#মালা_করনু_তারে_দান,পর্বঃ২৪ শেষ
অরিত্রিকা আহানা
“অসৎ লোকদের তাদের মতন করে শিক্ষা হয়। নইলে তাঁরা বুঝবে না। তাদের কাছে নীতিবাক্যের কোন দাম নেই। তোফায়েল সিনহা মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে বিনিকে ফাঁসিয়েছে। তাই আমরা তাঁর ভাষাতেই তাঁকে শিক্ষা দেবো। তোমার কাজ হচ্ছে সাক্ষী জোগাড় করা। ফলস উইটনেস। যে আমাদের হয়ে তোফায়েল সিনহার বিরুদ্ধে কোর্টে সাক্ষী দেবে। টাকা পয়সা যা লাগবে আমাকে বলো। আমি চেক লিখে দেবো।’
সহকারী তৌহিদাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বললো ইফরান। তৌহিদার মুখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠলো। এত দিনে তোফায়েল সিনহাকে ভালো মতন শিক্ষা দেওয়ার একটা উপায় পাওয়া গেছে। জালিয়াতির মামলায় কম করে হলেও পাঁছ ছয় বছর জেল হবে শয়তানটার। উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে প্রশ্ন করে বসলো সে,
—‘গ্রেট আইডিয়া। আপনি এই বুদ্ধি পেলেন কোথায় স্যার?’
ইফরানও মুখ ফস্কে বলে ফেললো,’বিনি দিয়েছে।’
তৌহিদার মুখে হাসির গাঢ়তর হলো। কিঞ্চিৎ গর্ব বোধ করলো বিনির প্রতি। হেসে উঠে বললো,
—‘এইজন্যই ম্যামকে এত জোস লাগে! কোন ভনিতা নেই। ডিরেক্ট অ্যাকশন। হোয়াট অ্যান অ্যামেজিং অ’রা! রিয়েলি আই জাস্ট লাভ হার।’
ইফরান ফাইল থেকে মুখ তুলে তৌহিদার দিকে চাইলো। তৌহিদার মুখে হাসি। ইফরানের চোখে চোখ পড়তেই বিব্রত হলো। বিনয়ী গলায় বললো,
—‘সরি স্যার। অনেক বেশি এক্সাইটেড হয়ে পড়েছিলাম।’
—‘ইট’স ওকে। এবার যান। যেই কাজ দেওয়া হয়েছে সেটা করুন।
—‘জি স্যার।’
কাগজ পত্র নিয়ে বেরিয়ে গেলো তৌহিদা। সে চলে গেলে ইফরান আয়েশি ভঙ্গিতে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো। বলা বাহুল্য তৌহিদার কথাতে খুশিই হয়েছে সে। নিজের অজান্তেই মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। অফিসে, বাড়িতে বিনির ভক্ত কূলের অভাব নেই। লোকজন তাঁকে ভয় পায় আবার পছন্দও করে। কি অদ্ভুত ব্যাপার! ইফরান হাসলো। সবাই তাঁর বউটাকে এত পছন্দ করে ভাবতেই মনে মনে প্রশান্তি অনুভব করলো।
★
রাতের বেলা খাবার দাবার শেষে খাটের ওপর লম্বা হয়ে শুয়েছিলো ইফরান। বিনির ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছিলো। চুল সরে গিয়ে উন্মুক্ত পৃষ্ঠদেশ দেখা যাচ্ছে। ইফরান প্রথমে খেয়াল করে নি। পাশ ফিরে শুতে গিয়ে নজরে পড়লো। কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো সে। দ্রুত অন্যপাশে ফিরে গেলো যাতে বিনিকে দেখা না যায়। কিন্তু বেশিক্ষণ সংযম ধরে রাখতে পারলো না। নেত্রযুগল বারবার বিনির মোহনীয় দেহাবয়বে গিয়েই স্থাপিত হলো। পাশ ফেরার বাহানায় ঘনঘন চাইলো বিনির দিকে।
এদিকে বিনি আয়নার ভেতর দিয়ে সবই দেখছে। ভীষণ মজা লাগছে তাঁর। ইফরানকে জ্বালাতন করতে পেরে মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ বোধ করছে। অসভ্যটা বউয়ের সামনে নিজেকে সাধু প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। বিনি যেন জানে না সে কেমন।
উঠে গিয়ে ইফরানের সামনে বসলো সে। হাত দিয়ে পিঠের ওপর থেকে চুল সরিয়ে নিয়ে বললো,
—‘লকেটটা খুলে দাও তো। বারবার চুলের সাথে আটকে যায়। ব্যথা পাই।’
ধবধবে ফর্সা পিঠ ইফরানের সামনে উন্মুক্ত। ইফরান বোকার মতন চেয়ে রইলো বিনির মুখের দিকে। মাথা ঝিমঝিম করছে তাঁর। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে তাঁর। পরিস্থিতি বোধগম্য হচ্ছে না। দূর থেকেই তো ভালো ছিলো। কাছে এসে এভাবে প্রভোক করার মানেটা কি? বিনি কি তাঁর ধৈর্য শক্তির পরীক্ষা নিচ্ছে? নাকি ভূতে ধরেছে বিনিকে? এমন করছে কেন সে?
