মেঘে_ঢাকা_চাঁদ (পর্ব ১০)

0
469

#মেঘে_ঢাকা_চাঁদ (পর্ব ১০)
সায়লা সুলতানা লাকী

“খুনের কথা শুনে অবাক হচ্ছিস? শুনতে চাস সেই কথা? হজম করতে পারবিতো? মনের মধ্যে চাপা দিয়ে রাখছি এতটা বছর ধরে। তুষের আগুনের মতো জ্বলে জ্বলে কয়লা করে ফেলছে মনটাকে। আর বলছিস এই মন দিয়ে তোকে দয়া করতে? তোর লজ্জা করে না আমার সামনে এসে দাঁড়াতে? নাকি বাড়ি থেকে পালানোর সময় তোর সব লজ্জা আব্বা আম্মাকেই দিয়ে গেছিস? ” বড় তাচ্ছিল্যের সাথে কথাগুলো বলে থামল রেহেনা বেগম।

“আপা আমিতো কিছুই জানি না। তোমরাতো আমাকে কিছু জানাও নাই। আমি ভেবেছি আমি বাসায় থাকলে আব্বা আমাকে বিয়ে দিয়ে দিবে। কয়েকদিন যাবৎ খুব ঘন ঘন ঘটক চাচা আসছিল বাসায়। সেই ভয়ে আমি সংকিত ছিলাম, তাই দিকপাশ চিন্তা না করে চলে গিয়েছিলাম লিখনের কাছে। আব্বা বা বড় ভাইদের মুখোমুখি দাঁড়াবার শক্তি বা সাহস কোনটাই ছিলো না অন্য দিকে লিখনের প্রতি ছিল আমার অগাধ বিশ্বাস । ও আমাকে আগলে রাখবে এমনটা আমি জানতাম আর সেই বিশ্বাসকে পুঁজি করে আর কোন রিস্ক না নিয়ে ওর কাছে ছুটে গিয়েছিলাম। আমি যাওয়ার পর কি ঘটেছে তার কিছুই আমি জানতাম না। পরে আব্বার স্ট্রোকের কথা আমার বান্ধবীর কাছে শুনেছি। বহুবার যোগাযোগ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু আম্মা আর যোগাযোগ করতে দেয়নি, এক কথাই বলেছিল আমি নাকি মরে গেছি তাদের জন্য । আমার শাশুড়ি বলেছিল এটা ক্ষনিকের রাগ, সময় গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কই আমার জীবনেতো এখনও কিছুই ঠিক হলো না।” বলতে বলতে রেশমা কেঁদে ফেলল।

