চন্দ্রমহল -১১

0
310

চন্দ্রমহল -১১
২৭.
(১৬ বছর পূর্বে)
দুদিন ধরে প্রমিলার ভীষণ জ্বর।বিছানা থেকে নামতে পারছে না।শরীর অত্যধিক দুর্বল। রাজেন্দ্র নারায়ণ পেয়াদা পাঠিয়েছেন ডাক্তার বাবুকে নিয়ে আসার জন্য।কিন্তু ডাক্তার নেই,শহরে গিয়েছেন ঔষধ আনার জন্য।
রাজেন্দ্র নারায়ণের একমাত্র ছোট বোন রানী প্রমিলার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে বসে বসে।
রানীর ও শরীর ভালো নেই। কয়েকদিন ধরে খেতে পারছে না।যা খাচ্ছে তাই বমি করে ফেলে দিচ্ছে।

জমিদার সুশান্ত সেনের ছোট ভাই সৈকত সেন রাজেন্দ্র নারায়ণের জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে নিজের বাড়ি যাচ্ছিলো। পথিমধ্যে শুনতে পেলো জমিদার বাড়িতে রোগী আছেন কিন্তু ডাক্তার নেই।
সৈকতের হাতে ডাক্তারের ব্যাগ দেখে নায়েব মশাই তাকে নিয়ে আসেন মহলে প্রমিলার চিকিৎসা করতে।

প্রমিলার কক্ষে প্রথম বারের মতো রানী সৈকতকে দেখে।প্রথম দেখাতেই রানী সৈকতের প্রেমে পড়ে যায়।
সৈকত প্রমিলাকে দেখে ঔষধ দিয়ে চলে যায়।

সৈকত যাবার পরের দিন রানী নিজে রাজেন্দ্র নারায়ণের কাছে যায়।পুরো পৃথিবী একদিকে আর রাজেন্দ্র নারায়ণের কাছে নিজের একমাত্র ছোট বোন অন্যদিকে।
শৈশবে মা মারা যাবার পর নিজের হাতে বোনকে মানুষ করেছেন রাজেন্দ্র নারায়ণ।
তাই বোনের প্রতি তার অগাধ মায়া।মাথা নিচু করে রানী ভাইকে বললো,”দাদা তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।”

রাজেন্দ্র নারায়ণ বসে বসে দাবার গুটি সাজাচ্ছেন।বোনের কথা শুনে নড়েচড়ে বসলেন।তারপর জিজ্ঞেস করলেন,”কি বলবি বল?”

রানী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,”জমিদার সুশান্ত সেনের ভাইকে আমার মনে ধরেছে।”
এটুকু বলে রানী আর দাড়ালো না।ছুটে পালিয়ে গেলো। রাজেন্দ্র নারায়ণ হেসে পেয়াদাদের বললেন,”ঘোড়ার গাড়ি বের করতে বল,আমি জমিদার সুশান্ত সেনের মহলে যাবো।”

নানারকম উপহারাদি নিয়ে রাজেন্দ্র নারায়ণ সুশান্ত সেনের মহলে গেলেন।
সুশান্ত সেন আতিথিয়েতায় কোনো ত্রুটি রাখলেন না।রাজেন্দ্র নারায়ণের থেকে নিজের ভাইয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে সুশান্ত সেন ও সম্মতি দিয়ে দিলেন।

রাজেন্দ্র নারায়ণ যেতেই সুশান্ত সেন স্বর্ণলতা আর সৈকতকে ডেকে পাঠালেন।তারপর রাজেন্দ্র নারায়ণের আগমনের উদ্দেশ্য বললেন তাদের কাছে।
ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,”বাবা বেঁচে থাকলে আজ এই সিদ্ধান্ত বাবা নিতেন,যেহেতু বাবা নেই তাই তোমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত আমি নিজেই নিলাম।তোমার কি কোনো আপত্তি আছে রাজেন্দ্র নারায়ণের বোনকে বিয়ে করতে? ”

সৈকত লজ্জায় আরক্ত হয়ে বললো,”দাদা,আপনি আমার দাদা হলেও আছেন,বাবা হলেও আপনি আছেন।আপনার সিদ্ধান্তই আমার জন্য চূড়ান্ত। আমি বিশ্বাস করি আমার ভালো হবে কিসে সে সম্পর্কে আপনি আমার চাইতে বেশি চিন্তিত।সুতরাং আমার কিছু বলার নেই আর।”

