#মায়াবন_বিহারিনী পর্ব ১০

0
454

#মায়াবন_বিহারিণী পর্ব ১০
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)

২৬.
আবেগের কথা শুনে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় উপমা। অতঃপর আবেগের উদ্দেশ্যে বলে উঠে,
– “পুরুষ মানুষের মন নিয়া কোনো বিশ্বাস নাই বুঝলেন ডাক্তার মশাই? তাদের মন, চিন্তা ভাবনা ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়। মুখে এক কথা বললেও মনে মনে ভাবে আরেক কথা।
ঐ যে হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন না,
রূপবতী নারীদের দেখেও অগ্রাহ্য করায় পুরুষ মানুষ এক আলাদা আনন্দই পায় তয় মনে মনে ঠিকই তার প্রেয়সীরে চায়।”

উপমার মুখে এসব কথা শুনে চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম আবেগের। মেয়েটা এত চঞ্চল কেন? মুহূর্তেই তিলকে তাল বানিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে এই মেয়ে। কি সব হাবিজাবি বকছে একাধারে সে? উপমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে চাপা কন্ঠে বলে উঠে,
– “একদম চুপ! পাকা মেয়ে একটা। সবসময় মুখে তার পাকা পাকা কথা। এই মেয়ে বয়স কত হবে তোমার? বড়জোর ষোলো কি সতেরো। এই অল্প বয়সে এমন ভাবে বলছো যে পুরুষের মন নিয়ে গবেষণা করে ডিগ্রি অর্জন করে বসে আছো।”
আবেগের কথায় হাসি থামিয়ে দেয় নিমিষেই উপমা। মুখটাকে সামান্য গম্ভীর করে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবেগের দিকে। দুজনের চোখাচোখি হয়ে যাওয়ায় ইতস্তত বোধ করে আবেগ। তাই দ্রুত নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নেয় অন্যপ্রান্তে।
– “পুরুষ মানুষের মন পড়তে আবার ডিগ্রি অর্জন করা লাগে নাকি ডাক্তার মশাই? শুইনা রাখেন, পুরুষ মানুষের মন বুঝতে কোনো ডিগ্রি মিগ্রি লাগে না, সেই বিশেষ ক্ষমতা মাইয়া মাইনষের অনেক আগে থেকেই আছে।”
আবেগের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠে উপমা। উপমার এমন পাকা পাকা কথা হজম হয় না আবেগের। রাগান্বিত মুখশ্রীতে কিছু বলার উদ্দেশ্য ঠোঁট দুটো প্রসারিত করবে তার পূর্বেই আরেক দফা অবাক হয় সে। সেদিনের মতো আজও চোখের নিমিষেই উধাও হয়ে গিয়েছে উপমা। না এই মেয়ের নিশ্চয়ই কোনো অদৃশ্য হওয়ার বিশেষ শক্তি রয়েছে না হলে কেউ এভাবে চোখের পলকেই নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে পারে? এই চিন্তায় মগ্ন হয়ে ফুস করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে আবেগ।

এদিকে বাইরে বেরিয়ে এসে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে উপমা। মুখশ্রী জুড়ে তার আনন্দের রেখা। একটু আগেই আবেগকে‌ বলা কথাগুলো মনে পড়তেই হেসে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে সে। চোখের সামনে কাউকে নিজের কথায় জব্দ করার মধ্যে যেন আলাদা আনন্দই লুকায়িত। উপমাকে এমনভাবে হাসতে দেখে তার দিকে এগিয়ে আসে হৈমন্তী। ক্যাম্পের বাইরে নয়ন আসাতে উপমাকে রেখেই সন্তর্পণে বেরিয়ে পড়ে সে। পুনরায় এখানে আসতে বাইরেই উপমাকে পরিলক্ষিত হয় তার।
– “এই উপমা, এইহানে দাঁড়াইয়া একা একা হাসতেছিস কেন? পাগল টাগল হইয়া গেলি নাকি? এক মিনিট তুই তো একটু আগেই ঐ শহুরে ডাক্তারের লগে দেখা করতে গেছিলি, তাইনা? এমন কি হইলো?”

