#মায়াবন_বিহারিনী পর্ব ১৮

0
276

#মায়াবন_বিহারিণী পর্ব১৮
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)

চৈত্রের প্রায় শেষ সময়। রাতের আকাশে পুনরায় এক ফালি চাঁদ দেখা যাচ্ছে। বোধহয় নতুন চাঁদের দ্বিতীয় দিন, অর্থাৎ এককথায় বলা যায় শুক্লা দ্বাদশী‌র রাত্রি। তার মৃদু আলোতে চারপাশ খানিকটা আলোকিত হয়ে আছে। ঘরের জানালা ঘেঁষে সেগুলোই পরখ করে যাচ্ছে উপমা। ঘুমের রেশ টুকু নেই দুটো নেত্রপল্লবে। মনটা বেশ বিষন্ন আর অবসাদ অনুভব হচ্ছে। বাড়ির সামনের পলাশ গাছটায় বসে থাকা ডাহুক পাখিটাও যেন ডেকে ডেকে তার দুঃখে নিজের দুঃখ প্রকাশ করছে। তার সুপ্ত হৃদয়ের বেদনার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে আবেগ। আজ তার প্রিয়তমকে‌ একটু বেশিই মনে পড়ছে। পাশেই বিছানায় এক কোণে ডায়েরিটা অগোছালো ভাবে পড়ে রয়েছে। তবে এর মাঝে আজকে আরো একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে গিয়েছে।
এইতো ঘন্টা কয়েক আগের কথা,,

সন্ধ্যার পর বাড়িতে বেশ কয়েক মিষ্টি, সন্দেশের হাঁড়ি, নিয়ে হাসি সহযোগে প্রবেশ করেন ইফতেখার সাহেব। উপমা সবেমাত্র হাত মুখ ধুয়ে কাপড় পাল্টে কলপাড়‌ থেকে বেরিয়ে ঘরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখনই ইফতেখার সাহেবের সঙ্গে চোখাচোখি হয় তার। একপ্রকার পাশ কাটিয়ে এড়িয়ে পুনরায় ঘরে চলে আসে উপমা। অবশ্য ততক্ষণে আমেনা বেগম রুম থেকে বেরিয়ে পড়েছেন। ঘরে প্রবেশ করতেই পূর্ণা বেশ উৎসুক হয়ে এগিয়ে গিয়ে উপমাকে জড়িয়ে ধরে।

– “বুবু, বুবু জানো? আব্বায় আমার আর তোমার জন্য সদর থেইকা মেলা সুন্দর সুন্দর জামা আনছে। তোমার পছন্দের নতুন শাড়িও আনছে। আবার দেখো চুড়িগু‌লাও কি সুন্দর! ঝিলমিল করতেছে।”
পূর্ণার আনন্দিত ও উৎসুক কন্ঠস্বর। অন্যদিকে পূর্ণার বলা কথা, ইফতেখার সাহেব ও আমেনা বেগমের চালচলন সবকিছুই প্রায় মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে উপমার। কি শুরু হয়েছে আজকে এসব? ইফতেখার সাহেব এবং আমেনা বেগমের মূল উদ্দেশ্যটাই বা কি? যার কারণে তিনি আজ এসব অদ্ভুত আচরণ করে যাচ্ছেন! উপমা যখন এসব নিয়ে হিসাব মিলাতে ব্যস্ত ছিল তখনই তার সূক্ষ্ম ভাবনার জগতে ছেদ পড়ে ইফতেখার সাহেবের ডাক শুনে।

– “উপমা, ও উপমা! এদিকে আয় মা!”
পিলে চমকে উঠে উপমা। এখন আবার তাকে ডেকে পাঠানো হচ্ছে। কাহিনীর মধ্যে আসল ঘাপলা টা কোথায়? এরই মাঝে দ্বিতীয় ডাক পড়তেই সেও কিছু একটা ভেবে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে। এগিয়ে গিয়ে ইফতেখার সাহেবের রুমের দরজায় দাড়াতেই ইফতেখার সাহেব খুশি হয়ে দ্রুত বসা থেকে উঠে আসেন।

