চন্দ্রমহল ১২(শেষ পর্ব)

0
541

চন্দ্রমহল ১২(শেষ পর্ব)
৩০.
বাগান বাড়িতে আজকে সাজ সাজ রব।আজকে ইংরেজ সরকারের বিশিষ্ট ভদ্রলোকদের জন্য বাগান বাড়িকে সাজানো হচ্ছে নতুন রূপে।দেখে মনে হচ্ছে এ যেনো কোনো ইন্দ্রপুরী। রঙিন সব আলো জ্বলছে চারদিকে। কাঁচা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে বাগান বাড়ির পুরো আঙিনা।
দাসী থেকে শুরু করে সবাই নতুন কাপড় পরে সেজেছে আজ মনের মাধুরি মিশিয়ে।

বন্দীশালার প্রধান ফটকের বাহিরে দুজন প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে ভেসে আসা গানের তালে তালে দুলছে তারাও।
বনলতা কোমরে লুকানো ব্যাগ থেকে একটা সরু তার বের করলো।তারপর গরাদের বাহিরে হাত বের করে তার দিয়ে খুঁচিয়ে তালা খুলে ফেললো।তালা খুলতেই চোর কানাই কে একটা প্রণাম জানালো মনে মনে।কানাই যদি এই পদ্ধতি না শেখাতো তবে আজ কিভাবে বের হতো সে!

প্রলয় আর স্বর্ণলতা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। পা টিপে টিপে বনলতা এগিয়ে গেলো প্রধান ফটকের দিকে।তারপর সেখানে গিয়ে একটা মশাল দিয়ে নিজের শাড়ির আঁচল ছিড়ে তাতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠলো আগুন আগুন বলে।

ভেতরে চিৎকার শুনে প্রহরীরা চমকে গেলো। একজন দরজার নিচ দিয়ে উঁকি দিতেই দেখলো সত্যি আগুন জ্বলছে। দেরি না করে তারা দরজা খুলে দিলো।দরজা খুলতেই বনলতা একটা লাঠি নিয়ে দুজনের মাথায় আঘাত করলো। তারপর দুজন অজ্ঞান হয়ে যেতেই তাকে বন্দী করে রাখা কক্ষে দুজনকে বন্দী করে রাখলো।

রাজেন্দ্র নারায়ণের তিন ছেলেই সেজেগুজে বসে আছে মেহমানদের সাথে।বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে সবাই মিলে।আর তার মধ্যে চলছে মদ খাওয়া।

বনলতা একটা দাসীর শাড়ি পরে নিলো,তারপর দাসীদেরমতো করে নিজের চুল বেঁধে নিলো কাঁচা ফুল দিয়ে।ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক লাগালো মোটা করে।কপালে বড় একটা লাল টিপ দিলো।নিজের চেহারায় বদল আনতে সুঁই দিয়ে মুহুর্তেই নিজের নাখ ফুটো করে নিলো।সেই রক্তাক্ত অবস্থায় নাকে মস্ত বড় একটা নাকফুল দিলো।কানেও দিলো নাকফুলের সাথে মিলিয়ে এক জোড়া বড় দুল।কাজল দিয়ে মুখে বড় করে একটা তিল আঁকলো বাম গালের মধ্যখানে।

তারপর আয়নায় তাকালো।নিজেকে দেখে নিজেই সন্তুষ্ট হলো।সে যে বনলতা খুব একটা গভীর ভাবে না তাকালে কেউ বুঝবে না।তারপর খোঁপায় নিজের কাঠি লাগালো,কোমরে লুকিয়ে রাখার ব্যাগটা কোমরে সযত্নে লুকিয়ে রাখলো।বুকের ভেতর থেকে কিছু ঔষধ বের করলো।
এই ঔষধ সে প্রভাতের চেম্বার থেকে চুরি করে এনেছে।

গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বের হয়ে গেলো বাহিরে।সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত,কারো সময় নেই কারো দিকে তাকানোর। বনলতা রান্নাঘরে ঢুকে গেলো। কয়েকজন দাসী খাবার সাজাচ্ছে।
বনলতা অনেকগুলো ঔষধ বের করে গুড়ো করতে লাগলো একটা হামানদিস্তায়।
একজন দাসী এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,”কি করছিস লো তুই?”

