চন্দ্রমহল -১০
২৪.
বনলতা চন্দ্রমহলে এসেছে প্রলয়কে দেখার জন্য।না বুঝে সে প্রলয়কে আঘাত করেছে।এজন্য নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে তার বারবার। অনুশোচনা থেকে ছুটে এসেছে সে প্রলয়ের খোঁজ খবর নিতে।
কিন্তু প্রলয় কে পেলো না খুঁজে।
প্রলয়কে কোথাও খুঁজে না পেয়ে চুপিসারে বনলতা আবারও পুকুরের দিকে গেলো।মায়ের খোঁজ নিতে হবে তার।
ঝোপের ভেতর ঢুকতেই বনলতা চমকে গেলো। না কোথাও ভাঙা নেই দেয়ালের।দেয়াল আগের মতোই ঠিকঠাক করা।তাহলে কি হবে এখন?
বনলতা ভেবে পাচ্ছে না তার মা সত্যি পালাতে পেরেছে কি-না।
এক অজানা ভয়ে বনলতার গলা শুকিয়ে গেলো।
ঝোপ পেরিয়ে আরেকটু সামনে গেলে একটা মোটা আম গাছ আছে।এই গাছটাও বনলতা ডাল কেটে রেখেছে যাতে করে এই গাছ বেয়ে সে বের হতে পারে যদি কখনো দেয়াল সবার চোখে পড়ে যায়।বনলতা জানে দেয়ালের ভাঙা অংশ দেখলে কেউ আর ভাববে না বনলতা দ্বিতীয় একটা ব্যবস্থা ও করে রেখেছে।
আমগাছের আর কিছুটা পরে বনলতা দেয়ালের এপাশ ওপাশের মাটি খুঁড়ে গর্ত করে রেখেছে,যাতে করে দেয়ালের নিচের ফাঁকা জায়গা দিয়ে বের হয়ে যেতে পারে।সেই গর্তেও বনলতা ঝোপ লাগিয়ে রেখেছে।
দেয়ালের ভাঙা অংশ খুঁজে পাবার আনন্দে প্রভাতের আর মনে হলো না এরকম আরো অনেক রাস্তা থাকতে পারে।
আমগাছে উঠে বনলতা সহজেই ওপারে চলে গেলো। গিয়ে দেখে ঘাটে নৌকা বাঁধা নেই।তারমানে স্বর্ণলতা পালাতে পেরেছে।
কিন্তু তবুও বনলতার মনের খচখচানিটা গেলো না।কিছুক্ষণ বসে চিন্তা করতে করতে শুনতে পেলো দূর থেকে প্রভাতের গান ভেসে আসছে।
সতর্ক হয়ে বনলতা নদীর পাড়ের কাশফুল গাছের ভেতর গা ঢাকা দিলো।
প্রভাত মাঝিদের বলছে,”বাগানবাড়ির ঘাটে যাবি,মহলের ঘাটে না।বাবার শিকার আমি বাবার হাতে তুলে দিবো।বাবা নিশ্চয় ভীষণ খুশি হবে।আমাকে জমিদারি রক্ষার যোগ্য উত্তরসূরী ভেবে আমার হাতে জমিদারি তুলেও দিতে পারে।”
মুহুর্তে সবকিছু বনলতার কাছে জলের ন্যায় পরিস্কার হয়ে গেলো। সেই সাথে তার মনে হলো সে বুঝি সুশান্ত সেনের যোগ্য কন্যা হয়ে উঠতে পারে নি।
নিজের মা’কে রক্ষা করতে পারলো না সে।নিজেকে জীবন যুদ্ধে পরাজিত মনে হলো এক মুহুর্তের জন্য বনলতার।
খোলা আকাশের নিচে,তপ্ত রোদে মাটিতে শুয়ে বনলতা চোখের জল বিসর্জন দিলো।পরমুহূর্তে বনলতার মনে হলো,কেনো এভাবে নিজেকে সে দুর্বল ভাবছে?
