#সুখের_নেশায় পর্ব ১৭

0
559

#সুখের_নেশায় পর্ব১৭
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা

সাফারাত বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই পৃথকের বাবা -মা এসে সামনে দাঁড়াল। নিমেষে চোখে মুখে বিরক্তি উপচে পড়ল তার। শার্টের উপরের বোতাম টা খুলে সূক্ষ্ম নিঃশ্বাস ফেলল। ধরন এমন যেন নিঃশ্বাস টা আঁটকে ছিল গলায়। চাচা-চাচীর দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত নম্র স্বরে প্রশ্ন করলো,

” কিছু বলবেন আপনারা?”

পৃথকের বাবা নিজের স্ত্রীর দিকে তাকালো একবার। মুখ ফিরিয়ে গমগমে স্বরে বললেন,

” কেস টা ফিরিয়ে নাও সাফারাত। নিজের চাচাতো ভাইয়ের সাথে এমন শ/ত্রুতা মানায় না তোমার। ”

” আর আমার উপর আপনাদের অত্যাচার, আপনার ছেলের আমাকে মে/রে ফেলার চেষ্টা সবকিছুই মানানসই ছিল? ”

সাফারাতের প্রশ্নের পৃষ্ঠে জবাব দেওয়ার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পেলেন না পৃথকের বাবা-মা। উপায় না পেয়ে পৃথকের মা ডুকরে কেঁদে উঠলেন। সাফারাতের হাত ধরে বলতে লাগলেন,

” একটু দয়া করো। ছেলেটাকে ছাড়িয়ে আনো। আমি তোমায় কথা দিচ্ছি ওর কারণে কখনও কোনো ক্ষতি হবে না তোমার। তুমি দয়া না করলে আমার ছেলেটার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। ”

দয়া!আহা এ যেন বিদ্রুপের হাসির যোগ্য সাফারাতের নিকট। হাসিটুকু চেপে রাখল। চিরাচরিত গম্ভীর স্বরে বললো,

” জেনেশুনে নিজের বুকে ছুরির মা/রার মানুষ আমি নই। ”

ব্যাস এতটুকুই একটা বাক্য। আর এক সেকেন্ডও ব্যয় না করে দ্রুত বেগে উপরে চলে গেল। পৃথকের মা মেকি কান্নার ফোঁটা মুছে কিড়মিড়িয়ে বলে উঠল,

” দেখলে এই ছেলের এটিটিউড?তোমাকে আগেই বলেছিলাম সময় থাকতে শেষ করে দাও একে। কিন্তু তুমি আমার কথাটাই আমলে নিলে না। ”

” মে/রে ফেলেটাই বাকি ছিল। ওর ওই দূরসম্পর্কের খালা না নিয়ে গেলে আজ ও এমন হতো না। ”

” ওই মহিলা না জানি কি করল যে এই ছেলে এমন আগুন হয়ে ফিরে এলো। ”

পৃথকের বাবা চিন্তিত হয়ে সোফায় বসে পড়লেন। ছেলেকে কিভাবে মুক্ত করবেন জেলে থেকে ভেবে কুল কিনারা পাচ্ছেন না৷ সাফারাত কোনো রাস্তাই রাখল না। সাফারাতের সাথে কথা বলা তো দূর হিম শীতল দৃষ্টি দেখলেই অন্তর আত্মা শুকিয়ে যায় উনার।
.
.
ভোরের স্নিগ্ধ আলো ফুটেছে সবে। চৈত্রিকা জানালা মেলে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস টেনে নিল ভিতরে। অর্ধরাত্রি নিদ্রাহীন কাটিয়ে প্রভাতের এই নির্মল বাতাস টুকু যেন খুব দরকার ছিল। চৈত্রিকার মস্তিষ্কে বিভিন্ন ভাবনার বিচরণ থেমে নেই। তাহাফের ব্যাপারটা বেশ ভাবিয়েছে তাকে। এছাড়া সাফারাতের সাথে নতুন করে পথ চলা,সাফারাতের অতীত সব চৈত্রিকার ঘুম কেড়ে নিয়েছে। কি হয়েছিল সাফারাতের অতীতে?না চৈত্রিকা আর ভাবতে পারছে না। এবার সরাসরি সাফারাত কেই জিজ্ঞেস করবে। চৈত্রিকার এখনো মনে পড়ে সিলেটের সেই স্মৃতিগুলো।

কলেজে নতুনদের নবীনবরণ আজ। চৈত্রিকা তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে কলেজে এলো। তারও যে আজ নবীনবরণ। কলেজে ঢুকে পরিচিত বান্ধবীদের না পেয়ে যখন খুঁজতে ব্যস্ত তখনই একটা ছেলের কন্ঠ পেয়ে থমকে গেল পা দুটো আপনাআপনি। পিছনে তাকিয়ে দেখে সতেরো কি আঠারো বছরের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে। নিমিষেই সকল তাড়াহুড়া, ব্যস্ততা ভুলে যায় চৈত্রিকা। তার কিশোরী মন এক মুহুর্তের জন্য হলেও অজানা কারণে কেঁপে উঠে। নরম গলায় বলে,

