#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক পর্ব ৩৮

0
597

#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক পর্ব ৩৮
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️

প্রেমস্নিগ্ধ নিশাবসান হলো। প্রত্যুষের নীলাভ আভায় ছেঁয়ে গেছে পৃথিবী। ঘড়ির কাঁটা ভোর পাঁচটা বিশে যেয়ে আটকেছে। রাত্রি চোখ মেললো একটু একটু। আধো জাগ্রত তন্দ্রাঘোরের মাঝেই নিভ্রানের ঘুমন্ত চেহারায় চোখ বুলালো। তাকে বাহুডোরে গুটিয়ে নিয়ে বিভোর হয়ে আছে মানুষটা। দু’নাকের ডগা ছুঁইছুঁই। একটা উক্তি আছে,”মেয়েদের নাকি ঘুমন্ত অবস্থায় সবচাইতে সুন্দর লাগে”। অথচ নিভ্রানের ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখে রাত্রির তক্ষুনি ঘোরতর মিথ্যা মনে হলো এতদিনের প্রচলিত উক্তিটা। ডাহা মিথ্যা! ঘুমন্ত অবস্থায় এই মানুষটাকে সৌন্দর্যের দিক দিয়ে কেও হারাতেই পারবেনা। কক্ষনো পারবেনা। অসম্ভব!
নিজের ভাবনায় ডুবে নিজেই হেসে ফেললো সে। গালের কাছে কিছুক্ষণ বৃদ্ধাঙ্গুল বুলিয়ে কপালের অবিন্যস্ত চুলগুলো বামহাত দিয়ে সরিয়ে গাঢ় করে ঠোঁট ছোঁয়ালো মাঝখানটায়। অনেকক্ষণ, খুব সময় নিয়ে। নিভ্রান একটু নড়েচড়ে উঠলো। ঘুমে আলগা হয়ে আসা হাতের বন্ধন দৃঢ় করলো। তবে চোখ খুললোনা। ঘুম ভাঙলোনা। বাইরে ভোরের আলো ফুটতে আরম্ভ করেছে। বৃষ্টি থামার নাম নেই। পবিত্র প্রেমের সাক্ষী থাকার জন্য সে আজ বিদায় নিতে নারাজ।

আটটার দিকে ঘুম ভাঙলো নিভ্রানের। কাঁধের কাছে মাথা রাখা রাত্রির চুলের গোছা তার নাক- মুখের উপর গড়াগড়ি খাচ্ছে। সুবাসিত নেশা ঘাটানো ঘ্রাণে ঝিঁমিয়ে আসলো নাসিকারন্ধ্র। হাত উঠিয়ে চুলগুলো সরিয়ে দিলো সে। ঘড়ির দিকে চেয়ে যত্ন করে রাত্রিকে বালিশে শুইয়ে গলা পর্যন্ত ব্ল্যাঙ্কেট তুলে দিলো। মেয়েটা ক্লান্ত। আজ আর ভার্সিটির জন্য ডাকার দরকার নেই। ঘুমাচ্ছে ঘুমাক।
______________

রাত্রি উঠেছে দুপুরের দিকে। লোকটা তাকে ডাকেনি কেনো? ক্লাস মিস হয়ে গেলো। অভ্যাসবশত পাশ থেকে ফোন হাতে নিলো। স্ক্রিনে মেসেজ আইকন উঠে আছে। চাপ দিতেই দেখা গেলো নিভ্রানের মেসেজ,”আজকের নোটসগুলো আসার সময় নিয়ে আসবো আমি। চিন্তা করোনা।”
মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটে। ফোনটা রেখে শাওয়ার নিয়ে বাইরে বের হলো সে। টেবিলে খাবার সাজানো। নাস্তা কে বানালো? খালা ঘর মুছছে তখন। তাকে দেখেই একগাল হেসে বললো,”ভাইয়ে আপনের আর খালাম্মার নাস্তা বানায় রাখতে কইছিলো। খালাম্মার টা সক্কালেই দিয়াইসি। আপনেরটা এতক্ষণে ঠান্ডা হইয়া গেসে। গরম কইরা দিমু?”
রাত্রি চেয়ার খুলে বসতে বসতে বললো,
—“না খালা দরকার নেই। আপনার ভাইয়া খেয়েছেন?”

