#সুখের_নেশায় পর্ব ৩৪

0
615

#সুখের_নেশায় পর্ব ৩৪
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা

ফজরের আযানের ধ্বনি কানে ভেসে আসতেই সাফারাত নড়েচড়ে উঠে। বুকে গুটিসুটি মেরে ঘুমন্ত চৈত্রিকাকে টেনে সোজা করে পাশে শুইয়ে দিল। তৎপরে সাফারাত গালে হাত বুলিয়ে পাশে শুয়ে নেত্রদ্বয় নিমীলিত করে নেয়। নরম একটা স্বর চৈত্রিকার কর্ণধারে পৌঁছায় নিমেষে।
‘ উঠুন চৈত্র জান। ‘

এক বাক্যে চৈত্রিকা তৎক্ষনাৎ ক্ষীণ নড়ে উঠল। ঘুম ভীষণ পাতলা ওর। বিলম্ব না করে চক্ষুদ্বয় মেলার চেষ্টায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। মাত্র দু ঘন্টা পূর্বে ঘুমে বিভোর হয়েছিল, যার ফলে চোখ মেলা কষ্টকর হয়ে পড়ছে। তবুও পিটপিট করে সাফারাত এর মুখের দিকে কপাল কুঁচকে চাইল। ও কি ভুল কিছু শুনল?জান?এটাই তো ডাকলো সাফারাত। হুট করেই চৈত্রিকার বুকের অবস্থা বেশ টালমাটাল। ভাঙা গলায় প্রশ্ন করে,
‘ আপনি এই মুহুর্তে আমায় ডেকেছিলেন? ‘
‘ ইয়েস ডেকেছি। উঠুন। ‘
‘ আচ্ছা আপনি কি আমাকে শুধু নাম ধরে ডেকেছিলেন? ‘

চৈত্রিকার এমন অদ্ভুত প্রশ্নে সাফারাতের ভ্রুঁ যুগল কুঁচকে এলো। কপালে বলিরেখার ভাঁজ ফুটে উঠল। লহু স্বরে বললো,
‘ আপনার নাম ধরে ডেকেছি। কেন? আপনার নাম কি চৈত্র না?’
থতমত খেয়ে যায় চৈত্রিকা। আমতাআমতা করে বলে,
‘ হ্যাঁ। কিন্তু নামের সাথে আর কিছু ডাকেন নি?’
‘ আর কিছু ডাকার কথা ছিল?’-‘-এক ভ্রুঁ উঁচিয়ে প্রশ্ন করল সাফারাত।
‘ উঁহু! ফ্রেশ হতে হবে। নামাজের সময় পার হয়ে যাচ্ছে। ‘

চৈত্রিকা সাফারাতের প্রশ্নসূচক চেহারায় দৃষ্টি রেখে তড়িঘড়ি করে বলে উঠল কথা কাটানোর নিমিত্তে। নয়ত কেমন করে জিজ্ঞেস করবে যে আপনি কি আমায় জান ডেকেছিলেন? আমার মনে হলো জান ডেকেছেন। এই লজ্জাতুর শব্দটা উচ্চারণ করতে পারবে না ও। তাই যে করে হোক সাফারাতের দৃষ্টি হতে পালাতে হবে এখন,এই মুহুর্তে। বিছানা থেকে তাড়াহুড়োয় উঠতে নিলে সাফারাত উঠে বসে। কন্ঠে উদগ্রীব, উত্তেজনা।

‘ যেতে পারবেন?আমি কোলে করে দিয়ে আসি ওয়াশরুমে?’

চৈত্রিকা উঠতে গিয়েও থমকে গেল। শ্রবণগ্রন্থি ঝালাপালা করে উঠে ওর লজ্জায়,সংকোচে। সাফারাতের দিকে তাকানোর সাহস অব্দি নেই ওর। এটা কি প্রশ্ন ছিল নাকি লজ্জায় ফেলার,ডুবানোর মন্ত্র? শাড়ি সামলে জবাব না দিয়ে এক প্রকার দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে চৈত্রিকা। অর্ধ গোসল সেড়ে খেয়াল হলো কাপড় আনে নি। জড়তা সংকোচ নিয়ে দরজা একটুখানি খুলে ডেকে উঠল,

‘ সাফারাত! ‘
‘ কি কালার শাড়ি পড়বেন?’