কম্পমান হাতে বিনির লকেট খুলে দেওয়ার চেষ্টা চালালো সে। কিন্তু লকেট খুললো না। শক্তভাবে আটকে রইলো।
বিনি দাঁত দিয়ে কামড়ে খুলে দেওয়ার পরামর্শ দিলো। ইফরান তব্দা খেয়ে বসে রইলো। বিনির কথাবার্তা, কার্যকলাপ সব মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে তাঁর। কিছু তো একটা গণ্ডগোল আছে।
তাঁকে বসে থাকতে দেখে বিনি উঠে যাওয়ার উদ্যোগ করলো। নিজেই লকেটটা সামনে ঘুরিয়ে দাঁত দিয়ে কামড়ে খুলে নিলো। ইফরান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো বিনির দিকে। বিনি হাসছে ঠিকই। কিন্তু কোথাও যেন একটা আড়ষ্টতা কাজ করছে তাঁর মাঝে। কি হতে পারে বিনির এই আড়ষ্টতার কারণ? কেন বিনি নিজেকে এতটা পরিবর্তন করার চেষ্টা চালাচ্ছে? আকাশ পাতাল ভেবেও এই প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করতে পারলো না ইফরান।
বিনি উঠে যেতে চাইলে চট করে তাঁর হাত চেপে ধরলো। সন্দিগ্ধ কন্ঠে জানতে চাইলো,
—‘কি হয়েছে তোমার? এমন করছো কেন?’
বিনি স্বাভাবিক ভাবে হাসার চেষ্টা করলো। বললো,
—‘কি আবার হবে। দুষ্টুমি করছিলাম তোমার সঙ্গে।’
—‘কিন্তু তুমি তো এমন দুষ্টুমি করো না? মানে আগে কখনো দেখি নি।’
—‘আগে করিনি বলে এখনো করা যাবে না? ঠিক আছে আর করবো না। এবার ছাড়ো।’
—‘তোমার কাছে আমি জাস্ট সত্যিটা জানতে চাইছি।’
ইফরানের কন্ঠে ভরপুর সন্দেহ। হঠাৎ মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো বিনির। সজল হয়ে উঠলো চোখজোড়া। ইফরানের ধরে রাখা হাতের দিকে চেয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
—‘বললাম তো কিছু হয় নি। হাত ছাড়ো।’
হাত ছেড়ে দিলো ইফরান। বিনি কখনো মনের কথা তাঁর কাছে প্রকাশ করে না। আজও করবে না। জোরাজুরি করে লাভ নেই। ইফরানকে এখনো সে নিজের যোগ্য বলে মনে করে নি। নইলে মনের কথা ঠিকই খুলে বলতো। চুপচাপ বিছানায় থম মেরে বসে রইলো ইফরান।
বিনি পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করলো। কিন্তু ইফরান তা হতে দিলো না। নিচের দিকে তাকিয়ে থমথমে গলায় বললো,
—‘আমি জানি আমি অযোগ্য। কিন্তু তাই বলে কি একটুও বিশ্বাস করা যায় না? উপকার করতে না পারি ক্ষতি তো করবো না।’
বিনির দৃষ্টি ছলছল। নিজের দুঃখের কথা মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারে না সে। তবে আজ আর চেপে রাখতে পারলো না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খানিকটা বলেই দিলো,
—‘অযোগ্য তুমি নও। অযোগ্য আমি। তোমাকে আকর্ষণ করার কোন ক্ষমতা আমার নেই।’
ইফরান চমকে উঠলো। বিস্ফোরিত নেত্রে বিনির মুখের দিকে চেয়ে রইলো সে। অবিশ্বাস্য গলায় বললো,
—‘এসব তুমি কি বলছো? নিজের সম্পর্কে এমন ধারণা তোমার হলো কি করে?’
—‘কেন হতে পারে না? এটা তো সত্যি কথা।’
ইফরানের গলার স্বর নরম হয়ে এলো। নতি স্বীকার করে বললো,
—‘কি হয়েছে তোমার? কেন এমন করছো? আমি কি কোন ভুল করেছি?’
—‘না তো। তুমি কেন ভুল করবে? আমি কি সেকথা বলেছি?’
