#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক পর্ব ৩

0
1437

#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক পর্ব ৩
#লেখিকা_মালিহা_খান

গন্তব্য পৌছে গেছে সিএনজি।পুরোটা সময় চোখ বন্ধ করেই কাটিয়েছে রাত্রি।চলন্ত বাহনটা হুট করে থেমে যেতেই চকিতে চোখ মেললো সে।নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসতেই নজর গেলো নিভ্রানকে ধরে রাখা হাতটার উপর।রাত্রির দৃষ্টি অনুসরণ করেই নিভ্রান ফিচেল গলায় বললো,”এবারো আপনি ধরে রেখেছেন।”
লজ্জা পেলো রাত্রি।নিভ্রান ঠোঁটে দুষ্টুমিমাখা হাসি।সেদিকে চোখ পরতেই লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নামালো সে।তড়িঘড়ি করে হাতটা ছেড়ে দিয়ে ব্যাগ থেকে নিজের ভাগের টাকা বের করে নিভ্রানের দিকে এগিয়ে দিয়ে মিনমিনে কন্ঠে বললো,”আপনি একসাথে দিয়ে দিয়েন।”
ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো নিভ্রান।রাত্রি ঠায় ধরে রয়েছে টাকাটা।বোঝাই যাচ্ছে সে কোনোক্রমেই নিভ্রানকে পুরো ভাড়া দিতে দিবেনা।মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে টাকাটা হাতে নিলো নিভ্রান।রাত্রি দেরি করলোনা।দ্রুত পলিথিনটা সরিয়ে দরজার হাতল ঘুরালো।নিভ্রান কিছু বলতে যেয়েও থেমে গেলো।ততক্ষনে বেরিয়ে পরেছে রাত্রি।মাথার উপর একহাত দিয়ে বৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করে অন্যহাতে ব্যাগটা নেয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিতেই টনক নড়লো নিভ্রানের।চোখের পলকে টাকাটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাত্রির ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে অপরপাশের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো সে।একপ্রকার দৌড়ে হাতের ছাতাটা খুলে রাত্রির মাথার উপর ধরলো।ঘটনার আকস্মিকতায় থতমত খেয়ে গেলো রাত্রি।লোকটা ছাতা কখন হাতে নিলো?
নিজে ভিজে তার উপর ছাতা ধরে রেখেছে কেনো?তার ভাবনার মাঝেই নিভ্রান মৃদু ধমকের স্বরে বলে উঠলো,
—“আপনি কি পাগল নাকি রাত?এই বৃষ্টিতে কেউ এভাবে বেরিয়ে পরে?”

বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালো রাত্রি।বললো,
—“আপনি নিজেই তো ভিজে যাচ্ছেন।”বলেই নিভ্রানের বাহুতে আলতো করে ধরে তাকে ছাতার ভিতরে নিয়ে এলো রাত্রি।কুঁচকানো ভ্রু জোড়া ঠি ক করে ঠোঁট চেপে মৃদু হাসলো নিভ্রান।বললো,”বৃষ্টি আমার ভীষণ পছন্দ রাত।ভিজতে বেশ লাগে।কিন্তু আপনিতো বৃষ্টি বিদ্বেষী।আপনি কেনো ভিজবেন?”

মাথা ঝুঁকিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো রাত্রি।একহাত দিয়ে মুখ ঢেকে হাসতে হাসতেই বললো,
—“আপনাকে কে বলেছে আমি বৃষ্টি বিদ্বেষী?”

—“ওইযে গতরাতে বাতাস শুরু হওয়া মাত্রই যখন আপনি জানালা আটকে দিলেন তখন।”বলে সিএনজির ড্রাইভারকে একটু অপেক্ষা করতে বলে সামনে এগোলো নিভ্রান।তার পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চললো রাত্রিও।স্টুডেন্টকে বাড়ির গেটের ছাউনির ভেতরে ঢুকে যেতেই মুচকি হেসে হাতটা বাড়িয়ে দিলো রাত্রি।বললো,
—“দিন,এটুকু আমিই পারবো।”

স্মিত হাসলো নিভ্রান।ব্যাগটা রাত্রির কাছে দিয়ে নিজের ডানহাতটা রাখলো রাত্রির মাথার উপর।হকচকালো রাত্রি।চোখমুখ প্রশ্নাত্বক হয়ে উঠলো।নিভ্রান সেই চাহনী উপেক্ষা করে কোমল স্বরে বললো,”সাবধানে থাকবেন রাত।”
রাত্রি আমতা আমতা করলো।মা বাদে এমন আদরমাখা কথা সে শেষ কবে কার কাছ থেকে শুনেছিলো মনে পরছেনা।মুখের চোয়াল ভারি হয়ে উঠলো।চোখ জ্বালা করছে।কিন্তু এই মাঝরাস্তায় লোকটার সামনে কেঁদে ফেলা একেবারেই বাচ্চাদের মতো একটা কাজ হবে।বারকয়েক ঢোঁক গিলে কান্নাগুলো লুকিয়ে ফেললো সে।নিভ্রান আর সময় নষ্ট করলোনা।আলতো করে মাথার দুবার বারি দিয়ে হাত সরিয়ে নিলো।বললো,

