#সুখের_নেশায় পর্ব ৩

0
717

#সুখের_নেশায় পর্ব ৩
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা

” ভালো আছি,ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।”

দারোয়ান কাকার বেসুরেলা কন্ঠের গান শুনে মুখে হাত রেখে হাসি আটকানোর বৃথা প্রয়াস চালাচ্ছে মিম। কিন্তু হাসি!তার চেষ্টা কে হার মানিয়ে বেরিয়ে এল শব্দ করে। অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ল মেয়েটা। হাসির শব্দে লজ্জায় গান থামিয়ে মুখ কাচুমাচু করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন দারোয়ান কাকা। চৈত্রিকা চোখ পাকিয়ে তাকাল মিমের দিক। বোনের চোখ রাঙানোতে বহু কষ্টে হাসি থামাতে সক্ষম হলো মিম।

চৈত্রিকার ঘাড় ঘুরিয়ে দু’তলার দিকে চোখ বুলালো। বাবা এমন সময় জানালার ধারে বসে থাকেন। আজ দেখতে না পেয়ে চৈত্রিকা কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। দারোয়ান কাকার দিকে চেয়ে নম্রতার সহিত নিচু স্বরে প্রশ্ন করল,

‘ ফুল গুলো কে দিয়েছে কাকা?’

‘ আমি তো কইতে পারি না মা। ডিউটিতে আইবার পর দেখলাম চেয়ারের উপর থুইয়া রাখছে কেউ। একটু আকটু তো পড়ালেহা করছি ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত। তাই তোমার নাম ডা পড়তে সমস্যা হইল না।’

‘ আপনার আগে আরেকজন ছিল ডিউটিতে ভোর পর্যন্ত। উনি দেখেন নি?কেউ গেইটের ধারে এসে রেখে গেল দারোয়ানের চোখ ফাঁকি দিয়ে ব্যাপারটা অদ্ভুত।’

দারোয়ান এদিক সেদিক তাকালেন। ভয়মিশ্রিত স্বরে বলে উঠলেন,

‘ আসল কথা হইল রাতে যে ডিউটিতে আছিল হে আজ ফজরের আযানের আগেই চইল্লা গেছে। ওর মাইয়াডার শরীর ভালা না। জ্বর আইছে শেষ রাতে। আমারে ফোন দিয়া বইলা গেছিল। আমি আইতে আইতে ৬টা বাজছে। মালিকের কাছে বিচার দিও না মা। ‘

‘ দিব না কাকা। আপনার কাছে আমার ছোট্ট একটা অনুরোধ থাকবে দয়া করে বাবা কে বলবেন না আমার নামে কেউ ফুল দিয়েছে। ‘

‘ বলমু না। তুমিও কইয়ো না আমার বিষয়টা। কইলে আমার চাকরি থাকব না।’

চৈত্রিকা মাথা দু’দিকে নাড়াল। অর্থাৎ সে বলবে না। মিমের হাত টা ধরে পা বাড়িয়েও থেমে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে মৃদু হেসে বলে উঠল,

‘ গানটা সুন্দর ছিল কাকা। নিঃসন্দেহে গাইতে পারেন। মিমু তো আপনার গানের গলায় মুগ্ধ হয়েই হাসছিল। ক’জনই বা পারে মানুষের ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটাতে!’

চৈত্রিকার কথায় খুশিতে গদগদ হয়ে গেলেন দারোয়ান কাকা। চৈত্রিকাও ঠোঁটে হাসি বজায় রেখে মিম কে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল।

‘ আপু!’

‘বল।’

‘ কাকার গান চুড়েল,পেত্নীদের হি হি শব্দকেও হার মানাবে। তুমি কেন মিছে মিছে প্রশংসা করলে?’

পা দুটো সিঁড়িতে থামিয়ে দিল চৈত্রিকা। চোখে মুখে ফুটে উঠল গম্ভীর ভাব। সূক্ষ্ম একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে শান্ত গলায় উত্তর দিল,

‘ কাউকে আঘাত করা উচিত নয় আমাদের মিমু। একটা মানুষ যতই খারাপ হোক অথবা তার কাজগুলো প্রশংসার দাবিদার না হোক তবুও তাকে নিয়ে উপহাস করা অন্যায়। অন্যের মনে আঘাত দিয়ে কখনও ভালো থাকা যায় না। তোর হাসিতে কাকার মনোক্ষুণ্ণ হয়েছে। আচ্ছা তুই কি কোনো কারণ ছাড়া হাসতে পারিস?মিছে মিছে হাসি কখনও পায়?’

