#মায়াবন_বিহারিনী পর্ব ১১

0
321

#মায়াবন_বিহারিণী পর্ব ১১
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)

জানালার পাশ ঘেঁষে নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে রয়েছে উপমা। বাইরের আকাশ থেকে ঝকঝকে চাঁদের আলো এসে জানালা ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করেছে। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ যেন চাঁদের আলোর প্রখরতা একটু বেশিই। মনটাও কেমন যেন অবসাদ আর বিষন্ন লাগছে তার।
বাইরে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতেই চোখ পড়ে টেবিলের কোণে পড়ে থাকা সাদা খাম‌টার উপর। সকালের হৈমন্তীর আনা খামটায় সবচেয়ে বড় খুশি লুকিয়ে ছিল। মাধ্যমিক শেষে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার জন্য ফরম আনিয়ে‌ছিল শহর থেকে হৈমন্তী। এখানে নেটওয়ার্কের তেমন একটা ভালো ব্যাবস্থা না থাকায় সদ‌রেই যেতে হয় বেশিরভাগ। হৈমন্তী যখন খামটা এনে উপমার হাতে তুলে দিয়েছিল তখন মনে হচ্ছিল সে তার স্বপ্নের দিকে আরো এক ধাপ অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু সবটা কি এতটাই সহজ? মাধ্যমিক পর্যন্ত খুব কসরত করে পড়াশোনা করতে হয়েছে তাকে। আর্থিক দিক দিয়ে নয় বরং পারিবারিক দিক দিয়ে। ইফতেখার সাহেব আর আমেনা বেগম প্রায় সময়ই বাঁধা দিত পড়াশোনায় কিন্তু কে জানত তাদের এই সিদ্ধান্ত নাকোচ করার পেছনে কত বড় ষড়যন্ত্র লুকিয়ে রয়েছে?
ভাবতে ভাবতেই এগিয়ে গিয়ে খামটা হাতে তুলে নেয় উপমা। আগামী পনেরো দিন পরেই নির্বাচনের পরীক্ষা শুরু হবে; তার জন্য শহরেও যেতে হবে। বিরাট শহর; অচেনা অজানা, স্বপ্ন পূরণের শহর। তবে সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য সামনে কি অপেক্ষা করছে কে জানে?

দুটো দিন কেটে গিয়েছে। আজ চেয়ারম্যান বাড়িতে বেশ কয়েকজন কমিটির সদস্য উপস্থিত হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জন প্রার্থী মনোনয়নপত্রে এবার ও ইফতেখার সাহেব যোগ দিয়েছেন। তাই তো সকাল থেকেই ইফতেখার সাহেব ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন নির্বাচনের নিয়মকানুন নিয়ে। সেদিনের মতো আজও সজলও উপস্থিত রয়েছে উক্ত জনসমাবেশে। সজলকে চোখে পড়তেই দ্রুত সম্ভব বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে বেরিয়ে পড়ে উপমা। তাছাড়া আজ বাড়িতে পূর্ণাও নেই। হৈমন্তীর ও বাড়িতে আত্নীয় স্বজন নিয়ে সমাগম চলছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে দ্রুত নদীর রাস্তার দিকে হাঁটা ধরে সে। এখান থেকে সামনেই বকুল গাছ আর কাঠগোলাপ‌ গাছ থেকে কয়েকটা ফুল কুড়িয়ে নেয়ার চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ে আনমনে।
আজ দুদিন হয়ে গিয়েছে আবেগের কোনো খোঁজ নেই। এ দুদিনে এদিকটায় ও তাকে দেখা যায় নি। তবে কি সেদিনের বলা কথায় আবেগ কোনো ভাবে কষ্ট পেয়েছে? ক্যাম্পে কি একবার যাবে? কিন্তু অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে; এখন তো গেলেও ত
নির্দিষ্ট মানুষটাকে পাওয়া যাবে না। এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে পুনরায় একই জায়গায় একরাশ মন খারাপ নিয়ে বসে পড়ে উপমা।

“সে যেন কেন এলো না,,
কিছু ভালো লাগে না
এবার আসুক তারে আমি, মজা বোঝাব!
যদি ফুলগুলো হায়; অভিমানে ঝরে যায়
আমি মালা গেঁথে বলো কারে পরাবো?

