আলো_আধারের_খেলা পর্ব_০৫

0
344

আলো_আধারের_খেলা
পর্ব_০৫
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ

“এটা হলো আমাদের ১৫ লক্ষ টাকার দুলাভাই।

হবু শালির মুখে এই কথা শুনে ভীষণ অবাক হলো রুয়েল।এদিকে রাইসার আরেক নিকটতম আত্নীয়ও এসে বললো,কই সে ১৫ লক্ষ টাকার জামাই?রুয়েল এবার আর চুপ করে থাকলো না।সে ঊর্মিকে বললো,ভাবী সবাই এভাবে ১৫ লক্ষ টাকার কথা বলছে কেনো?আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।ঊর্মি রুয়েলের কথা এড়িয়ে গিয়ে বললো,দূর!কি শুনেছো না শুনেছো!চুপ করে বসো তো।

এদিকে পাশের রুম থেকে রুবেলের উচ্চ কন্ঠ শোনা গেলো।সে চিৎকার করে বললো, ১০ লক্ষ টাকা দেনমোহরে সে কখনোই তার ভাই এর বিয়ে দেবে না।তখন রাইসার চাচা বললো,আমরা কি কম দিচ্ছি নাকি? ১৫ লক্ষ টাকা নগদ, ৫ লক্ষ টাকার ফার্নিচার আবার সাথে ৫ ভরি স্বর্ণও দিচ্ছি।রুবেল সেই কথা শুনে ভীষণ রেগে গেলো।সে এক কথায় বলে দিলো এ বিয়ে কখনোই হবে না।এই বলে রুবেল রাগ করে রুয়েলের হাত ধরে বের হয়ে যেতে ধরলো।
তখন রাইসার বাবা তার ভাইকে বুঝিয়ে বললো যে ভাই জিদ করো না।ওনারা দেনমোহর যেটা করতে চাচ্ছে ওটাতেই রাজি হয়ে যাও।
বেচারা রুয়েল বোকার মতো হা করে থাকলো। সে কারো কথা কিছুই বুঝতে পারলো না।
কিন্তু রুয়েল এবার আর চুপ করে থাকলো না।সে তার ভাইকে বললো,ভাইয়া হয়েছে টা কি?সবাই এভাবে রেগে আছে কেনো?আর আপনিই বা এরকম রিয়্যাক্ট করছেন কেনো?
রুবেল সেই কথা শুনে রুয়েলকে একটু সরে নিয়ে গিয়ে বললো, রাইসার ফ্যামিলি ১০ লক্ষ টাকা দেনমোহর করতে বলছে।সেটাও আবার নগদ পরিশোধ করতে হবে।কিন্তু আমি বলেছি ৫ লক্ষ টাকার কথা।
রুবেল সেই কথা শুনে নিজেও ভীষণ অবাক হলো।সে জোরে করে বললো,মগের মুল্লুক পাইছে নাকি?ডিমান্ড ছাড়া বিয়ে করছি তার আবার কিসের এতো দেনমোহর?আর আমি এতো বেশি দেনমোহরে কিছুতেই বিয়ে করবো না।যেটা আমি নগদ পরিশোধ করতে পারবো সেটাই হবে আমার বিয়ের দেনমোহর।

রাইসার ভাই রাহাত রুয়েলের সব কথা শুনে ফেলেছে।সে রুয়েলের কথা শুনে একদম অবাক হয়ে গেলো।রুয়েল তো ১৫ লক্ষ টাকা ডিমান্ডের কথা জানেই না।তাহলে এটা রুয়েলের ভাই রুবেলের চক্রান্ত।রাহাত মনে মনে ঠিক করলো ডিমান্ডের কথাটা রুয়েলকে সে বলে দিবে।তাহলে হয়তো রুয়েল তার বোনকে কোনো ডিমান্ড ছাড়াই বিয়ে করবে।কারণ রুয়েল তো এই মাত্র বললো,সে বিনা ডিমান্ডে বিয়ে করবে।আর যে দেনমোহর দেবে সেটা একদম নগদ পরিশোধ করবে।

