মালা_করনু_তারে_দান,পর্ব-৮,৯

0
300

#মালা_করনু_তারে_দান,পর্ব-৮,৯
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব-৮

রাহেলা মির্জার সঙ্গে তাঁর ঘরে বসে গল্প করছিলো বিনি। তিনি আলমারি থেকে পুরোনো শাড়ি নামিয়ে বিনিকে দেখাচ্ছিলেন।
ইফরানের বাবা ছিলেন শৌখিন মানুষ। বউয়ের জন্য প্রচুর কেনাকাটা করতেন। গোটা আলমারি ভর্তি শাড়ি গয়না যত্ন করে রেখে দিয়েছেন রাহেলা মির্জা। পুত্রবধূর সঙ্গে পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বারবার আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ছিলেন।

বিনি কিছুটা সান্ত্বনা, কিছুটা আহ্লাদ, কিছুটা উচ্ছ্বাস নিয়ে দুষ্টুমিষ্টি খুনসুটিতে মেতে উঠলো শ্বাশুড়ি মায়ের সঙ্গে। রাহেলা মির্জা বাচ্চা মেয়েটার দুষ্টুমিতে বারবার লজ্জারাঙ্গা হয়ে যাচ্ছিলেন। বউ শ্বাশুড়িতে বেশ ভালোই জমে উঠেছিলো।

হঠাৎ গল্পগুজবের মাঝে রতনের চিৎকারের শুনে দুজনেই থমকে গেলেন। আওয়াজটা দোতলার সিঁড়িঘর থেকে আসছে। চিৎকার করে সারাবাড়ি মাথা তুলে ফেলেছে রতন।
রতন এই বাড়ির কাজের লোক। সাপ্তাহিক, মাসিক বাজার করার দায়িত্ব তাঁর। বয়স খুব বেশি নয়। আঠারো কি উনিশ হবে। বিনির সঙ্গে খুব ভাব। অল্প কদিনেই দুজনের ভীষণ সখ্যতা হয়ে গেছে। রতন ছোট ভাইয়ের মত স্নেহ করে বিনি।

কি হয়েছে সেটা দেখার জন্য দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরোলো বিনি। রাহেলা মির্জা ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে আলমারি বন্ধ করলেন। এমন চিৎকার চেঁচামেচির সঙ্গে তিনি পূর্বপরিচিত। ইফরান বাড়িতে থাকলে রোজই এমন কিছু না কিছু ঘটে।

দোতলায় বারান্দায় পা রাখতেই বিনির চোখেমুখে একরাশ বিরক্তি, রাগ, ক্ষোভ ফুটে উঠলো। ইফরান দোতলার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে রতনকে মারছে।

রতনের অপরাধ সে সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় ইফরানের হাতের ওপর গরম চা ফেলে দিয়েছে। ইফরান তখন রেডি হয়ে বাইরে বেরোচ্ছিলো। হাতের গরম চা ছিঁটকে কিছু জামাকাপড়েও পড়লো। তৎক্ষণাৎ কষে চড় লাগালো রতনের গালে। চড় দিয়েও ক্ষ্যান্ত হলো না। কাল রাত থেকেই কোন এক অজ্ঞাত কারণে তাঁর মেজাজ খারাপ। সেই ঝাল সমস্তটা একেবারে রতনের ওপর ঝাড়লো।

বিনি দৌঁড়ে গিয়ে তার হাত চেপে ধরলো। ভৃত্যরা সকলে আতংকে চোখ বড়বড় করে ফেললো। এই বাড়িতে ইফরানের হাত ধরে এমন সাহস কারো নেই।ইফরানকে তাঁরা ভীষণ ভয় পায়। তাই বিনির দুরবস্থার কথা ভেবে মনে মনে উদ্বেগ বোধ করলো। এবার নিশ্চয়ই বিনির গায়েও হাত তুলবে ইফরান! তেমন হলে চাকরবাকরদের সামনে ভয়ানক লজ্জায় পড়বে তাঁদের ছোটমা!

