#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক পর্ব ৩২

0
614

#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক পর্ব ৩২
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️

গাছের পাতাগুলো শব্দ করে দুলছে। ঝড়ঝড়ে একটা আওয়াজে পরিবেশ শিঁউরে শিঁউরে উঠছে। সাঁই সাঁই ফুলস্পিডে ড্রাইভ করছে নিভ্রান। মঙ্গলবার, তাই রাস্তায় জ্যাম নেই। তাছাড়া সে রং রোডে এসেছে। এদিকে জ্যাম থাকা অনেকটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
রাত্রি বন্ধ জানালার কাঁচে হাত রেখে বললো,”এটা একটু নামিয়ে দিননা।”
নিভ্রান আড়চোখে তাকালো। একহাত বাড়িয়ে সুইচে চাপ দেয়া দেখিয়ে বললো,”এভাবে খুলতে হয়।”
রাত্রি ভ্রু কুঁচকে বললো,”কি করলেন? আবার দেখান।”
নিভ্রান হাসলো। গাড়ির স্পিড কমিয়ে রাত্রির কোলের উপর রাখা হাতটা টেনে নিয়ে সুইচে চাপ দিইয়ে বললো,”এইযে উঠে গেলো।” বলে আবার চাপ দিইয়ে বললো,”আবার দিলে, নেমে গেলো।”
এবার মিষ্টি করে হাসলো রাত্রি। ঠোঁট এলিয়ে বললো,”ওহ, বুঝেছি।”
নিভ্রান আবারো হাসলো। বাতাসের হিংস্র আলিঙ্গনে রাত্রির ওড়না পড়ে গেছে। চুল আছরে পড়ছে আঁখিপল্লবে। ঠোঁটের কোঁণে ঝালমুড়ির হলদেটে ঝোল। নিভ্রান আঙ্গুলের উল্টোপিঠ ঘষে ঝোল মুছিয়ে দিলো। চুল গুলো কানের পিছে গুঁজতে গুঁজতে বললো,”বেশি হাওয়া লাগিওনা। ঘেমে আছো। ঠান্ডা বেঁধে যাবে।”

রাত্রি কথা শুনলোইনা। বরং জানালা দিয়ে মাথাটা আরো একটু বাইরের দিকে বাড়িয়ে দিলো। ঠান্ডা বাতাসে কি সুন্দর কাঁচামাটির ঘ্রান আসছে। পাতা উড়ে উড়ে এদিক ওদিকে ছিঁটকে পড়ছে। হঠাৎই দমকা ধুলো চোখে ঢুকে গেলো। রাত্রি চোখ বুজে মাথা ঢুকাতে ঢুকাতে চেঁচিয়ে উঠলো,”আহ্।”

নিভ্রান তৎক্ষণাৎ গাড়ি থামালো। অস্থির হাতে চোখ পরখ করতে করতে বললো,”দেখি, জ্বলছে?”
রাত্রি চোখ খোলার চেষ্টা করলো। নিভ্রান ড্রয়ার খুলে পানির বোতল বের করলো। রুমাল ভিজিয়ে চোখে চেপে ধরলো। যত্ন করে মুছিয়ে দিলো। রাত্রি তখনো চোখ বন্ধ করে রেখেছে। নিভ্রান আস্তে করে বললো,”খুলোতো, এখনো জ্বলছে? ।”

রাত্রি পিটপিট করলো। নিচু গলায় উওর দিলো,”নাহ্”।

নিভ্রান কাঁচ তুলে দিলো। পানির বোতল লাগিয়ে ড্রয়েরে ঢুকিয়ে বললো,”আমার কথাতো শুনোনা একটাও।”
রাত্রি উওর না দিয়ে বাইরে তাকালো। আকাশ সাদা হয়ে আছে। ধবধবে মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে শূন্য জুড়ে। কি সাদাময়! স্নিগ্ধ! মায়াময়!
মিনমিন করলো সে,
—“ঝড় হবে মনেহয়।”

_________________

বাসায় এসে আর শাওয়ার নেয়নি রাত্রি। শুধু হাত- মুখ ধুয়ে রান্নাবান্না সেরে নিয়েছে। খাওয়া পর্ব শেষ হলো একটু দেরি করেই। রাত তখন এগারোটার বেশি। রাত্রি চুলে হাতখোঁপা করতে করতে ব্যালকনিতে উঁকি দিলো। বৃষ্টিপাগল তখন বৃষ্টি দেখায় ব্যস্ত।
বাইরে গুড়ি গুড়ি বর্ষণ শুরু হয়েছে। বাতাসে ঘর ঠান্ডা। নিভ্রান ব্যালকনি, জানালা সব খুলে রেখেছে। রাত্রি শাড়ি- টাওয়াল ওয়াশরুমে রেখে ব্যালকনিতে উঁকি দিলো একবার। বৃষ্টিপাগলটা ঠায় দাড়িয়ে আছে।
আস্তে করে বললো সে,”আমি গোসলে গেলাম। বিছানা গুছিয়ে দিয়ে যাবো? আপনি ঘুমাবেন এখন?”