তার এখনো অনেক কিছু করার আছে।সে চাইলে সব পারবে।এভাবে কেনো হার মেনে নিবে সে?
দরকার হলে লড়াই করে মরবে,ভীতুর মতো চোখের জল বিসর্জন দিবে না আর।
শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠে বসলো। তারপর দুই হাতে মাথা চেপে ধরে ভাবতে লাগলো কিছু একটা।
সবশেষে বনলতার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।এবার বনলতা তার তৃতীয় পথে প্রবেশ করলো জমিদার বাড়ির সীমানায়। তারপর আগের মতো চুপিচুপি অপেক্ষা করতে লাগলো সন্ধ্যা হবার।
জংলায় বসে অপেক্ষা করতে করতে অসংখ্য মশার কামড় খেলো বনলতা। ঝোপের ভেতর থেকে একটা সাপ বের হয়ে এলো,বনলতা চুপ করে বসে রইলো।কিছুক্ষণ থেকে সাপটা আবারও পালিয়ে গেলো।
অপেক্ষার সময় দীর্ঘ হয় বনলতা জানে,তাই বিরক্ত না হয়ে নিজের প্ল্যান ১ আর প্ল্যান ২ নিয়ে ভাবতে লাগলো। ভাবতে ভাবতে কখন সন্ধ্যা নেমে এলো টের পেলো না বনলতা।
হুঁশ হতেই পা টিপে টিপে আবারও মহলের ভেতরে গেলো।তারপর সিড়ি বেয়ে উঠে গেলো প্রভাতের চেম্বারে। চেম্বার থেকে নিজের প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র নিলো বনলতা। একটা ছোট পলিথিনে ঢুকিয়ে সেসব নিজের ব্লাউজের ভেতর ঢুকিয়ে রাখলো।
তারপর আর লুকোচুরি নয়,সোজা বের হলো। বনলতাকে দেখতেই পেয়াদারা তেড়ে এলো বনলতার দিকে।চারপাশ থেকে ঘেরাও দিয়ে ফেললো সবাই মিলে।তারপর বাগানবাড়িতে নিয়ে চললো।
২৫.
রাজেন্দ্র নারায়ণের মুখোমুখি চেয়ারে বসে আছে স্বর্ণলতা। রাজেন্দ্র নারায়ণের মুখ হাসিহাসি। তার আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে আবার।একটা সুগন্ধি পান মুখে দিয়ে রাজেন্দ্র নারায়ণ বললো,”তা লতাজি,বলুন পেরেছেন আপনি আমার হাত থেকে বাঁচাতে?
আপনার মেয়ে কি পেরেছে আপনাকে আমার হাত থেকে রক্ষা করতে বলুন?
কেনো এই মিছে লুকোচুরি খেললেন আমার সাথে আপনি?
রাজেন্দ্র নারায়ণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া এতোই সহজ ভেবেছেন আপনি? ”
বলেই স্বর্ণলতার বাম গালে সপাটে একটা চড় বসালো।মুহুর্তে রক্তাভ হয়ে গেলো ফর্সা গালখানা।ভয় পেলো না স্বর্ণলতা। এমনিতেই রমনা মাসির মৃত্যু দেখে সে অনেক বড় আঘাত পেয়েছে। নিজেকে তার অপরাধী মনে হচ্ছে। রাজেন্দ্র নারায়ণের কোনো কথা তাই তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো না।
রাজেন্দ্র নারায়ণ স্বর্ণলতার মাথার চুলের মুঠি চেপে ধরে বললো,”তুই কি ভেবেছিলি এত্য সহজে তোকে আমি ছাড়বো?
