চন্দ্রমহল -০৮
২০.
বনলতা বন্দীশালার কক্ষের এক কোণে বসে রইলো। একটু পর রঙ্গনা এলো সাথে করে দুজন তাগড়া যুবতী মেয়ে নিয়ে।বনলতা হাটু ভাজ করে বসে রইলো।গরম পানির পাতিল,সুই,ব্লেড,লবন মরিচ সব এনে বনলতার সামনে রাখলো মেয়ে দু’টো।
রঙ্গনা ভিতরে ঢুকতেই একটা মেয়ে একটা চেয়ার এগিয়ে দিলো রঙ্গনার দিকে।চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রঙ্গনা বনলতার মুখোমুখি বসে বললো,”তাহলে তুই সুশান্ত সেনের মেয়ে?”
বনলতা জবাব দিলো না।রঙ্গনা আঁচল থেকে পান বের করে মুখে পুরলো।মশালের আলোয় ভীষণ সুখী দেখাচ্ছে রঙ্গনাকে।পান চিবিয়ে পিক ছুড়ে মারলো বনলতার গায়ে।
তারপর খিলখিল করে হাসলো।
আঁচল দিয়ে মুখ মুছে বললো,”এই রঙ্গনা যাকে পুরো বাগানবাড়িতে সবাই সম্মান করে, যার ভয়ে সবাই তটস্থ
থাকে সর্বদা,যার হুঙ্কারে বাগানবাড়িতে ভূমিকম্প হয় সে রঙ্গনাকে কি-না চাকরানির কাজ করতে হয়েছে প্রতি সপ্তাহে একদিন। তোর মায়ের ঘর পরিস্কার করতে হতো আমার। তোর মায়ের শৌচাগার,পরনের এক সপ্তাহের জমানো কাপড় সব কি-না আমাকে পরিস্কার করতে হয়েছে।কতোবড় লজ্জাজনক আমার জন্য তা শুধু আমি জানি।
আমার প্রতিবার ভীষণ ইচ্ছে হতো স্বর্ণলতাকে গলা টিপে খুন করার।কিন্তু জমিদার বাবুর অতি আদরের ফুটন্ত গোলাপে তো কারো হাত দেওয়া নিষিদ্ধ ছিলো।
যে জমিদার রাজেন্দ্র নারায়ণ সিং রঙ্গনার রঙে ডুব দিতো সে কি-না আমাকে পাত্তাই দেয় না।সব পাওয়া না পাওয়ার হিসেব আমি আমার জীবনের খাতায় টুকে রেখেছি।একদিন আমার দিন আসবে সেদিন কড়ায় গন্ডায় সব হিসেব নেব শুধু এই আশায়।
আমার কাছে কি ছিলো না বল?
রূপ,যৌবন সবই ছিলো তবুও আমাকে দশজনে ছিড়েখুঁড়ে খেয়েছে আর স্বর্ণলতা!
তাকে কি-না ফুলদানিতে সাজিয়ে রেখেছে ওই জমিদার!
অথচ কথা ছিলো আমি থাকবো জমিদার রাজেন্দ্র নারায়ণের মনের ফুলদানিতে। আমাকে নিজের মনপ্রাণ উজাড় করে দিবে বলে কথা দিয়েও জমিদার কথা রাখে নি।এখন কি-না আবার তোকে নিয়ে এসে বলে গেলো যেনো কোনো সমস্যা তোর না হয়।একটা ফুলের টোকা ও যেনো না দেওয়া হয় তোকে।
স্বর্ণলতাকে তো আমি পাই নি,তাতে কি বনলতা তো আছে।জমিদারের নজরদারির জন্য তো তোর মায়ের একটা চুল ও ধরতে পারি নি তোকে কিভাবে এখন জমিদার বাবু বাঁচাবে?
তোকে আমি এমন শাস্তি দিবো যে সবার কলিজা ভয়ে থরথর করে কাঁপবে।জমিদার বাবু জানবে তুই পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছিস বলে তোকে শাস্তি দিয়েছি।”
বনলতা চুপচাপ সব শুনলো। তারপর বললো,”তোর বলা শেষ হয়েছে? ”
রঙ্গনা হতভম্ব হয়ে গেলো। এই মেয়ে একটুও ভয় পায় নি তার কথা শুনে?