দৈবাৎ প্রশ্নে হকচকিয়ে গেল চৈত্রিকা। সাফারাত উল্টো হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। তার ফর্সা দেহ দৃশ্যমান। উদোম পিঠ,তাগড়া বলিষ্ঠ দেহ অবলোকন হতেই চৈত্রিকার গলা শুকিয়ে আসছে। তার চেয়েও অত্যাধিক অবাকের বিষয় সে কি করে বুঝল চৈত্রিকার কাপড়ের জন্য হাক ছেড়েছে? চৈত্রিকা ভাবনায় এতো মগ্ন ছিল ও বুঝতেই পারে নি সামনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। গরম, উত্তপ্ত নিঃশ্বাস মুখে পড়তেই কেঁপে উঠল ও। সমুখে দৃষ্টি মেলে দেখে সাফারাত কলা পাতা রঙের একটা শাড়ি,ব্লাউজ প্রয়োজনীয় সকল জিনিস ওর দিকে বাড়িয়ে রেখেছে। কখন এলো?আগে থেকেই সব রেডি করে রেখেছিল নাকি?আর শাড়ির ও ব্লাউজের সাথে অন্যসব প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো?হোক না স্বামী তবুও সাফারাতের হাতে সবকিছু দেখে চৈত্রিকার লজ্জায় মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম। হাত কাঁপছে ঠকঠক করে।

‘ লজ্জায় লাল-নীল হবেন নাকি এগুলো নিবেন?’

লাল-নীল?হ্যাঁ। চৈত্রিকা অনুভব করতে পারছে ওর দু’গালের উত্তাপ। নিশ্চয়ই অনেক লাল হয়ে আছে। দ্রুত গতিতে কাপড়গুলো নিয়ে সাফারাতের মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিল। এতক্ষণে বোধহয় বন্দি খাঁচায় আটকে থাকা পাখির ন্যায় চৈত্রিকার নিঃশ্বাস ও মুক্তি পেল। প্রায় দম বন্ধ হওয়ার জোগাড় ছিল।
.
.
.
চৈত্রিকা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসতেই দেখে সাফারাত বিছানার চাদর পাল্টে ফেলেছে। আগের চাদর টা হাতে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতে নিলেই ইতস্তত কন্ঠে বলে উঠল চৈত্রিকা,
‘ আমাকে দিন। আমি ধুয়ে দিব। ‘
‘ নো নিড, আমি পারব। নামাজ পড়ুন আপনি। আমি আসছি। ‘
‘ কিন্তু! ‘
সাফারাত গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,
‘ আমি ধুয়ে দিব চৈত্র। ইজি হোন আমার সাথে। এতো সংকোচ রাখবেন না। ‘
চৈত্রিকা আর কিছু বলতে পারল না। জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে পড়ল। সাফারাতও ফ্রেশ হয়ে রুমেই নামাজ আদায় করে নেয়। বিছানায় গা এলিয়ে বলে উঠল,
‘ ঘুমাবো চৈত্র। আপনি চাইলে ঘুমিয়ে নিতে পারেন কিছুক্ষণ। ‘
‘ বাহিরে যাবো একটু।’-মিনমিন স্বরে বলে উঠল চৈত্রিকা।

