#অপূর্ব প্রাপ্তি পর্ব ১৫
#নাফিসা নীলয়া
তিতলির সামনেই প্রি টেস্ট পরীক্ষা এজন্য সে মন লাগিয়ে দিন রাত পড়াশোনা করছে। কোনোদিকে তার খেয়াল নেই। সে সারা বছর না পড়ে পরীক্ষার আগে দিন রাত পড়ে পরীক্ষা দেয়। আর প্রতিবার পড়ার সময় মনে মনে প্রতীজ্ঞা করে এবারই শেষ। এরপর থেকে সারা বছর পড়বে তাহলে আর পরীক্ষার সময় বাড়তি টেনশন নিতে হবে না। কিন্তু তা আর হয় না। সারা বছর আর সে পড়ে না পরীক্ষার আগেই তার পড়া হয়। তিতলির পড়ার সময়ই শিহাব দরজায় নক করলো। তিতলি এতে প্রচুর বিরক্ত হলো। সে ভেবেছে রেহান এসেছে। কিন্তু উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখলো শিহাব এসেছে।
-ঘরে আয় ভাই। আর যা বলার তাড়াতাড়ি বলে চলে যা। আমার অনেক পড়া আছে।
শিহাব মলিন মুখ করে ঘরে ঢুকলো। তিতলি পুনরায় টেবিলে বসে পড়তে থাকলো। শিহাব এসেছিলো তিতলির সাথে কথা বলে মন ভালো করতে। কিন্তু তার বোন তো পাওাই দিচ্ছে না।
-পরীক্ষার আগে এতো প্রেশার না নিয়ে সারা বছর পড়লেই তো পারিস।
শিহাবের কথায় তিতলি বই বন্ধ করলো। তারপর ভাইয়ের কাছে এসে বসলো।
-আমি যদি সারাবছর পড়ি তাহলে মজা মাস্তি করবে কে? তাছাড়া আমি তোর মতো আতেল হতে চাই না।
-আতেল হতে বলিনি৷ ঠিক করে পড়তে বলেছি,সবসময় তো বই নিয়ে বসে থাকতে বলিনি।
শিহাবের গম্ভীর মুখ দেখে তিতলি বুঝলো তার ভাইয়ের মন খারাপ। কিন্তু কেন! জিজ্ঞেস করলেও তো বলবে না। তাও জিজ্ঞেস করেই দেখুক তিতলি।
-তোর কি হয়েছে বল তো? দেখ আমার কাছে একদম লুকানোর চেষ্টা করবি না। কেন এতো মন খারাপ?
-আচ্ছা ধর আমি একজনের সাথে রাগের মাথায় খুব খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি। তারপর অনুতপ্ত হয়ে তার কাছে ক্ষমা চাইতে গেছি। আর সে আমাকে তিন ঘন্টা পনেরো মিনিট দাড় করিয়ে রাখলো তাহলে কি তার ওপর আমার আরো রেগে যাওয়া উচিত না?
-সে কি ইচ্ছে করে দাড় করিয়ে রেখেছে তোকে?
-না ঠিক ইচ্ছে করে ও না। আমি বুঝতে পারছিলাম তার দেরি হবে।,আর কয়েকজন বলেছিলোও সে তার গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বের হবে না। তাও দাড়িয়ে ছিলাম।
-তাহলে তো আমি তার দোষ দেখছি না। তুই বুঝতে পারছিলি যে তার দেরি হচ্ছে তাও অপেক্ষা করছিলি। সে তো ইচ্ছে করে দাড় করিয়ে রাখেনি। তাহলে তার ওপর রেগে থাকার প্রশ্নই আসে না। তুই তাকে স্যরি বলেছিস?
-না বলা হয়নি।
-তাহলে বলে দিবি সমস্যা কি? দোষ করে ক্ষমা চাইলে তো কেউ ছোট হয়ে যায় না।
-আচ্ছা বলে দিবো।
শিহাব নিজের বোনের কাছে স্মোকিং করার বিষয়টা বলতে পারলো না। বলতে পারলো না এজন্যও তাকে কথা শুনতে হয়েছে। তিতলি তাকে কখনো স্মোকিং করতে দেখেনি।
তিতলি শিহাবের গালে হাত দিয়ে বললো।
-এখনো আমার ভাইয়ের মন খারাপ?