“মাত্র মাত্র টের পেয়েছি আমি আবার মা হব। আনন্দ আর ভয় দুইটাই মনের মধ্যে বাসা বাঁধতে লাগল। বাসায় শাশুড়ি নাই তিনি গেছেন তার ছোট মেয়ের বাসায় বেড়াতে রাজশাহীতে। বাসায় তখন আমি একা দুই মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি রীতিমতো। আম্মাকে জানালাম সব, বললাম আমার কাছে এসে থাকতে। আম্মাও জানালো সব কিছু গুছিয়ে এসে থাকবেন আমার কাছে কয়দিন। আর তাতেই মনে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। হুমার বাবাকে খবরটা জানাতেই তার চোখেমুখে আনন্দ খেলে গেল। ও যে কি পরিমান খুশি হল তা বোঝানো মুসকিল। রাতে বাসায় ফেরার সময় আমার জন্য গোলাপি রঙের একটা শাড়ি নিয়া এসেছিল। আমি শুধু তার আনন্দ দেখি চোখ মেলে। হুমার বাবা বলল, –রেহেনা দেখো এবার তোমার একটা ছেলে হবে। ওরা দুই বোন দুইভাই থাকবে। দুই রুমে দুইজন দুইজন করে থাকবে। নতুন যে দুই সেঙ্গেল বেড বের হইছে ওগুলাই দুইটা দুই রুমে এনে দিব। তোমার আর টেনশন থাকবে না ছেলে একা কীভাবে থাকবে তা নিয়ে ।
আমি তার কথা শুধু মন দিয়ে শুনি কোন উত্তর দেই না, আমার শুনতে ভালো লাগে। শাশুড়িকে জানানোর জন্য বললাম। তখন হুমার বাবা বলল — থাক মা বেড়ায়ে আসুক তারপরই জানবে। এখন ওইখানে জানানোর দরকার নাই। কে কি মন্তব্য করে বসে তারতো কোন ঠিক ঠিকানা নাই।
তার কথায় আর শাশুড়িকে তখন জানানো হলো না। এদিকে আমার শরীর খারাপ হতে শুরু করল, বমি করতে করতে কাহিল অবস্থা আমার, তার উপর মাথা ঘুরায় শুধু । তিনতিনটা বাচ্চাকে নিয়ে বেহাল এক অবস্থায় পড়লাম। কোন উপায় না পেয়ে আবার আম্মাকে ফোন দিলাম যাতে আম্মা দ্রুত চলে আসে আমার কাছে আর নয়তো তোকে যেন পাঠায় কয়দিনের জন্য । ও আল্লাহ, আমি ফোন দিতেই দেখি আম্মা কাঁদতেছে। কারন জিজ্ঞেস করতেই জানালো তুই বাসায় নাই, বিকেলে বের হইছিস আর রাত নয়টা বাজে তখনও ফিরিস নাই। সে কি এক ভয়ংকর অবস্থা বাসার, তিন ভাই পাগলের মতো তিনদিকে ছুটাছুটি করছে তোকে খোঁজার জন্য। তোর সব বান্ধবীদের বাসায় ফোনও নাই তাই যেয়ে যেয়ে খোঁজ করতে হচ্ছে। এদিকে আব্বা বাসায় প্রচন্ড রাগারাগি করতেছে আম্মার সাথে। আব্বার সব রাগ তখন আম্মার উপর, আম্মা কোনোভাবেই তা সামলাতে পারতাছে না। এর ভীড়ে আমি আর আমার কথা বলতে পারলাম না। ফোন কেটে দিয়ে নিজেও বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিতে চেষ্টা করলাম কোথায় আছিস তুই তা জানার জন্য। হুমার বাবাও বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ খবর নিতে শুরু করল, থানা হাসপাতাল কোন কিছুই বাদ দিলো না। আম্মাকে কি স্বান্তনা দিব আমি নিজেও তখন শুধু কাঁদতেছি বোনের চিন্তায়। কি হল কোনো দুর্ঘটনা ঘটল কি না ওর সাথে এসব ভেবে ভেবে। রাতে আর ঘুম হল না কারউই। এভাবে কাটল পরেরদিন সারাবেলা। এর পর তোর ফোন পায় মা। তোর সাথে কথা বলে ফোন রাখতেই আম্মা ধপাস শব্দ শুনে পিছন ফিরে দেখে আব্বা সেন্সলেস হয়ে ফ্লোরে পড়ে আছে। বাসার সবাই ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেল সাথে সাথে। আমি খবর পেয়ে ওই রাতেই ওই অবস্থায় চলে গেলাম হাসপাতালে। টানা দুইদিন চলল দৌড়াদৌড়ি, প্রচন্ড এক মানসিক চাপে কাটল প্রতিটা মুহুর্ত ।ডাক্তার তাৎক্ষণিকভাবে পরীক্ষা নিরিক্ষা করে রিপোর্ট দিলেন। জানলাম আব্বা ব্রেন স্ট্রোক করেছিলেন। জানে বেঁচে গেলেন ঠিকই কিন্তু বাকি জীবনটা যে কয়দিন পৃথিবীতে ছিলেন থাকলেন অসার হয়ে। ইশারায় চোখ নাড়িয়ে এটা সেটা বোঝাতেন। শেষের দিকে ভাঙা ভাঙা শব্দে কিছু বলতে চাইতেন আর ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকতেন দুচেখের কোন বেয়ে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ত শুধু । এতো গেলো আব্বার পরিনতি। কিন্তু আমার? আমার অবস্থা কি হল—-” বলে থেমে গেলেন রেহেনা বেগম। জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লেন।গলা ধরে এল তার, মনে হল কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে খুব, তারপরও আবার শুরু করলেন—

