চন্দ্রমহল -০৯
২১.
রাজেন্দ্র নারায়ণ সিং গম্ভীরমুখে পায়চারি করছেন নিজের মহলের বাহিরে।লজ্জায়,অপমানে নিজের মাথা নিচু হয়ে যাচ্ছে।
নিজেকে নিজে ধিক্কার দিচ্ছেন বারবার। বাহিরের ঝড়োর মতো কিছু ঝড়ো চিন্তাভাবনা বারবার তাকে নাড়িয়ে যাচ্ছে।
একটা পুঁচকে মেয়ের কাছে তিনি হেরে গেছেন ব্যাপারটা মাথায় আসলেই তার রাগ সপ্তমে উঠে যায়।যাকে ১৬ বছর ধরে আগলে রেখেছেন,কাক পক্ষীকেও জানতে দেন নি তাকে কি-না ঈগলের মতো ছিনিয়ে নিয়ে গেলো সামান্য একটা মেয়ে!
বুকের ভেতর একটা হাহাকার বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।অবচেতন মনের কোথাও যেনো স্বর্ণলতা একটা শক্ত জায়গা দখল করে নিয়েছেন।
রাজেন্দ্র নারায়ণের মাথা কাজ করছে না।কি করবে সে এখন?
দুজন পেয়াদা ছুটে এসে খবর দিলো স্বর্ণলতাকে মহলের ভেতরে বাহিরে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। কথাটা শুনে রাজেন্দ্র নারায়ণ সিং আরো বেশি চিন্তায় পড়ে গেলেন।
জমিদারের এই চিন্তা দুশ্চিন্তায় রূপ নিলো আরো আধাঘন্টা পরে,যখন বাগানবাড়ি থেকে যখন পেয়াদা এসে জানালো বনলতা পালিয়েছে,রঙ্গনার অবস্থা খুব খারাপ।
হঠাৎ করেই রাজেন্দ্র নারায়ণের মনে হলো তার বয়স যেনো ২০ বছর বেড়ে গেছে।তীব্র হতাশা ঝেঁকে ধরলো তাকে।মাথার ভেতর ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার।
এই কি তবে তার পরাজয়ের সূচনা!
আঁতকে উঠলেন রাজেন্দ্র নারায়ণ নিজের পরাজয়ের কথা ভাবতেই।
পরমুহূর্তে সমস্ত দ্বিধা,ভয়,সংকোচ কাটিয়ে চেচিয়ে উঠে প্রভাতকে ডাকলেন।প্রভাত নিজের কক্ষে শুয়ে আছে।বাবার চিৎকার শুনে হকচকিয়ে উঠলো,তারপর ছুটে বেরিয়ে গেলো।
চেম্বারের সামনে আসতেই প্রভাতের পা জোড়া থেমে গেলো হঠাৎ করে। চেম্বারে পাহারারত পেয়াদা চারজন মাটিতে পড়ে আছে অজ্ঞান হয়ে। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলো প্রলয় ও নেই ভেতরে। প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো প্রভাতের।
নিচে নামতেই রাজেন্দ্র নারায়ণের মুখে সবটা শুনলো।তাৎক্ষণিক প্রভাতের মনে হলো কোনো না কোনো ভাবে প্রলয় জড়িত এর সাথে।এজন্যই প্রলয় পালিয়েছে বনলতাকে মুক্ত করতে।
রাজেন্দ্র নারায়ণ এই কথা শুনতেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন।প্রভাতকে হুকুম দিলেন আশেপাশের সব এলাকা তন্নতন্ন করে খুঁজে সুশান্ত সেনের স্ত্রী আর কন্যাকে খুঁজে নিয়ে আয়।
প্রভাত মাথা নিচু করে সম্মতি জানালো।
২২.
তলোয়ার হাতে প্রলয় বাগানবাড়িতে ঢুকেছে। ভেতরে কারো আর্তনাদ শুনে শিউরে উঠলো প্রলয়। বনলতা নয়তো!