সাফারাত কোনো প্রকার প্রতুত্তর করলো না। চোখ বুঁজে ফেলল। চৈত্রিকা ঠাহর করতে পারে সাফারাতের নীরবতা সম্মতির লক্ষণ।
ভেজা চুল ঝেড়ে শাড়ির আঁচল টেনে মাথায় ঘোমটা দিয়ে নিল চৈত্রিকা। দরজা হালকা করে ভিজিয়ে সিঁড়ির অভিমুখে এলো। নিচে তাকাতেই দেখতে পায় মিনা সোফায় ঘাড় হেলিয়ে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে হাত পা ছড়িয়ে। মেয়েটা নিজের ব্যাপারে একদম বেখেয়ালি। গলা টা মৃদু ব্যাথা করছে চৈত্রিকার। গরম পানি করে খেলে কিছুটা হলেও রিলিফ পাওয়া যাবে। চৈত্রিকা ধীরস্থির ভঙ্গিতে সিঁড়ি অতিক্রম করে নেমে এলো। মিনা কে ডাকতে লাগল আস্তে-ধীরে, নিচু গলায়। চোখ মেলতেই ক্ষীণ স্বরে বললো,

‘ রুমে গিয়ে ঘুমাও। এখানে একটু পর মানুষ আসবে যাবে। খারাপ দেখাবে তো। ‘
মিনা ব্যগ্র কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ রুম থেকেই আইলাম মাত্র ভাবী। এনে আইয়া কুদ্দুর বইতেই চোখ টা লাইগা গেছে। ‘
‘ সমস্যা নেই। রুমে যাও তুমি। ‘
‘ আপনার কি কিছু লাগব?আমারে কন কি লাগব?’
‘ গরম পানি। আমি নিজেই করতে পারব। তুমি যাও। ‘
‘ না না আমি এখনই কইরা আনতাছি। আপনি এনে বসেন। ‘
‘ লাগবে না। আমি পারব মিনা। তুমি গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নাও। ‘

কথাটা বলেই চৈত্রিকা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল। একটা পাতিলে পানি গরম করতে দিয়ে চোখ বুলালো পুরো রান্না ঘরে। আরেকবার এখানে আসার কারণে বৃহৎ আকারের কিচেন রুমটা দেখে বিস্ময়াবিষ্ট হলো না চৈত্রিকা। গরম পানি একটা স্টিল এর গ্লাসে ঢেলে লবণ মিশিয়ে নিল। গ্লাসটা ছোট কাপড় দিয়ে ধরে তাপ যেন হাতে না লাগে। গ্লাসটা হাতে নিয়ে ড্রইং রুমে আসতেই মুখোমুখি হয় মৌসুমি বেগমের। চৈত্রিকা তব্দা খেয়ে যায়। পরক্ষণেই সালাম দেওয়া মাত্র মৌসুমি বেগম কড়া কন্ঠে বলে উঠলেন,

‘ লাজ শরমের অভাব নাকি তোর?বস্তির মেয়ে হয়ে অবশ্য সংস্কৃতি, আদব কায়দা জানা তোর ধাঁচের না। আমরা তো শাশুড়ির আদেশ বিহীন লজ্জায় বিয়ের পরদিন রুম থেকেই বের হয় নি। আর তুই সোজা কিচেনে ঢুকে গেলি?এতো বড় বাড়ি, কিচেন রুম দেখে লোভ সামলাতে কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই!’

মৌসুমির বেগমের ব্যবহারে হতবিহ্বল চৈত্রিকা। ও জানত উনি স্বভাবে কর্কশ কিন্তু এমন ব্যবহার মোটেও আশা করে নি। অভ্যন্তরে জাগ্রত ব্যাথা,যন্ত্রণা জল হয়ে পরিপূর্ণ করলো চৈত্রিকার চক্ষু কোল। তবুও হাসিমুখে কঠিন এক জবাব দিল সে,

‘ আমার তো শাশুড়ী নেই ফুপু। অন্য কেউ নির্দেশ দিবে না। তাই অপেক্ষা না করে নিজেই চলে এলাম। আফটার অল সংসার টা আমার। বর বললো সংসার টা সামলানোর দায়িত্ব আমার। আমি আবার স্বামী ভক্ত। ‘

মৌসুমি বেগম রাগান্বিত চোখে তাকালেন। দাঁত কিড়মিড় করে বললেন,
‘ বড়দের সাথে এভাবে কথা বলা শিখিয়েছে তোর মা?এই তোর ব্যবহার?’
‘ বস্তির মেয়ে তো তাই। ‘