এদিকে রাইসার বাবা রুবেলের কাছে তার ভাই এর হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিলো।আর বললো আপনারা দেনমোহর যেটা করতে যান ওটাই হবে।রুবেল রাইসার বাবার কথা শুনে কিছুটা শান্ত হলো।সেজন্য রুবেল এনগেজমেন্ট পার্টি শুরু করতে বললো।এদিকে রাহাত চুপচাপ রুয়েলের পাশে এসে বসলো, আর বললো,দুলাভাই আপনি কি জানেন আপনার ভাই ১৫ লক্ষ টাকা নগদ নিচ্ছে।
রুয়েল রাহাতের কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। রাহাত তখন বললো, শুধু তাই না,৫ লক্ষ টাকার ফার্নিচার সাথে আবার ৫ লক্ষ টাকার সোনার গহনা।
রুয়েল রাহাতের কথা শুনে মনে হয় আকাশ থেকে পড়ে গেলো।সে আর এক সেকেন্ড দেরি না করে তার ভাই এর কাছে চলে গেলো।আর সবার সামনেই বললো,ভাইয়া এসব কি শুনছি?আপনি নাকি যৌতুক হিসেবে ১৫ লক্ষ টাকা নিচ্ছেন?সাথে আবার ১০ লক্ষ টাকার ফার্নিচার আর গহনা?
রুবেল রুয়েলের কথা শুনে তাড়াতাড়ি করে তার কাছে চলে এলো।আর বললো,কি বলছিস এসব?কার থেকে শুনেছিস?
রুয়েল রাগান্বিত হয়ে বললো,যার থেকেই শুনি না কেনো কথা টা সত্য না মিথ্যা।
রুবেল সাথে সাথে বলে দিলো একদম মিথ্যা কথা।তুই চুপচাপ বসে থাক।কিছুক্ষনের মধ্যেই তোদের রেজিস্ট্রি হবে।
রুয়েল তখন রাহাত কে টেনে এনে বললো,রাহাত তুমি তখন আমাকে যা যা বলেছো সেটা সবার সামনে বলো দেখি?
রাহাত বাচ্চা মানুষ। এতো কিছু বোঝে না।বড়দের গোপনীয় কথা সে ফাঁস করে দিলো।রুবেল রাহাতের মুখে যৌতুকের কথা শোনার সাথে সাথে একদম স্তব্ধ হয়ে গেলো।সে ভেবেছে রুয়েল কখনো জানতেই পারবে না। আর বিয়ের পর জানলে কিছু একটা অজুহাত দেখিয়ে কেটে দিবে।

রুয়েল কে চুপ থাকা দেখে রুবেল বললো, আমার কি দোষ? ওনারা নিজেরাই এসব দিতে চেয়েছে।আমি সেজন্য কিছুই বলি নি।
রুয়েল তখন বললো, ভাইয়া এইভাবে আমাকে ছোট করতে পারলেন?
ওনারা দিতে চাইলো আর আপনি সেটা নিতে রাজি হলেন?ছিঃ ভাইয়া।আমি কখনোই ভাবি নি আপনি এমন করবেন।অন্ধের মতো বিশ্বাস করতাম আপনাকে।আর তার প্রতিদান এইভাবে দিলেন?আমাদের মানসম্মান এইভাবে কেনো নষ্ট করলেন?
রুবেল একদম নিচ মুখ হয়ে থাকলো।এইভাবে ধরা পড়ে যাবে সে সেটা স্বপ্নেও ভাবে নি।এদিকে ঊর্মি রুয়েলকে এসে বোঝাতে লাগলো।যা হবার হয়ে গেছে।তোর ভাই বুঝতে পারে নি।রুয়েল একটা কথাও বললো না।সে সবাইকে রেখে চলে আসলো।

এদিকে রাইসার ফ্যামিলির সবাই রুয়েলের পিছু নিলো।তাকে যেতে বারণ করলো।মেয়েটার কি হবে এখন? এই মেয়েকে কে বিয়ে করবে নানা রকম কথা বলতে লাগলো।রুয়েল কারো কথাই শুনলো না।তার মন টা এতো টাই ভেংগে গেলো যে তার কানে আজ কারো কথাই ঢুকলো না।তার শুধু বার বার এটাই মনে হলো যে তার ভাই কেনো তাকে না জানিয়ে এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নিলো?তাদের কি টাকা পয়সার অভাব নাকি যে মেয়েপক্ষদের কাছ থেকে টাকা নিতে হবে।
রুয়েল রাগ করে সোজা তার এক বন্ধুর বাসায় চলে গেলো।সে আর তাদের বাসায় আসলো না।