কিন্তু তেমন কিছুই ঘটলো না। উল্টে বিনি বাচ্চা ছেলেদের মতন হাত ধরে টেনে ইফরানকে ঘরে নিয়ে এলো। হতবুদ্ধি ইফরান বাধ্য ছেলের মত বিনির পেছন পেছন এলো। কিন্তু ঘরে ঢুকেই তাঁর রাগ বেড়ে গেলো। ক্ষোভ মিশ্রিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
—‘এটা কি হলো?’
—‘শুধু শুধু চাকরবাকরদের গায়ে হাত তুলবে কেন?’
—‘সেই কৈফিয়ত কি তোমাকে দেবো?’
—‘অবশ্যই দেবে। না দিলে বাইরে যেতে দেবো না।’

জবাবে ইফরান রক্তচক্ষু নিয়ে বিনির দিকে তাকালো। বিনি তাতে গা না করে বললো,
—‘বিয়ে করেছো অথচ বউ মানবে না তা কি করে হয়? আমি তোমার বউ এই কথাটা না চাইলেও তোমাকে মানতে হবে। ‘

ইফরান শার্টের হাতা গোটালো। বিনির দিকে সামান্য ঝুঁকে ঠোঁট খিঁচে বললো,
—‘আমার সঙ্গে একদম গলাবাজি করবে না। গলা নামিয়ে কথা বলবে। চুপ করে আছি বলে ভেবো না, তোমার সব কথা আমি মেনে নেবো।’

বিনি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু ইফরানের হাতের দিকে নজর পড়তেই থমকে গেলো। পোড়া জায়গাটা লাল হয়ে ইতোমধ্যে ফোস্কা পড়ে গেছে। ফর্সা চামড়ায় দাগ অনেক বেশি বোঝা যাচ্ছে। তাঁর হঠাৎ চুপ করে যাওয়াতে কপালে ভাঁজ পড়লো ইফরানের।
বিনির দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের হাতের দিকে চাইলো সে। হাত ভয়ানক জ্বালাপোড়া করছে। এতক্ষণ রাগের কারণে অনুভব করতে পারে নি। কিন্তু এখন এই হাতের দিকে তাকিয়ে রতনকে আরেকদফা উদুম কেলাতে মন চাইছে। গলা চড়িয়ে মিনুকে ডাক দিলো সে।

সঙ্গে সঙ্গে মিনু বরফ নিয়ে হাজির। রাহেলা মির্জাও এসেছেন। ছেলের হাতের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলেন। যতই রাগ অভিমান থাকুক না কেন রাহেলা মির্জার প্রাণপাখিটা ইফরানের ভেতর। এই ছেলেটা ছাড়া তিনি কিচ্ছু বোঝেন না। সমস্ত পৃথিবী একদিকে আর ইফরান একদিকে।

মিনুর হাত থেকে বরফ নিয়ে জোরপূর্বক ইফরানকে খাটে বসালেন। সযত্নে পোড়া জায়গায় বরফ লাগিয়ে দিলেন। ইফরান মুখ গোমড়া করে বসে রইলো। রাহেলা মির্জা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে স্নেহের সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
—‘বেশি জ্বালা করছে?’
—‘না।’

ইফরানের গলাটা কাটকাট শোনালো। বিনি একদৃষ্টিতে শ্বাশুড়ি মায়ের উদ্বিগ্ন মুখখানার দিকে চেয়ে রইলো। ভদ্রমহিলা ছেলে অন্তঃপ্রাণ। রাগ করুক আর যাই করুক ইফরানই তাঁর কাছে সব। আর ঠিক সেইজন্যই ইফরান অতিরিক্ত আদর পেয়ে বখে গেছে। মায়ের ভালোবাসা, স্নেহ এসবকে কাজে লাগিয়ে যা খুশি তাই করে বেড়াচ্ছে সে।

বরফ লাগানো শেষে রাহেলা মির্জা মিনুকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় বিনিকে ইশারায় বাকি বরফটুকু লাগিয়ে দিতে বললেন।
তিনি বেরিয়ে গেলে বিনি বিড়বিড় করে বললো,
—‘আলালের ঘরের দুলাল। সামান্য একটু চা পড়েছে তাতেই চিৎকার করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছে।’