থানা থেকে জামিনে বেরিয়ে আসার সময় সেদিন রাকার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো বিনির। ইফরান বিনিকে গাড়িতে তুলে দিয়ে অফিসে গিয়েছিলো জরুরী কাজ সারার জন্য। তাই তাঁর সঙ্গে দেখা হয় নি। বিনিকে দেখেই রাকা মাঝরাস্তায় গাড়ি থামানোর জন্য বারবার হাত নাড়িয়ে ইশারা করলো। বাধ্য হয়ে বিনি গাড়ি থামালো। তারপর থেকেই শুরু হলো রাকার নানারকম আজগুবি আলাপ। নিজের রাগ, জেদ, হতাশা ঠেকাতে একেরপর এক অশোভনীয় কথাবার্তা বলে বিনির মনকে বিক্ষিপ্ত করে দিলো এই আত্মভ্রষ্ট, অনধিকার চর্চাশীল মূর্খ তরুণী। বারবার করে বোঝাতে চাইলো বিনি নারী হিসেবে ব্যর্থ। স্বামীকের আকর্ষণ করার কোন ক্ষমতা তাঁর নেই। তাঁর জায়গায় অন্য কেউ থাকলে অনেক আগেই শুধরে যেতো ইফরান। ইত্যাদি নানা রকম কথাবার্তা।
মানব হৃদয় বড়ই বিচিত্র। অনেক সময় অনেক কঠিন কথা মানুষ সহজে হজম করে নিতে পারে আবার অনেক সহজ কথাও সহজভাবে মেনে নিতে পারে না। বিনি তাঁর ব্যতিক্রম নয়। এতদিন যাবত ইফরানের কাছ থেকে অবহেলা পেয়ে এসেছে সে। তাই হঠাৎ রাকার এমন অশ্লীল, নোংরা আক্রমণ হজম করে উঠতে পারলো না। আত্মবিস্মৃত হলো। ভুলে গেলো ইফরানের অনুতাপের কথা। মস্তিষ্ক জুড়ে উদয় হলো নানারকম অলীক চিন্তাভাবনার। এতগুলো দিন কত যত্নে ইফরান তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছে, কত মরিয়া হয়ে অপেক্ষা করেছে তাঁর চোখে পুরোনো স্নেহ ভালোবাসা ফিরে পাবার জন্য সব ভুলে গেলো বিনি। এখানেই রাকার সৌভাগ্য! নইলে তাঁর মতন লাইফলেস, ঈর্ষাপরায়ণ মেয়ের কি এত ক্ষমতা যে কথার দ্বারা বিনিকে জ্বালায়?
ইফরান নিজের ওপর বিতৃষ্ণা বোধ করলো। বিনি এমন হতাশাগ্রস্ত, দুর্বলচিত্ত আচরণের জন্য সে মনে মনে নিজেকে দায়ী করলো সে। তার উদাসীনতাই বিনিকে এই পরিস্থিতিতে এনে দাঁড় করিয়েছে। এতটা অসহায় করে দিয়েছে। হাটুমুড়ে বিনির সামনে বসে পড়লো। আর্দ্র সিক্ত কন্ঠে বললো,
—‘আমি হাতজোড় করে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। আমার ভুলের জন্য কেউ যদি তোমাকে অসম্মান করে থাকে তবে সে দায়ভার আমার। তারজন্য তুমি নিজেকে দোষ দিও না। দোহাই তোমার। তোমাকে এমনভাবে দেখতে আমার কষ্ট হচ্ছে।’
বিনির ঠোঁট কামড়ে কান্না চাপার বৃথা প্রয়াস চালালো। কিন্তু অসহায় তপ্ত অশ্রু বাধা মানলো না। বাধ ভেঙ্গে অঝোর ধারায় মাটিতে গড়িয়ে পড়লো। ইতোপূর্বে নিজের অসংলগ্ন আচরণের কথা ভেবে মনে মনে লজ্জিত হলো। তথাপি চট করে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারলো না। ইফরানের কাছে অসহায়ত্ব, অস্বস্তি ঠেকাতে তড়িঘড়ি করে বললো,
—‘সরি। আমি আসলে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম এই কয়দিন। তাই না চাইতেও অনেক ভুলভাল কাজ করে ফেলেছি। তোমাকে বিব্রত করার জন্য দুঃখিত।’
কথা শেষ করে বেরিয়ে যাচ্ছিলো বিনি। ইফরান চট করে তাঁর পথ অবরোধ করে বললো,
—‘আমি বিব্রত হই নি। আমি শুধু তোমাকে স্বাভাবিক দেখতে চাইছিলাম।’
—‘হয়েছি আমি স্বাভাবিক। এবার পথ ছাড়ো।’
—‘আমি তোমার সঙ্গে বসে কিছুক্ষণ গল্প করতে চাই। অনেক কথা বলার আছে তোমাকে আমার। ‘
বিনির বিশেষ হোলদোল হলো না। স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
—‘মায়ের ওষুধের কথা মনে করিয়ে দিতে হবে। মিনু ছাদে তালা দিয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করতে হবে। গ্যাসের চুলা বন্ধ করতে হবে। অনেক কাজ। দেখি ছাড়ো।’
অগত্যা সামনে থেকে সরে দাঁড়াতে হলো ইফরানকে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
—‘তুমি স্বাভাবিক থাকলেও কষ্ট পাই না থাকলেও কষ্ট পাই। স্বাভাবিক থাকলে পাত্তা দাও না। আর স্বাভাবিক না থাকলে আমি সহ্য করতে পারি না। কি যে একটা জ্বালার মধ্যে আছি!’