তিতলির আদুরে কন্ঠে শিহাবের মন খারাপ একটু কমে গেল। সে তিতলির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো।
-একদম না। তুই পড় আমি যাই।
শিহাব তিতলির ঘর থেকে চলে গেল।
নীরা বাড়িতে এসেছে একরাশ খারাপ মেজাজ আর কষ্ট নিয়ে। শিহাবের ওপর সে আজ অনেক রেগে গেছে। তার ওপর আসার সময় সে ফুল গাছ কিনতে গেছিলো,তখন একটা ছেলে ইচ্ছে করে ভীড়ের মাঝে তার আপওিকর জায়গায় হাত দিয়ে গেছে। নীরা ছেলেটাকে ধরতেই যাচ্ছিলো কিন্তু ছেলেটা ভীড়ের মাঝে হারিয়ে গেল। মুখটা ভোতা করে সে বেল বাজালো। দুই তিন বার বাজাতে হলো। তারপর মিলা এসে দরজা খুলে দিলো। নীরা ভেতরে ঢুকলো। মিলা হাসি হাসি মুখ করে আছে কিন্তু নীরা আজ ভেতরে ঢুকে হাসলো না। মিলা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার আপার দিকে৷ এমন তো হয় না। তার আপা বাড়িতে এসেই হাসি দিয়ে তাকে হালচাল জিজ্ঞেস করে। কিন্তু আজ ঘটনা ব্যতিক্রম ঘটলো। নীরা সোজা তার ঘরে চলে আসলো। ড্রয়িংরুমে রেজাউল ও ছিলেন উনিও কিছুটা অবাক হলেন। নীরা প্রতিদিন বাড়ি ফিরে সবার সাথে কথা বলে। বিশেষ করে মিলার সাথে কথা বলতে বলতে ঘরে ঢুকে। আজ চুপচাপ ঘরে চলে গেল ব্যাপার কি। তিনি ইশারায় মিলাকে ডাকলেন। মিলা গেল।
-কি ব্যাপার বল তো নীরা হঠাৎ এতো চুপচাপ কেন? এরকম তো হয়নি। বাড়িতে এসেই তো ও সবার সাথে দেখা করে কথা বলে।
-কি জানি বুঝতে পারছি না তো আব্বা। আপা তো এমন করে না।
-তুই দেখে আয় ওকে।
-আচ্ছা আমি গিয়ে দেখি কি হয়েছে ওর।
বলতে বলতেই মিলা নীরার ঘরে চলে গেল। দেখলো নীরা ঘরে নেই। ইতিমধ্যেই সে ওয়াসরুমে ঢুকে গেছে। মিলা অপেক্ষা করলো কিছুক্ষন কিন্তু নীরা বের হচ্ছে না দেখে বের হয়ে আসলো। আবার ড্রয়িং রুমে ফিরে আসলো দেখলো মালিহাও এখন ড্রয়িং রুমে বসে আছেন। রেজাউল বলেছেন নীরা এসে চুপচাপ ঘরে ঢুকে গেছে কারো সাথে কথা বলেনি। মালিহাও তাই দুঃশ্চিন্তা করছেন। মিলা ফেরত আসায় তারা মিলার দিকে তাকালেন। মিলা মুখ লটকে জানালো সে কথা বলতে পারেনি। নীরা ওয়াসরুমে ঢুকে গেছে। এতোক্ষনেও বের হয়নি। এবার মালিহা গেলেন নীরার ঘরে, দেখলেন নীরা চুল মুছতে মুছতে বের হচ্ছে। মালিহা নীরার হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে নিলেন। নীরা বিছানায় বসলো। মালিহা যত্ন করে মেয়ের মাথা মুছে দিচ্ছেন। নীরা এবারও চুপচাপ হয়ে আছে কথা বলছে না। মালিহা এবার কথা বলে উঠলেন।
-কি হয়েছে নীরা এতো চুপচাপ কেন তুই?