বস্তুত নিজের ভেতরের আবেগ,উৎকণ্ঠা এগুলো ইফরানের কাছে প্রকাশ করতে চায় না বিনি। যে মানুষ তাঁকে ভালোবাসে না তারপ্রতি ভালোবাসা দেখানো বোকামি। ইফরানের কাছে ভালোবাসার কোন মূল্য নেই। বিনির আবেগ সে বুঝবে না। তাই তাঁর কাছে কখনো নিজেকে প্রকাশ হতে দেবে না বিনি।

ইফরান রাগে বরফের বাটিটা টেবিলের ওপর থেকে হাত দিয়ে ঠেলে ফেলে দিলো। গটগট করে বেরিয়ে যেতে নিলে বিনি সামনে দাঁড়িয়ে পথ অবরোধ করলো। ইশারায় ভেজা শার্টটা দেখিয়ে বোঝালো চেইঞ্জ করতে হবে। শার্টে চায়ের দাগ বসে গেছে।

ইফরান নির্লিপ্ত। যেন বিনি কি বলছে শুনতেই পায় নি। এবার বিনি নিজে তাঁর শার্টের বোতাম খোলার জন্য হাত বাড়ালো।
চট করে হাতটা ধরে ফেললো ইফরান। বিস্ফোরিত নেত্রে বিনির দিকে তাকালো। বিনি অবিচল! যেন এই অধিকার তাঁর বহুকাল পূর্বে লব্ধ!
শেষমেশ নিজেই শার্টটা খুলে বিনির হাতে দিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো ইফরান।

বিনি মিনুকে ডেকে দাগওয়ালা শার্টটা ধুতে পাঠিয়ে দিলো। খাটের ওপর বসে পা দোলাতে দোলাতে বললো,
—‘একটা দরকারি কথা বলার ছিলো।’
ইচ্ছে করে গলা চড়িয়ে বললো যাতে ইফরান শুনতে পায়। কিন্তু বলার সময় অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলো।

ইফরান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছে। বিনির কথায় কোন ভাবান্তর হলো না। আলমারি থেকে নতুব একটা ইস্ত্রী করা শার্ট বের করে সেটা গায়ে জড়িয়ে নিলো। বিনি আড়চোখে একবার তাকিয়ে ফের গলা চড়িয়ে বললো,
—‘খুব দরকারি।’
ইফরান ভ্রু কুঁচকালো। ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
—‘বকতে থাকো!’
তার বলার ধরণ দেখে বিনির হাসি পেয়ে গেলো। হাসি সংযত করে নিয়ে বললো,
—‘হানিমুনের ব্যাপারে কি প্ল্যান করেছো? আমি তো কাজের চাপে আলাপ করবার সময়ই পাচ্ছি না।’

ইফরান শার্টের হাতা গোটাচ্ছিলো। সেটা থামিয়ে দিয়ে ভয়ানক চোখে বিনির দিকে তাকালো।
তার ধারণা বিনি পাগল! বেয়াদব!
মহাবেয়াদব!
অসভ্য! ফাজিল! লাজলজ্জাহীন!
ইফরানের মাথাটা পুরো খারাপ করে দিয়েছে। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে রক্তচক্ষু নিয়ে বললো,
—‘তুমি অনেক বেশি জ্বালাতন করছো।’
—‘জ্বালাতন যে কেবল তুমিই করতে পারবে এটা কোন আইনে লেখা আছে?’
বিনির কন্ঠে মৃদু ভর্ৎসনা। অগত্যা ইফরান ঝগড়া থামিয়ে দিলো। হাতদুটো দুদিকে প্রশস্ত করে বললো,
—‘ওকে ফাইন। তোমার যা খুশি করো। আমি আর বাধা দেবো না। কিন্তু আগামী একমাস আমি বাড়ি ফিরবো না। তুমি এখন মাকে গিয়ে সেকথা জানাবে। সঙ্গে এটাও বলবে যে আমার বাড়ি না ফেরার সমস্ত দায়ভার তোমার। তুমি বাড়াবাড়ি করেছো বলেই আমি বাড়ি ছেড়েছি।’

মানুষকে আঘাত দেওয়ার বেলায় বরাবরই ইফরান মির্জা পটু। একাজে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। খুব নিখুঁত ভাবে মানুষকে কষ্ট দিতে পারেন তিনি। কাকে,কখন কীভাবে কষ্ট দিতে হয় খুব ভালো করে জানেন।

বলা বাহুল্য, বিনি যে খুব সহজে নিজের অধিকার ছেড়ে দেবে না একথা ইফরান বুঝে গেছে। তাই চিৎকার চেঁচামেচির চাইতে অধিকারবঞ্চিত করাই হবে বিনির জন্য মোক্ষম শাস্তি।
বুঝেশুনে আসল হাতিয়ারটাই বেছে নিয়েছে সে। কষ্ট না দিয়েও কষ্ট দেওয়া যায়। মনে মনে হাসলো ইফরান। বিনি এবার বুঝবে ইফরান মির্জা কি জিনিস!