#মালা_করনু_তারে_দান
অরিত্রিকা আহানা
#অন্তিমপর্ব
বিনি নিচে নামতেই রাহেলা মির্জাকে দেখতে পেলো। মিনুকে দিয়ে সব কাজ গুছিয়ে পান চিবুচ্ছেন তিনি। বিনিকে দেখে মিষ্টি হেসে বললেন,
—‘ইফরান কোথায়?’
—‘ঘরে আছে।’
—‘ওর মতিগতি কিন্তু আমার ভালো ঠেকছে না। দুদিন ধরেই দেখছি কেমন অদ্ভুত অদ্ভুত, আচরণ করছে। আমি কিন্তু তোকে আগেই বলে রাখছি, ঐ ছেলে যাই বলুক না কেন তুই কিন্তু পায়ে ধরে মাফ না চাইলে ক্ষমা করবি না।’
বিনি হাসলো। শ্বাশুড়ি মায়ের পায়ের কাছে বসে বললো,
—‘পা জোড়া আপনার হলে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আমার স্বামীকে আমি অন্য কারো পা ছুঁতে দেবো না।’
বিনির লাজুক মুখপানে চেয়ে রাহেলা মির্জা সকৌতুকে হাসলেন। বউ শ্বাশুড়িতে বেশ একদফা খুঁনসুটি চললো। আঙুলের ডগায় পুত্রবধুর হাস্যরত মুখখানা তুলে ধরে গভীর স্নেহে চুমু খেলেন রাহেলা মির্জা। মিষ্টি হেসে বললেন,
—‘আমার কঠিন ছেলে এমনি এমনি তোর প্রেমে পড়ে নি। সে বুঝেছে তোকে হারালে তাঁর কূল নেই।’
বিনি হাসলো। শ্বাশুড়ি মায়ের সঙ্গে খুনসুটি শেষে সাড়ে বারোটায় ঘরে গেলো। ইফরান ঘুমিয়ে পড়েছে। বাতি নিভিয়ে নিঃশব্দে বিছানায় শুয়ে পড়লো বিনিও।
★
সকাল বেলা তাড়াতাড়ি অফিসের উদ্দেশ্যে বেরোলো ইফরান। জরুরি মিটিং আছে। কিন্তু দুপুর না গড়াতেই ফিরে এলো। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইলো। কারো সঙ্গে কোন কথা বললো না। রাহেলা মির্জা ভ্রু কুঁচকালেন।
বিনি হাতের কাজ গুছিয়ে উপরে গেলো। সামান্য ঠেলা দিতেই দরজা খুলে গেলো। খাটের ওপর থম মেরে বসে আছে ইফরান। তার সুকুমার মুখমন্ডল তমসাচ্ছন্ন। নেত্রযুগল অশ্রু পরিপূর্ণ। বিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—‘কি হয়েছে তোমার?’
ইফরান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করলো। টুপ করে একফোঁটা অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়লো বিনির হাতের ওপর। আর্দ্র সিক্ত কন্ঠে বললো,
—‘আমার জন্যই রাকা তোমাকে অতোগুলো কথা বলার সুযোগ পেয়েছে। নইলে এতবড় সাহস ওর কোনদিন হতো না। আমিই সবাইকে সুযোগ করে দিয়েছি।’
লতিফ মিয়ার কাছ থেকে রাকার কৃতকর্মের খবর জানতে পেরেছে ইফরান। সেদিন লতিফ মিয়াই বিনিকে নিয়ে বাসায় ফিরেছিলো। তাই সুযোগ পেয়ে ইফরানের কাছে সব বলে দিয়েছে।
ইফরান কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। তাঁর জন্যই বিনিকে এতটা অপমানিত, অপদস্থ হতে হয়েছে। বিনির সব অপমান, দুঃখ,কান্না সবকিছুর জন্য ইফরান দায়ী। তাঁর ভুলেই জন্য রাকার মতন মেয়ে বিনির দিকে আঙ্গুল তোলার সাহস পেয়েছে।
দুহাতে মুখ ঢেকে বিছানায় বসে পড়লো সে। তার চোখের পানি নিঃশব্দে মাটিতে পড়ছে। কিন্তু বুকের যন্ত্রণা হালকা হচ্ছে না। বিনি বিস্ফোরিত নয়নে ইফরানের পাশে গিয়ে বসলো। তাঁর চোখেও পানি। অসহায়ের, উদ্ভ্রান্তের মতন সামনের চেয়ে রইলো। রাকার সেদিনের কথাগুলো মনে পড়তেই কান্নার চোখ ভিজে উঠলো। সেদিনের অপমান বিনি ভোলে নি। ভুলে থাকার ভান করেছে কেবল। কিন্তু আজকে ইফরানের অসহায় চেহারা দেখে আবার সব মনে পড়ে গেছে।