সুশান্ত সেন ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,”আজ আমার বড়ই আনন্দের দিন ভাই।আমি আমার ছোট ভাইকে সেন বংশের সব আদবকায়দা শিক্ষা দিতে পেরেছি। আমার আর কোনো চিন্তা রইলো না ভাই।”

তারপর স্বর্ণলতাকে বললেন,”উপহারাদি সাজিয়ে নাও,আগামীকাল আমরা মেয়ে দেখতে যাবো।”

পরদিন দুটো ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে সুশান্ত সেন ছোট ভাইয়ের জন্য বউ দেখতে গেলেন।
সব কিছু ঠিকঠাক ছিলো কিন্তু বিয়ের দিন তারিখ ধার্য করার মুহুর্তে ঝড়ের মতো কক্ষে প্রবেশ করলো নিতিন।নায়েব মশায়ের ছেলে নিতিন।
নিতিনকে দেখে রানীর চোখ মুখ শুকিয়ে গেলো। সবার সামনে নিতিন গিয়ে রানীর হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো,”এসব কি হচ্ছে রানী?তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে যাচ্ছো?
আমাদের তিন বছরের প্রেম কি তুমি ভুলে গেলে?”

মুহুর্তের মধ্যে কক্ষে যেনো বজ্রপাত হলো।নিতিনের কথা শুনে রাজেন্দ্র নারায়ণ উঠে গিয়ে নিতিনের গলা টিপে ধরলেন।কিন্তু নিতিনকে থামাতে পারলেন না।
রাজেন্দ্র নারায়ণের হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে নিতিন সৈকতের হাত চেপে ধরে বললো,”ডাক্তার বাবু,আমার কথা বিশ্বাস করেন। আমি রানীকে নিজের জীবনের চাইতে বেশি ভালোবাসি। রানী আমার সন্তানের মা হতে চলেছে। আমরা খুব শীঘ্রই বিয়ে করতাম।কিন্তু আপনাকে দেখার পর রানীর মত পাল্টে গেছে।ও আপনাকে পছন্দ করে বলে আমাকে এখন অস্বীকার করছে।”

নিতিনের কথা শুনে সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। সৈকত এগিয়ে গিয়ে রানীকে জিজ্ঞেস করে,”উনি যা বলেছেন তা কি সত্যি?
আমাকে মিথ্যা বলবেন না।আমি একজন ডাক্তার, পরীক্ষা করলেই আমি বুঝে যাবো আপনি সত্যি গর্ভবতী কি-না। ”

সৈকতের এই কথা শুনে রানী আর অস্বীকার করার সাহস পেলো না।তবুও নিজের দাদার কাছে গিয়ে বললো,”আমার কোনো দোষ নেই দাদা।এই নিতিন আমাকে জোর করে এরকম করেছে।ওর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক ছিলো না কখনো। ”

নিতিন অবাক হয়ে গেলো রানীর মিথ্যা কথা শুনে। তারপর বললো,”আমাকে লিখা তোমার সবগুলো চিঠি এই মুহূর্তে আমার কাছে আছে রানী।”

রাজেন্দ্র নারায়ণ আর নিতিনকে মুখ খোলার সুযোগ দিলেন না। গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়ে পেয়াদাদের বললেন,”একে বন্দী করে রাখ।”

নিতিনের এসব কথার পর সৈকত নিজের দাদার দিকে তাকালো। সুশান্ত সেনের চেহারা থমথমে হয়ে গেছে। রাগান্বিত হয়ে তিনি বললেন,”আমরা তাহলে আসি।আমার মনে হয় এই বিয়ে হলে আমার ভাই আপনার বোন কেউই সুখী হবে না।”

রাজেন্দ্র নারায়ণকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সুশান্ত সেন বের হয়ে গেলো।তার পিছুপিছু স্বর্ণলতা,সৈকত ও বের হয়ে গেলো।