নিভ্রান হাল্কা করে ঘাড় ফিরালো। ভাবলেশহীন বললো,”না, যাও। এখন ঘুমাবোনা।”
রাত্রি মাথা নাড়িয়ে চলে আসলো। গোসলের জন্য ঢুকলো।
শরীর ভিজিয়ে ফেলেছে পুরোদমে তখনই বাঁধলো বিরাট বিপত্তি। কারেন্ট চলে গেছে। এক দু’মিনিট অপেক্ষা করলো। আইপিএস আছে তো বাসায়। লাইট জ্বলছেনা কেনো? বদ্ধ জা’গাটায় ঘনালি অন্ধকারে ঝর্ণার পানির ঝিরঝির শব্দে আত্না উড়ে গেলো রাত্রির। দরজার ছিটকিনি হাতরাতে হাতরাতে চেঁচিয়ে উঠলো সে,”এই আপনি কোথায়? এদিকে আসেন।”
ওপাশ থেকে দ্রুত পদচারণ শোনা গেলো। নিভ্রান খটখট করলো,”কি হলো? ঠি ক আছো?”

রাত্রি কাঁদো কাঁদো কন্ঠে উওর দিলো,
—“এখানের লাইট জ্বলছেনা কেনো?”

নিভ্রানের এতক্ষণে খেয়াল হলো ঘরের লাইটও বন্ধ। মাথায় খেলে গেলো, বাসার আইপিএস তো দু’সপ্তাহ আগে নষ্ট হয়েছে। এদিকে লোডশেডিং হয়না তেমন, তাই ঠি ক করার কথা মনেও ছিলোনা। রাত্রির এলোমেলো দরজা হাতানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে। নিভ্রান ফোন বের করে ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে শান্ত স্বরে বললো,”ভয় পায়না, তুমি বেরিয়ে আসো। আমি ফোনের লাইট রেখে দেই ভিতরে।”

রাত্রি প্রায় কেঁদে বললো,”ছিটকিনি খুলতে পারছিনাতো।”

নিভ্রান সাথে সাথেই বললো,
—“রাত, শান্ত হও। আস্তেধীরে চেষ্টা করো। খুলে যাবে।”

শহরে তখন মুষুলধারে বৃষ্টি। কদমফুলেরা ভিজে একাকার। ভিজে একাকার রাত্রিও যখন দরজা খুলে ভয় কাটাতে নিভ্রানের বুকে লেপ্টে গেলো কয়েকটা হৃদস্পন্দন বোধহয় তখনই খোয়া গেলো নিভ্রানের। রাত্রির ভেজা চুল, গায়ের সাথে লাগানো চুপচুপে কামিজ শরীর ভিজিয়ে দিলো। পুরুষালী মনটা ছটফট করে উঠলো আদিম অনুভূতিতে। মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো গাঢ় ইচ্ছে। নিজেকে সামলাতে চট করে ফোনের ফ্ল্যাশলাইটটা নিভিয়ে দিলো সে। বারকয়েক ফাঁকা ঢোক গিলে একটু একটু শ্যাম্পুর ফেনা লাগানো চুলের ভাঁজে হাত ডুবিয়ে বললো,
—“অন্ধকার ভয় পাও?”

রাত্রি অস্ফুট স্বরে সাড়া দিলো,
—“হু।”

—“আচ্ছা, ঠি কাছে। এভাবে থাকলে জ্বর হবে। চুলটা ধুয়ে জামাটা চেন্জ করে নাও। লাইট দিচ্ছি ভেতরে। আই পিএসটা নষ্ট। কারেন্ট আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাবেনা।”

রাত্রি পিঠের কাপড় আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রুদ্ধ স্বরে বললো,” না না, অপেক্ষা করি।”

নিভ্রান শ্বাস ফেললো। আলতো করে ছাড়িয়ে নিয়ে গালে হাত রেখে বললো,”আমি বাইরেই আছি। ভয় পায়না।”
ফোনের লাইটটা সাবান রাখার কেস এর উপর ফিট করে বেরিয়ে এলো সে। দরজাটা বাইরে থেকে টেনে ভিড়িয়ে বললো,
—“আটকানো লাগবেনা, আমি ধরে রাখছি।”
নিজের গা ই তখন ভিজে চুপচুপে। পিঠের শার্ট রাত্রির হাতের শ্যাম্পু মেখে একাকার।
_________________