বিনির হাসিহাসি মুখ নিমিষেই ফ্যাকাসে, বর্ণহীন হয়ে গেলো। চোখ ছলছল করে উঠলো। বিতৃষ্ণায় ভরে গেলো মনটা। এমন নির্দয়, হৃদয়হীনের সাথে কেন তাঁর জীবন জড়ালো?
নারীর মন বোঝে না, মায়ের কোল চেনে না, সংসারে মন নেই, এমন পাপী নরাধমকে দিয়ে বিনি করবে টা কি?
চোখ ভর্তি টলমল পানি আর হৃদয়ভর্তি বেদনা নিয়ে ইফরানের চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো সে। ইফরান ফিরেও তাকালো না। বিষাদময় হয়ে উঠলো বিনির গোটা সকাল। কি করলে সে ইফরানকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারবে সেটা ভেবেই গোটা দিন কাটিয়ে দিলো।
#মালা_করনু_তারে_দান
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব-৯

চারদিন হয়ে গেলো সত্যি সত্যিই বাড়ি ফেরে নি ইফরান। কোন খোঁজখবরও পাঠায় নি। রাহেলা মির্জা ছেলের চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়লেন। অতিরিক্ত টেনশনে তাঁর প্রেশার বেড়ে গেলো। বাধ্য হয়ে বিনি তাঁর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ইফরানের খোঁজে বেরোলো।

হালিম মিয়া অবশ্য আগেই খবর নিয়ে এসেছে। ঢাকার ভেতরেই একটা হোটেলে উঠেছে ইফরান। একসপ্তাহ থেকে সেখান থেকে চিটাগাং রওনা করবে। চিটাগাং যাওয়ার আগেই ধরতে হবে। যে করেই হোক বাসায় ফিরিয়ে আনতে হবে। নইলে আবার কতদিনের জন্য উধাও হয়ে যায় কে জানে।

বিকেলের দিকে হালিম মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হলো বিনি। হোটেলে পৌঁছে হালিম মিয়া নিচে রিসিপশনে বসে রইলো। বিনি গেলো ইফরানের খোঁজ করতে। রুম নাম্বার আগেই জেনে নিয়েছে।

‘চারশো তিন’ নাম্বার রুম, বিনি লিফট থেকে বেরিয়ে বিড়বিড় করলো।
কিন্তু রুমের কাছে পৌঁছুতেই তাঁর পা দুটো থমকে গেলো। চোখ সরু হয়ে এলো।
বিশ একুশ বছর বয়সী একটা মেয়ে তাড়াহুড়ো করে ইফরানের রুম থেকে বেরোচ্ছে। মেয়েটার মুখে প্রচ্ছন্ন হাসি। পোশাকআশাকের ধরণও বেশি সুবিধার নয়।
অজানা আশঙ্কায় বিনির বুকটা আচানক কেঁপে উঠল। মাথার ভেতর নানাধরণের বাজে চিন্তাভাবনা উঁকি দিলো। কে এই মেয়ে? ইফরানের কাছে কেন এসেছে? মেয়েটা হাসছিলোই বা কেন?