রাজেন্দ্র নারায়ণ বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,”সব ঠিক হয়ে যাবে রানী।তুই চিন্তা করিস না।আমি আগামীকাল আবার যাবো সুশান্ত সেনের মহলে।আর এই নিতিনকে আমি মাটির নিচে পুঁতে দিবো।”

সেই রাতেই রাজেন্দ্র নারায়ণ নিতিনকে খুন করেন।তারপর পরদিন আবারও যান সুশান্ত সেনের মহলে
কিন্তু সুশান্ত সেনকে তার সিদ্ধান্ত থেকে নড়াতে পারলেন না।রাজেন্দ্র নারায়ণ সুশান্ত সেনের হাত ধরে বললেন,”আমার বোন আমার উপর ভরসা করে আছে।আমাকে খালি হাতে ফিরাবেন না।আমার বোনের জীবন নষ্ট হয়ে যাবে তাহলে। আমার জমিদারি আমি আপনার ভাইকে লিখে দিবো তবুও আপনি আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না অনুগ্রহ করে। ”

সুশান্ত সেন এই কথায় রেগে গেলেন। তারপর বললেন,”আমার ভাই ও আমাকে ভীষণ ভরসা করে সিংজী,তার ব্যাপারে সমস্ত সিদ্ধান্ত আমি নিই।আমি চাই না জেনেশুনে এমন সিদ্ধান্ত নিতে যার কারণে আমার ভাইয়ের আমার উপর থেকে ভরসা উঠে যায়।আমার ভাইয়ের মনঃক্ষুণ্ন হবে এমন সিদ্ধান্ত আমি নিতে পারবো না। ”

রাজেন্দ্র নারায়ণ নিজের মহলে ফিরলেন শূন্য হাতে।লজ্জায় বোনের সামনে গেলেন না।
চারদিকে ইতোমধ্যে সবাই জেনে গেছে রানীর কথা।লোকে নানান কথা বলছে।রানী এই লজ্জা মেনে নিতে না পেরে গায়ে আগুন দেয় এক রাতে।
রাজেন্দ্র নারায়ণ তখন মদ খেয়ে মাতাল হয়ে আছেন বাগানবাড়িতে। নেশার ঘোরে তিনি কিছুই বুঝলেন না কি বলছে কে।
টের পেলেন পরেরদিন। তখন আর কিছুই করার ছিলো না তার।
বোনের লাশের ছাই হাতে নিয়ে রাজেন্দ্র নারায়ণ শপথ করলেন,”সুশান্ত সেনকে এই শাস্তি আমি দিবোই দিবো।আমার বোনের মৃত্যুর একমাত্র কারণ ওই সুশান্ত সেন আর সৈকত সেন।”

২৮.
সব জমিদার ইংরেজ সরকারকে রাজস্ব দিলেও শুধুমাত্র সেনেরা এর ব্যতিক্রম ছিলো।পূর্ব পুরুষের সময় থেকে সেন বংশের জমিদারি থেকে ইংরেজরা কোনো রাজস্ব নিতে পারে নি।
ইংরেজ সরকারের চারজন রাজস্ব আদায়কারী ছিলো মার্টিন,মার্গারেট,নিকোলাস এবং জোনাস।রাজেন্দ্র নারায়ণের মহলে রাজস্ব আদায় করতে এলে রাজেন্দ্র নারায়ণ এদের সাথে চুক্তি করেন।
যেহেতু সেনদের থেকে রাজস্ব আদায় করা যায় না তাই এদের অপসারণ করে নতুন জমিদার বসালে প্রতি বছর রাজস্ব আদায় করতে পারবে তারা।আর এই রাজস্বের পুরোটাই চারজন ভাগ করে নিতে পারবে।