জবাবের অপেক্ষা না করে বনলতা বললো,”শোন,আমার মা হচ্ছে জমিদার সুশান্ত সেনের স্ত্রী,বনলতা সেনের মা।তুই হচ্ছিস জমিদারের রক্ষিতা। যে স্বেচ্ছায় নিজেকে পতিতা করে রেখেছে,তোর আমার মায়ের সাথে নিজেকে তুলনা করবার সাহস কিভাবে হলো?
তোর ওই জিহ্বা আমি ব্লেড দিয়ে কেটে ফেলতাম শুধু মাত্র আমার মায়ের সাথে তোকে তুলনা করার অপরাধে। কিন্তু তা এখন আমি করবো না কেননা তাহলে তো তুই জমিদারকে বিস্তারিত বর্ণনা দিতে পারবি না কিভাবে তোকে আমি শাস্তি দিয়েছি। আমি চাই জমিদার শুনুক,শুনে ভয় পাক।ভাবুক তার জন্য তাহলে কি কঠিন শাস্তি রয়েছে।এটুকুর জন্য তোকে আমি কম শাস্তি দিবো।”
রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে রঙ্গনা মেয়ে দুটোকে আদেশ দিলো,”ওই হারামজাদিকে বেঁধে ফেল।”
মেয়ে দুটো এগুতেই বনলতা লাথি দিয়ে গরম পানির পাতিল ফেলে দিলো।
ফুটন্ত পানি পায়ে পড়তেই মেয়ে দুটোর পা পুড়ে গেলো।আর্তনাদ করে উঠলো তারা।যেনো প্রাণ বের হয়ে যাচ্ছে তাদের।রঙ্গনা নিজেও আঁতকে উঠলো।
ছুটে বন্দীশালা থেকে বের হতে যেতেই বনলতা বিদ্যুৎ বেগে ছুটে এসে রঙ্গনার চুলের মুঠি চেপে ধরলো। তারপর বললো,”খুব ভাব বেড়েছে না তোর?
জমিদারের রক্ষিতাদের নেত্রী হয়ে নিজেকে অনেক বড় কিছু ভেবে এসেছিস এতোদিন।এই বলে একটা মোটা পিলারের সাথে রঙ্গনাকে বেঁধে ফেললো বনলতা।
কক্ষের ভেতর থেকে সুই,লবণ,মরিচ আর ব্লেড বের করে তাকে বন্দী করে রাখা কক্ষের দরজা বন্ধ করে দিলো বাহিরে থেকে মেয়ে দুজনকে ভেতরে রেখে।
রঙ্গনার চোখ মুখ ভয়ে পান্ডুর বর্ণ রূপ নিয়েছে। ব্লেড দিয়ে বনলতা রঙ্গনা মাথার সব চুল কামিয়ে ফেললো।দুএকবার রঙ্গনা মাথা নাড়িয়েছে ফলে মাথার দু’জায়গায় গভীর ক্ষত হয়ে গিয়েছে, ব্যথায় নীল হয়ে গেছে রঙ্গনার চেহারা।
তারপর আর মাথা নাড়ানোর সাহস পায় নি রঙ্গনা।মাথা কামানো শেষ করে বনলতা রঙ্গনার কোমরে শাড়ির ভাঁজ থেকে সুপুরি কাটার যাঁতি বের করে নিলো।তারপর বললো,”এই যাঁতি দিয়ে কতো মেয়ের আঙুল কেটে নিয়েছিস তুই হাসতে হাসতে। আজ দেখ তোর কেমন লাগে!”
এই বলে রঙ্গনার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল কেটে ফেললো বনলতা। আহত পশুর মতো আর্তনাদ করে উঠলো রঙ্গনা।বনলতা মুচকি হাসলো। তারপর বললো,”না চিৎকার করবি না।চুপ,একদম চুপ!”