টানা সাতদিন বাসা হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি কখনও খাওয়া না খাওয়া, নির্ঘুম রাতগুলো বারান্দায় পার করতে করতেই যাচ্ছিল সময়টা। একদিন হঠাৎ ফিল করলাম প্রচন্ড তলপেটে ব্যথা। ব্যথা তীব্র আকার ধারন করলে আর সহ্য করতে পারি না, ধপাস করে বসে পড়ি হাসপাতালের বারান্দায়। আমার চারপাশ হেলেদুলে উঠল বলে মনে হল। চোখেমুখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। আর তখনই টের পেলাম রক্তের স্রোত।দুই পা বেয়ে তা মেঝে রাঙিয়ে দিল মুহূর্তের মধ্যে । সিস্টাররা ধরাধরি করে আমাকে বেডে উঠিয়ে ডাক্তারকে ডেকে আনল। কিন্তু তাতে কি আর শেষ রক্ষা হয়? হলো না শেষ রক্ষা। হুমার বাবার সব আনন্দ ওই জমাট বাঁধা রক্তের স্রোতের সাথে বয়ে গেল চোখের সামনে দিয়ে, আর আমি কিছুই করতে পারলাম না। হাসপাতালে সেদিন একটা খুন হল। বলতে পারিস সেই খুনের খুনি কে? ওই খুনটা কি হওয়ার কথা ছিলো? ডাক্তার যখন বললেন আমার উচিৎ ছিল মানসিক চাপ না নেওয়ার, ফুল বেড রেস্টের দরকার ছিল তখন আমার। চার নাম্বার বাচ্চা ছিল এটা ,সেখানে আমি কেন এতটা কেয়ারলেস হয়েছিলাম এই বিষয়ে। হুমার বাবাকে কোনভাবেই শান্ত করা যাচ্ছিল না ডাক্তারের কথাগুলো শুনার পর থেকে। ওর রাগ সব এসে পড়ল আমার উপর। আমি কেন হাসপাতালে আসলাম? কেন বাসায় রেস্টে থাকলাম না? কেন এতটা মানসিক চাপ নিলাম?
আমি কাকে বোঝাব! আমার অতি আদরের বোনটা জানা নাই শোনা নাই কার সাথে পালিয়ে চলে গেছে তা জানিনা ভালো মতো। ছেলেটা কি আদৌ ওকে বিয়ে করেছে নাকি শুধু মাত্র ভোগ করে ছুড়ে ফেলবে। কি হবে বোনটার ভবিষ্যৎ? আমার আব্বা অসার হয়ে পড়ে আছে হাসপাতালে। কি হচ্ছে তার সাথে তাও অজানা পুরো দুদিন পরে আব্বার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল তাও গিয়ে পেলাম এক অসার দেহ। কোন কথা নাই কোন ধমক নাই কোন হাসি নাই এ যেন এক জিন্দা লাশ। সামনে দাঁড়িয়ে আমরা কাঁদছি কিন্তু আব্বা হাত তুলে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারছে না। এই কষ্ট কীভাবে সহ্য করি আমি? আমিতো মানুষ, কোন ফেরেস্তা না। এই কথা আমি আজও হুমার বাবাকে বোঝাতে পারলাম না। তার চোখে আমিই দোষি। আমি খুনিকে খুন করতে সাহায্য করেছি। আমিও অপরাধী। হুমার বাবাকে আম্মা কীভাবে মেনেজ করেছিল সেদিন তা আমি জানি না। আমি শুধু জানি আমি আমার আদর ভালোবাসা আমার সুখ আমার শান্তি সব সব হারিয়ে শূন্য হাতে বাসায় ফিরলাম। আমার সব থাকতেও শূন্য হয়ে গেলাম। কেন এমন হলো বলতো তুই?
এক বিধ্বস্ত মন নিয়ে অসুস্থ্য শরীর নিয়ে বাসায় কোনরকমে টিকে আছি। এর মধ্যে আসল আমার শাশুড়ি। ওরে আল্লাহ এ যেনো আরেক আযাব, কাটা গায়ে নুনের ছিটা পড়তে শুরু করল উঠতে বসতে খোঁটা আর খোঁটায়। দগ্ধ মনটা আরও দগ্ধ হতে শুরু করল। এক একটা সময় মনে হতো তোকে পেলে আমি নিজেই খুন করব। আমাদের আম্মা, যাকে মানুষ এক ডাকে বলতো রত্নগর্ভা মা। সেই আম্মা রাতারাতি এক ব্যর্থ মা হয়ে গেলেন। যে পারে সেও লজ্জা দিয়ে কথা বলে যে পারে না সেও সুযেগটা ছাড়ে না। আমার বাসায় আসা ছেড়ে দিল আম্মা, আমার শাশুড়ির অপমানের জ্বালা সইতে না পেরে।
আচ্ছা তুইতো এখন সব বুঝিস, কি বুঝিস না? বলতো এসব কেন ঘটেছিলো আমার সাথে? আমারতো এমন হওয়ার কথা ছিলো না। আমার বাচ্চাটার এই পরিনতি হওয়ার কথাতো ছিলো না? ছিলো কি? তুই ওই কাজ না করলে কি এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো? কেন করছিলি তুই এমন? শুধু নিজেরটাই বুঝলি আমরা তোর কেউ ছিলাম না? আমাদের কথা একবারও ভাবলি না কেন? কেন আমার বাচ্চাটাকে পৃথিবীতে আসার আগেই খুন করলি? এখন যদি আমি রৌশনকে খুন করে তোকে বলি আমাকে দয়া করে মাফ করে দে, পারবি? পারবি আমাকে ক্ষমা করতে? দয়া করতে?”