-কিছু হয়নি তো আম্মা।
-তাহলে আজ এতো চুপচাপ কেন তুই?
-আমি কি সবসময় হউহুলোড় করি নাকি মিলার মতো।
কিঞ্চিত হাসতে হাসতে বললো নীরা।
-কি হয়েছে বল তো?তুই হইহুল্লোড় করিস না ঠিক আছে। কিন্তু এমন গুম মেরেও থাকিস না।
নীরা বুঝলো তার মাকে এভাবে বোঝানো সম্ভব না।
-আমার একটা স্টুডেন্ট একটু অসুস্থ আম্মা তাই আমার একটু মন খারাপ।
পুরো ঘটনা চেপে গেল নীরা। তার একজন স্টুডেন্ট সত্যিই একটু অসুস্থ কিন্তু অতোটাও না যতোটা হলে সে এমন বিমর্ষ হয়ে থাকবে। মালিহার সন্দেহ তবুও গেল না। কিন্তু তাও কিছু বললেন না তিনি। মেয়ে বড় হয়েছে এখন তার নিজস্ব স্পেস আছে। তাছাড়া নীরা ওমন মেয়ে না। তার মেয়ে লাখে একটা। সিরিয়াস কিছু হলে নীরা সবার আগে তার কাছেই বলে। তাই আর বেশি ঘটালেন না তিনি। তাও মনটা খচখচ করলো।
-আচ্ছা বাদ দে কিন্তু এই শীতের রাতে গোসল করলি কেন তুই? এখন যদি ঠান্ডা লেগে যায়?
-লাগবে না আম্মা ভাত বাড়ো তো খিদে পেয়েছে। আজ তাড়াতাড়ি ঘুমাবো।
মালিহা চলে গেলেন ভাত বাড়তে। নীরাও বের হলো। ভাবলো সবার সামনে এমন বিমর্ষ হয়ে থাকলে চলবে না। শুধু শুধু সবাই দুঃশ্চিন্তা করবে। তাই সবার সাথে খেয়েদেয়ে হাসিমুখে সে ঘরে চলে আসলো।
দরজা বন্ধ করে লাইট অফ করে শুয়ে পরলো সে। চোখ দিয়ে আপনাআপনি জল গড়িয়ে পরলো। একটা কথা সে কখনো কাউকে বলেনি নিজের মাকেও না। সেবার সে ক্লাস নাইনে পড়তো। একজন টিউটরের কাছে পড়তে যেতো সে। তার আম্মা অনেক কষ্টে যুদ্ধ করে তাকে পড়াতো কোনো সাপোর্ট ছিলো না। একদিন বৃষ্টির সময় সে পড়তে গেলে দেখে তাদের ব্যাচের কেউ আসেনি। সে একাই এসেছে। পড়ালেখায় ছোট থেকেই ভীষণ সিরিযাস ছিলো নীরা। নিজের প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে সে এতোদূর এসেছে। সেসময় সে একা ছিলো। স্যার তাকে বসতে বললো। সে সরল মনে বসে পরলো পড়া শুরু করলো। স্যার পড়ানোর ফাকে ইনিয়েবিনিয়ে তার শরীর স্পর্শ করার চেষ্টা করলো। বিচক্ষন নীরা ততোক্ষনে বুঝে গেছে তার সাথে কি হতে পারে সে তৎক্ষনাত চলে আসার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু ওইযে তার দূর্বলতা তার পা। তার পায়ের জন্য সে জোর কদমে আগাতে পারছিলো না। আর ওই সুযোগই নেওয়ার চেষ্টা করেছিলো তার জানোয়াররূপী শিক্ষক। তার প্রতিবন্ধী হওয়া নিয়ে বাজে বাজে কথা শুনিয়ে আয়ওে আনার চেষ্টা করছিলো। নীরা নিজেকে বাঁচানোর জন্য স্যারের হাতে কম্পাস গেঁথে দিয়েছিলো। তারপর কোনোরকমে স্যারের গায়ে টেবিল ফেলে সে ব্যাগ নিয়ে নিজের পা হেঁচড়ে দৌড়ে বেড়িয়ে এসেছিলো। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে গেছিলো। নীরা ছাতা নিয়েই গেছিলো। কিন্তু জানোয়ারের হাত থেকে বাঁচার জন্য ওভাবে তাকে আসতে হয়েছিলো। সে বহু কষ্টে নিজের পা হেঁচড়ে হেঁচড়ে বের হয়ে এসেছিলো। মাঝরাস্তায় বৃষ্টির মধ্যেই বসে চিৎকার করে কাঁদছিলো। কেন তার জীবনটা এরকম, কেন তার সাথেই এমন হয় অভিযোগ করছিলো আল্লাহর কাছে। সেইবার কোনোরকমে বাসায় ফিরেছিলো নীরা। মালিহা সেদিন বাসায় ছিলেন না। তার ভাই অসুস্থ থাকায় তিনি মিলাকে নিয়ে তাকে দেখতে গিয়েছিলেন। তারপর নীরা তার মাকেও এই ঘটনা বলেনি। তার মা তাকে নিয়ে অনেক চিন্তা করতো। সবার বিরদ্ধে গিয়ে তাকে পড়াতো। সবসময় ঢাল হয়ে তার সামনে দাড়াতো। সেই মাকে আর দুঃশ্চিন্তায় ফেললো না নীরা। টিউটরের কাছে পড়া বাদ দিলো এই বলে যে সে আর টাকা খরচ করতে দিতে পারবে না। এমনিতেই তখন মালিহাকে পড়ানোর খরচের জন্য কথা শুনতে হতো। তাই নীরা পড়া বাদ দিয়ে দিলো। একটা মেয়ের জন্য ওরকম ঘটনা মুত্যুসম। সারাজীবনের ট্রমা। এইরকম ঘটনায় অনেক মেয়ে আমৃত্যু মানসিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অনেকেই কাটিয়ে উঠে অনেকে কাটিয়ে উঠতে পারে না। কোনো মেয়েই এমন ঘটনা কখনো ভুলতে পারে না। আজকের নীরা হলে সেই জানোয়ারকে সে কখনো ক্ষমা করতো না। উপযুক্ত শাস্তি দিতোই। তারপর থেকে কোনো মেয়েকে এমন পরিস্থিতি তে পরতে দেখলে নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে প্রতিজ্ঞা করে নীরা। সেদিন তিতলিকে ওমন পরিস্থিতি তে পরতে দেখে নিজের কথা মনে পরে গেছিলো নীরার। তিতলির জায়গায় সে নিজেকে অনুধাবন করেছে সেদিন ও। সেদিন ও তার কষ্ট হয়েছে। আজ আরো দ্বিগুন কষ্ট হচ্ছে।ভেতরে ভেতরে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। আজও হচ্ছে। তবে কাউকে বুঝতে দেয়নি। সেদিনও না আর আজও দিবে না।
সেই ঘটনার অনেক বছর হয়ে গেছে। কিন্তু নীরা আজও ভোলেনি। কি পরিস্থিতি থেকে সে আল্লাহর রহমতে বেড়িয়ে এসেছিলো আজও ভাবে। এরপর থেকে এসব ভাবলেই তার গায়ে জ্বর চলে আসতো। বাজে স্পর্শ গুলো মনে হয় আজও শরীরে লেগে আছে। মালিহা ভাবতেন এমনিই জ্বর আসতো। আর আজ যখন ফুল গাছ কেনার সময় সেইরকম বাজে স্পর্শ পেলো তখন পুরোনো ঘা তাজা হয়ে উঠলো। মনে হচ্ছে নিজেকে পুঁড়িয়ে ফেললে ভালো হতো। এখনো বুকের ভেতর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। রাতে ভীষণ জ্বর এসে পরলো নীরার। সরারাত জ্বরে পরে কাঁতরালো। তাও ওভাবেই পরে রইলো। কাউকে ডাকলো না। ভেবেছিলো কমে যাবে।