মাথা দুলিয়ে না বুঝালো মিম। মিমের কোমল গালে হাত ছুঁয়ে চৈত্রিকা আলতো হাসল। ক্ষীণ স্বরে বলে উঠল,

‘এই শহরে হাসির কারণ হবার মানুষের বড্ড অভাব মিমু। কাকার কারণেই তোর অধর ছড়িয়ে শব্দ করে হাসিটা এসেছে। উনাকে ধন্যবাদ জানানো প্রয়োজন তোর। একটুখানি হাসির গুরুত্ব যে কতটুকু,যার কপালে সুখের দেখা মিলে না কেবল সেই বুঝে। ‘
.
.
ওড়নার নিচে ফুলগুলো কোনো রকমে লুকিয়ে রুমে এলো চৈত্রিকা। টবে কালশিটে রূপ ধারণ করা জারবেরা গুলোর সাথে আজকের গুলো স্থান পেল। নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে চৈত্রিকা পাড়ি জমাল ভাবনায়। আজ থেকে চার দিন পূর্বে নানা রঙের জারবেরা দিয়েছিল কেউ। যার বর্তমান অবস্থা পাপড়ি গুলো শুকিয়ে যাওয়ার পথে।

সবে টিউশনি শেষ করে গলির মোড়ে হাঁটছিল চৈত্রিকা বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে। বিস্তর অম্বরে তখন মেঘেরা ছোটাছুটি খেলায় মত্ত হয়েছে। সাদা নয় বরঞ্চ কালো মেঘ। চৈত্রিকার হুট করে মনে হলো সবসময় ব্যাগে জায়গা দখল করে রাখা ছাতাটা আজ বাসায় রয়ে গেছে। কখন ধরায় নেমে আসে বৃষ্টি,ছুঁয়ে দেয় সমস্ত কায়ায় তা তো বলা মুশকিল। ফলস্বরূপ দ্রুত গতিতে পা চালাচ্ছে সে। গলি পেরিয়ে রাস্তায় আসতেই একটা বাচ্চা ছেলে দৌড়ে এসে তার সন্নিকটে হাজির হলো। বাচ্চা টার হাত ভর্তি লাল,হলুদ,গোলাপি রঙের জারবেরা। ফুলগুলো বাড়িয়ে দিয়ে মায়াময় কন্ঠে বললো,

‘ মামী মণি নাও।’

মামী মণি!ডাকটা কর্ণগোচর হতেই স্তব্ধ হয়ে পড়ল চৈত্রিকা। স্থবির দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ফুলগুলো হাতে তুলে নেওয়া মাত্র ছেলেটা চলে গেল কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা কালো গাড়িটায় উঠে। চৈত্রিকা শত প্রয়াস চালিয়েও গাড়িতে কে আছে তা দেখতে পারল না। কারণ তার দেখার আগেই গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। না পারল দেখতে,না পারল সেই ডাক,ফুল দেওয়ার মানে উদ্ধার করতে।

মায়ের ডাকে খানিকটা ভরকে গেল চৈত্রিকা। কাজে সাহায্যের জন্য ডাকছেন তিনি। চৈত্রিকা ভাবনা হতে বের হয়ে হতাশা মিশ্রিত শ্বাস ফেলল। জীবনটা কেমন গোলকধাঁধায় পরিণত হয়েছে তার, যা থেকে বের হওয়ার সঠিক পথ খুঁজতে ব্যর্থ সে। আলতো হাতে ছুঁয়ে দিল ফুলগুলোকে। আনমনে বলে উঠল,

‘ তোমার মনে আছে সাফারাত?শেষ দেখায় বলেছিলাম আমার জীবনে প্রণয়ের আরম্ভ টা হোক এক হাত ভর্তি ফুল দিয়ে। তখনও আমার অজানা ছিল সেই কথাটাই হবে আমার তোমার সাথে শেষ কথা। গতকালও কথা হয়েছে তবে সেই সাফারাত ভিন্ন, তুমি নও।’
___________