রেশমা এতক্ষণ মুখ চেপে কাঁদতে ছিল এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। “আপা, আপাগো আমিতো এসব কিছুই জানতাম না। আমিতো এমন কিছু হবে তা ভাবিনি। আপা আমি সত্যি সত্যিই অপরাধী, এই অপরাধ ক্ষমার যোগ্য না। আপা তুমি আমাকে কোনদিনও ক্ষমা করো না।”

“তুই চাইলেও আমি করতে পারবো না। তোর ছায়া দেখলেই আমার এই পুরোনো কষ্টটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে আমি সহ্য করতে পারি না। আমি অত উদার না।
দয়া, দয়া সবাই করতে পারে না। তুইতো দয়া করে সেদিন নিজের ভালোবাসাকে ছাড়িসনি কারউ কথা ভেবে। তবে কেন অন্যের কাছে দয়া চাস? তোর জন্য আমার কোন দয়া নাই, একজন খুনির জন্য আমার কাছে কোন দয়া নাই। তুই হুমার বাবার স্বপ্নটাকে খুন করেছিস, স্বামীর কাছে আমার আদর ভালোবাসা গ্রহণযোগ্যতাকে খুন করেছিস, তুই আমার সুন্দর মনটাকে খুন করেছিস —”

“বড়পা, দুলাভাই আসছেন খেতে। বড়ভাবি খাবার দিচ্ছেন। আপনাকে ডাকে।” ছোটভাবির ডাকে রেহেনা বেগম থেমে যায়। রেশমার সাথে আর কোন কথা না বলে পা বাড়ায় ডাইনিংএর দিকে। ছোটভাবিও চলে রেহেনার পিছে পিছে শুধু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রেশমা। আজ আর তার মুখে কোন কথা নাই। সেদিনকার কথা খুব মনে পড়তে লাগল। তখন পুরোপুরি লিখনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল। লিখন ছাড়া আর সব ছিল মিথ্যা। লিখনের জন্য এভাবে বাড়ি ছাড়ার প্রতিফল যে এত কিছু হবে তাতো স্বপ্নেও আসেনি। নিজের আপনজনদের কত কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে ওর ভুলের মাসুল সরুপ। কেনোজানি আজ নিজের সাথেই নিজে চোখ মেলাতে লজ্জা করছে, বড্ড বেশি লজ্জা করছে। কি করবে, কার কাছে গিয়ে মনের কষ্ট দূর করবে? ওর যে বুকটা জ্যাম বেঁধে গেল হঠাৎ করে। বেঁচে থাকতে ওর আব্বুর সামনে এসেছিল কয়েকবার কিন্তু তিনি প্রতিবারই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। আজ যা শুনল ওর আম্মার কথা তাতে আরও লজ্জা বেড়ে গেল। মমতাময়ী মা না জানি কত কতবার লাঞ্ছিত হয়েছেন শুধু মাত্র তার ছোট মেয়ের কর্মের জন্য। ” এসব নিয়ে আর ভাবতে পারছে না রেশমা নিজের চুল টেনে বসে পড়ল ঘরের এক কোনায়। ইচ্ছে করছে জোরে গলা ছেড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে, কিন্তু এখানে তাও সম্ভব না। বড় আশা করে এসেছিল মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে। অথচ এখনতো মনে হচ্ছে ও ওর নিজের সুখও সব হারিয়ে ফেলল। খুনির তোকমা গায়ে লাগিয়ে আর যাই হোক কখনও সুখে থাকা যায় না। এই কষ্ট কই রাখবে রেশমা তাই ভাবতে লাগল।