মধ্যরাতের অন্তিম সময়ে এসে আটকেছে ঘড়ির কাঁটা।
ঝম ঝম বৃষ্টিতে মাতাল করা সুর। নেশা ধরে যায় অন্যরকম। রাত্রি ঘুমাচ্ছে অঘোরে। ভেজা চুল বালিশে ছড়িয়ে শুয়েছিলো। এখন শুকিয়ে গেছে। শ্যাম্পুর মিষ্টি গন্ধ সাথে শরীরের তীব্র মেয়েলি সুঘ্রানটা ঝড় তুললো নিভ্রানের বুকে। কম্পিত হলো প্রতিটি শিরা- উপশিরা। বাইরের ঝড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে চললো মনের ওলোটপালট। বজ্রপাতের সাথে আলোড়িত হলো হৃদস্পন্দন। থেমে থেমে জোরালো শ্বাস ফেলে ঘন্টার পর ঘন্টা চলছে সংযমের যুদ্ধ।
ধারাম করে একটা প্রলংকারী বজ্রপাতে নড়েচড়ে আরো মিশলো রাত্রি। ঝড়ের তান্ডব বাড়িয়ে দিলো বহুগুন। নিভ্রান ফোঁস করে শ্বাস ফেললো। রাত্রিকে বালিশে শুইয়ে দিয়ে মগ্ন চোখে চেয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ। ফ্যানের বাতাসের সাথে ব্যালকনির খোলা দরজা দিয়ে আসা এলোমেলো হিম অনিলেও শরীর ঘেমে গেছে।
নিভ্রান ঝুঁকলো আরো অনেকটা। উত্তাল স্পর্শ ছুঁইয়ে দিলো কপালের মাঝখানে। পাতলা গোলাপি ঠোঁটে বৃদ্ধাঙ্গুল বুলালো বেশ কিছুক্ষণ। অত:পর চট করে উঠে দাড়ালো বিছানা ছেড়ে। এমন উন্মাদনার নিমিত্ত সে জানেনা। এতো তৃষ্ণার উৎপত্তি সে জানেনা। শুধু জানে বুকটা খাঁ খাঁ করছে। অভাবে অভাবে পুড়ছে হৃদয়।
ব্যালকনিতে যেয়ে দাড়ালো সে। বৃষ্টিটা এতো নিষ্ঠুর কেনো? এতো প্রেমময় কেনো হতে হলো তাকে? এতো উন্মাদ কেনো বানাতে হলো? কেনো এতো পিপাসার জন্ম দিতে হলো?
নিভ্রান রেলিংয়ে হাত রেখে দাড়ালো। বৃষ্টির ফোঁটায় চেয়ে রইলো মনভরতি নালিশ নিয়ে।

বজ্রপাতের কাঁপানো শব্দে এবারো ঘুম হাল্কা হলো রাত্রির। তবে এতোক্ষণের মতো বারবার শক্তপোক্ত বুকটায় গুটিয়ে যেতে না পেরে ঘুমটা ভেঙে গেলো তার। বিরক্তি নিয়ে বিছানা হাতরালো সে। নিভ্রান পাশে নেই বুঝতেই চোখের পাতা খুলে গেলো আপনাআপনিই। চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসলো সে। তাকে একা রেখে মানুষটা গেলো কোথায়? ওয়াশরুমে নেই। ভেতরে লাইট নেভানো। দরজার নিচের ফাঁক দিয়ে এখান থেকেই বোঝা যাচ্ছে। গায়ের উপর থেকে ব্ল্যাঙ্কেট সরিয়ে আলুথালু শাড়ি নিয়েই উঠে ফ্লোরে পা রাখলে সে। ফ্লোর টা কি আশ্চর্য ঠান্ডা।পায়ের পাতা মনে হয় জমেই গেলো। রাত্রি এককদম এগিয়ে দৃষ্টি ঘুরাতেই ব্যালকনির সুঠামদেহী অবয়বে চোখ আটকালো। উনি এতরাতে ওখানে কি করছেন? ঘুমালো তো তার সাথেই। ওখানে গেলো কখন?
একপা দু’পা করে আগালো। চোখের পাতায় তখনো ঘুমের রেশ। পুরোপুরি কাটেনি। ব্যালকনির কাছাকাছি যেতেই আবার বিদ্যুৎ চমকালো। আলোতে স্পষ্ট হয়ে উঠলো নিভ্রানের পেটানো পিঠ। গায়ে জামা নেই। শোয়ার আগেই খুলে ঘুমিয়েছিলো।
রাত্রি জড়নো কন্ঠে বললো,
—“এখানে দাড়িয়ে আছেন কেন? ঠাটা পড়ছে দেখছেন না? ভেতরে আসুন।”
নিভ্রান আনমনে বললো,
—“ভেতরে গেলেতো বিদ্যুৎপিষ্ট হয়ে যাচ্ছি রাত।”কথাটা বলে পরক্ষণেই চট করে তাকালো পেছনে। বুকে বৃষ্টির ফোঁটা ছড়িয়ে আছে।

রাত্রি চোখ কুঁচকে এগিয়ে গেলো। পাশাপাশি যেয়ে দাড়ালো। বাহু ধরে বললো,
—“ভিজে যাচ্ছেন। চলুন।”

বজ্রপাত হলো তখনই। রাত্রি আৎকে উঠে বাহুর মধ্য চোখ লুকালো। নিভ্রানের হঠাৎ কি হলো কে জানে। একমূহুর্ত বিলম্ব না করে রাত্রিকে কাছে টেনে নিলো সে। মত্ত ছোঁয়ায় কোমড় খামছে আচমকাই কাঁপন ধরালো অধরে অধরে।

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here