ডাইনিং টেবিলে বসে আছে সাফারাতের দাদি,চাচা-চাচি সকলে। সাফারাত চেয়ার টেনে দাদির পাশে বসল। দাদির প্লেটে রুটি দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো,

‘ এখন যিনি রান্না করেন তার রান্নার হাত মোটেও ভালো নয় দাদী। খেয়ে তৃপ্তি পাই না। পানসে পানসে লাগে। তোমার তো রান্নার করার বয়স নেই। আর চাচী আম্মু তেমন একটা ভালো রান্না করেন না। নতুন লোক আনা হবে রান্নার জন্য। তাছাড়া রান্নার পাশাপাশি তোমার দেখাশোনার কাজও করবে।’

‘ এমন কেউ মানে তো বউ। তুমি কি বিয়ে করে বউ আনছো ভাই?’

প্রিয়ন্তীর কথায় নত মাথা তুলে সটান হয়ে বসল সাফারাত। দুর্বোধ্য হেসে বললো,

‘ বউ না রান্নার জন্য লোক আনছি। কেউ কেউ চায় না আমার জীবনে সুখ আসুক। সবাই থেকেও একা আমি। যাকেই আঁকড়ে ধরব। দিনশেষে দেখা যাবে সেই আমাকে আঘাত করতে প্রস্তুত।’

সাফারাতের কথা শুনে চাচা-চাচিসহ সকলের মুখটা পাংশুটে হয়ে গেল মুহুর্তে। প্রিয়ন্তী সাফারাতের দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের বাবা-মা এবং সবার দিকে চাইল। পনেরো বছরের প্রিয়ন্তী খুব একটা না বুঝলেও এতটুকু ঠাওর করতে পারে তার বাবা-মার সাথে সাফারাতের সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়। বিশাল এই বাড়িতে অতি কাছাকাছি বসবাস সবার অথচ মনে মনে দূরত্ব হাজার মাইল কিংবা তারও বেশি!

সাফারাত হাত ধুয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই সাফারাতের দাদি সুফিয়া বেগম ডেকে উঠলেন। রাশভারি গলায় বললেন,

‘তোমার বাবা ফোন দিয়েছিল৷ কথা বলতে চায় তোমার সাথে।’

নিমেষে চোখ দুটো লাল রঙে ছেয়ে গেল সাফারাতের। কপালে বৃদ্ধাঙ্গুলি ঘষে বললো,

‘ আমার মনে হয় তোমার মোবাইল টা ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া উচিত। যেই জিনিস আলতু ফালতু লোকের সাথে কথা বলার জন্য ব্যবহার হচ্ছে,তা আমার বাড়িতে থাকতে পারবে না।’

সাফারাতের ক্রুদ্ধ,রোষপূর্ণ কন্ঠে দমে গেলেন সুফিয়া বেগম। করুণ চাহনি নিয়ে চাইলেন সাফারাতের দিকে।
____

‘ আপনি কি আজ ডাক্তার দেখাবেন না চৈত্রির বাবা?’

তীর্যক চাউনি নিক্ষেপ করলেন আহমেদ সাহেব। কন্ঠে একরাশ রাগ নিয়ে বলে উঠলেন,

‘ তোমাকে অনেকবার বলেছি ওই মেয়ের বাপ বলে সম্বোধন করবে না আমাকে। যে মেয়ে আমার ছেলের প্রাণ কেঁড়ে নিয়েছে সে কখনও আমার সন্তান হতে পারে না। যদি সম্ভব হতো তবে নিজ হাতে গলা টিপে মেরে ফেলতাম।’

ফাহমিদার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে গেল। প্রতিবাদ করে বললো,

‘ নিজের ভাইকে কেন মারবে ও?আপনি আজও ভুল টা আঁকড়ে মেয়েটাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছেন। শেষ করে দিচ্ছেন আমার মেয়েটাকে।’

