#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক পর্ব ২৫

0
623

#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক পর্ব ২৫
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️

বেডে অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছেন রুবিনা। কপালে মোটা ব্যান্ডেজ। রাত্রি তার ক্যানেলা লাগানো হাত ধরে কপাল ঠেকিয়ে বসে আছে। চোখ বন্ধ। নিশ্চিত বুঝতে পারছে মায়ের মাথার ভয়াবহ আঘাতটাই তার অসুস্থতার পেছনের রহস্য। আর এই কাজটা যে তার মামির দ্বারাই হয়েছে সে ব্যাপারেও শতভাগ নিশ্চিত।
এই জন্যই তার মামির দেখা নেই আশেপাশে।
নিভ্রান কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। রাত্রি চোখ মেলে তাকালো। দৃষ্টিজোড়ায় রাজ্যের ক্লান্তি। নিভ্রান কাছে এসে আলতো করে মাথার উপর হাত রাখলো। নরম গলায় বললো,
—“ডক্টরের সাথে কথা বলেছি রাত। আন্টির কন্ডিশন এখন যথেষ্ট স্টেবল। চিন্তার কিছু নেই। স্যালাইনটা শেষ হোক। তারপর ডক্টর এসে দেখে যাবে। চিন্তা করোনা।”

রাত্রি মাথা নাড়ালো। মুখ ফুটে কিছু না বললেও নিভ্রান সহজেই বুঝতে পারছে মেয়েটার মাথাভর্তি চিন্তা। একয়দিনে এতটুকু অনন্ত চিনেছে সে যে রাত্রি মরে গেলেও মুখ ফুটে কিচ্ছু বলবেনা। মাথা থেকে হাত সরিয়ে পকেট থেকে ওয়ালেট বের করলো সে। আলতো করে রাত্রির হাত টেনে মুঠোয় ধরিয়ে দিয়ে আস্তে করে বললো,”রাখো।”
রাত্রি চকিতে তাকালো। হাতের মধ্য মোটাসোটা ওয়ালেট। নিভ্রান হাত সহ মুঠ করে রেখেছে বিধায় ফিরিয়ে দেয়ার উপায় নেই। আমতাআমতা করলো। দ্বিধাগ্রস্ত কন্ঠ তার,”লাগবেনা..”
নিভ্রান স্নান হাসলো। একটু ঝুঁকে কানের পিছে চুল গুঁজে দিতে দিতে মোলায়েম স্বরে বললো,
—“এসব নিয়ে তোমার ভাবতে হবেনা রাত। বসো,আমি খাবার নিয়ে আসি। কিছু খাওনি। চোখমুখ শুকিয়ে গেছে।”

—“কিন্তু…”

—“চুপ,বসো। কি খাবা? আমি নিয়ে আসি।”

রাত্রি চোখ নামিয়ে নিলো। মানুষটা কিভাবে পারে?
নিভ্রান হাসলো। ফিচেল গলায় বললো,
—“আচ্ছা বলা লাগবেনা। আর হসপিটালের বাদবাকি সব বিল দিয়ে দিয়েছি। শুধু তোমার মামার টাকাটা দিয়ে দিও। উনার চাহনীটা আমার জাস্ট সহ্য হচ্ছেনা।”

রাত্রি চোখ পাকিয়ে তাকালো।লোকটা এমন একটা অবস্থায়ও মজা করছে?কিভাবে পারে?

______________

রুবিনার জ্ঞান ফিরেছে। চোখ মেলে মেয়েকে মাথার কাছে বসে থাকতে দেখে যেনো আত্না জুড়িয়ে গেলো তার।
মা কে চোখ খুলতে দেখে মুখে হাসির ঝলক খেলে গেলো রাত্রির। ফ্যাকাশে চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। রাতভর নির্ঘুম থাকার ক্লান্তি যেনো নিমিষেই কেটে গেলো। ক্যানেলা লাগানো কাঁপা কাঁপা হাতেই রাত্রির মাথা টেনে কপালে চুমু খেলো সে। রাত্রি মিষ্টি করে হাসলো।
—“এখন ভালো লাগছে মা?

রুবিনা নিষ্প্রান স্বরে বললো,
—“তুই কখন আসলি? তোর মামা ফোন দিয়েছিলো?”