ইফরান বিনি হাতদুখানা তুলে নিয়ে করুণ কন্ঠে বললো,
—‘আমাকে তুমি মাফ করে দাও। আমি অন্যায় করেছি তোমার সঙ্গে। যোগ্য মর্যাদা দিতে পারি নি।’
★
দুজনেই কাঁদছে। একে অপরের কাছে দুঃখ ভাগ করে নিতে পেরে কাঁদছে। অন্তর্যন্ত্রণায় কাহিল দুটো হৃদয় সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে কাঁদছে। এই কান্না যেন শেষ হবার নয়।
অনেকক্ষণ বাদে বিনি কান্না থামালো। চোখ মুছে একটা হাত রাখলো ইফরানের মাথার ওপর। সযত্নে তাঁর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
—‘কান্না থামাও। পুরুষ মানুষের এভাবে কাঁদতে নেই।’
ইফরানের কান্না থামলো না। বিনির হাত চেপে ধরে নিজের গালে ছুঁইয়ে সিক্ত কন্ঠে বললো,
—‘আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। আমি আর এই যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছি না।’
বিনির দৃষ্টি আটকে গেলো। কন্ঠে ঝরে পড়লো অকৃত্রিম মায়া। স্নেহজড়িত কন্ঠে বললো,
—‘কান্না থামাও। আমি তোমাকে সুখি দেখতে চাই।’
ইফরান জবাব দিলো না। বেশকিছুক্ষণ নিরবে বসে রইলো। তারপর বড় করে একটা নিশ্বাস ছাড়লো। হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে শান্ত কন্ঠে বললো,
—‘আমি সুখি। তোমাকে পেয়ে আমি ভীষণ সুখি।’
—‘তাহলে কান্না থামাও।’
—‘কাঁদছি না তো।’
বিব্রত মুখে সামান্য হাসার চেষ্টা করলো ইফরান। বিনির সামনে সে কাঁদছিলো ভাবতেই ঈষৎ লজ্জা বোধ করলো। বিনিও হাসলো। কিঞ্চিৎ ঠাট্টাসুরে বললো,
—‘মা বলেছিলেন কঠিন সাজা দিতে। আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু মায়ের ছেলে তো দেখি সাজা দেওয়ার আগেই কেঁদেকেটে এক অবস্থা করে ফেলেছে। দেশে পুরুষ জাতির মানসম্মান বলে তো আর কিছু রইলো না।’
বিনির ঠাট্টায় হাসতে পারলো না ইফরান। তাঁর ভেতরে তখনো তোলপাড় চলছে। সযত্নে আঁকড়ে ধরলো বিনির কোমর। মাথাটা ধীরে ধীরে তাঁর বুকের সঙ্গে লেপ্টে নিয়ে বললো,
—‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
বিনির হাসি প্রশস্ত হলো। আলতো স্পর্শে ইফরানের চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বললো,
—‘ভালোবাসো। তো?’
—‘ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি।’
—‘অনেক ভালোবাসো।’
ইফরানের মনের মধ্যে অদ্ভুত সব খেয়ালের উদয় হচ্ছে। বিনিকে এত কাছে পেয়ে এক অদ্ভুত, অদম্য, অপরাজেয় মাদকতা ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর শরীরে। ঘোর নেশায় ডুব দিতে মন চাইছে। উঠে গিয়ে দরজায় খিল দিলো সে। কাছে এসে শক্ত করে বিনিকে জড়িয়ে ধরলো।
বিলি গোলগোল চোখ করে বললো,
—‘দরজা বন্ধ করলে কেন? ছাড়ো আমাকে।’
ইফরান ছাড়লো না। ঠোঁটের কোনে অবাধ্য হাসি ফুটিয়ে বললো,
—‘দরজা খোলা রেখে আদর সোহাগ হয় না।’
প্রতিবাদ করার সময়টুকুও পেলো না বিনি। তীব্র আক্রমণে বিনিকে নিজের বাহুডোরে বন্দী করে নিলো ইফরান। ওষ্ঠাধরের নিবিড় নির্যাতনে নিষ্পেষিত করে দিলো বিনিকে। তাঁর শরীরের ভারে পিষ্ট হয়ে গেলো বিনি। ছাড়া পাওয়ার জন্য হাঁসফাঁস করে বললো,
—‘ছাড়ো আমাকে। দিনের বেলায় দরজা বন্ধ করেছো। সবাই কি ভাববে?’