বিয়ের পর বাড়ির কাজের লোকদের কাছ থেকে ইফরানের সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছে বিনি। ইফরান চরিত্রহীন, মাতাল লম্পট ইত্যাদি নানান ধরণের কথাবার্তা। কিন্তু নিজে এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারে নি। আদৌ ইফরান ভালো নাকি সত্যিই তাঁর চরিত্রে দোষ আছে কিছুই জানে না বিনি। তবে বিয়ের পর থেকে এই পর্যন্ত বিনির সঙ্গে তেমন কোন অসংলগ্ন আচরণ করে নি ইফরান।
বদমেজাজি, খিটখিটে প্রকৃতির হলেও তার চরিত্রের কোন দোষ এখনো ধরতে পারে নি বিনি। তবুও অনেক কিছুই মাথায় আসছে। দেরী না করে চট করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লো। মেয়েটা কেন এসেছিলো সেটা ইফরানকেই জিজ্ঞেস করবে।

ইফরান মানিব্যাগ টাকা রাখছে। তাঁর গালে লিপস্টিকের দাগ। বিছানা এলোমেলো। সন্দেহ দৃঢ়তর হলো বিনির। ঘৃণায় মুখ বিকৃত করে ফেললো।
একটু আগে ইফরান নিশ্চয়ই মেয়েটাকে টাকা দিয়েছিলো? নাহলে মানিব্যাগ হাতে থাকবে কেন? গালে লিপস্টিকের দাগ কেন? ইফরান তাহলে টাকা নিয়ে এসব করে বেড়াচ্ছে?

বুকের ভেতর কান্নার দলা পাকিয়ে আসতে চাইলো। তাঁর স্বামী চরিত্রহীন! এমন বাজে জঘন্য দৃশ্য দেখার আগে বিনি কেন মরে গেলো না! সারাজীবন ধরে নিজেকে শুদ্ধ রেখে এসে শেষে কিনা এসব দেখতে হচ্ছে?

ভয়ানক ক্রোধে ইফরানের গেঞ্জির কলার টেনে ধরলো সে। আর যাই হোক ইফরানের এতবড় অপরাধ সে কিছুতেই ক্ষমা করবে না। দরকার পড়লে খুন করবে তাঁকে। তবুও পার পেয়ে যেতে দেবে না।

ইফরান সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে। তাঁর হাতে এখনো মানিব্যাগ ধরা। বিনিকে দেখে হকচকিয়ে গেলো। বিনি তখন ক্রোধের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছে। সজোরে ইফরানের গেঞ্জি টেনে ধরে চিৎকার দিয়ে বললো,
—‘এসব করার জন্য বাড়ি ছেড়েছো?’

ইফরান তার কথার আগাগোড়া কিচ্ছু বুঝতে পারলো না। বিনির হাত থেকে গেঞ্জি ছাড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করলো। বিনি ছাড়লো না। পারলে সে ছিঁড়েই ফেলে।
ইফরান অত্যাধিক রাগে, বিরক্তিতে গলা চড়িয়ে বললো,
—‘এখন আমি যদি টানাটানি করে শাড়ি খুলে দেই তবে কেমন হবে?’

বিনি কিচ্ছু শুনলো না। ক্ষুধার্ত বাঘিনীর ন্যায় ইফরানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ইফরান ধাক্কা সামলাতে বিছানায় শুয়ে পড়লো। বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে বললো,
—‘আশ্চর্য! কি হচ্ছে টা কি? এভাবে পাগলের মত আচরণ করছো কেন?’

বিনি ইফরানের মাথার চুল টেনে ধরলো। সজোরে ঘুষি মারলো বুকে। ভয়ানক চিৎকার দিয়ে বললো,
—‘ঘরে বউ রেখে বাইরে ফুর্তি। এত শখ মেয়ে মানুষের? আজকে তোমার একদিন কি আমার একদিন।’
ইফরান বহু কষ্টে টেনে তাঁকে গায়ের ওপর থেকে সরালো। গলায় ধমকের সুর এনে বললো,
—‘কি আবোলতাবোল বকছো? হয়েছে টা কি?’
—‘দুশ্চরিত্র লম্পট। তোমাকে খুন করবো আমি।’
—‘আমি কি করেছি?’
—‘আবার জিজ্ঞেস করছে কি করেছি। নির্লজ্জ বেহায়া।’