বনলতা হেসে বললো,”আর বলিস না,জমিদার বাবুর সেজো ছেলে বলেছে এগুলো গুড়ো করে মদের বোতলে মিশিয়ে দিই যেনো।তাহলে না-কি ওদের শক্তি বাড়বে।”

একজন দাসী মুখ টিপে হেসে বললো,”বেশি দিস নে লো,আজ বন্দী ওই মেয়েটা নয়তো মরেই যাবে এদের সবার সোহাগ পেয়ে।”

বাকীরা সবাই হেসে উঠলো এই কথা শুনে। বনলতাও হাসলো।তারপর বললো,”ওই বেটি মরুক আর বাঁচুক আমাগো কি তাতে,আমরা হইলাম দাসী। আমাগোরে যেই কামের হুকুম দেয় তাই তো তামিল করা লাগবে।”

বাকীরা সবাই তার সাথে তাল মিলালো একজন দাসী ছাড়া।
সে বললো,”এরকম করে বলিস না।ওই মেয়েটা তো খারাপ কিছু করছে না।আমার যদি ক্ষমতা থাকতো ওরে মুক্ত করে দিতাম।একবার ভেবে দেখ এরা আমাগোরে দিয়ে কি না করায়।সব রকমের খারাপ কাম করায়,আবার দাসীর কাম ও করায়।এইটা তো জীবন না আমগো।ওই মেয়েটাই পারবে আমাদের এই অন্ধকার জীবন থেকে মুক্তি দিতে।”

সবাই হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে যার যার কাজে লেগে গেলো। বনলতা সবগুলো ঔষধ ৩ টা বোতলে মিশিয়ে ট্রে তে করে বৈঠকখানায়।রাজেন্দ্র নারায়ণ সবেমাত্র এসে বসেছেন। বনলতা ট্রে রাখতেই রাজেন্দ্র নারায়ণ জিজ্ঞেস করলেন,”কে তুমি?
আগে তো দেখেছি বলে মনে হয় না।”

বনলতা হেসে বললো,”ইয়ে বাবুজি,আমাকে দুদিন আগেই এনেছিলো এখানে।”

রাজেন্দ্র নারায়ণ আর কথা না বাড়িয়ে চলে যেতে বললো।বনলতা হাফ ছেড়ে বাঁচলো।

৩১.
বৈঠকখানায় আসর জমে উঠেছে,সেই সাথে বোতল ও খালি হচ্ছে।রাজেন্দ্র নারায়ণ বললো,”মিস্টার মার্টিন,আপনার মনে আছে সুশান্ত সেনের স্ত্রীর কথা?”

মার্টিন কিছুক্ষণ ভেবে বললো,”ও হো,ইয়েস ইয়েস,আমি তাকে ভুলতে পারি নি। এই ভারতবর্ষে এরকম সুন্দরী নারী আমি বেশি দেখি নি।”

নিকোলাস আরেক পেগ খেতে খেতে বললো,”ওই রাতের কথা আমি কিছুতেই ভুলবো না।আমরা সবাই মিলে কি এনজয় করেছিলাম!”

রাজেন্দ্র নারায়ণ বললো,”আপনাদের ভাগ্য ভালো বলতে হবে,আজকে আপনাদের জন্য আছে সেই সুশান্ত সেনের কন্যা বনলতা। মায়ের চাইতে মেয়ে আরো বেশি সুন্দরী। আর এখনো কুমারী মেয়ে। ”

জোনাস বললো,”মিস্টার সিং,মেয়েটাকে নিয়ে আসুন। আমি ওরকম সুন্দরী মেয়ের কথা শুনলে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারি না।”

রাজেন্দ্র নারায়ণ বললো,”এতো অধৈর্য হবার কিছু নেই স্যার,মেয়েটা আমার মাছে বহাল তবিয়তে আছে।”

তারপর প্রভাতকে বললো,”যাও,ওই মেয়েকে নিয়ে আসো।”