—‘যার যা খুশি ভাবুক। আমার তাতে কিচ্ছু আসে যায় না।’
বিনি ছাড়ানোর চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলো। এই ছেলে কথা শুনবার নয়। কোনদিন শোনে নি আজও শুনবে না। অতএব আত্মসমর্পণ শ্রেয়। তাঁর আত্মসমর্পণে ধীরে ধীরে কোমল হলো ইফরান। নিজের সঙ্গে লেপ্টে নিলো বিনিকে।
আধবোজা চোখ মেলে চাইলো বিনি। তাঁরই মুখ পানে চেয়ে মিটিমিটি হাসছে ইফরান। আগ্নেয়গিরির সুপ্ত লাভা জ্বালিয়ে তাতে জল ঢালছে নরাধমটা। ইচ্ছা করেই যেন অনুমতির প্রসঙ্গ তুললো,
—‘অনুমতি না দিলে আর এগোবো না।’
নিজের উন্মত্ত,অস্থির চাহনি ইফরানের কাছ থেকে গোপন করতে না পেরে লজ্জায় আরক্তিম হয়ে গেলো বিনি। এমন পাপী, বর্বর সৃষ্টিকর্তা ভাগ্য করে তাঁর কপালেই জুটিয়েছেন! ঠেলে ইফরানকে সরিয়ে দিতে দিতে বললো,
—‘ছাড়ো আমাকে। আমার কাজ আছে।’
বিনির রাগ দেখে ইফরান হাসলো। তাঁর কানের কাছে মুখ নামিয়ে, সমস্ত শরীরে মৃদু কম্পন ধরিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বললো,
—‘জ্বলছে? এতদিন ঠিক এইভাবে জ্বলেছে আমার। রোজ রোজ আমার চোখদুটো অনেক অত্যাচার সহ্য করেছে।’ ফিসফিস করে বিনির কানেকানে কিছু বললো সে।
ধরণী দ্বিধা হোক! বিনি মাটিতে মিশে যাক, নতুবা এই লজ্জাহীন লজ্জা দিয়ে দিয়ে বিনিকে মেরে ফেলবে। বিনি মুখ লুকিয়ে বললো,
—‘নির্লজ্জ! বেশরম! আমি কবে পেট দেখিয়ে কাপড় মেলে দিয়েছি?’
—‘না দিলে তোমার পেটের লালদাগ আমি দেখলাম কি করে? কি করে কাটলো? কার সঙ্গে মারামারি করেছো?’
পরপর তিনটে প্রশ্ন করেছে ইফরান। বিনি জবাব দিলো না। ছোটবেলা গাছ থেকে পড়ে গিয়ে কেটেছে। কিন্তু সেকথা ইফরানকে জানাবে না। রাগে চোখ পাকিয়ে বললো,
—‘অসভ্য। লুকিয়ে লুকিয়ে এসব করেছো?’
—‘লুকিয়ে কোথায়? আমি তো খাটে বসেই দেখতাম।’
ইফরানের সহজ স্বীকারোক্তি। বিনি অবাক হলো। কৃত্রিম রাগে মুখ বাঁকালো। ফোড়ন কেটে বললো,
—‘খুব তো বলেছিলে আমি মহাপুরুষ। মহাপুরুষদের নাকি নিজের বউয়ের প্রতি আকর্ষণ থাকে না? এখন সব ফুড়ুৎ হয়ে গেলো?’
ইফরান আরেকটু নিবিড়ভাবে কাছে টেনে নিলো বিনিকে। গভীর স্নেহে চুমু খেলো বিনির কপালে। দুষ্টু হেসে বললো,
—‘বলেছিলাম নাকি? কই আমার তো মনে পড়ছে না?’
—‘আলবাত বলেছো।’
ইফরান মাথা নাড়িয়ে বললো,
—‘না। বলি নি।’
—‘অবশ্যই বলেছো।’
—‘ওটা মিথ্যে ছিলো।’
—‘মিথ্যে?’
বিনি ঠোঁট উল্টালো। ইফরান উপরে নিচে মাথা নাড়ালো। বললো,
—‘হ্যাঁ মিথ্যে। আর এখন আমি তোমাকে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যিটা বলবো।’
—‘কী সেটা?’
বিনি কপালে ফের চুমু খেলো ইফরান। মিষ্টি হেসে ফিসফিস করে বললো,
—‘আমি প্রতিমুহূর্তে, প্রতিসেকেন্ডে তোমার প্রতি ভীষণরকম ভাবে আকর্ষিত হই বিনি। দৈহিক এবং মানসিক, সব রকমভাবে।’
বিনি চোখ বন্ধ করে নিরবে শুনলো। ইফরান না থেমেই বললো,’আমার ব্যর্থতা হচ্ছে আমি সেটা অনেক দেরীতে বুঝতে পেরেছি।’
বিনি কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। লজ্জায় রাঙ্গা হলো মুখ। অস্বস্তি ঠেকাতে তাড়াতাড়ি করে বললো,
—‘হয়েছে ছাড়ো। কারো ব্যর্থতার গল্প শুনতে আমার ভালো লাগে না। আমি নিচে যাবো।’
ইফরান ছড়লো না। ঠোঁট কামড়ে দুষ্টু হেসে বললো,
—‘শত্রুর ঘাটিতে এসে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা বৃথা ম্যাডাম। তার চেয়ে বরং মিত্রতা করো।’
ইফরান ফের আক্রমণ চালালো। বিনি ছাড়িয়ে নেওয়া বৃথা চেষ্টা করলো না। কি লাভ চেষ্টা করে? ইফরান কি তাঁর কথা শুনবে?
