছে।
ভোরের আলো ফোটার একটু পরেই চুপিচুপি সবার নজর এড়িয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে উপমা। এখনও সবাই ঘুমিয়েই আছে। সেই ধারণা নিয়েই বারান্দায় প্রবেশ করতেই কোনো পুরুষালি হাতের চড় তুমুল গতিতে এসে পড়ে উপমার কোমল গালে। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে যায় উপমা। সাথে সাথেই মুখ থেকে মৃদু কন্ঠে বেরিয়ে আসে, ‘আহ্!’
মাথাটা পুরো ঝিমঝিম করছে। করারই কথা; এত শক্তিশালী চড় খেলে যে কারোরই মাথা ঘুরে যাবার কথা। ধীরে ধীরে মাথাটা তুলে তাকাতেই খেয়াল করে ইফতেখার সাহেব তার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। চেহারায় তার রাগ ও ক্ষোভের মিশ্রণ। আমেনা বেগম ও পেছনে দাঁড়িয়ে সরু দৃষ্টিতে তার দিকেই চেয়ে আছেন। হঠাৎ করে যে কি হলো তা বুঝতে পারে না উপমা।
– “আব্বা, তুমি আমার গায়ে হাত তুললা? কি করছি আমি?”
ইফতেখার সাহেবের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করে ওঠে উপমা। উপমার কথা শুনে অনেকটাই মুখ বাঁকিয়ে কটাক্ষের জবাবে আমেনা বেগম বলে উঠেন,
– “ন্যাকা সাজা হইতাছে মুখপুড়ী? অ্যাহ্, সারা গ্রামগঞ্জে ঘুইরা ঘুইরা নাগরের সাথে প্রেম করবি আবার উল্টো জিজ্ঞেস করিস কি হইছে!”
আমেনা বেগমের কথার ভাবার্থ খুঁজে পায় না উপমা। কার কথা বলছে সে?
– “কি সব বলতেছ তোমরা? কার সাথে ঘুরছি আমি?”
– “চুপ একদম চুপ! মুখপুড়ী, অপয়া একটা! আবার মুখে মুখে তর্ক করিস। সজল সব দেখছে। কি কইরা তুই ঐ ডাক্তার বেটারে জড়াইয়া ধইরা আছিলি। ছিঃ ছিঃ! গ্রামে কুকাম কইরা বেরাইয়া মুখে তার বড় বড় কথা। বলি কি লজ্জা করে না? ঐ নদীর ঘাটেই তো ডুইবা মরলে পারিস।”
আমেনা বেগমের কথায় এবার সবকিছু ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করে উপমার কাছে। সজল যে তার চরিত্রে এভাবে নর্দমার কাদা ছুড়ে মারবে তা কে জানতো? সে প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইফতেখার সাহেব কাট কাট গলায় বলে উঠেন,
– “আইজকাই এইসবের মিটমাট কইরা দিতে হইব। আর কান খুইলা শুইনা রাখ; আইজকাই তোর বিয়া হইব তাও আমার পছন্দের পোলার লগে। সজলের লগেই তোর বিয়া হইব। তোর কারণে আমি আমার মানসম্মান হারাইতে পারুম না।”
ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে মুহুর্তেই পুরো চেহারার রং উড়ে যায় উপমার। কি করে সম্ভব এ? সজলের মতো একজন চরিত্রহীন মানুষকে বিয়ে করার চেয়ে তো ঐ নদীতে ডুবে মরাই উত্তম মনে হলো উপমার কাছে। কিন্তু না, এই বিয়ে করা সম্ভব নয়। এই বিয়ে হয়ে গেলে আবেগের কি হবে। এই ভাবতে ভাবতেই উপমা প্রতিবাদী স্বরে বলে উঠে,
– “আব্বা!”
কিন্তু ইফতেখার সাহেব উপমাকে পাত্তা না দিয়েই বারান্দা থেকে বেরিয়ে যান। তবে যাওয়ার পূর্বে বলে যান,
– “আমি যাইতাছি গঞ্জে। আইসা যাতে দেখি এই বাড়ির বড় মাইয়া বিয়ার জন্য তৈরি।”
আমেনা বেগম ও মুখ বাঁকিয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ান। ইফতেখার সাহেব ও চলে যেতেই সেখানে উপস্থিত হয় সজল। আর সজলের দিকে চোখ যেতেই উপমার রাগ উঠে যায়। একপ্রকার তেড়ে গিয়ে সজলকে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বে সজলই বলে উঠে,
– “কইছিলাম না তোরে আমার কাছে আসতে হইব; এক রাতের জন্য হোক আর নাইলে সারাজীবনের জন্য হোক। দেখ ঘুইরা ফিরা তুই আমার জালেই আটকা পড়লি উপমা। তৈরি থাকিস, দেখা হইব।”
– “ভালো হইব না কিন্তু সজল ভাই। আপনের ভালো মানুষির পর্দা আমি খুইলা দিমু। আর একটা কথা ভালো কইরা শুইনা রাইখেন; এই বিয়া দুঃস্বপ্নেও কোনোদিন হইব না।”
বলেই সজলকে পাশ কাটিয়ে ভেতরের দিকে চলে যায় উপমা। ছোট পূর্ণা সবটা দেখলেও ভয়ে জড়সড় হয়ে আর মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস পায় নি।………………..
#চলবে 🖤
( কেমন হয়েছে সে সম্পর্কে একটু গঠনমূলক মন্তব্য জানাবেন। ধন্যবাদ ❤️)