– “আহা বাইরে দাঁড়ায় আছিস কেন? ভেতরে আয়। এই যে দেখ তোর পছন্দের গুড়ের সন্দেশ আর রসগোল্লা আনছি। নে দেখ খাইয়া দেখ তো কেমন। আর তোর শাড়ি চুড়ি পছন্দ হইছে তো মা?”
ইফতেখার সাহেবের কথা শুনে উপমার মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম। এ তো আজ ইফতেখার সাহেবের এক অন্যরকম রূপই দেখা যাচ্ছে। উপমা তার কথা মতোন ভেতরে প্রবেশ করে ঠিকই কিন্তু আর বসে না। আমেনা বেগম বাটিতে বেশ কয়েকটা মিষ্টি তুলে উপমার দিকে এগিয়ে দিলে হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দেয় উপমা। অতঃপর ভ্রু সামান্য কুঁচকে দৃঢ় কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
– “এসব বাহানা না দিয়া আসল কাজের কথায় আসো! এইসব করার মানে কি চেয়ারম্যান সাহেব? আমি খুব ভালো কইরাই জানি এসবের পেছনে আপনার বড় কোনো উদ্দেশ্য আছে। তাই ঘটনার মারপ্যাঁচ না কইরা সরাসরি বইলা ফেলেন।”
উপমার কথায় মুহূর্তে রং উড়ে যায় ইফতেখার সাহেবের। তিনি যে বেশ থতমত খেয়ে গিয়েছেন তা তার মুখশ্রী দেখেই বোঝা যাচ্ছে। উপমার কথা শুনে ইফতেখার সাহেব হাতে থাকা ব্যাগটা পাশে রেখে গম্ভীর গলায় বলে উঠেন,
– “আচ্ছা তুই আগে এইখানে বস, তারপর তোরে সব কইতা‌ছি।”

উপমাও‌ আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ পাশে রাখা মোড়াটাতে‌ বসে পড়লো।
– “আমি জানি উপমা মা, তুই আমার উপর রাইগা‌ আছিস। রাই‌গা থাকার ই‌ কারণ। এরকম একখান খারাপ মানুষের কুকর্ম সম্বন্ধে জানলে রা‌ইগা থাকার ই‌ কথা। তাছাড়া তোর মা অয়ন্তিকা,, থাক সেই প্রসঙ্গে না যাই। তয় মা একটু ভালো কইরা দেখ তোর এই বুড়া বাপটার‌ বয়স হইতাছে। আর ক‌ইদিন ‌ই বাচু‌ম মা, তুই বল!
পারলে তোর এই বুড়া বাপ টারে মাফ কইরা দিস। আমি আজ থেইকা তোর কোনো কাজে বাঁধা দিমু না। তোরে অনেক পড়ামু। অনেক বড় ডাক্তার বানামু‌।”

শেষো‌ক্ত কথাগুলো বেশ কান্না মিশ্রিত কন্ঠেই বলে উঠেন ইফতেখার সাহেব। আমেনা বেগম ও আঁচলে মুখ গুঁজে আছেন। এবার উপমা একটু নড়েচড়ে উঠে। তার মস্তিষ্কের নিউরনগুলো‌র কার্যক্ষমতাও সজাগ হয়ে উঠে ক্রমশ। কি বলছেন এসব ইফতেখার সাহেব? সে কি আসলেই ঠিক শুনছে? কিন্তু হঠাৎ করে ক্ষমা চাওয়ার বিশেষ কোনো কারণ? নাকি এও কোনো সাজানো নাটক?
– “কি হইলো, উপমা মা? কিছু বলতেছিস‌ না কেন? তুই কি তোর বাপরে মাফ করতে পারবি না?”
প্রত্যুত্তরে কোনো কথা বলে না উপমা। মাথা নিচু করে উঠে বেরিয়ে পড়ে ইফতেখার সাহেবের কক্ষ হতে।

৪৭.
এতক্ষণ গভীর ভাবনায় পড়ে গিয়েছিল উপমা উক্ত ঘটনা নিয়ে। তার হঠাৎ করেই চোখ পড়ে ঘড়ির কাঁটার দিকে। ঘড়ির কাঁটায় ৪:০০ টা বাজে। ভোর হতে চললো প্রায়। পরক্ষণেই তার সমস্ত ইন্দ্রিয় জুড়ে আবেগের ভাবনা বিরাজমান হতে শুরু করে। তার প্রিয় মানুষ তো একটু পরেই প্রস্থান করবে এই ত্রিমোহিনী থেকে। তার সঙ্গে কি শেষবারের মতন দেখা করা প্রয়োজন না? পূর্ণা নিঃশব্দে ঘুমাচ্ছে। ঘড়ির কাঁটার দিকে পুনরায় একবার তাকিয়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা রুমাল বের করে নেয় উপমা। বেশ কয়েকদিন আগেই অতি সযত্নে নিজ হাতে বিভিন্ন কারুকাজ আর নকশা করে রুমালটি তৈরি করে সে। আবেগকে দিবে দিবে বলে আর দেয়া হয় নি কোনো এক কারণে। আজ দিবে ঠিক করে সেটা নিয়েই রুম খুলে ছুট লাগায় বাইরের দিকে। ইফতেখার সাহেব আর আমেনা বেগম নিশ্চয়ই এতক্ষণে গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছেন।
বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে উপমা বের হয় উত্তরের রাস্তায়। নিশ্চয়ই এখনো আবেগ বাসা থেকে বের হয় নি। তাই সরাসরি সেখানে যাওয়ার পরিকল্পনাই করে উপমা।