—“হু,উনার তো আছেই এককথা।টাকা টাকা টাকা।”

—“এভাবে বলেনা মা..”
রুবিনা আরো কিছু বলবে তার আগেই নিভ্রান ঢুকলো। হাতে খাবারের প্যাকেট। রুবিনাকে সজাগ দেখে বিনয়ী স্বরে সালাম দিলো সে। রুবিনা কয়েক সেকেন্ড চেয়ে রইলো। রাত্রি একপলক নিভ্রানের দিকে তাকালো। অত:পর মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
—“আমার বন্ধু।”

রুবিনা ভ্রু কুঁচকালো। চোখের মনি সরু। ঠোঁটের আগায় গভীর প্রশ্ন। এত বড় ছেলেটা তার মেয়ের বন্ধু?রাত্রি তো এর থেকে বয়সে অনেক ছোট হবে।
মায়ের না বলা সন্দেহপ্রবণ প্রশ্নগুলো সহজেই বুঝলো রাত্রি। গলা ঝাড়লো সে,”খুব ভালো বন্ধু মা। রাতের বেলা যখন তোমার খবর পেলাম তখন বাস পাইনি তাই উনি গাড়ি করে নিয়ে এসেছেন।”
রুবিনার মনের প্রশ্ন পরিষ্কার না হলেও থেমে গেলেন উনি। মেয়ের ওপর যথেষ্ট ভরসা আছে। আবেগ অনুভূতিতে গা ভাসিয়ে দেয়ার মতো মনমানসিকতা তার মেয়ের কোনোকালেই ছিলোনা।
নিভ্রান নিজেই এগিয়ে এলো এবার। প্যাকেট গুলো রাত্রির হাতে ধরিয়ে অমায়িক হেসে বললো,
—“এখন কেমন আছেন আন্টি?”
জবাবে রুবিনাও হাসলেন। ছেলেটার হাসিটা খুব আন্তরিক। হাবভাবে প্রাপ্তবয়স্কের একটা গভীর ছাপ আছে। মায়া কন্ঠে তিনি উওর দিলেন,
—“ভালো বাবা।”

রাত্রি তখনো খাবারের প্যাকেট খুলেনি দেখে নিভ্রান নিজেই টেনে নিলো। পলিথিন থেকে ভেজিটেবল রোলের প্যাকেট বের করলো। মোড়ানো কাগজ খুলে মুখের সামনে ধরে বললো,”হা করো।”
রাত্রি হা করলোনা। খানিক আপত্তি করতেই নিরবে চোখ রাঙালো সে।অর্থ,”এখন হা না করলে আমি ধমকাতে বাধ্য হবো।”
রাত্রি মুখ খুললো। এককামড় খেয়ে চিবাতে চিবাতেই রুবিনার দিকে তাকিয়ে বললো,
—“আপনার মেয়ে একদম নিজের খেয়াল রাখে না আন্টি।”

রুবিনা আবারো হাসলো। একরাশ প্রশান্তি নিয়ে চেয়ে রইলো সুন্দর মূহুর্তটায়। ছেলেটার এভাবে যত্নের সহীত খাইয়ে দেয়া, একটুপর পর কপালের চুল সরিয়ে দেয়া, থুতনির নিচে হাত পেতে পরে যাওয়া খাবার মুখে তুলে দেয়া সব কি শুধুই বন্ধুত্বের খাতিরে?
____________

মামির দিকে তীক্ষ্ণ চাহনীতে চেয়ে রয়েছে রাত্রি। চোখের দৃষ্টি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ,শাণিত। সেই ধারেই যেনো সামনের মানুষ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে। রাত্রির মামি লিমা। মধ্যবয়স্ক মহিলা। পেঁচানো মস্তিষ্কের অধিকারীনী।
রুবিনা তখন বেডসাইডে হেলান দিয়ে নতবদনে চেয়ে রয়েছে। তার পাশেই রাত্রি। মেয়ের স্বভাব চরিত্র চেনা আছে। এত সহজে সে লিমা কে ছেড়ে দিবেনা কখনোই। নিভ্রান তার কাছ ঘেঁষেই দাড়িয়ে আছে। রাত্রি প্রশ্ন ছুড়লো,
—“ডাক্তার বলেছে আপনারা যখন মাকে এনেছেন তখন মায়ের মাথায় গুরুতর আঘাত ছিলো। রক্তক্ষরণের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারতো। আমার প্রশ্ন সেই আঘাতটা মা পেলো কিভাবে?”