দরজার কাছ থেকে সরে এলো চৈত্রিকা। রুমে এসে পা দুটো ভেঙে বসে পড়ল ফ্লোরে। দুই চক্ষে জল নেই। কিন্তু রক্তাক্ত হচ্ছে অভ্যন্তরে। চৈত্রিকার যেন অনুভূত হচ্ছে তার অভ্যন্তরে গড়িয়ে যাচ্ছে তরল লাল রক্ত। যে রক্ত কেউ দেখছে না,কখনও দেখবে না। বাবার ভুল কি করে ভাঙ্গাবে সে?আদৌ কি তা সম্ভব! এতো বছরে পারে নি আর হয়ত পারবে না। চৈত্রিকা নিজেই তো একটু একটু করে মরছে প্রিয়জন হারানোর বেদনায়।

চৈত্রিকা নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়াল। যতবার আত্মার মৃত্যু হয়,হোক। মেনে নিবে সে। কিন্তু কখনও ভাঙ্গবে না। অনেক দায়িত্ব আছে তার। বাবা শতবার,সহস্র বার অস্বীকার করুক তাকে সন্তান হিসেবে কিন্তু সে ঠিকি পালন করে যাবে সন্তানের দায়িত্ব। ছোট্ট একটা কাগজে লিখল- আমি বাহিরে যাচ্ছি মা,খুব শীগ্রই ফিরব।
এই কথাটি বলার জন্যই ছুটে গিয়েছিল মায়ের রুমের দিক। বুক চিরে বেরিয়ে এল এক অতি যন্ত্রণা, বেদনা মিশ্রিত শ্বাস। যাকে এক কথায় বলা যায় দীর্ঘশ্বাস। কাগজ টা রান্নাঘরে চুলোর কাছাকাছি একটা ছোট্ট পাথর দিয়ে চাপা দিয়ে রাখল। কোনো এক সময় রেললাইন থেকে পাথর টা কুড়িয়ে এনেছিল চৈত্রিকা নানার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে।
.
.
বর্ষণ হচ্ছে। মুষলধারে বর্ষণ। প্রিয় বান্ধবী মিহিতার হাত ধরে দৌড়ে বাস স্ট্যান্ডের ছাউনির নিচে ঠাঁই নিল চৈত্রিকা। আজও ভুলে গেছে ছাতা আনতে। বাসা থেকে বেরিয়ে দেখেছে রৌদ্রজ্বল দিন। তারপর মিহিতাদের বাসা হতে বেরোতেই মাঝ রাস্তায় ঝমঝম শব্দ করে নেমে পড়ল বৃষ্টি। বাস স্ট্যান্ডে তেমন কোনো লোক নেই। ওদের থেকে খানিকটা দূরে দাড়িয়ে আছে তিনটে ছেলে। হয়ত বাসের অপেক্ষায়। নিজের দিকে তাকিয়ে মুখটা লজ্জায় চুপসে গেছে চৈত্রিকার। তেমন একটা ভিজে নি কিন্তু সাদা রঙের জামা হওয়ায় অল্প ভেজাতেই দৃষ্টিকটু দেখাচ্ছে খুব। মিহিতার দিকে তাকিয়ে দেখল ওর ড্রেস ভিজলেও খারাপ দেখাচ্ছে না। কালো রঙের হওয়ার দরুন হয়ত।

পাতলা ওড়নাটা দিয়ে যতটুকু পারল নিজেকে ঢেকে নিল চৈত্রিকা। অপেক্ষা এখন বর্ষণ মুক্ত প্রকৃতির। মিহিতার সাথে টুকটাক কথায় মগ্ন অবস্থায়, আচমকা বাম হাতে কারো হিম শীতল স্পর্শে কেঁপে উঠল বক্ষস্থল। ভয়ার্ত চোখে পাশে তাকালো। কাউকে দেখতে না পেয়ে অবাক হলো প্রচন্ড। স্পর্শ টা অনুভব করেছে সে। মিছে হয় কেমন করে!পরক্ষণেই ঘাড়ে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস পড়তেই চকিতে ঘুরে তাকালো। পরিচিত মুখ আঁখি জোড়ায় ভেসে উঠতেই চৈত্রিকা হতভম্ব, হতবাক হয়ে পড়ল। কন্ঠনালি হতে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এলো,

‘ সাফারাত!’

#চলবে,,,!

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here