সে যে কেন এলো না; কিছু ভালো লাগে না।
না ভালো লাগে না,,,
এবার আসুক তারে আমি মজা বোঝাব!”

নদীর ঘোলাটে কর্দমাক্ত পানির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে নুড়ি পাথর ছুড়তে ছুড়তে সুর তোলে উপমা। একা একা বসে থাকার সময়টা আসলেই বেশ কঠিন। নীরব বাক্যহীন সঙ্গী থাকাও‌ এর চেয়ে শতগুণে ভালো। ভাবতে ভাবতেই পেছন থেকে কারো গম্ভীর কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই হকচকিয়ে উঠে সে।

– “কাকে মজা বোঝাবে শুনি?”
সরু চোখে পেছনে ঘুরে তাকাতেই আরেক দফা অবাক হয় উপমা। ফর্মাল লুক ছেড়ে একটা টিশার্ট আর একটা ট্রাউজার পড়েই এসে পড়েছে আবেগ। আচ্ছা আবেগ কি সত্যিই এখানে আছে নাকি তার ব্যাপারে ভাবতে ভাবতে এমন অবস্থা হয়েছে যে যেখানেই দৃষ্টি যাক না কেন শুধু তাকেই দেখা যাবে। উপমাকে এমন গোল গোল চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুচকি হাসে আবেগ। অতঃপর খানিকটা এগিয়ে গিয়ে উপমার পাশে বসে পড়ে।
– “কি যেন বলছিলে? কার গলায় যেন মালা পড়াবে?”
উপমা তখনও আবেগের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আবেগের প্রশ্ন শুনে আনমনেই বলে উঠে,
– “আপনারে!”
পরক্ষণেই হুঁশ ফিরে আসে তার। একটু আগেই কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেলেছে ভেবেই জিভ কাটে উপমা। আবেগের দিকে তাকিয়ে থতমত খেয়ে বলে উঠে,
– “না, মানে আপনে! আপনে এইখানে কি করতেছেন? এইটাই জিজ্ঞেস করতে চাইছিলাম।”

– “কেন আমার কি এখানে আসা কোনো বারণ আছে? নাকি তুমিই ভয় পাচ্ছ একটা পুরুষ মানুষের সাথে থাকতে?”
আবেগের ক্ষীণ কন্ঠে করা প্রশ্নের জবাব দেয় না উপমা। শুধু অপর পাশের মানুষটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে।

২৯.
সূর্যের কিরণ নিভিয়ে গিয়ে সন্ধ্যার আকাশ নীলচে বর্ণ ধারণ করেছে। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর আবেগ মৃদু কন্ঠে উপমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
– “আর ছয়দিন পর চলে যাব আমি।”
আবেগের বলা ছোট্ট কথাটিও বিরাট আকারের মনে হলেও মুখে কিছু প্রকাশ করে না উপমা।
– “সন্ধ্যা হইয়া আসতেছে ডাক্তার মশাই। চলেন যার যার বাড়িতে ফেরা যাক। ঐ যে আকাশে তাকাইয়া দেখেন পাখিরাও তাদের নীড়ে ফিরতে শুরু করছে।”
আবেগের কথা এড়াতে বলে বসা থেকে উঠে পড়ে উপমা।

– “কেন আমি চলে যাব বলে তোমার মন খারাপ হবে না?
আর বাকি রইল বাড়ি যাওয়ার কথা? থেকে যাই না আরো কিছুক্ষণ, সময়টা তো মন্দ নয়।”
আবেগের কথায় পা দুটো থমকে দাঁড়ায় উপমার। আবেগের চলে যাওয়ায় কি আসলেই মন খারাপ হবে তার? কই আগে তো এমন হয়নি কখনো। চলে যাওয়ার কথা শুনতেই একপ্রকার শূন্যতা অনুভব হচ্ছে মনের ভেতর। কিন্তু কেন? কিসের এই অনুভূতি? কিসের এই অস্থিরতা?