এদিকে রুবেল আর ঊর্মি রুয়েলকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেলো।তবুও তার খোঁজ পেলো না।অবশেষে রুবেল নিজেও জিদ ধরলো আর খুঁজবে না সে রুয়েলকে।যেখানে মন চায় চলে যাক।সে কি এমন অপরাধ করেছে?ওর ভালোর জন্যই তো টাকাগুলো নিয়েছিলো।১৫ লক্ষ টাকা দিয়ে এই ছয় মাস দিব্যি কেটে যেতো তার।এই ছয় মাস তো রুয়েল দেশেই থাকবে।

যৌতুক নেওয়ার আউডিয়া টা ঊর্মির ছিলো।সে রুবেল কে বলেছে এমন ছেলের সাথে যে কেউ বিয়ে দিতে চাইবে, আর আমরা যেটা দাবি করবো সেটাই দিবে কনেপক্ষ।তাছাড়া রুয়েল যে ছয়মাস দেশে থাকবে সেই ছয়মাস তো আর বিদেশ থেকে কোনো টাকা আসবে না।সেজন্য রুয়েল যেখানেই বিয়ে করুক নগদ টাকা দিলেই আমরা রাজি হবো বিয়েতে।সেজন্য তারা জহিরের মেয়ে জান্নাতের কথা শুনতেই পারতো না।কারণ জহির এতো বেশি বড়লোক না।সামান্য একটা মুদির দোকান আছে তার।তার উপর জান্নাত যেভাবে চলাফেরা করে যেটা তাদের পরিবারের কেউই চলে না।সেজন্য ঊর্মির জন্য জান্নাতের সাথে রুয়েলের বিয়ে টা হয় নি।

এক সপ্তাহ পর রুবেল আর ঊর্মি খোঁজ পেলো রুয়েলের।রুয়েল তার কোনো এক ফ্রেন্ডের বাসায় আছে।তখন ঊর্মি আবার রুবেল কে বুদ্ধি দিলো যে রুয়েল যদি রাগ করে আর বিদেশ না যায় তখন আমরা মাসে মাসে টাকা পাবো কোথায়?বা এমনো তো হতে পারে সে বিদেশ গিয়ে আর আমাদের টাকা পাঠালো না।সেজন্য তুমি রুবেলের কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নাও।আর বলো তোমার এটা ভুল হয়ে গেছে।আর কখনোই এই ভুল হবে না তোমার।
রুবেল ঊর্মির কথা শুনে রুয়েলের বন্ধুর বাসায় চলে গেলো।সাথে তাদের মাকেও নিলো।আর যাই করুক মাকে দেখলে রুয়েল আর রাগ করে থাকতে পারবে না।

রুবেল রুয়েলকে দেখামাত্র তার পায়ে পড়তে ধরলো।রুয়েল তা দেখে বললো,ভাইয়া কি করছেন এসব?আপনি আমার গুরুজন।এভাবে পায়ে পড়ছেন কেনো?
রুবেল তখন বললো,আমার ভুল হয়ে গেছে ভাই।আমি বুঝতে পারি নি।আর কখনোই এই ভুল হবে না।
রুয়েল একটা কথাও বললো না।কারণ তার মন টা এখনো ঠিক হয় নাই।তখন রুয়েলের মা রুয়েলকে জড়িয়ে ধরে বললো,বাবা মায়ের কথা একবারো ভাবলি না।এইভাবে রাগ করে থাকতে পারলি?আমি কি করেছি?
–না মা কেউ কিছুই করে নি।আর আমি কারো উপর রেগেও নেই।
রুবেল তখন রুয়েলের হাত ধরে বললো ভাই বাসায় চল।তোকে না দেখতে পেয়ে সবাই ভীষণ টেনশনের মধ্যে আছে। হিয়া আর হৃদয় তোকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছে।
রুয়েলের মাও রুয়েলের হাত ধরে সেম কথা বললো,
রুবেল তোর বড় ভাই হয়।তোর বাবা মারা যাওয়ার পর এই ভাই ই সবার দেখাশোনা করেছে।সেই বাবার মতো ভাই না বুঝে একটা ভুল করে ফেলেছে।সে তো ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছেই।
রুয়েল আর রাগ করে থাকতে পারলো না।সে সবার সাথে বাড়ি চলে এলো।তবে রুয়েল আর আগের মতো হাসিখুশি থাকতে পারলো না।তার শুধু বার বার ঐ টাকার কথায় মনে হতে লাগলো।তার ভাই কেনো করলো এই কাজ?