খেতে খেতে সবারই নেশা লেগে গেছে।প্রভাত টলমল পায়ে সামনে এগুতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো। সবাই একসাথে হেসে উঠলো। তারপর রাজেন্দ্র নারায়ণ ঘুমে তলিয়ে গেলো।রাজেন্দ্র নারায়ণের পরে আর বেশি দেরি হলো না।দুই মিনিটের মধ্যে সবাই যার যার জায়গায় ঘুমিয়ে গেলো।

রান্নাঘরে গিয়ে বনলতা সেই মেয়েটাকে খুঁজে বের করলো,যে এখান থেকে বের হতে চায়।তারপর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো বাহিরের দিকে।
মেয়েটার দুই হাত নিজের হাতে নিয়ে বললো,”তোমার নাম কী?”

মেয়েটা বললো,”রত্না। কেনো?”

বনলতা বললো,”শুনো রত্না,আমি বনলতা। সেই মেয়ে যাকে জমিদার বন্দী করে রেখেছে। তুমি কি এখান থেকে বের হতে চাও?
তাহলে আমাকে সাহায্য করো একটু।তোমার মতো যারা যারা এখানে থাকতে চায় না তাদের নিয়ে এসো।আজ যদি আমাকে সাহায্য করো তবে মনে রেখো,আজকে থেকে তোমরা মুক্ত।”

রত্নার চোখেমুখে খুশির ঝিলিক দেখা দিলো বনলতাকে দাড়াতে বলে ভেতরে গেলো।এবং ১২-১৩ জন মেয়ে নিয়ে ফিরে এলো।
বনলতা বাহিরে গেইটের কাছে গিয়ে শিস বাজাতেই গাড়োয়ান ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে এলো ভেতরে। এই গাড়োয়ান প্রমিলার বাপের বাড়ির লোক,প্রমিলার মাধ্যমে বনলতার সাথে পরিচয়। বনলতা আগেই সব ঠিক করে রেখেছিলো।

মেয়েগুলো মিলে ধরাধরি করে মার্টিন,মার্গারেট,জোনাস,নিকোলাস,রাজেন্দ্র নারায়ণ এবং প্রভাত ৬ জনকেই গাড়িতে তুললো।তারপর বনলতা ছুটে গিয়ে স্বর্ণলতার কক্ষের দরজা খুলে স্বর্ণলতাকে বের করে আনলো।

একটু এগুতেই বনলতার বুকের ভেতর কেঁপে উঠলো হঠাৎ করে। একবার পেছন ফিরে তাকালো।
দেখলো প্রলয় হাসিমুখে তাকিয়ে আছে বনলতার দিকে।

বনলতা এগিয়ে গিয়ে দাড়ালো প্রলয়ের কক্ষের সামনে। তারপর বললো,”আপনি যদি জমিদার পুত্র না হতেন তবে বিশ্বাস করেন আমি আমার জীবন আপনার সাথে বাঁধতে একটুও আপত্তি করতাম না।কিন্তু আফসোস আমার। আপনার মনটা যতোই পবিত্র হোক,দেহে তো আপনার রাজেন্দ্র নারায়ণের রক্তই বইছে।আপনাকে দেখলেই আমার অতীত মনে পড়বে,আর আজকের পর থেকে আমাকে দেখলে আপনার ও মনে ভালোবাসা জন্মাবে না।
আমাকে ক্ষমা করবেন।”

প্রলয় জিজ্ঞেস করলো,”আমার দেহে রাজেন্দ্র নারায়ণের রক্ত বইছে বলে আমার এক বুক ভালোবাসা তুমি পায়ে ঠেলে দিবে?”

অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বনলতা বললো” হ্যাঁ দিবো।”

প্রলয় আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। বনলতা তার মা’কে নিয়ে চলে গেলো।

৩২.
ঘুম ভাঙতেই একে একে সবাই নিজেদের পাশাপাশি পিলারের সাথে বাঁধা অবস্থায় দেখতে পেলো। হাত উপরে কাঠের সাথে বেঁধে রাখা।
একটা সোফায় বনলতা বসে আছে।

নিকোলাস চিৎকার করে বললো,”কি হচ্ছে এসব?”