ভোর রাতে মিলা পানি খেতে উঠেছিলো। তার ঘরে পানি ছিলো না। এদিকে হঠাত ঘুম ভাঙার পর পিপাসাও পেয়েছে। এজন্য ড্রয়িংরুমে সে পানি খেতে এসেছিলো। নীরার ঘর থেকে গোঙানোর আওয়াজ পেয়ে সে ভয় পেয়ে গেল। দ্রুত নীরার ঘরের সামনে গেল। দরজার নব ঘুরালো। কিন্তু নীরা ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে রেখেছে। আতংকে মিলা ওখানে দাড়িয়েই কেঁদে দিলো। নীরাকে ডাকতে থাকলো। বারবার দরজায় বারি দিতে থাকলো। নীরার উঠে দরজা খোলার মতো শক্তি ছিলো না। তবুও কষ্ট করে উঠলো তবে ফ্লোরেই পরে গেল অচেতন হয়ে। মিলা মালিহাদের ঘরে গিয়ে তাদের ডেকে আনলো। মালিহা আর রেজাউল ও অস্থির হয়ে পরলেন। মালিহা নিজেকে শক্ত করলেন। নীরার দাদী ও উঠে গেছেন। তিনিও প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেছেন।
-আম্মা আপার কি হলো? আপা দরজা খুলছে না কেন?
মিলাকে শান্ত হতে বললেন মালিহা। কঠিন পরিস্থিতি তেও তিনি নিজেকে শক্ত রাখতে পারেন। কাঁদতে কাঁদতে দিশেহারা হয়ে গেল মিলা। রেজাউল পাশের ফ্ল্যাটের একজন ছেলেকে ডেকে এনেছেন। তারপর সবাই মিলে দরজা ভাঙলেন। মিলা আর মালিহা সবার আগে দৌড়ে ঘরে ঢুকে গেল। দেখলো নীরা নিচে পরে আছে অচেতন হয়ে। মিলা চিৎকার করে উঠলো। মিলা নীরাকে খুব ভালোবাসে তার আপার এই অবস্থা দেখে মিলার কান্না থামছে না। অল্পতেই প্যানিক হয়ে পরেছে সে। মালিহা নীরাকে ধরে দেখলেন জ্বরে সারা শরীর পুড়ে যাচ্ছে। নীরাকে বিছানায় শোয়ানো হলো। আশেপাশের প্রতিবেশীরা ও ভয় পেয়ে গেছিলো। নীরা সবার উপকার করে সবসময় । এরকম একজনের জন্য সবাই দুঃশ্চিন্তা করছিলো। নীরাদের পাশের ফ্ল্যাটে একজন লোক ফার্মেসি চালান। সেই ভদ্রলোক ওকে দেখলেন। নীরাকে জলপট্টি মাথায় পানি দেওয়ার পরও জ্বরের মাএা কমানো গেলো না। যখন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না তখন সেই লোক ওকে পাশের হসপিটালে নিয়ে যেতে বললেন। যেহেতু জ্ঞান ফিরছে না। রেজাউল খুব কষ্ট পাচ্ছেন। তার মেয়ের কি হাল হয়ে গেল।
শিহাবের ঘুম আসছে না। পুরো রাত সে ঘুমায়নি। তিতলির কথার পরও না। খালি মনে হচ্ছে নীরা তাকে কি করে কথাগুলো শোনাতে পারলো। তার ও দোষ আছে। কিন্তু তাই বলে নীরা তাকে ওভাবে বলবে! শিহাবের অসহ্য লাগছে। সে ফোন হাতে নিলো। কই নীরা নাকি তাকে টেক্সট করে। কোথায় টেক্সট। সে এখনই নীরাকে ফোন করবে৷ করে বলবে এমন হেয়ালি করার মানে কি। নিজেই তো বললো বাসায় গিয়ে টেক্সট করে দিবে। শিহাবেরও সময়ের দাম আছে। যখন তখন বললেই তো আর সে সময় বের করতে পারবে না।আগে থেকেই সময় বলতে হবে। প্রতিদিন কি সে তিনঘন্টা সময় বের করবে। আশ্চর্য! সে ইতস্তত করে এই ভোর রাতেই নীরাকে কল দিলো। যেভাবেই হোক এই অস্থিরতায় নীরার কন্ঠস্বর ও শোনা হবে।