—“ছাতাটা ধরুন।ফেরার সময় প্রয়োজন হতে পারে।’না’ করবেননা একদম।”

লোকটার আদেশভরা চোখের দিকে তাকিয়ে আর না করতে পারলোনা রাত্রি।ছাতাটা নিয়ে বললো,
—“ধন্যবাদ।কিন্তু আপনাকে ফেরত দিবো কি করে?”

ঠোঁটের কোঁণ প্রসারিত হয়ে গেছে নিভ্রানের।রাত্রি যে এত সহজে মেনে যাবে সে আশা করেনি।বৃষ্টি মাথায় নিয়েই দু সিঁড়ি নেমে গেলো নিভ্রান।গলা বাড়িয়ে বললো,
—“যান,আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে।আর আমার ছাতা আমি নিজেই ফেরত নিয়ে যাবো।আসি,আল্লাহ হাফেজ।”

রাত্রির উওর শোনার আগেই কাঁদাপানিতে ঝপাঝপ শব্দ সৃষ্টি করে দ্রুত সিএনজিতে উঠে গেলো নিভ্রান।রাত্রি
বিমূঢ় হয়ে চেয়ে থেকে ছাতাটা বন্ধ করে চুপচাপ ভেতরে ঢুকে গেলো।

সিএনজিতে উঠে বসতেই ফোন বেজে উঠলো।পকেট থেকে দামি মোবাইলটা বের করে মুচকি হাসলো নিভ্রান।
মা ফোন দিয়েছে।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তেজী স্বর ভেসে আসলো,
—“বাড়িতে পৌছেছিস?একটা ফোন পর্যন্ত দেস না।কতবার বলি গাড়ি নিয়ে চলাফেরা কর।চট্রগ্রাম থেকে ফিরলি তাও বাসে করে।কি দরকার ছিলো এই ঝড়বাদলের মধ্য?”

নিভ্রান নির্বিকার ভঙ্গিতে উওর দিলো,
—“সবসময় তো গাড়িতেই আসা যাওয়া করি মা।এবারই শুধু বাসে আসলাম।আমি আর আধঘন্টার মধ্যই পৌছে যাবো।পৌঁছেই তোমাকে ফোন দিতাম।বুঝলে?কেনো যে এত টেনশন করো তুমি।”

নাহিদা হাসলেন।বললেন,
—“একা একা না থেকে তোর নিজের বাড়িতে চলে আয় বাবা।তাহলেইতো আমি চিন্তামুক্ত হয়ে যাই।”

তপ্ত শ্বাস ছাড়লো নিভ্রান।মা প্রতিদিন নিয়ম করে এই একটা কথা বলবেই তাকে।দিনশেষে রাত নেমে আসা যেমন বাধ্যতামূলক তেমনই দিনশেষে একবার হলেও মায়ের এই কথাটা শোনাও যেনো বাধ্যতামূলক।একথাটার পর আর কখনোই কথা বাড়ায়না নিভ্রান।এবারো ব্যাতিক্রম হলোনা।ভরাট গলায় সে বললো,
—“আচ্ছা রাখছি মা,পরে কথা হবে।বিকেলে ফোন দিবোনে।”

বিরস কন্ঠে সম্মতি জানিয়ে ফোন রাখলেন নাহিদা।ছেলের এই একরোখা জেদি স্বভাব সেই ছোট থেকে।
একবার যা বলে দিবে সেই কথার নড়চড় হবেনা কখনো।পৃথিবী উল্টে যাক তবু সে নিজের সিদ্ধান্তে অনড়।
__________