প্রশ্ন করে কোন লাভ হবে না বুঝতে পেরে ইফরান জোরপূর্বক বিনিকে সরিয়ে দিয়ে বিছানায় থেকে নেমে দাঁড়ালো। দরজার দিকে পা বাড়াতেই বিনি এমনভাবে তাঁকে প্যাঁচিয়ে ধরলো যে শত চেষ্টা করেও ছাঁড়াতে পারলো না। সাপের মতন গলা প্যাঁচিয়ে ধরলো। অগত্যা আবার বিছানায় বসে পড়লো ইফরান। হাতের মুঠোয় কপাল চেপে ধরে বললো,
—‘পাগল। মহাপাগল এসে জুটেছে আমার কপালে। বাড়ি ছেড়ে হোটেলে উঠেছি এখানেও শান্তি নেই!’
বিনির মেজাজ তখন সপ্তম আসমানে। সে পারলে গলাটিপে মেরে দেয় ইফরানকে।

পাশে কাঁচের টি-টেবিল। অসাবধানতায় সেটার চৌকা কোনা আরেকটু হলেই বিনির পেটে গেঁথে যাচ্ছিলো। ইফরান টেনে তাঁকে সরিয়ে আনলো। অবচেতন মনেই একরাশ উদ্বিগ্নতা ঝরে পড়লো তাঁর কন্ঠে। ধমক দিয়ে বললো,
—‘মাথা খারাপ নাকি তোমার? কি করছো খেয়াল আছে?’

বিনি শান্ত হলো না। মেঝেতে বসে চিৎকার করে বললো,
—‘একদম ঠিক করেছি। আমি মরে গিয়ে তোমাকে ফাঁসিয়ে যাবো। যার স্বামী চরিত্রহীন তাঁর বেঁচে থেকে কি লাভ? এমন স্বামীর মুখ দেখার চাইতে মরে যাওয়াই ভালো।’
—‘আর যার বউ পাগল তাঁর কি করা উচিৎ?’

বিনির জবাবের অপেক্ষা না করে ইফরান পুনরায় স্বগতোক্তি করলো,
—‘মেয়ে মানুষের সঙ্গে ফুর্তি? চরিত্রহীন? কবে দেখেছো তুমি আমাকে?’

বিনি জলন্ত চোখজোড়া তাঁর দিকে তাক করতেই ফের সন্দিহান গলায় বললো,’একসেকেন্ড! আমি যদি ফুর্তি করেও থাকি তোমার তাতে কি? তুমি তো টাকার জন্য বিয়ে করেছো। তাহলে আমাকে নিয়ে মাথাব্যথা দেখাচ্ছো কেন?
বিনি তাঁর কথার জবাব দিলো না। দাঁতে দাঁত ঘষলো। মাথা দুলিয়ে বললো,
—‘এখন আমি বুঝতে পারছি কেন তোমার ঘরে মন টেকে না। অন্য কোথাও চাহিদা মিটে গেলে ঘরের আর প্রয়োজন কি? অবশ্য চরিত্রহীন, লম্পটদের কাছ থেকে ঘরের মূল্য আশা করাটাও বোকামি।’

ছাইরঙা হয়ে গেলো ইফরানের গৌরবর্ণ মুখখানা। এবার বিনি মনে মনে আত্মতৃপ্তি বোধ করলো। যাক, কিছুটা হলেও অপমান বোধ আছে। সে পুনরায় খোঁচা দিতে ছাড়লো না। বললো,
—‘তাই যদি হয় তাহলেও আমি বলবো ঘরে বউ থাকতে বাইরে কেন? ঘরের বউকে তো টাকা দেয়ার প্রয়োজন হয় না? যার টাকা আয় করার মুরোদ নেই তার এসব বাজে খরচা করার কোন অধিকারও নেই।’

অগ্নিশিখার ন্যায় জ্বলে উঠলো ইফরানের চোখজোড়া। কপালের শিরাগুলো রাগে ফুলে উঠলো। হাতের মুঠো শক্ত করে বিনিকে চড় মারতে উদ্যত হলো সে। কিন্তু পরোক্ষণেই থমকে গেলো। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে বিনির মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হাত নামিয়ে নিলো। ভয়ানক ক্রোধে চিৎকার দিয়ে বললো,
—‘তুমি এক্ষুনি এইমুহূর্তে এখান থেকে বেরিয়ে যাবে নইলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না।’
বিনিও ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয়। পাল্টা জবাব দিয়ে বললো,
—‘একদম চিৎকার দিয়ে কথা বলবে না। চরিত্রহীন লোকের এত বড়গলা মানায় না। কি ভেবেছো ভয় দেখিয়ে আমাকে চুপ করিয়ে দেবে?’