– “ঐসব তুই বুঝবি না। ডাক্তার মশাই একটু অদ্ভুত স্বভাবের। তবে লোকটার মনটা বেশ ভালা।”
– “সবই বুঝি, উপমা। এইসব বাহানা দিয়া লাভ নাই। তোর কথাবার্তায় স্পষ্ট বোঝা যাইতেছে যে তুই ঐ শহুরে ডাক্তারের প্রেমে পইড়া গেছিস তাও খুব গভীর কইরা।”
হৈমন্তীর কথা শুনে মুহুর্তেই মুখের হাসি উবে যায় উপমার। শরীর জুড়ে এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যায় তার। কি বলছে এসব হৈমন্তী? আসলেই কি তাই? সত্যিই কি তবে সে আবেগের প্রেমে পড়ে গিয়েছে? কিন্তু এও কি সম্ভব? তার ভাবনার মাঝেই ছেদ পড়ে কাঁধে কারো ঝাঁকুনি অনুভব হওয়াতে।
– “কি রে কোথায় হারাইয়া গেলি? উপমা?”
– “কি সব হাবিজাবি বকতেছিস তুই? এমন কিছুই না। আর এখন কি তোর জন্যে মন খুইলা হাসাও যাবে না নাকি? সবকিছু যে ডাক্তার মশাইরে কেন্দ্র কইরাই হইতে হবে এমন কোনো কথা নাই।”

কথা কাটিয়ে দেয়ার জন্য কোনোমতে বলে উঠে উপমা।
– “হাবিজাবি না। মিলিয়ে রাখিস এই হৈমন্তীর কথা। ডাক্তার মশাই ই তোর জীবনের প্রেমিক পুরুষ হইয়া আইব।”
হৈমন্তীর কথাকে পাত্তা না দিয়ে খোলা আকাশের বিশালতায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উপমা।

২৭.
বিকেলের আকাশে সূর্য পশ্চিম দিকে প্রায় অস্তমান‌। পুকুড়পাড় থেকে বাড়ি ফিরেছে উপমা। আজ হাত ভর্তি ফলমূলের জায়গায় হাত ভর্তি বকুল ফুলের মালা। চারপাশে বকুলের মোহনীয় সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে। বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে যেতেই পেছন থেকে ডাক পড়ে পূর্ণার। উপ‌মাও হাতে থাকা ফুলগুলো একপাশে রেখে পেছনে ঘুরে তাকাতেই কিছুটা আঁতকে উঠে। পূর্ণার ফর্সা মুখশ্রী রক্তিম আভা ধারণ করেছে। চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত। বাম গালেও হাতের তিন আঙুলের ছাপ; দেখেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কেউ তার গালে সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছে। আতংকিত চোখে দ্রুত পায়ে পূর্ণার দিকে এগিয়ে যেতেই পূর্ণাও ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে জড়িয়ে ধরে উপমাকে।

– “পূর্ণা, কি হইছে? এইভাবে কাঁদতেছিস কেন? আর গালে এই দাগ কেন?”
উপমার আগ্রাসী কন্ঠস্বর। পূর্ণা উপমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সামান্য। এতে কিঞ্চিৎ ভয় পায় উপমা।
– “আব্বায় মারছে। আইজ দুপুরে আব্বায় রুমে বইসা আম্মার লগে অয়ন্তিকা মায়ের মৃত্যু নিয়া কথা কইতেছিল। বলতেছিল অয়ন্তিকা মায়রে কেউ মাইরা ফালাইছে; তাও খুব বাজে কইরা। আব্বার কথা শুইনা আমি তার কাছে গিয়া শুধু জিজ্ঞেস করছি যে কে তারে মাইরা ফালাইছে? আমি জোরাজুরি করায় আমারে না বইলা চড় বসায় দিছে।”

পূর্ণার কথায় পিলে চমকায় উপমা। শুধুমাত্র এ কথা জিজ্ঞেস করার ফলস্বরূপ পূর্ণাকে চড় খেতে হয়েছে? কিন্তু কেন? কি এমন রহস্য লুকিয়ে আছে অয়ন্তিকার মৃত্যুর মধ্যে? আর কেই বা দিবে এসব অজানা প্রশ্নের উত্তর? ইফতেখার সাহেব? হ্যাঁ একমাত্র সেই এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারবে। এসব চিন্তা করতে করতে পূর্ণার গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয় উপমা।

সুবিশাল অট্টালিকা। অট্টালিকার একপাশে গার্ডেন, অন্যপাশে সুবিশাল সুইমিংপুল। ডুপ্লেক্স বাড়ির ভেতরেও ঠিক একইরকম দামী দামী সামগ্রী দিয়ে সজ্জিত। দেখেই বেশ বোঝা যায় বাড়ির মালিক বেশ শৌখিন মানুষ।
হলরুমে সোফায় বসে নিউজপেপারে চোখ বুলিয়ে আবার চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন মধ্যবয়স্ক একজন পুরুষ। মুখশ্রী তার বেশ গম্ভীর। শরীরের চামড়ায় বার্ধক্যের ছাপ পড়লেও পোশাক আশাকের দিক থেকে সে বেশ পরিপাটি। টেবিলের উপর চায়ের কাপটা রাখতেই কিচেন থেকে বেরিয়ে আসেন ইশিতা বেগম। ইশিতা বেগমের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে গলা খাঁকারি দেন মিস্টার আহিল শাহরিয়ার।
– “আবেগ কবে ফিরবে কিছু বলেছে?”
ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করেন আহিল সাহেব।