রঙ্গনার কান্না থামলো না।এক এক করে বনলতা রঙ্গনার দুহাতের বৃদ্ধাঙ্গুল,কনিষ্ঠা আঙুল আর মধ্যমা আঙুল কেটে নিলো।
ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে বনলতার সবুজ শাড়ি কালো করে দিলো,রঙনার পরনের হলুদ শাড়ি লাল হয়ে গেলো।চিৎকার করে রঙ্গনা ক্ষমা চাইতে লাগলো।
কিন্তু বনলতা তা আমলে নিলো না।রঙ্গনার গায়ের ব্লাউজ খুলে ব্লেড দিয়ে রঙ্গনার পুরো পিঠ কেটে দিলো।তারপর কাটা গায়ে লবণ ছিটিয়ে দিলো।রঙ্গনার চিৎকারে পুরো বাগানবাড়িতে থাকা সবার আত্মা কেঁপে উঠলো। কেউ সাহস করে বন্দীশালার দিকে এগিয়ে এলো না।সবাই ভেবেছিলো বন্দীনি মেয়েটাকে রঙ্গনা শাস্তি দিচ্ছে।
রঙ্গনার কান্না একটু কমতেই বনলতা মরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে দিলো। রঙ্গনার আবারও চিৎকার করে উঠলো। ব্যথা,জ্বলুনি সহ্য করতে না পেরে বললো,”তোর পায়ে পরি আমাকে তুই মেরে ফেল।এভাবে আমাকে আর কষ্ট দিস না।আমাকে মেরে ফেল তুই বনলতা। ”
বনলতা মুচকি হেসে বললো,”না,তা হবে কিভাবে মাসি?
তোমাকে মেরে ফেললে তোমার পিরিতের জমিদারকে আমি কিভাবে বুঝাবো এই বনলতার হৃদয় কতোটা পাষান হতে পারে!
শত্রুকে বনলতা কিভাবে শাস্তি দেয় তার একটা নমুনা তো জমিদার বাবুকে দেখাতে হবে।তবেই না সে বুঝবে সুশান্ত সেনের রক্ত কতোটা ভয়ঙ্কর হতে পারে!
এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে আমি কিভাবে বেঁচে ছিলাম তা আমি জানি শুধু।সব উসুল করবো আমি।”
একটা দেয়াল থেকে একটা মশাল নিয়ে বনলতা রঙ্গনার পায়ের কাছে রাখলো।তারপর পরনের শাড়ি হাটুর উপর তুলে দিলো যাতে শাড়িতে আগুন না লাগে।
রঙ্গনা চিৎকার করে উঠলো।
কিন্তু বনলতা শুনলো না একসাথে জড়ো করে রাখা পা দুটো আগুনে পুড়তে লাগলো।
রঙ্গনার কলিজা কাঁপানো আর্তচিৎকার শুনে বাগানবাড়িতে থাকা সবার বুক কাঁপলো,বনলতাকে বন্দী করে রাখা কক্ষের ভেতর আটকে রাখা মেয়ে দুটো এসব দেখে অজ্ঞান হয়ে গেলো ভয়ে।
নির্বিকার রইলো বনলতা। মুচকি হেসে বললো,”তোমার জন্য আমার ভীষণ মায়া হয় মাসি।তোমাকে আমি বেশি শাস্তি দিবো না তাই।”
এই বলে বনলতা ঝড়ের বেগে ছুটে বের হয়ে গেলো।
বাহির হয়ে একজন দাসী কে বললো,”রঙ্গনা মাসি তোমাকে যেতে বলেছে ভেতরে তার জন্য পান নিয়ে।”
দাসী কিছু না ভেবেই পানের বাটা নিয়ে এগিয়ে গেলো বন্দীশালার দিকে।বনলতা রঙ্গনার কক্ষে ঢুকলো।পুরো বাগান বাড়িতে রঙ্গনার কক্ষের জানালায় কোনো গ্রিল দেওয়া নেই খোলা জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে বের হয়ে গেলো বনলতা।তারপর বাগানবাড়ির পিছন দিক দিয়ে একটা গাছে উঠে দেয়ালের অপর পাশে চলে গেলো।
তারপর নদীর পাড় ধরে দৌড়ে চন্দ্রমহলের পেছন দিকের পুকুর ঘাটে চলে গেলো। ঝোপের ভেতর দিয়ে ঢুকে মহলে ঢুকে পড়লো।
এক পথে বনলতা চন্দ্রমহলে প্রবেশ করলো অপর পথে প্রলয় বাগানবাড়িতে প্রবেশ করলো। এক বুক আকুলতা নিয়ে যাকে দেখতে গেলো প্রলয় তার দেখা আর পেলো না।কে জানে কখনো আর দেখা পাবে কিনা!
চলবে…..
জাহান আরা