নীরাকে রেজাউলই কোলে তুলে নিলেন। তারপর বের হয়ে গেলেন। এখনই পাশের হাসপাতালে নিয়ে যাবেন। মিলা পাশে দাড়িয়ে কাঁদছে। মালিহা মিলাকে বললেন প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে নিতে আর দরজা লক করে বের হতে। ওদের দাদীকে পাশের ফ্ল্যাটে রেখে যাবেন। মিলা নীরার ফোনটাও নিয়ে নিলো। তখনই শিহাবের কল আসলো। নাম্বার সেভ করাই ছিলো। মিলার কান্না কিছুটা থামালেও এই মুহূর্তে সে ফোন ধরার মতো অবস্থাতে নেই। সে ফোন রিসিভ করলো না। কিন্তু শিহাব বারবার কল দিলো। শেষমেষ সে ধরলো।
-হ্যালো নীরা?তুমি বলেছিলে টেক্সট করে বলবে। বললে না তো। আমার ও সময় বের করে নিতে হবে। আমার তো আর অফুরন্ত সময় নেই।
শক্ত কন্ঠে বললো শিহাব।
-ভাইয়া আমি মিলা।
মিলা ভাঙা ভাঙা কন্ঠে জবাব দিলো। মিলার কন্ঠস্বরেই বোঝা যাচ্ছে সে কেঁদেছে। শিহাবের ঠিক লাগলো না।
-মিলা কি হয়েছে? নীরার ফোন তোমার কাছে আর তোমার গলা এমন শোনা যাচ্ছে কেন?এনিথিং রঙ?
-শিহাব ভাই আপা জ্বরে অচেতন হয়ে গেছে। আমার আপার কি হয়ে গেল। আমরা ওকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছি এখন রাখি।
তাড়াতাড়ি বলে উঠলো মিলা। মিলার উওর শুনে শিহাব ঝিম মেরে গেল। অতি কষ্টেও গলা দিয়ে কোনো কথা বের করতে পারলো না।
-ভাইয়া আমি রাখি এখন।
মিলার কথায় হুশ ফিরলো শিহাবের।
-মিলা কোন হসপিটাল? প্লিজ তাড়াতাড়ি নাম বলো।
মিলা বুঝতে পারলো না শিহাব হসপিটালের নাম জেনে কি করবে। আর এই মুহূর্তে বুঝতেও চাইলো না। সে নাম বলে দিলো। তারপর তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে গেল।
শিহাব নামটা শুনে কল কেটে দিয়ে অস্থির হয়ে পরলো। তার পুরো পাগল পাগল অবস্থা। কি করবে না করবে বুঝতে পারছে না সে। কোনো রকম গাড়ির চাবি আর ওয়ালেট নিয়ে বেড়িয়ে পরলো। তাড়াহুড়ো করে বের হওয়ার সময় সিড়ি থেকে পরে গেল। ভাগ্যিস শেষের সিড়ি ছিলো। তাও শিহাব কোনো ভ্রক্ষেপ করলো না বেড়িয়ে পরলো। সর্বোচ্চ স্পিডে গাড়ি ড্রাইভ করলো হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
নীরাকে হসপিটালে নিয়ে আসার পর ট্রিটমেন্ট করা হলো। অতিরিক্ত স্ট্রেসে জ্বরের প্রকোপে অচেতন হয়ে পরেছিলো।পাশাপাশি বিপি ও অনেক লো। আপাতত ঠিক আছে নীরা। এতক্ষনে সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