—“না, আমি কইলাম খাইয়া যান, কয় দেরি হইয়া গেসে, খাইবোনা।”

রাত্রির মন খারাপ হয়ে গেলো। মানুষটা না খেয়েই চলে গেছে? এমনেও দুপুরে ঠি ক মতো খায় কিনা জানেনা। কতবার বাসা থেকে খাবার বানিয়ে দিতে চেয়েছে নিবেইনা। জেদি একটা। ইশ! তার ঘুমটা সকালে ভাঙলোনা কেনো? মানুষটার এতটুকু খেয়ালই রাখতে পারেনা সে। ধ্যাত্।

সারাদিন এ ঘর ও ঘর করেই কাটলো। বিকেলের দিকে আলমারি খুলে বসলো রাত্রি। বিয়ের শাড়িটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলো পাক্কা ত্রিশমিনিট যাবত। আলমারির উপরের দিকের একটা তাকে নিভ্রানের কয়েকটা জামাকাপড় আলাদা করে রাখা। রাত্রি হাতের নাগাল পায়না অতদূরে। তাই দেখাও হয়নি কখনো। তবে আজ দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।
কাজ নাই আর কি ই বা করবে এখন? বাড়তি সময়গুলোই হয় যতো অকাজের কারখানা। ডাইনিং টেবিল থেকে একটা চেয়ার এনে সেটার উপর উঠে দাড়ালো সে। এখন আরামে নামানো যাবে কাপড়গুলো।
একটা ব্ল্যাক কালারের পোলো টি- শার্ট, হাল্কা নীল রংয়ের শার্ট, গ্রে কালারের শার্ট, আর দু-তিনটা মেয়েদের চুলের চিকন কালো ক্লিপ। রাত্রি কপাল কুঁচকালো। ভাঁজ করে রাখা কাপড়গুলো দু’হাতে ধরে নামালো। সব শার্ট, টি- শার্ট তো নিচেই রাখা। এগুলো আলাদা কেনো? অদ্ভুততো।

নিভ্রান ফিরলো তাড়াতাড়িই। কলিংবেল না বাজিয়ে পকেট হাতড়ে চাবি বের করে গেট খুললো। রাত্রি ঘরে ছিলো তখন। দরজার আওয়াজ শুনতেই চট করে বেরোলো সে। নিভ্রানকে সবে ঢুকতে দেখে স্হির চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। নিভ্রান একঝলক তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বামহাতটা সোজা বাড়িয়ে দিলো। অর্থ,”কাছে আসো।”
রাত্রি চুপটি করে এগিয়ে গেলো। নিভ্রান কপাল টেনে চুমু খেলো প্রথমেই। পিছন দিয়ে অপরপাশের বাহু জড়িয়ে নিয়ে বললো,” কি করছিলে?”

রাত্রি ছোট্ট করে উওর দিলো,”কিছুনা।”

ঘরে এসে চোখ গেলো বিছানায় রাখা জামাকাপড়গুলোর দিকে। নিভ্রান দেখেও না দেখার ভান করলো।
ব্যাগ থেকে একটা ক্লিয়ার ফাইল বের করে সেন্টার টেবিলের উপর রেখে বললো, “তোমার নোটস। সাবজেক্ট টি চারদের থেকেই আনিয়েছি। ভুল থাকবেনা কোনো।”

রাত্রি হাতে নিলো। নিভ্রান শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে আড়চোখে আরো কিছুক্ষণ দেখে নিলো বিছানার কাপড়গুলো। রাত এগুলো বের করেছে কেনো? কিছু বুঝে গেছে নাকি মেয়েটা? হায় আল্লাহ!
শার্টটা গা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ধীরকন্ঠে বললো সে,”এগুলো বের করে রেখেছো কেনো?”
রাত্রি শুনতে না পেয়ে বললো,
—“জি?”

নিভ্রান গলা ঝেড়ে বললো,”ওগুলো বিছানায় রেখেছো কেনো? আলমারিতে ছিলোতো।”

রাত্রি সহজ গলায় উওর দিলো,”আপনি একয়টা জিনিস আলাদা করে রেখেছেন কেনো?”

নিভ্রান আমতাআমতা করলো। সে খুবই পাগলাটে স্বভাবের। এ জিনিসগুলো যত্নে রাখার পিছনেও কারণ আছে। রাত কে কি বলবে? মেয়েটা উল্টোপাল্টা ভেবে বসবে না তো? কেঁদে দেয় যদি?
রাত্রি উওরের আশায় চেয়ে আছে। নিভ্রান নামানো কন্ঠে বললো,
—“ওগুলো খুব স্পেশাল রাত।”

—“জামাকাপড় স্পেশাল হয় নাকি?”

নিভ্রান হাসলো। রাত্রি সন্দিহান কন্ঠে বললো,”হাসছেন কেনো?”