– “না,‌ আবেগ ফোনে তেমন কিছু বলেনি। মনে হয় না ও ওর ট্রেনিং ছেড়ে চলে আসবে।”

– “আহা, বলেনি তো কি হয়েছে? আমি বারবার বলেছি আমার সামনে কখনো নেগেটিভ কথা বলবে না ইশিতা। পরিস্থিতি নিজের আয়ত্তে আনতে শেখ। আবেগকে বোঝাও। আমি খুব ভালো করেই জানি যে এসব ওর সাধ্যের নয়। এসব ছেড়ে ওকে আমার বিজনেসের দায়িত্ব নিতে বলো।
বড় ছেলে ইহান ও তো হয়েছে একই স্বভাবের। সবাই যদি নিজের মন মর্জি মোতাবেক চলতে থাকে তাহলে স্পষ্ট বলে দিচ্ছি তোমার ছেলেদের বাড়ি ছাড়া করে দিতে আমার মোটেও সময় লাগবে না।”

আহিল সাহেবের কথা শুনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকেন ইশিতা বেগম। এ ছাড়া যে আর কিছুই করার নেই তার। স্বামীকে বহুবার বোঝালেও ফলাফল হয় শূন্য। তখনই দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে বলে উঠে ইহান,

– “আমি কিংবা আবেগ কোনোদিক দিয়েই ভুল নই বাবা। তুমিই শুধু তোমার ইচ্ছা অন্যের উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টায় আছো। আবেগের সিদ্ধান্তে কি ভুল আছে। বিডিতে কি কোনো ভালো ডাক্তারি পড়াশোনা নেই? অবশ্যই আছে। আর ডাক্তার হওয়া কোনো সাধারণ কথা না। আ’ম শিওর আবেগ একদিন বিডির একজন অন্যতম কার্ডিওলজিস্ট হয়ে দেখাবে।
আর রইলো বাদবাকি আমার কথা? আমি আমার ফটোগ্রাফী নিয়ে বেশ ভালোই আছি। শুধু একটা কথা মনে রেখ, কাউকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঠেলে দিলে তার পরিণাম খারাপই হয়।”

– “ইহান! তুমি তোমার বাবার সাথে মুখে মুখে তর্ক করছো!”

– “আমি তর্ক করছি না বাবা, শুধু সত্যিটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আর তোমার এভাবে জোর গলায় বললেও সত্যিটা বদলে যাবে না।
আসি মা, দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার।”
বলেই আর এক মুহূর্ত দেরি করে না ইহান। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায় বাইরে। দোতলায় দাঁড়িয়ে থাকা ইহানে‌র স্ত্রী জুঁই পরক্ষণ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
এদিকে ইহানের কথা শুনে তীব্র মাত্রায় রাগান্বিত হয়ে যান আহিল সাহেব। তাই সোফা থেকে উঠে গিয়ে নিজ রুমের দিকে বড় বড় পা ফালান।

– “পুরুষ মাইনষের মন নিয়া কোনো বিশ্বাস নাই। তারা সামনাসামনি প্রেয়সীকে অগ্রাহ্য করলেও মনে মনে ঠিকই নিজ প্রেয়সীকে কামনা করে।”
আসলেই কি তাই? ব্যালকনিতে ইজি চেয়ারের উপর বসে উপমার বলা কথাগুলো কল্পনা করে আবেগ। হাতে তার উপমার কানের একটা ঝুমকা। কেন যেন মেয়েটাকে এটা আর ফেরাতে মনে ধরে না। এসব ভাবতে ভাবতেই কিছুটা চোখ লেগে আসে আবেগের।
শ্যামল মুখশ্রী। ডাগর ডাগর চোখ জুড়ে কাজলের ছোঁয়া। চোখ দুটোও যেন মায়াময়। ঠোঁটে চঞ্চলতার আবির্ভাব।
পরক্ষণেই চোখ‌ মেলে তাকায় আবেগ। কি সব উল্টোপাল্টা ভাবছে সে? তার কল্পনা জুড়ে কোনো নারীর বিচরণ? কিন্তু এও কি সম্ভব নাকি? না কিছুতেই না। এসব শুধুমাত্র বিভ্রান্তি। মনে মনে নিজেকে বোঝাতে বোঝাতেই উঠে রুমে চলে যায় সে। উদ্দেশ্য কার্ডিওলজি নিয়ে একটা বই এর চ্যাপ্টার শেষ করা।………….

#চলবে 🍂

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here