” আমাকে ডাকছো?”
ছেলেটা একটুখানি এগিয়ে এলো। হালকা হেসে বললো,
” হুম তোমাকেই ডাকছি। প্রিন্সিপাল স্যারের অফিস টা কোথায় বলতে পারবে?”
চৈত্রিকার ভ্রুঁ কুঁচকে গেল। মনে মনে বললো- ‘ অদ্ভুত! ‘

” তুমি আর আসো নি কলেজে? ”
” না ভর্তি হবার পর আজকেই এলাম। ”
” ওহ। এতদিন এতগুলো ক্লাস হলো অথচ আজ এলে?”
” আমি এতদিন সিলেটে ছিলাম না। আমি ঢাকাতে থাকি। ”
” ঢাকাতে থাকলে এখানে কেন এলে?”

চৈত্রিকার চক্ষুদ্বয় ছোট্ট ছোট্ট হয়ে এল। ছেলেটা সেদিকে তাকিয়ে বললো,
” এতদিন নানার বাসায় ছিলাম। সিলেট আমার দাদুর বাড়ি। ইন্টার টা এখানে থেকেই কমপ্লিট করব। বাই দ্যা ওয়ে, আমি সাফারাত। সাফারাত এহমাদ। হোয়াটস ইয়োর নেইম? ”

কিশোর বয়সের চৈত্রিকা প্রথমবারের মতো কোনো ছেলের সান্নিধ্যে এসে কেমন ফ্রিজ হয়ে গেল। মনে তার হাজারো লাল,নীল নানা রঙের প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। যতবার তাকিয়েছে সাফারাতের দিক বুকটা ধুক ধুক করছে প্রচন্ড। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চেয়ে প্রতুত্তর করল,
” আমি চৈত্রিকা। ”
” ওহ্। চৈত্র মাস। ”

চৈত্রিকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। পরক্ষণেই লজ্জিত ভঙ্গিতে আওড়ালো,

” চৈত্র মাস? ”
” ইয়েস। চৈত্রিকা থেকে চৈত্র। চৈত্র মানেই চৈত্র মাস। ”

‘ চৈত্র মাস ‘ আহা!শব্দটা কতকাল ডাকে না সাফারাত। চৈত্রিকা স্মৃতির পাতায় ডুবে রইল না আর। কতশত মুহুর্ত তাদের। স্মৃতিতে একেকটা মুহুর্ত জাগিয়ে তুলতেও সারাদিন ফুরিয়ে যাবে তবুও শেষ হবে না মিষ্টি সেই সময়গুলো। সেদিনের পর থেকেই দু’জনের একটুআধটু কথোপকথনে গড়ে উঠে বন্ধুত্ব। অতঃপর গভীর বন্ধুত্ব। ওদের এই বন্ধুত্ব নিয়ে কত হিংসে করত ক্লাসের সকলে। তখন চৈত্রিকার বেশ আনন্দ হতো। তৃপ্তি পেত এটা ভেবে ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটার, সুন্দর মনের মানুষটার বেস্ট ফ্রেন্ড সে।

দরজায় করাঘাতের শব্দে চৈত্রিকার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। প্রচন্ড জোরে ধাক্কাচ্ছে কেউ। স্তব্ধ হয়ে গেল চৈত্রিকা। কিছু বুঝে উঠার আগেই ফাহমিদার উত্তেজিত কন্ঠস্বর ভেসে এলো দরজার অপর পাশ হতে। চৈত্রিকা দৌড়ে গিয়ে দরজা মেলে দিতেই ফাহমিদা মেয়ের উপর ঢলে পড়লেন। মা’কে ধরে ভয়ার্ত চোখে তাকালো। ফাহমিদা বহু কষ্টে উচ্চারণ করলেন,

” তোর বাবা,,তোর বাবা কেমন যেন করছে চৈত্র। কেমন যেন করছে। ”

আর বলতে পারলেন না তিনি। ভেঙে পড়লেন কান্নায়। চৈত্রিকার মন টা কু ডাকছে। মা’কে পাশের চেয়ারে বসিয়ে পাগলের মতো ছুটে এল বাবার কক্ষে। বিছানায় ছটফট করছেন আহমেদ। শ্বাস ফেলছেন খুব জোরে জোরে। মিম বাবার হাত ধরে কেঁদে যাচ্ছে অনবরত। মাথা টা ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে চৈত্রিকার। কি করবে,কোথায় যাবে কিছুই বুঝতে পারছে না। কয়েক পা পিছিয়ে হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি অতিক্রম করে নিচে নেমে এলো। শ্বাস ফেলতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে তার। গেইটের দিকে যেতে যেতে পায়ের তলায় কিছু একটা বিঁধতেই ব্যাথায় কুঁকড়িয়ে উঠল। উন্মুক্ত, খালি পায়ের তলায় ইটের কণা বিঁধেছে। ব্যাথায় দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। তাতে তোয়াক্কা করল না চৈত্রিকা। তার যে এখন বাবার জন্য ভাবতে হবে,বাবাকে বাচাতে হবে। দারোয়ান দেখল চৈত্রিকার রক্তমিশ্রিত পায়ের ছাপ। আঁতকে উঠলেন তিনি। এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল,