এদিকে রাইসার বাবা বার বার রুবেলকে ফোন দিতে লাগলো।আর বলতে লাগলো,
কি হলো আপনাদের?কোনো খবরই তো দিচ্ছেন না।রুবেল আর কি বলবে?সে রুয়েলকে বিয়ে ব্যাপারে সাহস করে আর কিছু বলতে পারলো না।

রুয়েল আগের মতো আর তার ভাই এর সাথে ঠিক করে কথা বলে না।তখন ঊর্মি রুবেলকে বললো,আমরা যে ভুল করেছি রুয়েল সেটা ক্ষমা করতেই পারছে না।ওর মন টা ভীষণ ভেংগে গেছে।রুয়েল আমাদের ভুল বুঝছে।সেজন্য আমার মনে হয় কি জান্নাতের সাথে ওর বিয়ে ঠিক করলে ও মনে হয় ঠিক হয়ে যাবে।আর আমাদের প্রতি ভুলটাও ওর দূর হবে।
রুবেল ঊর্মির কথা শুনে নাক ছিটকালো।আর বললো,পাগল হইছো তুমি?না এটা সম্ভব না।মেয়েটাকে তো ভালো লাগেই নি, তার উপর জহিরের সাথে আমাদের আত্নীয়তা করা মানানসই হবে না।
ঊর্মি সেই কথা শুনে বললো, ভালো করে বোঝো একবার।যেখানেই রুয়েল বিয়ে করুক না কেনো ও কিন্তু যৌতুক নিবে না।সেজন্য টাকার আশা ছেড়ে দাও।এখন শুধু চিন্তা করো বিয়ের পরও যেনো রুয়েল চেঞ্জ না হয়?
–মানে কি বলছো?
ঊর্মি তখন বললো, আধুনিক স্টাইলিশ মেয়ে ঘরে আনলে রুয়েলের সব টাকা পয়সা সে নিজের আয়ত্তে নেবে।তখন আর আমাদের দেবে না।কিন্তু জান্নাতের মতো বোকাসোকা কোনো মেয়েকে ঘরে আনলে রুয়েল বিয়ের পরও আমাদেরকেই টাকা পাঠাবে।
রুবেল সেই কথা শুনে বললো, তুমি তো ঠিক বলেছো।এভাবে তো ভেবে দেখি নি কখনো।জান্নাতকে আমরা যেভাবে চলতে বলবো সে সেভাবেই চলবে।আর রুয়েল তো আমাদের ছাড়া কিছুই বোঝে না।

জান্নাতকে বোকাসোকা আর সহজ সরল মেয়ে ভেবে ঊর্মি আর রুবেল ঠিক করলো জান্নাতকেই তারা রুয়েলের বউ করে ঘরে তুলে আনবে।সেজন্য রুয়েলের গ্রামে থাকা সেই চাচার হাতে আবার প্রস্তাব দিলো বিয়ের।
কিন্তু এবার জহির আর রাজি হলো না।সে উলটো রাগ দেখালো।তারও একটা ইমেজ আছে।বার বার এভাবে তারা ফাজলামি করতে পারে না।
রুয়েলের চাচা তখন বললো,এবার এক্কেবারে পাক্কা কথা দিলাম জহির।শুধু আমি না রুবেল আর ঊর্মি নিজে আসবে তোর কাছে।

#চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here