– “কি হলো থমকে দাঁড়ালে যে?”
– “যে চলে যাওয়ার সে তো চইলা‌ই যায়। চাইলেই কি আর তারে মায়ার বাঁধনে আটকান যায়? এইটাই যে প্রকৃতির নিয়ম ডাক্তার মশাই!”
উপমার নির্লিপ্ত প্রত্যুত্তর। আজ আবেগের আচরণ অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু ভিন্ন মনে হচ্ছে তার নিকট। এদিকে উপমার জবাবে মুখ স্থির হয়ে আসে আবেগের। সে ভাবেনি যে উপমা তাকে এত সহজেই চলে যেতে দিবে তাকে। কিন্তু পরক্ষণেই উপমার মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে এগিয়ে যায় তার দিকে।
ট্রাউজারের পকেট থেকে একটা কালো পায়েল বের করে উপমার সামনে তুলে ধরতেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় উপমা।
– “ভেবেছিলাম যেদিন চলে যাব সেদিন তোমার সাথে দেখা করে এটা দিয়ে যাব। কিন্তু না এখন মনে হচ্ছে এটা আজকেই দিয়ে যাই। মনে হয় না এখানে আর কখনো আসা হবে।”

প্রচন্ড অভিমানের সুরে বলা কথার ভাবার্থ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না উপমা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টে তাকিয়ে বলে উঠে,
– “কেন আসবেন না? আপনে তো বললেন আরো ছয়দিন থাকবেন। এতদিন বুঝি একটা মানুষ ঘরে থাকতে পারে?”
– “না পারলেও মানিয়ে নিব।”
বলেই উপমার হাতে পায়েল টা তুলে দেয় আবেগ। শ্যামাঙ্গিণী মেয়েটার প্রতি কি তার কোনোভাবে দুর্বলতা এসে পড়েছে? ঘুরেফিরে সেই এই মেয়েটার চোখের মায়া‌য়ই পড়তে হয় তার। এদিকে আবেগের আলতো স্পর্শে শিউরে উঠে উপমা। আসলেই কি তবে ডাক্তার মশাই আর আসবে না?
উপমার চোখ থেকে দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নেয় আবেগ। অতঃপর মুচকি হেসে হাঁটা শুরু করে চলতি মেঠোপথের দিকে। উপমাও কোনো একটা অদৃশ্য বাধার কারণে মুখ ফুটে বলতে পারে না কিছু। শুরু নীরব ভঙ্গিমায় চেয়েই রয়।
ঘড়ির কাঁটায় বাজে রাত আটটা। বেশ খানিকক্ষণ সময় পূর্বেই বাড়ি ফিরেছে উপমা। তবে বাড়ি ফেরার পথে দেখা হয়েছিল ইনস্পেক্টর আমানের সাথে। উপমাকে দেখে আমান সাহেব ও এগিয়ে এসে ইফতেখার সাহেবের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। উপমাও সবকিছুর জবাব দেয় ঠিকঠাক। কিন্তু ইফতেখার সাহেবকে তদারকি করার পেছনে আমান সাহেবের উদ্দেশ্য কি? একবার মুখ ফুটে বলতেও চেয়েছিল সেদিনের ব্যাগে থাকা সামগ্রী সম্পর্কে। কিন্তু কোনো এক কারণে চুপ করে বাড়ি এসে পড়ে সে। অবশ্য বাড়ি ফিরে এও শুনেছে ইফতেখার সাহেব নাকি গুরুত্বপূর্ণ কাজে সজলের সঙ্গে সদরে গিয়েছেন।
হিসেব মিলাতে মিলাতে টেবিলের কাছে গিয়ে বসে পড়ে উপমা। আধভাঙা টেবিলের ড্রয়ার টেনে খুলতেই সেখানে থাকা একটা ধূসর রঙের ডায়েরি বেরিয়ে আসে। সাথে করে চোখ পড়ে ডায়েরির উপর থাকা কালো পায়েল টার দিকে। ডায়েরিটা মোটামুটি পুরনো। সাথে করে মিশে আছে নানা দৃশ্যপট ও স্মৃতি। আজ ও তেমনি দৃশ্যপট রেখে দিতে কলমদানি থেকে একটা কলম তুলে নেয় সে।………………

#চলবে 🍂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here