অনেক রাতে রেশমার মা আসলেন ঘুমাতে রুমে। মেঝের এক কোনে রেশমাকে বসে থাকতে দেখে চমকে গেলেন
“কিরে তুই এখানে এভাবে বসে আছিস কেন? খেয়েছিস?”

“খিদে নেই আম্মা, বাচ্চারা খেয়েছে?”

“হুমম, ওরা সব ছাদেই বসে খেয়ে নিয়েছে। আর রুশুতো ওর খালুজির সাথেই খেলো। তোর ছেলেটাকে বড় জামাই খুব আদর করে। কতগুলো চকলেট এনে দিয়েছে। আমাকে এনে দেখালো রুশু, খুব খুশি হয়েছে ও।”

“আম্মা তুমি কি আমার উপর অনেক রাগ? আমার জন্য তোমাকে জীবনে অনেক অপমান সহ্য করতে হয়েছে। বিশ্বাস করো আম্মা আমি একটুও আন্দাজ করতে পারিনি আমি চলে গেলে তোমাদের উপর এমন ঝড় নামবে। আমি যদি জানতাম তবে এমন কাজ কোনোদিনও করতাম না।” বলতে বলতে আবারও কেঁদে উঠল রেশমা।

“যা গেছে তাতো আর ফিরে পাওয়া যাবে না। শুধু শুধু এসব আর মনে করে কী লাভ? বাদ দে এসব।”

“কীভাবে বাদ দেই আম্মা? আমি যে আম্মা বড় আপার অনেক বড় ক্ষতি করে ফেলেছি। আমিতো জানতামই না এত কিছু যে ঘটে গেছে আমি যাওয়ার পর।”

“শুধু কি রেহেনা? অপমানবোধ নিয়ে বেঁচে ছিল বাকিটা সময় তোর আব্বা। গ্রামকে এত ভালোবাসতো, অথচ শেষ সময়টাতে আসতে পারেনি। প্রথম প্রথম বিছানায় প্রসাব পায়খানা করেই কেদে উঠতো লজ্জায় আর কষ্টে। কত বলতাম আপনিতো আর ইচ্ছে করে এমন করছেন না অসুস্থ বিধায় করছেন। কেন শুধু শুধু লজ্জা পাচ্ছেন?
আমার কথা শুনেও কাঁদা থামাতে পারতো না। মুখে কথা ছিলো না। আ,আও করে কিছু বলতে চাইত।মনে হত তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে কিছু বলার জন্য –”

“আম্মা থামো, তুমি থামো। আমি আর নিতে পারছি না। বলে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল রেশমা। ওর মা তখন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগলেন
-আমরা মানুষ তার কর্মের প্রতিফল যদি আগেভাগে দেখতে পারতাম তবেতো জীবন এক রেখাতেই চলত। দেখতে পারি না বলেই ক্ষনে ক্ষনে মোড় তৈরি হয়। এর মধ্যেই এগিয়ে যেতে হয়। জীবন এক মৃত্যু ছাড়া আর থামতে জানে না। বাবা মা যখন সন্তান লালন পালন করে তখন তাদের চোখ জুড়ে থাকে নানান স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন ভেঙে গেলে কষ্ট হয় সেই কষ্ট কেউ মেনে নিতে পারে কেউ পারে না। তোর আব্বা মানতে পারেনি। সবই ভাগ্য, ভাগ্যের বেশি কেউ দেয় না। তুই হয়তো না বুঝেই ভুল করেছিস কিন্তু তোর আব্বা তা মানতে পারেনি। এখন আর এসব কথা তুলে কাঁদিস না। এগুলা করে কি আর তোর আব্বাকে পাবো, নাকি রেহেনা আবার আগের জায়গাটা ফিরে পাবে। এখন সব কিছু ভাগ্য বলেই মেনে নিয়েছি সবাই। ”