দুপুরের হয়ে গেছে প্রায়।বৃষ্টি থেমেছে অনেক আগেই।তবে আকাশ মেঘলা হয়ে আছে।রুমে ঢুকেই ধপ করে বিছানায় বসে পরলো রাত্রি।শুয়েও পরলো প্রায় সাথেসাথেই।শরীর ভেঙে ঘুম আসছে।আবার ক্ষুধাও লেগেছে প্রচন্ড।বেশ কিছুক্ষণ মরার মতো পরে থেকে উঠে বসলো সে।গা থেকে ওড়না সরিয়ে চুলে হাত দিতেই একটু খটকা লাগলো।তার চুলতো বাঁধা ছিলোনা।এতক্ষণ খেয়াল করেনি।চুলে ঝুটি বাঁধলো কখন?
দ্রুতহাতে ঝুঁটিটা খুললো সে।হাতের মুঠোয় রিচব্যান্ডটা আসতেই ভ্রুজোড়া আপনাআপনিই কুঁচকে এলো।
ছেলেদের হাতের রিচব্যান্ড।মাঝখানে আবার সাদা ইংলিশ অক্ষরে লেখা,”NIVRAN”।কালো রংয়ের মধ্য সাদা অক্ষরগুলো ফুটে রয়েছে।তারমানে হয়তো লোকটা তাকে এটা দিয়ে ঝুঁটি বেঁধে দিয়েছিলো।আর নিভ্রান?নিভ্রান কি লোকটার নাম?এমন নাম হয় নাকি কারো?মাথা ঘামালোনা রাত্রি।দেখা হলে ফেরত দিয়ে দিবে ভেবে ব্যান্ডটা পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে রেখে ব্যাগ থেকে জামাকাপড় বের করে নিয়ে গোসলে ঢুকে গেলো।

বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে থাকে নিভ্রান।মা,বাবা,আর ছোট ভাইও শহরেই থাকে কিন্তু আলাদা।সে নিজের ফ্ল্যাট কিনেছে কয়েকবছর হয়ে গেছে।এরপর আর বাড়ি যায়নি।চট্রগ্রাম গিয়েছিলো নিজের অফিসের একটা কাজে।বাবার অবশ্য নিজস্ব ব্যাবসা আছে কিন্তু সেটায় তার আগ্রহ নেই।
রুমে এসে জামাকাপড় বদলে একেবারে শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরোলো নিভ্রান।বাসার মেইড সব রান্নাবান্না করে দিয়ে যায়।এই তিনদিন সে ছিলোনা আজকে ফিরবে আগেই বলে রেখেছিলো তাই সকালে এসেই ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে খাবার রেডি করে দিয়ে গিয়েছে।এজন্য অবশ্য তাকে বেশ মোটা অংকের বেতন দেয়া হয়।
ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলে রুমের এসি চালিয়ে দিলো নিভ্রান।জীবনে তার টাকার অভাব না থাকলেও সুখের বড়ই অভাব।এইযে একা একটা ফ্ল্যাটে সে থাকে।যতই বলুক না কেনো তার কোন সমস্যা হচ্ছেনা কিন্তু দিনশেষে একটা পরিপূর্ণ পরিবারের অভাবটাইতো তার নিত্যদিনের সঙ্গি হয়।
___________
দ্বিতীয় সাক্ষাত টা হতে তেমন দেরি হয়নি।পরেরদিন বিকেলে টি উশনি করিয়ে বাসার নিচে নামতেই নিভ্রানের মুখোমুখি হয় রাত্রি।তব্দা খেয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।লোকটাকে সে এইসময় এখানে আশা করেনি।ভাবেনি এত তাড়াতাড়ি আবার দেখা হবে।লোকটা নিশ্চয় ছাতা ফেরত নিতে এসেছে।কিন্তু লোকটা জানলো কি করে সে আজ বিকেলে পড়াতে এসেছে?সে যাই হোক,সে তো ছাতাটা সঙ্গে আনেনি।মূহুর্তেই কপালে সুক্ষ্ন চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে উঠে রাত্রির।
তাকে দেখেই ঠোঁট এলিয়ে হাসে নিভ্রান।জবাবে সৌজন্যমূলক হাসি হাসে রাত্রি।
নিভ্রান বলে,
—“কেমন আছেন?”

রাত্রি ক্ষীণ কন্ঠে জবাব দেয়,”জি ভালো”বলে একটু সময় নেয়।তারপর কাঁচুমাচু করে বলে,আপনি নিশ্চয় ছাতাটা নিতে এসেছেন?”

চোখ ছোট্ট ছোট্ট করে তাকায় নিভ্রান।পরক্ষণেই গোলমেলে কন্ঠে বলে,
—“জি,ছাতাটা নিতেই আসলাম।”

দপ করে নিভে যায় রাত্রি।অপরাধীর মতো চোখ নামিয়ে বিনীত কন্ঠে বলে,
—“আমি তো আসলে সেটা সঙ্গে আনিনি।আপনি একটু কষ্ট করে আমার সাথে বাসা পর্যন্ত যেতে পারবেন?
না হলে আপনার এড্রেস দিন আমি গিয়ে দিয়ে আসবোনে।”

নিভ্রান মুচকি হাসে।রাত্রির মাথায় হাত রেখে সহজ গলায় বলে,
—“আরে,আপনি এত সিরিয়াস হচ্ছেন কেনো রাত?একটা ছাতাই তো।চলুন,আপনার বাসায়ই চলুন।”

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here