বনলতা হেসে বললো, “১৬ বছর আগে করা পাপের শাস্তি। সেদিন তোরা আমার বাবা আর কাকার মুখ বেঁধে রেখেছিলি।আমি এতোটা নির্দয় হবো না।তোদের মুখ আমি বাঁধবো না।যন্ত্রনায় তোরা চিৎকার করবি তা শুনে আমি শান্তি পাবো।এই মহল চিনিতে পেরেছিস তো,সেই একই মহল,একই জায়গা,মানুষ আলাদা শুধু।”

ভয়ে আতঙ্কে রাজেন্দ্র নারায়ণের গলা শুকিয়ে গেলো।
বনলতা একটা হাতুড়ি হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর কয়েকটা পেরেক হাতে নিয়ে বললো,”সেদিন সবার আগে তুই আমার বাবার সামনে তার ছেলেকে খুন করেছিস।আমিও আজ তোর সামনে আগে তোর ছেলেকে কষ্ট দিবো।দেখ এবার সন্তানের কষ্টে বাবার কেমন লাগে।”

প্রভাত চিৎকার করে ক্ষমা চাইতে লাগলো।কিন্তু বনলতা সেসব কানে নিলো না,প্রভাতের দুই হাতের তালুতে ছয়টা পেরেক ঠুকে দিলো।

গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলো প্রভাত যন্ত্রণায়। কিন্তু রক্ষা পেলো না বনলতার হাত থেকে।প্রভাতের অবস্থা দেখে সবাই চিৎকার করতে লাগলো।

বনলতা পাগলের মতো হাসলো।একে একে সবার হাতে পেরেক ঠুকলো বনলতা। তারপর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সবার মাথায় পেরেক ঠুকলো দুইটা করে ।পশুর মতো চিৎকার করতে লাগলো সবাই যন্ত্রণায়।রাজেন্দ্র নারায়ণ নিজের মৃত্যু ভিক্ষা চাইলো এই যন্ত্রণা না পাওয়ার চাইতে।কিছুক্ষণ পরে কেরোসিন ঢেলে দিলো সবার গায়ে।দেশলাই বের করে একটা কাঠি জ্বালিয়ে আগুন লাগিয়ে দিলো। মুহুর্তের মধ্যে আগুন জ্বলে উঠলো সবার গায়ে।

দূরে সরে গিয়ে বনলতা সেই দরজার পেছনে গিয়ে লুকালো।১৬ বছর আগে যেভাবে দাঁড়িয়ে নিজের বাবার আর কাকার এভাবে পুড়ে যাওয়া দেখেছে সে।

৩৩.
স্বর্ণলতা বাহিরে দাঁড়িয়ে রইলো মেয়ের অপেক্ষায়। ভেতরের এসব তান্ডব দেখার সাহস তার নেই।বনলতা বের হয়ে আসলো অনেক সময় পরে।ঠোঁটে বিজয়ীর হাসি,চোখে জেতার আনন্দ,মুখে প্রশান্তি।
শান্তি পেলো স্বর্ণলতা নিজেও।

বনলতার এক হাত ধরে স্বর্ণলতা বললো,”এখনো একটা কাজ বাকি আছে মা।”

বনলতা জিজ্ঞেস করলো,”কি কাজ মা?”

স্বর্ণলতা বললো,”প্রলয়কে এভাবে ফিরিয়ে দিস না।ছেলেটা সত্যি তোকে ভালোবাসে।হাতের পাঁচ আঙুল এক রকম হয় না।ওর চোখে আমি তোর জন্য সত্যিকারের ভালোবাসা দেখেছি। ”

বনলতা দ্বিধান্বিত হয়ে বললো,”কি করবো আমি মা?”

স্বর্ণলতা হেসে বললো,”আগে গিয়ে প্রলয়কে মুক্ত করবি,আয়।”

বনলতা মায়ের হাত ধরে এগিয়ে গেলো প্রলয়কে মুক্ত করতে। দুচোখে নিয়ে চললো,এক আকাশ স্বপ্ন।

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here