সাদামাটা জবাব চৈত্রিকার। মৌসুমি বেগম ক্ষিপ্র নেত্রে তাকাতেই চৈত্রিকা পুনরায় বলে উঠল নম্রস্বরে,

‘ আপনার কিছু লাগবে ফুপু?আমায় বলুন। চা খাবেন?আমি বানিয়ে দিই?’
‘ গতকাল বউ হয়ে এসে আজ আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছিস?এখন কি তোর জন্য আমি আমার ভাইপোর বাড়িতে চলতেও পারব না?’
‘ অবশ্যই পারবেন। আমি তো আপনার হেল্প করতে চাইছিলাম। ‘
‘ তোর হেল্প নিব আমি?মৌসুমি হাওলাদারের এতো সময় খারাপ সময় আসে নি এখনও যে একটা বস্তির মেয়ের হাতের কিছু খেতে হবে আমার। আমার চোখের সামনে থেকে সরে দাড়া। ‘

একটা মানুষ ঠিক কতক্ষণ এসব কথা সহ্য করতে পারে চৈত্রিকার জানা নেই। চক্ষে টলমল করা জল অবাধে গড়িয়ে পড়ার তোরজোর চালাচ্ছে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে চৈত্রিকা সরে দাঁড়াতে যাবে ঠিক তখনই ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয় ওকে মৌসুমি। সঙ্গে সঙ্গে ডান হাত টা চেপে ধরে চিল্লিয়ে উঠলো চৈত্রিকা। পানির গ্লাস কিঞ্চিৎ উঁচু হতে মেঝেতে আছড়ে পড়ে ঝংকার শব্দের সৃষ্ট করে। চৈত্রিকার চোখ থেকে জল গড়াচ্ছে। জ্বলে যাচ্ছে ওর হাত টা। ঠোঁট কামড়ে কাঁদতে লাগল ও। সকল কান্ড দেখে মিনা হতভম্ব। দৌড়ে এসে চৈত্রিকার পাশে মেঝেতে বসল ও।

‘ হায় আল্লাহ! এটা কি করলেন ম্যাডাম? ‘

মৌসুমি মিনার ভয়ার্ত স্বর কর্ণপাত করলেন না। বরং তাচ্ছিল্য হাসলেন। গটগট করে উপরে চলে গেলেন তিনি। মিনা দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,

‘ অসভ্য মহিলা। ভাবী আপনার হাত বেশি জ্বলতাছে?আমি স্যার রে ডাইকা লইয়াই। ‘

চৈত্রিকা অন্য হাতে মিনার হাত ধরে আটকালো। টলমলে নয়ন জোড়া নিক্ষেপ করে মাথা নেড়ে না করলো। মিনা তড়তড় করে বলে উঠল,

‘ আমি বলমুই ভাবী। এই মহিলার একটা উচিত শিক্ষা দরকার। আপনের এতো সুন্দর হাত টা পুইড়া ফেললো। ‘

মিনার চক্ষু কোল ভিজে উঠেছে। কন্ঠে কাতরতা। চৈত্রিকা ব্যস্ত পায়ে রান্না ঘরে ছুটে এলো। পানির কল ছেড়ে দিয়ে হাত টা দিতেই ছ্যাৎ করে উঠল মন,হাত,অন্তর। বড্ড জ্বলছে। একটা মানুষ এতো নির্দয় কেমন করে হতে পারে?মৌসুমি যে ইচ্ছেকৃত এটা করেছে বুঝতে বাকি নেই চৈত্রিকার। সাফারাত তাহলে গতরাতে সঠিক কথা বলেছিল। এই বাড়িতে বসবাসরত মানুষগুলো বিষাক্ত। চৈত্রিকার চোখ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় নোনতা গরম জল ঝরছে। দু’ চোখের পাতা এক করে বিড়বিড় করে বলে উঠল,

‘ আমার জীবনে সুখের বসবাস চিরকালের জন্য নয়। জীবনে সুখ ছিনিয়ে আনার লড়াই টা খুব কঠিন। কষ্টদায়ক। ‘

#চলবে,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here