মুহূর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো প্রলয়ের।রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়ার অঙ্গিকার নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। কিন্তু গিয়ে দেখে রঙ্গনা শুয়ে আছে উপুড় হয়ে। রক্তাক্ত পিঠে ব্লেডের অসংখ্য কাটা দাগ,দেখেই প্রলয়ের মাথা ঘুরে উঠলো।
পায়ে ঔষধ লাগিয়ে দিচ্ছে একজন ডাক্তার। পশুর মতো চিৎকার করছে রঙ্গনা।প্রলয় সেখান থেকে সরে গিয়ে পুরো বাগানবাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজলো,কিন্তু কোথাও বনলতাকে খুঁজে পেলো না।
শেষে আবারও রঙ্গনার ঘরে এলো।রঙ্গনাকে জিজ্ঞেস করলো,”বনলতা কোথায়?”
ব্যথায় রঙ্গনার মুখ থেকে কথা বের হলো না।তাছাড়া জমিদারের এই পুত্রকে রঙ্গনা খুব একটা পছন্দ করে না।এই ছেলে সবসময় রঙ্গনাকে ঘৃণা করে এসেছে।বাগানবাড়ির ছায়াকেও এই ছেলে ঘৃণা করে।যাচ্ছেতাই বলে অপমান করেছে রঙ্গনাকে কেনো এখানে পড়ে আছে,মেয়েদের দিয়ে কেনো এসব পাপ কাজ করায় তারজন্য।
সবচেয়ে বড় কথা রঙ্গনা কারো কাছে স্বীকার না করলেও মনে মনে জানে এই ছেলের কথাবার্তা,চলনবলন,স্বভাব চরিত্র সবই রাজেন্দ্র নারায়ণ সিং এর বাবা নরেন্দ্র নারায়ণ সিং এর মতো। এজন্য কিছুটা ভয় পায় রঙ্গনা।
একজন দাসী বললো,”ছোট বাবু,ওই মেয়েটাই তো রঙ্গনা মাসিকে এভাবে আহত করে পালিয়েছেন গিয়েছে।”
কথাটা শুনে আনন্দে প্রলয়ের বুক ভরে গেলো। চিৎকার করে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হাসতে হাসতে বললো,”আমার বনলতাকে কেউ আটকাতে পারবে না,আমার বনলতা জিতবেই।”
রঙ্গনার কক্ষের বাহিরে দাঁড়িয়ে রাজেন্দ্র নারায়ণ সিং প্রলয়ের বলা কথাটা শুনলো।তারপর ভেতরে ঢুকে পেয়াদাদের আদেশ দিলো প্রলয়কে বন্দী করার জন্য।
গুরুগম্ভীর কণ্ঠের এই আদেশ শুনে সবাই চমকে গেলো শুধু প্রলয় ছাড়া। কিন্তু পেয়াদারা কেউ সাহস করে এগিয়ে এলো না। তারা জানে প্রলয়কে তারা ছোবার আগেই প্রলয় তাদের লাশ ফেলে দিবে।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে রাজেন্দ্র নারায়ণ নিজেই এগিয়ে এলেন।প্রলয়ের হাত থেকে তলোয়ার নিয়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন কয়েদখানার দিকে।
বাবাকে প্রলয় বাঁধা দিলো না।ঘরভর্তি মানুষের সামনে বাবা অপমানিত হোক তা সে চায় না।
একটা বন্দীশালার ভেতরে প্রলয় কে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিতেই প্রলয় বললো,”আমি চাইলে আপনার হাত থেকে ছুটে আসতে পারতাম,কিন্তু আপনার অসম্মান হবে সবার সামনে তাই চুপ করে থেকেছি।জেনে রাখুন,আমাকে এই বন্দীশালায় বন্দী করে রাখার ক্ষমতা কারো নেই।”
রাজেন্দ্র নারায়ণ হেসে বললো,”আমার শত্রুকে তুমি ভালোবাসো,তাকে আমার হাত থেকে রক্ষা করবে তুমি?