লিমার দৃষ্টি অস্থির। চোর ধরা পরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি। অগোছালো স্বরে বললেন তিনি,
—“কলপারে পরে গেসিলো। অসাবধানতায়…”

—“ধাক্কাটা নিশ্চয়ই আপনিই দিয়েছিলেন মামি?”

রাত্রির সরাসরি প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো লিমা। আমতা আমতা করে বললো,”আমি কেনো দিমু?”
হুঁশ হারিয়ে ফেললো রাত্রি। বসা থেকে দাড়িয়ে সজোরে চিৎকার করে উঠলো,
—“আপনারা কি মানুষ? একজন বয়স্ক মহিলা নিরুপায় হয়ে আপনাদের বাসায় থাকে। কিভাবে পারেন এমন আচরণ করতে? যদি মার কিছু হয়ে যেতো? আপনার তো আপন বোন মামা। আপনি কিভাবে পারেন? একটু মায়া হয়না?”

রুবিনা মৃদু স্বরে তার হাতে টান দিলো,”রাত মা, চুপ কর।”

—“কেনো চুপ করবো মা? এরকম চলতে থাকলে তো উনারা তোমাকে একদিন মেরেই ফেলবে। তারপর বলবে ভুলে মেরে ফেলেছি। আর আপনারা, মা তো আপনাদের কাছে বিনা পয়সায় থাকেনা মামা। আমাদের বাসা বিক্রির টাকা দিয়ে বাবার ঋন শোধ করার পর বাদবাকি টাকা তো ব্যাংকে আছে। মাসে মাসে সেখান থেকে তো টাকা পান আপনারা। সেটা দিয়েই তো মায়ের প্রয়োজন মিলে যায়। বাড়তি প্রয়োজন হলে আমি পাঠিয়ে দেই। শুধু বাসায় থাকে বলে এতো সমস্যা আপনাদের? আমি তো বলেছি ভার্সিটি টা শেষ হলেই মাকে এখান থেকে নিয়ে যাবো। ততদিন পর্যন্তও একটু অপেক্ষা করতে পারবেন না? এত পাষাণ কেনো আপনারা? কেনো এতো বিবেকহীন?”

লিমা যেনো সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলো।সুযোগ বুঝেই সে বললো,
—“তোমার মা রে আমরা আর রাখতে পারুমনা। আমাদের ই ঝামেলার শেষ নেই। উনার দুইদিন পরপর অসুখ আর পোহানোর ক্ষমতা নাই আমার।মা রে পারলে এহনই নিয়া যাওগা।”

লিয়াকত হোসেন চুপচাপ দাড়িয়ে আছেন। তার নিরবতাই বলে দিচ্ছে স্ত্রীর সাথে সে শতভাগ সহমত।
রাত্রি ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে তাকালো,”আপনার মতো খারাপ মানুষ আমি দেখিনি মামী।”এরইমাঝে একজন ডাক্তার উঁকি দিলো কেবিনে।একনজর দেখে বললো,”এটা হাসপাতাল,চিৎকার চেঁচামেচির জায়গা নয়।অন্যদের সমস্যা হচ্ছে।”

উনি চলে যেতেই নিভ্রান মুখ খুললো এবার,
—“আপনাদের আর রাখতে হবেনা। আন্টিকে রিলিজ দিলেই আমরা তাকে ঢাকায় নিয়ে যাবো। ফাইন?”

লিয়াকত হোসেন তাচ্ছিল্য করে বললেন,তোমার মাইয়া নতুন নাগর জুটাইছে বুবু। তার তাগদেইতো এতো দেমাগ ঝরতেছে।”

রাত্রি চোখ জ্বলে উঠলো। হুঙ্কার দিয়ে উঠলো সে,”খবরদার মামা! উনাকে নিয়ে একটা বাজে কথাও বলবেন না। আপনারা উনার..”অতিরিক্ত চাপ আর নিতে না পেরে কথা মাঝেই আটকে গেলো। মূর্ছা গেলো রাত্রি। শরীর অসাড় হয়ে লুটিয়ে পরলো রুবিনার কোলের উপর।

নিভ্রান একমূহুর্ত দেরি না করে আলতো করে তাকে উঠিয়ে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরলো।দু’হাতে আগলে ধরে মামা-মামীর দিকে চেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—“আর একটা কথা বললে আমি ভুলে যেতে বাধ্য হবো আপনারা বয়সে কত বড় বা সম্পর্কে কি হন।”

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here