১ সপ্তাহ পরে একদিন ৫ জন মিলে হানা দেয় সুশান্ত সেনের মহলে।প্রহরীরা আগেও রাজেন্দ্র নারায়ণকে আসতে দেখেছে বলে তারা বাঁধা দেয় নি।সুশান্ত সেন আর সৈকত সেন বসে বসে আলোচনা করছে সোনালের লেখাপড়া নিয়ে।সেই মুহুর্তে রাজেন্দ্র নারায়ণ তাদের কক্ষে ঢুকে যায় ইংরেজ বাবুদের নিয়ে।
চোখের পলকে সুশান্ত সেন আর সৈকত সেন এবং সুশান্ত সেনের পুত্র সোনাল সেনকেও বেঁধে ফেললো।
স্বর্ণলতা বিছানায় মেয়েকে নিয়ে শুয়ে ছিলেন।
বাহিরে চেঁচামেচি শুনে স্বর্ণলতা মেয়েকে শুয়ে থাকতে বলে নিজে উঠে গেলেন বাহিরে। রাজেন্দ্র নারায়ণ তাকেও বেঁধে ফেললো। সুশান্ত সেনের সামনে এক কোপে সোনালের দেহ থেকে মাথা আলাদা করে ফেললো। তারপর হেসে বললো,”কেমন লাগছে এখন জমিদার বাবু?নিজের ছেলের মৃত্যু দেখে কেমন লাগছে।”

ছেলের এই অবস্থা দেখে স্বর্ণলতা জ্ঞান হারালো।

মুখ বেঁধে রাখায় সুশান্ত সেন আর সৈকত সেন কোনো কিছু বলতে পারলো না।
তারপর যখন স্বর্ণলতার জ্ঞান ফিরলো নিজেকে সম্পূর্ণ নগ্নরূপে দেখতে পেলো।
লজ্জায়,অপমানে,শোকে সুশান্ত সেন আর সৈকত সেন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।
তাদের সামনে পাঁচজন নরপশু স্বর্ণলতার হাত পা মুখ বেঁধে রেখে তাকে ধর্ষণ করলো সারারাত ধরে।

বনলতা রাতে ঘুম থেকে উঠে মা’কে না পাশে না পেয়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে আসে।
বাহিরের কক্ষে সবার এই অবস্থা দেখে বনলতা ভয় পেয়ে যায়। ভয়ে দরজার পেছনে লুকিয়ে যায়।

রাতভর স্বর্ণলতাকে ধর্ষণ করার পর শেষ রাতে রাজেন্দ্র নারায়ণ সুশান্ত সেনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর বলে,”আমার আদরের বোনটা কি রকম যন্ত্রণা নিয়ে মারা গেছে তা আমি দেখি নি।আজ তোদের সেই ভাবে খুন করে আমার বোনের কষ্ট আমি অনুভব করবো।”
বনলতা দরজার আড়াল থেকে দেখলো কেমন দাউদাউ করে আগুনে জ্বলে যাচ্ছে বাবা আর কাকার দেহ।

স্বর্ণলতা জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে রইলো।

রাজেন্দ্র নারায়ণ হাসলো,বড় বিকৃত স্বরে হাসলো রাজেন্দ্র নারায়ণ। তারপর সকাল বেলা অজ্ঞান স্বর্ণলতাকে নিয়ে রাজেন্দ্র নারায়ণ নিজের মহলে ফিরে গেলো।প্রথম দুদিন প্রমিলা তার দেখাশোনা করেছে।তখন প্রমিলা স্বর্ণলতার কাছ থেকে সব কিছু শুনতে পায়।তারপর লুকিয়ে গিয়ে নিজে বনলতা কে নিজের কাছে নিয়ে আসে।নিজ হাতে গড়ে তোলে বনলতাকে এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গরূপে।

২৯.
স্বর্ণলতার মুখ থেকে সব শুনে প্রলয়ের মাথা নিচু হয়ে গেলো। বনলতা মুচকি হেসে বললো,”এবারও কি আপনি বলবেন আপনাকে ভালোবাসতে?
এবার নিশ্চয় বুঝেছেন বনলতা কেনো এতো ঘৃণা করে আপনাদের।এরপর আর কখনো আমার সামনে ভালবাসার কথা বলতে আসবেন না।”

প্রলয় কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,”আমি বারবার,হাজার বার তোমাকে ভালোবাসি বলবো।আমার বাবা অপরাধ করেছে কিন্তু আমি তো করি নি।তবে কেনো আমি শাস্তি পাবো বনলতা?
আমি ও তো তোমার কাছেই নিজের স্বস্তি খুঁজে পাই।”

বনলতা বললো,”আমি আপনাকে ঘৃণা করি,আজীবন ঘৃণা করবো।”

চলবে…….

জাহান আরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here