শুনে রাখো,আমি তা হতে দিবো না।ওই মেয়েকে আমি খুন করে ফেলবো।শত্রুকে বাঁচিয়ে রাখতে নেই,করুণা করতে নেই।তাতে তুমি বাঁধা দিলে তোমাকে খুন করতেও আমার হাত কাঁপবে না।”
প্রলয় হেসে বললো,”তা আমি জানি বাবা।নিজের জন্মদাতা পিতাকে যিনি হত্যা করতে পারে শুধুমাত্র জমিদারি আর বাগানবাড়িতে বেহায়াপনা করার সুযোগ পাবার জন্য তার পক্ষে সন্তানকে হত্যা করা আর কি ব্যাপার! ”
রাজেন্দ্র নারায়ণ চমকে উঠলেন। পুরো শরীর কেঁপে উঠলো তার থরথর করে। আজীবন যেই সত্য গোপন রেখেছেন তা কিভাবে জানলো প্রলয়!
একপ্রকার পালিয়ে গেলেন তিনি প্রলয়ের সামনে থেকে।
২৩.
প্রভাত মহলের বাহিরে এসে পাহারাদারদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো গেইট দিয়ে কেউ বের হয় নি।ফিরে এলো তাই প্রভাত আবারও মহলের ভেতরে। মহলের ভেতরে সব কক্ষ খুঁজলো।বনলতা মহলের ভেতরে এই খোঁজাখুঁজি দেখে সোজা প্রভাতের চেম্বারে ঢুকে গেলো। তারপর একটা আলমারির ভেতরে লুকিয়ে গেলো। প্রভাত নিজের চেম্বার বাদ দিয়ে সবখানে খুঁজলো।তারপর চন্দ্রমহলের পেছন দিকে গেলো। পাঁচিলের চারপাশ ধরে খুঁজতে খুঁজতে প্রভাত দেয়ালের ভাঙা অংশ খুঁজে পেলো।
বনলতার বুদ্ধি দেখে প্রভাত মুচকি হেসে বললো,”এই মেয়ে তো সবদিক দিয়েই পারদর্শী। ”
দেয়ালের ওপারে গিয়ে ভালো করে টর্চ মেরে খুঁজতে লাগলো।নদীর পাড় ধরে কিছুটা হাটতেই দেখতে পেলো নদীর পাড়ের একটা জাম গাছের সাথে একটা শিকল বেঁধে রাখা।
মুচকি হেসে প্রভাত মহলে ফিরে এলো।যা করার আগামীকাল সকালে করবে।
পরদিন ভোর হতেই প্রভাত পেয়াদা চারজন নিয়ে বের হলো নিজেদের বজরা নিয়ে। নদীতে যতোগুলো মাছ ধরার নৌকা আছে সবগুলোকে দাঁড় করিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজলো প্রভাত।সবাইকে জিজ্ঞেস করলো গতকাল বিকেল বেলায় কোনো মহিলাকে দেখেছে কিনা একা নৌকা চালিয়ে যেতে।
কয়েকজন কে জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলো গতকাল বিকেলে একজন মহিলা একা নৌকা চালিয়ে গিয়েছে।কিন্তু কোথায় গিয়েছে তা তারা জানে না।
প্রভাত আর কথা না বাড়িয়ে সামনে এগুলো।একজন পেয়াদা বললো,”বাবু সামনে হচ্ছে তাঁতীপাড়া। ”
প্রভাত হুকুম দিলো তাঁতীপাড়ার ঘাটে নৌকা ভিড়াতে।নৌকা ঘাটে ভিড়াতেই পাড়ার সব মানুষ ছুটে এলো।জমিদারের বজরা সবাই চেনে।সবাই অবাক হলো তাদের ঘাটে জমিদারের বজরা দেখে।
ঘাটে নেমে প্রভাত প্রথমেই জিজ্ঞেস করলো,”গতকাল আপনাদের পাড়ায় কোনো মহিলা এসেছে কি?