না ছাড়বো না।তোর মেয়েকেও ছাড়বো না।তোদের মা মেয়েকে নিয়ে একসাথে আমি ফুলসজ্জা করবো।সুশান্ত সেনের বংশকে আমি নির্বংশ করে দিবো।আমার ভুল হয়েছে সেই ১৬ বছর আগেই।
সেদিন যদি ওই মেয়েকে শেষ করে দিতাম তবে আজ আমার এতো বড় শত্রু জন্ম নিতো না।সেদিন ভুল করেছি এবার আর ভুল হবে না।তোর চোখের সামনে তোর মেয়েকে আমি খুন করবো।একবার শুধু হাতে পাই আমি।”
স্বর্ণলতা হাসলো।তারপর বললো,”আমার মেয়েকে তুই কিছুতেই খুঁজে পাবি না।আর যদি পেয়েও থাকিস তবে মনে রাখিস সেদিন নিজের যমদূতকে তুই নিজেই ঘরে ডেকে এনেছিস।তারপর এই পৃথিবীর আলো-বাতাস তোর জন্য আর বেশি দিন থাকবে না।”
রাজেন্দ্র নারায়ণ জানোয়ারের মতো হাসলো।হেসে বললো,”তোর মেয়ের পেয়ারের পুরুষ,নিজের মা আমার কাছে বন্দী। সেই সাহস তোর মেয়ের হবে না আমার সাথে লড়ার এখানে।”
স্বর্ণলতা অবাক হলো। বনলতা কাউকে ভালোবাসে!
কাকে ভালোবাসে বনলতা!
রাজেন্দ্র নারায়ণ একজন পেয়াদাকে বললো,”প্রলয়ের পরের কক্ষে একে আটকে রাখ।ইংরেজ বাবুরা আসবে যেদিন সেদিন বের করবি একে।”
কথামতো একজন স্বর্ণলতাকে নিয়ে গেলো। ভেতরে বসে স্বর্ণলতা মনেপ্রাণে প্রার্থনা করতে লাগলো যাতে করে বনলতা আর না আসে।মেয়েটা যেনো পালিয়ে যায় অনেক দূরে।তার যেনো কোনো ক্ষতি না হয়।
পেয়াদারা চলে যেতেই প্রলয় বললো,”শুনছেন আপনি? ”
স্বর্ণলতা জবাব দিলো,”আমাকে বলছেন?”
“হ্যাঁ আপনাকে বলছি,আপনি বনলতার মা না?”
“হ্যাঁ আমি বনলতার মা।আপনি কে?”
“আমি প্রলয়,জমিদার রাজেন্দ্র নারায়ণ সিং এর কনিষ্ঠ পুত্র আমি।”
স্বর্ণলতা অবাক হলো শুনে,তারপর বললো,”আপনি কি সেই যাকে আমার বনলতা ভালোবাসে বলেছে রাজেন্দ্র নারায়ণ? ”
প্রলয় করুণ হেসে বললো,”না মাসি,আমার ভালোবাসা এক পাক্ষিক।বনলতা তো আমাকে ঘৃণা করে।তবে আমি তাকে ভালোবাসি। নিজের প্রাণের চাইতে বেশি ভালোবাসি বলেই আজকে আমাকেও বন্দী করে রেখেছে বাবা।”
স্বর্ণলতা একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো,”অপাত্রে ভালোবাসা দিতে নেই বাবা,বনলতার ভালোবাসা তুমি পাবে না।তুমি জমিদার পুত্র,অন্য এক জমিদার কন্যা স্ত্রী হবে তোমার। বনলতা তো মরিচীকা বাবা।”
“মাসি,জমিদার বংশকে কেনো এতো ঘৃণা করে বনলতা আমাকে একটু বলবেন।তাহলে আমি নিজেকে সংশোধন করে নিবো।তবুও আমাকে বলবেন না বনলতা কে ভুলে যেতে।”
স্বর্ণলতা হেসে বললো,”১৬ বছর আগে যা ঘটেছে তা আজ ১৬ বছর পর কিভাবে শোধরাবে তুমি,প্রতিদিন আমি তোমার বাবার লালসার,ভোগের শিকার হয়েছি,সেই যন্ত্রণা তুমি ভুলিয়ে দিতে পারবে?