-আমারই উচিত ছিলো মেয়েটাকে দেখে আসা। রাতের বেলা এই শীতে গোসল করলো। আমার তো তখনই মনে হয়েছিলো ঠান্ডা লাগবে। কিন্তু ও বলেছিলো ওষুধ খেয়ে ঘুমাবে। আমিও বিশ্বাস করেছি। আর এখন এর ফল ভোগ করতে হচ্ছে। কেন যে মেয়েটাকে দেখে আসলাম না।
আক্ষেপ করতে করতে বললেন মালিহা। রেজাউল পাশেই বসে ছিলেন। বললেন
-আহহা নিজেকে ব্লেম করা বন্ধ করো মালিহা। এখন তো আমাদের মেয়ে ঠিক আছে এটাই শুকুর।
মিলা কেঁদে কেঁদে নিজের হাল বেহাল করে ফেলেছে। এলোমেলো চুলে বসে আছে। যতক্ষন পর্যন্ত তার আপা পুরোপুরি সুস্থ না হচ্ছে সে শান্ত হতে পারছে না।
এরই মধ্যে শিহাব প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে হাজির হলো। দূর থেকে মিলাকে দেখেই ডেকে উঠলো। মিলা অবাক হয়ে শিহাবের দিকে তাকালো। সে ভাবতেই পারেনি শিহাব এই ভোর রাতে এইভাবে এখানে এসে পরবে। শিহাবের অবস্থা করুন। বাসার টি-শার্ট টাউজার পরনে।এলোমেলো চুল,লাল চোখ। এরকম কেন শিহাবের অবস্থা সেই হিসেবই মিলাতে পারলো না মিলা।
-মিলা নীরা কোথায়? কি হয়েছে ওর, ও ঠিক আছে? আমাকে এখনই বলো কোন কেবিনে আছে ও? তাড়াতাড়ি বলো।
শিহাবের এমন অস্থিরতায় মিলা তৎক্ষনাত কিছু বলতে পারলো না। মালিহা আর রেজাউলে ও অবাক হয়ে গেলেন। রেজাউল তো শিহাবকে চেনেনই না। মালিহা শান্ত চোখে শিহাবকে পরখ করছেন।
-ভাইয়া আপনি শান্ত হোন আপা ঠিক আছে। অতিরিক্ত স্ট্রেসে আর জ্বরের জন্যই এমন হয়েছে। আপনি খামোখা আসতে গেলেন কেন? সকালেই আপাকে ছেড়ে দেওয়া হবে।
এতক্ষনে নীরার বাবা-মাকেও চোখে পরেছে শিহাবের। তার এমন অস্থিরতা নিশ্চয়ই সবাই ভালো চোখে দেখবে না। এজন্য সে বহু কষ্টে নিজেকে সামলালো। মালিহা আর রেজাউলের সাথে কুশল বিনিময় করলো। তবুও ভেতরে ভেতরে ছটফট করতে থাকলো সে।
-আসলে মিলার কাছে শুনে আমি একটু ঘাবড়ে গেছিলাম। ভেবেছিলাম সিরিয়াস কিছু না হয়ে যায়। তাই এখানে আসা।
-সমস্যা নেই নীরা ঠিক আছে বাবা। এখন ও ঘুমাচ্ছে। তোমার অসুবিধা হচ্ছে নিশ্চয়ই তুমি এখন চলে যেতে পারো। সকালেই আমরা নীরাকে নিয়ে যাবো।
-না আন্টি আমি একদম ঠিক আছি। আমিও থাকছি আপনাদের সাথে।
-না ভাইয়া আপনার শুধু শুধু কষ্ট করতে হবে না। আপনি বরং চলে যান।
-না মিলা। আমিই থাকতে চাইছি তোমাদের সাথে। আমার কোনো কষ্ট হবে না। জাস্ট কয়েকটা ঘন্টাই তো।
বলেই শিহাব বসে রইলো। মালিহা আর রেজাউল আর কিছু বললেন না। চুপচাপ রইলেন। কিন্তু মিলার কাছে বিষয়টা অন্যরকম ঠেকছে তবে আপাতত সে ও আর বিষয়টা নিয়ে ভাবলো না।
শিহাব নীরাকে দেখার জন্য ভেতরে ভেতরে মরে যাচ্ছে। কিন্তু এখন আবার বলতেও পারছে না। সে এসেই তো দেখতে চেয়েছিলো। তাই শিহাব এখানেই থাকবে যতক্ষন না নীরাকে দেখতে পায়।
–চলবে।