নিভ্রান ইশারা করে বললো,”নিয়ে আসো, বলছি কেনো স্পেশাল হয়।”

রাত্রি কাপড়গুলো হাতে তুলে নিলো। নিভ্রানের কাছে যেতেই তাকে টেনে উরুর উপর বসিয়ে নিলো সে। টি- শার্ট গুলো নামিয়ে রাখলো কাঁচের টেবিলের উপর। উপরের ক্নিপগুলো একসাথে করে রাখলো।
রাত্রির কানে গোঁজা চুলগুলো অযথাই আবার গুঁজে দিয়ে বলতে শুরু করলো,”এইযে কালো টি- শার্টটা এটা সেই প্রথমদিন পরে ছিলাম আমি। সেই যে তুমি বাসের মধ্যে বুকে মাথা রাখলে, জড়িয়ে ধরলে। আমি বাসায় এসে জামাটা আর ধুইনি কেনো জানো? তুমি কেমনে জানবে? আমি নিজেই জানিনা কেনো ধুইনি। শুধু মনে হচ্ছিলো মেয়েটার ছোঁয়াটা মুছে যাবে। গায়ের ঘ্রানটা মিলিয়ে যাবে। ধুয়ে যাবে পানির সাথে। তাই ওভাবেই রেখে দিয়েছিলাম। আর দ্বিতীয়, এই নীল শার্টটা…. তুমি যেদিন প্রথমবার সজ্ঞানে জড়িয়ে ধরে কান্না করলে। ওইযে মাঝরাস্তায়… ব্রিজের উপর…কষ্টগুলো একেবারে নিংড়ে দিলে বুকে। তোমার এলোপাথারি চোখের পানি লেগে গেলো শার্টটায়। আমি সেটাও ধুইনি। তোমার কান্নাগুলো লেগে আছে যে।
তারপর? তারপর এই গ্রে শার্টটা? এটা পরেছিলাম দুজনে বৃষ্টিতে ভেজার দিনটায়। প্রথম বৃষ্টিবিলাস। তোমার আমার সুন্দর মূহুর্তের চাক্ষুষ সাক্ষী। আমি আর পরিনি এটা। এই নির্লজ্জ শার্টটাও সেদিন তোমাকে ভিজতে দেখেছিলো। এটাকে আর বের করিনি। অসভ্য শার্ট।
উহুম! আর ক্লিপ? ক্লিপ… ক্লিপ গুলোও তোমারই। এ পর্যায়ে হেসে ফেললো নিভ্রান। দু’আঙ্গুলে কপাল ঘষে চোখ লুকিয়ে বলল,”এগুলো আমি নিয়ে এসেছিলাম তোমার বাসা থেকেই। ওইযে ছাতা আনতে গিয়েছিলাম যে। তুমি বোধহয় টের পাওনি। পানির গ্লাসে কদমফুল ডুবাচ্ছিলে তখন কি ভেবে যেনো বালিশের পাশ থেকে ক্লিপগুলো পকেটে ঢুকিয়ে নিলাম। চোরের মতো। নিয়ে এসে রেখেদিলাম যত্ন করে। কি যে ভালো লাগছিলো।”

এতটুকু বলে থামলো নিভ্রান। রাত্রি পানিতে পরিপূর্ণ টলমলে চোখে চেয়ে আছে। ছোট্ট চোখে জায়গা করতে না পেরে টপ টপ করে গাল গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো কান্নারা। নিভ্রানের হাসি মিলিয়ে গেলো। গালে হাত রেখে গমগমে গলায় বললো,
—“এই মেয়ে, খবরদার! কাঁদবে না।”

রাত্রি কথা শুনলোনা। শুনলোনা তার টলমলে চোখ। অবাধ্য অশ্রু বিসর্জিত হতে লাগলো। ঠোঁট কাঁপতে লাগলো থরথর করে। ফোঁপানোর শব্দে নরম হয়ে এলো নিভ্রানের কন্ঠ,
—“এজন্যই বলতে চাচ্ছিলামনা। ধুরো, কাঁদেনা। কেনো কাঁদছো? আমি ক্লিপ চুরি করে এনেছি বলে?”

রাত্রি কাঁধে মুখ গুঁজলো। দু’হাতে গলা জড়িয়ে ঝাঁঝালো স্বরে বললো,
—“আপনি ভালোনা। একদম ভালোনা।”

নিভ্রান হাসলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,” তুমি আমার জন্য কি আমি নিজেও জানিনা রাত। শুধু এতটুকু জানি, অকস্মাৎ এক বৃষ্টির দিনে সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে উপহার পাওয়া আমার একমাত্র মেঘরাণী তুমি। পৃথিবীতে রাত না নামলে সব যেমন অসামন্জস্যতায় ছেঁয়ে যাবে। সূর্যের আলোয় ঝলসে যাবে সমস্ত জগৎ। তেমনি আমার জীবনে তুমি নামক রাতটা না নামলে এই প্রেমিক হৃদয় ঝলসে যাবে, জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে যাবে সব। দগ্ধ হবে প্রেম আর তোমার আমি।”

~চলবে~

[রি-চেক হয়নি]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here