না বিনি সত্যিই শোনাতে চায়?
আপন মনেই চুপিচুপি হেসে ফেললো বিনি। নির্লজ্জ সেও কম নয়।
★
ইফরান সামনের ড্রয়ার থেকে ছোট একটা লকেট বের করে বিনির গলায় পরিয়ে দিলো। ভালোমতোন সেটা পরখ করে নিয়ে বললো,
—‘নজরুল তাঁর গানের মালা অরুন্ধতীকে দান করেছিলেন। যে বিরহে তাঁর প্রেমের প্রদীপ জ্বালিয়েছিলো, অন্ধকারে আলো দেখিয়েছিল। আর আমি আমার ভালোবাসার মালা তোমায় গলায় পরিয়ে দিলাম। কারণ তোমাকে দান করার ক্ষমতা আমার নেই। তুমি নিজেই দাতা। আমাকে তোমার ভালোবাসা দিয়ে সিক্ত করেছো।’
নজরুলের গানের চরণগুলি ছিলো ,
“বিরহে যার প্রেমারতি,আঁধার লোকের অরুন্ধতি,
তার তরে এই গান, মালা করনু তারে দান।”
ইফরান যেন সমগ্র আন্তরে ধারণ করে বলেছে কথাগুলো। বিনি হাসলো। এই হাসি অন্যরকম। বললো,
—‘দানটাই তো মানুষ নিঃস্বার্থ ভাবে করে। তবে তুমি কেন আমাকে দান করতে পারবে না?’
—‘বেশ। তবে আমার হৃদয়টাই তোমার দানের বস্তু হোক।’
উপচে পড়া ভালোবাসা! বিনির সমস্ত হৃদয়কে সিক্ত করে দিয়েছে। আদুরে হেসে বললো,
—‘নজরুলের গান তুমি কবে থেকে শোনো?’
ইফরান দুদিকে মাথা নাড়ালো। স্মিত হেসে বললো,
—‘তোমাকে কয়েকদিন শুনতে দেখেছি। ভাবলাম তোমার প্রিয়। তাই মুখস্থ করেছি।’
বিনি মৃদু শব্দ করে হাসলো। বললো,
—‘ভাগ্যিস উচ্চাঙ্গসংগীত আমার প্রিয় নয়!’
শব্দ করে হেসে ফেললো দুজনে। ভালোবাসি হলো আরেকদফা…!
★
অনেকদিন বাদে ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে অফিসে এসেছে ইফরান। মামলায় জয়ী হওয়ার খুশিতে মালা দিয়ে তাঁকে বরণ করেছে স্টাফরা।
ইফরান টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গার্মেন্টস ডিজাইন দেখছিলো। বিনি দরজা সামান্য ফাঁক করে ভেতরে উঁকি দিলো। ভেতরে ঢোকার অনুমতি প্রার্থনা করে বললো,
—‘আসতে পারি?
ইফরান ফোন থেকে মুখ না তুলেই বললো,
—‘জি অবশ্যই আসতে পারেন।’
বিনি হাসলো। দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে বললো,
—‘কি দেখছো?’
—‘একটা মেয়েকে। ভাবছি এই ড্রেসগুলোতে তাঁকে কেমন দেখাবে।’
পাশেই কিছু মেয়েলি গার্মেন্টস। বিনি সেদিকে না তাকিয়ে পা উচুঁ করে ইফরানের ফোনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়ালো। উৎসুক গলায় বললো,
—‘কই দেখি?’
ইফরান সরে গেলো। ফোন হাতের পেছনে লুকিয়ে বললো,
—‘তোমাকে দেখানো যাবে না।’
বিনি চোখ রাঙালো। কঠিন ধমক দিয়ে বললো,
—‘কি দেখছিলে তুমি?’
—‘কিছু না। বললাম তো তোমাকে দেখানো যাবে না।’
—‘কেন দেখানো যাবে না? কি আছে এই ফোনে। আমি দেখতে চাই।’
অগত্যা ইফরানকে রাজী হলো। ফোনটা বিনির হাত ধরিয়ে দিয়ে বললো,
—‘বেশ। এতই যখন দেখার শখ হয়েছে তখন দেখো। পরে কিন্তু আবার আমাকে দোষ দিতে পারবে না।’
বিনি কৌতূহল দমন করতে না পেরে তৎক্ষণাৎ ফোনের স্ক্রিনে চাইলো। মুহূর্তেই লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলো তাঁর গোটা মুখমন্ডল। চোখ বড়বড় করে ফেললো।
ইফরান গালে হাত রেখে বসে আছে। নির্দোষ মুখোভঙ্গি করে বললো,
—‘আমি আগেই বলেছিলাম না দেখতে। তুমিই জোর করেছো।’
বিনি দ্রুত ফোনটা টেবিলে রেখে দিলো। যেন ফোনে ময়লা লেগে আছে। হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললো,
—‘এমন নির্লজ্জ, বদমাশ তুমি কবে থেকে হলে?’