হাত দিয়ে পাশের ফ্লাওয়ার ভাসটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো ইফরান। বড়বড় দম নিয়ে নিজেকে শান্ত করার প্রয়াস চালালো। বিনির প্রতিটা বাক্য তার শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটিয়ে দিচ্ছে। এত কুৎসিত কথা সে কি করে উচ্চারণ করছে? আর যাই হোক মেয়ে মানুষ নিয়ে হোটেলে ফুর্তি করবে এত বাজে ছেলে ইফরান নয়। তার বখাটেপনা কেবল বন্ধুদের সঙ্গে তাল মেলালো পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। কিন্তু বিনিকে সেটা বোঝানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তাঁর নেই। বিনি তাঁকে ভুল বুঝুক, যা খুশি করুক এতে তাঁর কিচ্ছে আসে যায় না। শুধু ইফরানকে না রাগালেই হলো।

ইফরানের রাগত চেহারা বিনিকে কিছুটা সংকুচিত করে দিলো। এবার কন্ঠে একরাশ অভিমান ঢেলে দিয়ে অশ্রুসজল ভেজা চোখে বললো,
—‘এইসব করার আগে তোমার একবারও মায়ের কথা, আমার কথা মনে পড়ে নি? আমরা রোজ তোমার পথ চেয়ে বসে থাকি। আর তুমি হোটেলে বসে মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করছো?’

তার কন্ঠে উপচে পড়া আবেগ, আকুলতা, অসহায়ত্ব। চাইলেও উপেক্ষা করতে পারলো না ইফরান। হঠাৎ করেই যেন রাগ পড়ে গেলো। স্থিরচিত্তে, শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলো,
—‘আমার রুমে কোন মেয়ে দেখছো তুমি?’
—‘একটু আগে বেরিয়ে গেছে আমি দেখেছি।’
ইফরান হতাশভাবে বাইরে তাকালো। পূর্ববৎ শান্ত গলায় বললো,
—‘ও আমাদের ম্যানেজারের ভাগনী। সময় না পেলে মাঝেমধ্যে ওর হাত দিয়ে টাকা পয়সা লেনদেন করে ম্যানেজার। আজকেও আমাকে টাকা দিতেই এসেছিলো।’

জানালা দিয়ে ফুরফুরে শীতল বাতাস এসে ছুঁয়ে দিলো বিনিকে। নিমীলিত নয়নে ধীরে ধীরে ইফরানের দিকে মাথা তুলে চাইলো। চোখের পানি মুছে নিয়ে বললো,
—‘এতক্ষণ সেটা বললেই তো হতো।’
—‘আমার শখ হয়েছে পাগলের নৃত্য দেখার সেজন্য বলিনি।’
বিনি সবে নরম গলায় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু ইফরানের গালের দিকে নজর পড়তেই সন্দেহ পুনরায় মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। ভ্রু কুঁচকে থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করলো,
—‘সব ঠিক আছে কিন্তু তোমার গালে লিপস্টিকের দাগ কেন?’

ইফরান সঙ্গে সঙ্গে পেছনের আয়নায় নিজের গাল চেক করলো। খানিকটা লিপবাম লেগে আছে। বিরক্তি, বিভ্রান্তি দেখা দিলো তাঁর চোখেমুখে। অসভ্য মেয়েটা কখন এই কান্ড ঘটিয়ে গেছে ইফরান টেরই পায় নি। গালে হাত দিয়ে তাড়াতাড়ি লিপবাম মুছতে মুছতে বললো,
—‘আই ডোন্ট নো। মেবি সি কিসড মি!’
ব্যস! বিনিকে আর থামায় কে! ইফরানের প্রাণপাখিটা দেহ থেকে আলাদা করে দেওয়ার জন্য এই অল্পকিছু কথাই যথেষ্ট! দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে পুনরায় ঝাঁপিয়ে পড়লো ইফরানের ওপর। ইফরান দুহাতে তাঁকে জাঁপ্টে ধরে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু বিনি কি আর শোনে? সে সব সহ্য করতে পারবে কিন্তু স্বামী চরিত্রহীন এটা কখনো সহ্য করতে পারবে না। আজকে ইফরানকে জানেই মেরে ফেলবে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here