” কি হইছে মা?এই সাতসকালে তোমার এই অবস্থা কা?পা থাইক্কা তো রক্ত ঝরতাছে। ”

” চাচা একটা গাড়ি ডেকে আনেন। বাবাকে হসপিটালে নিতে হবে। ”

দারোয়ান কি শুনতে পেয়েছে চৈত্রিকার কথাটা?মেয়েটার মুখ দিয়ে শব্দ বেরিয়ে যেন বেরোচ্ছে না। কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে আছে কন্ঠনালিতে। চোখ দুটো ঘোলা হয়ে আসছে বারংবার। হৃদপিণ্ড টা অসম্ভব,অসহনীয় ব্যাথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। চৈত্রিকার শ্বাস কি বন্ধ হয়ে যাবে এখন?হাত মুঠো করে ফের বললো,

” বাবাকে হসপিটালে নিতে হবে চাচা। ”

দারোয়ান এবার বুঝতে পারল। চৈত্রিকা কে আশ্বাস দিয়ে বললো,

” তুমি কাইন্দো না। গাড়ি আনতাছি আমি। আনতাছি। ”

উপরে এসে বাঁধল আরেক বিপত্তি। বাবাকে কিভাবে নিচে নিয়ে যাবে সেটা ভেবে চৈত্রিকার মুখ শুকিয়ে গেল। মিম অশ্রুসিক্ত,ভেজা কন্ঠে ফুঁপিয়ে বলে উঠল,

” বাবা তো হাটতে পারে না। নিচে নিব কিভাবে আপু? ”

দারোয়ান একা পারবে না। চৈত্রিকা পাশের বাসার এক লোক কে ডেকে আনল। আজ খুব করে অনুভব করল মেহুল বেঁচে থাকলে হয়ত একা হাতে বাবাকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারত। একটুখানি সাহায্যের জন্য মানুষের দুয়ারে আকুতিমিনতি করতে হত না তার। বাবার এই অবস্থার জন্য চৈত্রিকা নিজেকে দায়ী করল। একটুখানি অসতর্কতার, জেদের কারণে প্রাণপ্রিয় ছোট ভাইকে হারাল। বাবার তীব্র অভিমানে বঞ্চিত হলো ভালোবাসা থেকে।
____________

গাড়ি দ্রুত বেগে এগিয়ে চলেছে অফিসের উদ্দেশ্যে। নিজের হাতের দিকে এক পলক চেয়ে চোখ সরিয়ে ফেলল সাফারাত। ঘড়িতে নয়টা বেজে পনেরো মিনিট। এসির ঠান্ডায় বিরক্তি লাগছে। ড্রাইভার কে বললো এসি অফ করে দিতে। গাড়ির জানালাগুলো মেলে দিতেই প্রকৃতির হাওয়ায় মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল একদম। অক্ষিপটে ভেসে উঠল চৈত্রিকার মায়াবী মুখ টা। ঝটপট আঁখিদ্বয় মেলে মোবাইলটা হাতে তুলে নেয়। চৈত্রিকার নাম্বারে ডায়াল করে মোবাইল টা কানে ধরে রাখল স্থির। কিন্তু রিসিভ হলো না। ভ্রুঁ যুগল কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত হলো। ললাটে স্পর্শ করল তা। পুনরায় কল দিয়ে যখন একই হাল পেল, উদভ্রান্তের ন্যায় লাগাতার কল দিতে থাকে সাফারাত। কল রিসিভ হলো দীর্ঘ,লম্বা একটা সময় পর। অপর পাশের ব্যক্তিকে কিছু বলতে না দিয়ে ধমকে উঠল সাফারাত ক্রোধমিশ্রিত স্বর দ্বারা।

” এতগুলো কল দিচ্ছি ধরছেন কেন আপনি চৈত্র। আপনি কি চাইছেন আমার নিঃশ্বাস আঁটকে যাক? ”

অপর পাশে পিনপতন নিরবতা। নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে কেবল। খুবই ক্ষীণ। সাফারাতের রাগ দ্বিগুণ বেড়ে গেল এতে। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

” স্পিক আপ ড্যামেট। ”

” আমার কোনো পরিচিত আত্মীয় স্বজন নেই এই শহরে। আমার বাবার লা/শ টা দাফনে একটু সহায়তা করবেন সাফারাত? ”

হতভম্ব, স্থবির হয়ে পড়ল সাফারাত। অত্যন্ত শান্ত ছিল চৈত্রিকার গলার স্বর। কলটা কেটে গেছে কিছুক্ষণ পূর্বে। কি বললো এটা চৈত্রিকা!

#চলবে,,,!

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here