রেশমা কিছু বলতে চাইলো কিন্তু ওর মা আর কথা বলতে দিলেন না মেয়ের চোখ মুছিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন বললেন ঘুমাতে। একটা সময় ও কাঁদতে কাঁদতে ঠিকই ঘুমিয়ে গেল। কখন যে পাশে রৌশন এসে শুয়েছে তা টেরও পেলো না।

ফযরের নামাজ পড়তে উঠে খেয়াল হল লাবন্যের কথা। ছেলেতো ঠিকই মা’কে খোঁজ করে মায়ের পাশে এসে শুয়েছে, কিন্তু লাবন্যতো আসে নাই। আসলে লাবন্য আছে কোথায়? কার পাশে ঘুমালো? চিন্তাটা মাথায় আসার সাথে সাথে দৌড়ে বের হল রুম থেকে। সব ঘুম, সব ঘরের দরজাই বন্ধ। কোন ঘরে নক করব? কোনো কূলকিনারা না পেয়ে আবার ফিরল রুমে অযু করে নামাজ পড়ে তসবিহ পড়ছিলো তখন ওর মা উঠলেন নামাজ পড়তে। মায়ের জন্য গরম পানি এনে দিল অযু করতে। তখন কথায় কথায় লাবন্যের কথা বলতেই রেশমার মা জানালো বাচ্চারা সব সারারাত ছাদে থাকবে এমনটাই বলেছিল। ওর মা নামাজ পড়তে দাঁড়ালে ও দৌড়ে ছাদে উঠল মেয়েকে দেখার জন্য। কারন বাড়ি ভরা ছেলে।ভাইয়ের ছেলে, ভাতিজির দেবররাও আছে। বলা যায় না কার মনে কি আছে? আর মেয়েতো একটু বেখেয়ালি তাই ভাবনাটা একটু বেশি। একবার একটা ক্ষতি হয়ে গেল আর কোনদিনও তা পূরণ করা যাবে না। আতংকিত মন নিয়ে ছাদে এসে দেখে সব ঘুম। একপাশে ছেলেরা তাশ খেলেছে। ওদের পাশেই এলোমেলো তাশ পড়া। মনে হচ্ছে সারারাত এগুলো সিগারেটও টানছে। সিগারেটের অবশিষ্টাংশ একভুর হয়ে আছে। এমন পরিবেশে ছিলো মেয়েটা, লিখন জানলে না জানি কি বলবে! খোঁজ করতে করতে একটু ভিতরের দিকে এগোলো। পানির ট্যাংকের গায়ে হেলান দিয়ে হিমেল বসে আছে আর ওর বিছানো পা’কে বালিশ বানিয়ে লাবন্য ঘুমিয়ে আছে। রেশমাকে দেখে হিমেল নড়েচড়ে বসল।

“খালামনি তুমি এই ভোরে?”

“ইন্না-লিল্লাহ! সারারাত তোরা এখানেই ছিলি? এই লাবন্য, লাবন্য ওঠ! ওঠ বলছি।”

লাবন্য ওর মায়ের মুখে ওর পুরো নাম শুনে অবাক হয়ে ঘুম ঘুম চোখে চেয়ে রইল।

“খালামনি ভয় পাচ্ছো কেন? এখানে আরও অনেকেই আছে তন্বীরাও আছে। ”

“থাকুক তাতে কি? ও কেন থাকবে? ও জানে না, ওর আব্বু এসব পছন্দ করে না। এখানে কত কত —-”
“খালামনি আমি কিন্তু সারারাত জেগেছিলাম, ওর কোন সমস্যা হয়নাই। এত টেনশন করো না।”

“হিমু তুই চুপ থাক। আপা জানলে আরেক কেলেংকারী হবে। মান সম্মানের ব্যাপার। আমারটা নিয়ে কোন ভয় নাই কিন্তু আমার মেয়ের ব্যাপারটা নিয়ে কোনো রিস্কে যেতে চাই না। তুই সারারাত জেগে ছিলি, চোখ লাল হয়ে আছে। এখন ঘুমা, আর লাবন্য তুই আমার সাথে নিচে চল সবাই জেগে উঠার আগে।” বলেই লাবন্যের হাত ধরে টেনে টেনে রেশমা নিচে নেমে গেল।
হিমেল যেনো অন্য এক রেশমাকে দেখল বলে মনে হল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here