—‘আমি?’
ইফরানের চোখেমুখে নিষ্পাপ ভাব। যেন কিচ্ছু জানে না। বিনিকে উদ্দেশ্য করে একটা গাত্রদাহী হাসি দিয়ে বললো,
—‘কি এমন আছে এই ছবিতে? জাস্ট একটা ..’
বলেই সে মুখ খুলতে নিলো। বিনি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুখ চেপে ধরে বললো,
—‘নির্লজ্জ। মেরে হাত পা ভেঙ্গে দেবো বলে দিলাম।’
—‘আমি এমনিতেই তোমার প্রেমে পড়ে আমি আধমরা হয়ে আছি বিনি। আমার হৃদয় নিয়ে তুমি অনেক খেলেছো ছিনিমিনি। এবার চট করে আমাকে জড়িয়ে ধরো।’
বিনি ছেড়ে দিলো। বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়ে বললো,
—‘থাকো তুমি। আমার কাজ আছে।’
—‘বেরিয়ে যাচ্ছো তো? তাহলে শুনে রাখো, রোজ একবার করে এই ছবি তোমাকে মেসেজে পাঠাবো। ফোনের ওয়ালপেপার সেট করে রাখবো। সবাইকে দেখাবো ইফরান তাঁর বউকে কীভাবে আ…।’
পুরো কথাটা শেষ করতে পারলো না সে। আবারো তাঁর মুখ চেপে ধরলো বিনি। ত্যাক্ত কন্ঠে বললো,
—‘অসভ্যতায় পিএইচডি করেছো তুমি।’
ইফরান জোরপূর্বক মুখ থেকে বিনির হাত ছাড়িয়ে নিলো। দুহাত দুদিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
—‘ফাস্ট। জলদি কর।’
বাধ্য হয়ে বিনি তাঁকে জড়িয়ে ধরলো। বিড়বিড় করে বললো,
—‘এবার ছবি ডিলিট করে দেবে।’
—‘এই ছবি ডিলিট হবে না। এই ছবি আলাদা আলাদা কপি করে আমার ল্যাপটপ মোবাইল সব জায়গায় রাখা হবে। প্রয়োজনে ওয়ালমেট বানিয়ে দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখবো। তবুও ডিলিট করবো না।’
—‘এমন কিন্তু কথা ছিলো না?’
—‘কি কথা ছিলো তাহলে? আমি কি একবারও বলেছি ছবি ডিলিট করবো?’
ইফরানের এমন পাগলামি মন্দ লাগছে না বিনির। ঠোঁট চেপে মৃদু হাসলো সে। ভালোবাসায় একটু আধটু পাগলামি না থাকলে চলে না। ইফরানের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
—‘রাকার সঙ্গে ঝগড়া করেছো কেন?’
রাকার প্রসঙ্গ উঠতেই মুখ বিকৃত করে নিলো ইফরান। বললো,
—‘আমি ঝগড়া করি নি। আমি শুধু ওকে বারণ করেছিলাম তোমার সঙ্গে ঝামেলা না করতে।’
—‘আচ্ছা? তাহলে তৌহিদা যে বললো রাকা কাঁদতে কাঁদতে অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে?’
ধরা খেয়ে ইফরান কাচুমাচু করলো। পাছে তাঁর ভালোবাসা বিনির কাছে ছেলেমানুষি কিংবা বাড়াবাড়ি মনে হয় এই ভেবে মনে মনে সংকুচিত হলো।
তাঁর বিব্রত মুখ পানে চেয়ে মিষ্টি করে হাসলো বিনি। নিজে থেকে ইফরানের বুকে মাথা রেখে তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—‘বেশ করেছো। আমার বর আমার হয়ে কথা বলবে না তো কি ঐ শাঁকচুন্নিটার হয়ে কথা বলবে! ভেবেছে কি সে নিজেকে।’
ইফরান সুযোগটা হাতছাড়া করলো না। আষ্টেপৃষ্ঠে নিজের সঙ্গে বেধে নিলো বিনিকে। ফিসফিস করে বললো,
—‘তুমি আবারো আমার হৃদয় নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে শুরু করে দিয়েছো বিনি। কান পেতে দেখো কত জোরে লাফাচ্ছে হৃদপিন্ডটা!’
বিনি কান পাতলো। সত্যি সত্যি লাফাচ্ছে হৃদপিন্ডটা। যেন বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। ইফরানের এত কাছে সে নিজেকে ছাড়া আর কাউকে আসতে দেবে না। বিনি তাঁকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যই আলতো করে কিল মারলো বুকে। বিজয়ীর ভঙ্গিতে মাথাটা ইফরানের বুকে স্থাপন করে বললো,
—‘সবে তো শুরু। এখনো অনেক বাকি…’
(সমাপ্ত)