– “কি ব্যাপার এত আয়োজন কিসের লাইগা? আর ঐ অপয়ারে ঐসব দামী দামী জিনিসপত্র আইনা দেয়ার কি দরকার ছিল? দিনশেষে দেখবা কালসাপের‌ মতোন ছোবল দিয়া বসব ঐ মুখপুড়ী‌!”
বিছানার এককো‌ণ গোছাতে গোছাতে ইফতেখার সাহেবকে কপট রাগ দেখিয়ে বলে উঠেন আমেনা বেগম। স্বামীর অর্থসম্পদ সতীনের মেয়ের পেছনে ব্যয় হচ্ছে বলেই রাগে শরীর জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে তার। ইফতেখার সাহেব তখন সিন্দুক হতে সাদা কাপড়ে পেঁচানো একটা বোচকায়‌ প্রয়োজনীয় সামগ্রী রাখছিলেন। গতকালই এসব সজলকে দিয়ে আনিয়েছেন তিনি। কোনো প্রকার বিপদ নেমে আসলে এগুলোই কাজে লাগাতে হবে। আমেনা বেগমের কথা কর্ণগোচর‌ হতেই তিনি আড়চোখে আমেনা বেগমের দিকে তাকান। মাঝেমধ্যে আমেনা বেগমকেও তার অসহ্য লাগে চোখের সামনে। প্রথম স্ত্রীর মতোন করুণ দশা করে ছেড়ে দিতে মন চায় কিন্তু পারেন না। তার কারণ হচ্ছে আমেনা বেগমের কুটনৈতিক বুদ্ধি। এ কারণেই মাছের কাঁটা গলায় আটকে থাকার মতোন সয়ে যেতে হয় তাকে।
– “মাইয়া মাইনষের মতোন মাথামোটা হইলে এই পর্যন্ত ক্ষমতায় টিকা থাকবার পারতাম না বুঝলা আমেনা? সবকিছুর জন্যই নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করতে হয়। খুব গভীর কইরা পরিকল্পনা করতে হয়।
তয় আরেকটা কথা কি জানো, বলির পাঁঠা, গরুরে‌ বলি দেওয়ার আগে পরম যত্ন করতে হয় ক্যান? যাতে কইরা বলি দেওয়ার সময় সেই বলির পাঁঠা তার যাবতীয় দুঃখ কষ্ট ভুইলা তার জীবন নিজ ইচ্ছায় উৎসর্গ কইরা দেয়। তেমনি মাইনষের জীবনের শেষ সময়টুকুতে‌ একটু খাতির আপ্যায়ন করলে মন্দ হয় না।”

ইফতেখার সাহেবের কথার মর্মার্থ বুঝতে বেশ খানিকটা বেগ পেতে হয় আমেনা বেগমকে। কিন্তু বুঝে ওঠার পরক্ষণেই তার মুখশ্রীতে পৈশাচিক আনন্দ তৃপ্তি ফুটে ওঠে।

বেশ খানিকটা পথ পেরিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে উপমা। একে তো চারপাশে অন্ধকার তার উপর উঁচু নিচু রাস্তা। আবেগের বাসার সামনে এসে দাড়াতেই হৃদস্পন্দন আগের তুলনায় অতি বেগে বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমশ তার। আচ্ছা আবেগ আছে তো? চলে যায় নি তো তার সাথে দেখা না করে? সামনে যতই এগোচ্ছে ততোই অসাড় হয়ে আসছে শরীর‌। কাঁপা কাঁপা হাতে দরজার কড়া রেখে কিছুক্ষণের জন্য থমকে যায় উপমা। আবেগ তার উপর অভিমান করে বসেনি তো আবার? ভাবতেই দরজায় কড়া নাড়ে সে।
নাহ্, কারো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তবে কি বাড়িতে কেউ নেই? না, কেউ না থাকলে তো তালা ঝোলানো থাকত। পুনরায় কড়া নাড়তে যাবে তার পূর্বেই দরজা খুলে যায়। দরজার ওপাশে থাকা ব্যক্তিটিকে দেখে বেশ হকচকিয়ে যায় উপমা। অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
– “আপনি?”
ঘুম ঘুম চোখে ছিল সায়ান‌। কোনো মেয়েলি কন্ঠ শুনে প্রথমে চমকে গেলেও পরমুহূর্তে উপমাকে দেখে স্বাভাবিক হয় সে।
– “উপমা তুমি এখানে?”
বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যায় উপমা। কিভাবে আবেগের কথা জিজ্ঞেস করবে সে ভাবতেই অস্বস্তি হয় তার।
– “আচ্ছা ডাক্তার মশাই কোথায়? তিনি কি ঘুমাচ্ছেন?”
ধীর গলায় জিজ্ঞেস করে উপমা। সায়ান উপমার ভাবমূর্তি বুঝতে পেরে মুচকি হাসে। তারপর প্রত্যুত্তরে যা বলে তাতে চোখ দুটো বড় বড় হয়ে যায় উপমার‌।…………..

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here