সেই দুঃসহ স্মৃতিকে তুমি ভুলিয়ে দিতে পারবে বাবা?
সুশান্ত সেনের বংশকে তোমার বাবা শেষ করে দিয়েছে পারবে তাদের ফিরিয়ে দিতে?”
প্রলয় কাঁপাকাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,”কী হয়েছিলো সেদিন? ”
“সেসব এক ইতিহাস বাবা,পুরনো সে ঘা কিছুটা শুকিয়েছে।সেসব মনে করিয়ে দিও না।সেই ঘা আবারও তাজা হয়ে যাবে।চোখের সামনে আমার সোনার সংসার জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। ”
“আমাকে জানতে দিন মাসি,আমি সব সত্যি জানতে চাই।আমার হৃদয়ের ব্যাকুলতা দেখেও বনলতা আমার দিকে তাকায় ঘৃণার দৃষ্টিতে। সেই আঘাতে আমার কলিজা ছিড়ে যায় মাসি।”
স্বর্ণলতা একটু চুপ থেকে বললো,”বেশ,আমি তোমাকে সব বলবো।রাতে সবাই ঘুমানোর পর তোমাকে আমি সব জানাবো।”
২৬.
বনলতাকে বেশ কয়েকজন পেয়াদা মিলে ধরে এনেছে।যদিও সবাই আতঙ্কে ছিলো কখন বনলতা তাদের উপর আক্রমণ করে বসে।কিন্তু বনলতা স্থির হয়ে ছিলো।
রাজেন্দ্র নারায়ণ বনলতা কে বন্দী অবস্থায় দেখে গলা ফাটিয়ে হাসলেন।চিৎকার করে বললেন,”দেখো সবাই,আমার শত্রু আবারও ধরা পড়েছে আমার জালে।এবার তাকে কে বাঁচাবে আমি ও দেখবো!
প্রলয় বাঁচাবে?সেতো আগেই বন্দী হয়ে আছে।স্বর্ণলতা?
সে-ও তো বন্দী।
এই কে আছিস,একে নিয়ে যা।প্রলয়ের কক্ষ বরাবর সামনের কক্ষে একে আটকে রাখ।এই চার-পাঁচ দিনে আমার ছেলে মন ভরে দেখে নিক নিজের ভালোবাসার মানুষকে। তারপর তো এ হয়ে যাবে বাজারের মেয়ে।”
তারপর হেসে উঠলো রাজেন্দ্র নারায়ণ আবারও আগের মতো।
বনলতাকে পেয়াদারা নিয়ে বন্দী করে রাখলো আবারও।
মায়ের দিকে তাকিয়ে বনলতা হাসলো,স্বর্ণলতা কেঁদে দিয়ে বললো,”কেনো ধরা দিলি তুই?”
বনলতা হেসে বললো,”আমার মাকে বাঁচাতে তো আমাকে আসতেই হতো মা।সে যতো কঠিন কারাগার হোক,আমার মা’কে আমি বন্দী থেকে মুক্ত করে নিয়েই যাবো।”
প্রলয় বললো,”আমাকে নিবে না বনলতা?”
ক্রুদ্ধ স্বরে বনলতা বললো,”আপনি আমার কেউ না।আপনার চিন্তা করার জন্য আপনার বাবা মা আছেন।আমার মায়ের আমি ছাড়া কেউ নেই।আপনি বাঁচেন কি মরেন তাতে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।”
চলবে…….?
জাহান আরা।
আগামী পর্বে পূর্বের সব রহস্য প্রকাশ পাবে।কেনো বনলতা জমিদারের রক্তকে ঘৃণা করে সব জানতে পারবেন।