অচেনা মহিলা যাকে আপনারা আগে কখনো দেখেন নি?যে সত্যি বলবেন তাকে এক বছরের খাজনা মাফ করে দেওয়া হবে।”
গতকালের সেই মহিলা বললো,”তা বাবু এসেছে একজন,আমাদের রমনা বুড়ির বোনঝি এসেছে শুধু।এই যে ওই নৌকায় করে এসেছে।”
প্রভাত বললো, “কোথায় সে,আমাদের নিয়ে চলুন।”
সাথে সাথে উৎসাহী জনতা ছুটতে লাগলো।
দূর থেকে মানুষের হৈহল্লা শুনে স্বর্ণলতা চমকে উঠলো। রমনা বুড়িকে বলতেই বুড়ি বললো,”বিপদ চলে এসেছে মা,তুই আমার ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে যা।কারো গোয়াল পেলে সেখানে লুকিয়ে থাকিস।”
স্বর্ণলতা বের হয়ে গেলো পেছনের দরজা দিয়ে। একটু যেতেই তার মনে হলো তাকে না পেয়ে এরা যদি বুড়ির কোনো ক্ষতি করে ফেলে!
নিজেকে বাঁচাতে নিজের আশ্রয়দাতাকে কিভাবে বিপদে ফেলবে সে!
পা আর সামনে এগুলো না।ফিরে এলো স্বর্ণলতা আবারও। বাহিরে দাঁড়াতেই শুনতে পেলো বুড়ি কেঁদে কেঁদে বলছে,”আমার বোনঝি চন্দনা এসেছে বাবু,সে আবার আজ ভোররাতেই চলে গিয়েছে।স্বামীর ভিটে মাটি ছেড়ে মন টিকছে না তার এখানে।”
প্রভাত ধমক দিয়ে বললো,”সত্যি কথা বল বুড়ি,নয়তো এখানেই তোর গর্দান যাবে।ঘাটে আমরা তোর বোনঝিয়ের নৌকা দেখেছি।”
বুড়ি আবারও কেঁদে কেঁদে আগের কথা বলতেই প্রভাত পেয়াদাদের হুকুম দিলো বুড়ির ডান হাত কেটে দেয়ার জন্য।
স্বর্ণলতা আর নিজেকে আড়ালে রাখতে পারলো না।দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়িয়ে বললো,”ওনাকে ছেড়ে দে,আমি স্বর্ণলতা। ”
প্রভাত তাকালো ভালো করে স্বর্ণলতার দিকে।তারপর মুচকি হেসে বললো,”এজন্যই তো বলি বনলতা এতো রূপবতী হলো কিভাবে,আর আমার বাবা কেনো সুশান্ত সেনের স্ত্রীকে লুকিয়ে রেখে ভোগ করেছে।রূপের সমুদ্র দেখছি।”
স্বর্ণলতা জোর গলায় বললো,”আমাকে নিয়ে চলো,কিন্তু রমনা মাসিকে ছেড়ে দাও।”
প্রভাত হেসে বললো,”তাকে একেবারেই মুক্তি দিবো আমি।জমিদারের শত্রুকে যে আশ্রয় দেয় সেও শত্রু।”
এই বলে এক কোপে রমনার দেহ থেকে গর্দান আলাদা করে ফেললো।
পাড়ার সবাই চিৎকার করে ভয়ে পালিয়ে গেলো।স্বর্ণলতার দুই পা যেনো জমে পাথর হয়ে গেছে। কিছুতেই সে নড়তে পারছে না।মুহুর্তে কি হয়ে গেলো তার মাথায় ঢুকলো না।
চলবে…….
জাহান আরা