#বর্ষণের সেই রাতে পর্ব ৪০+৪১

0
414

#বর্ষণের সেই রাতে পর্ব ৪০+৪১
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৪০
.
ভোর বেলা আদ্রিয়ান এর ঘুম ভাঙতেই ওর চোখ গেলো বেডের ওপর। এটা ওর প্রতিদিনের কাজ ঘুম থেকে ওঠার পরেই বেডের দিকে তাকায় অনিমাকে দেখার জন্যে। ঘুম ভাঙ্গা পিটপিটে চোখে বেডের দিকে তাকালো কিন্তু আজকে বেড ফাঁকা। সেটা দেখে আদ্রিয়ান এর ভ্রু কুচকে গেলো, ও চোখ হালকা কচলে নিয়ে ভালোভাবে চোখ বুলালো সারারুমে কিন্তু অনিমাকে দেখতে পেলো না। ও উঠে ব্যালকনিতে গিয়ে দেখে অনিমা একটা লাল রং এর শাল গায়ে জরিয়ে নিয়ে ব্যালকনির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে সকালের এই ফুরফুরে হাওয়াটা উপভোগ করছে। বাতাসে হালকা হালকা উড়ছে ওর এলোমেলো চুুলগুলো। অদ্ভুতরকম সুন্দর লাগছে ওকে। আদ্রিয়ান আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো অনিমার দিকে, অনিমা চোখ বন্ধ করে আছে বলে আদ্রিয়ানের উপস্হিতি বুঝতে পারছেনা। আদ্রিয়ান অনিমার পেছন থেকে ওর দুই হাতের ওপর দিয়ে হাত রাখল। অনিমা চমকে গিয়ে পেছনে ঘুরতে চাইলে আদ্রিয়ান ওকে আটকে দিয়ে বলল,

— ” আরে আমি। এতো নড়াচড়া কেনো করো বলোতো?”

অনিমা পুরো স্হির হয়ে দাড়িয়ে আছে। আদ্রিয়ান ওর দুই হাতের ওপর হাত দিয়ে রেখেছে আর আদ্রিয়ানের গরম নিশ্বাস ওর ঘাড়ে পড়ছে। অনিমা পুরো জমে গেছে চোখ খিচে বন্ধ করে রেখেছে। আদ্রিয়ান অনিমার কাধে থুতনি রেখে বলল,

— ” ম্যাডামের আজ এতো তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙ্গে গেলো যে?”

অনিমা আর কী বলবে? আদ্রিয়ানের এই সামান্য ছোঁয়াতেই ওর অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। ভীষণভাবে কাঁপছে ও। আদ্রিয়ান অনিমার কাঁপুনি ফিল করে ওর হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরল। কিন্তু তাতে অনিমার কাপুঁনি খুব একটা কমলোনা। আদ্রিয়ান বুঝতে পারলো অনিমা একটু অসস্তি বোধ করছে। তাই আদ্রিয়ান ওকে ছেড়ে দিয়ে বলল,

— ” এতো সকালে উঠে পরলে যে?”

— ” এমনিই..”

বলে অনিমা নিজের কপালের চুলগুলো সরাতে নিলেই আদ্রিয়ান অনিমার হাত ধরে আটকে নিলো তারপর ঐ হাত ধরে কাছে টেনে নিলো। অনিমা চমকে তাকালো আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ান একহাতে আদ্রিয়ানের কোমর ধরে রেখে ওপর হাতে কাপালের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলল,

— ” আমি যতক্ষণ তোমার কাছে থাকবো এই কাজটা আমার হুম?”

অনিমা চোখ নামিয়ে নিলো। আদ্রিয়ান অনিমার থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে ধরে বলল,

— ” জানো তোমার এই লজ্জামাখা চোখ নামিয়ে নেওয়া মুখটা কতোটা পছন্দের আমার।”

অনিমা নিজেকে ছাড়িয়ে চলে যেতে নিলেই আদ্রিয়ান ওর হাত ধরে ফেললো। অনিমা এতোটাই লজ্জা পেয়ে আছে যে পেছন দিকে তাকিয়ে অবধি দেখছেনা। আদ্রিয়ান অনিমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,

— ” আজ যেহেতু দুজনের ঘুমটাই এতো সকালে ভেঙ্গে গেছে তো দুজনেই একটু সময় তো কাটাতেই পারি নিজেদের মতো করে।”

অনিমা কিছু বললো না। আদ্রিয়ান ওকে ঘুরিয়ে জরিয়ে ধরলো নিজের সাথে। অনিমা চুপ করে চোখ বন্ধ করে আদ্রিয়ানের বুকে মাথা দিয়ে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মন দিয়ে ফিল করার চেষ্টা করছে আদ্রিয়ানের হার্টবিট। আদ্রিয়ান বলল,

— ” আজ একটা জায়গায় নিয়ে যাবো তোমাকে।”

অনিমা অবাক আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” কোথায়?”

আদ্রিয়ান অনিমার চুলগুলো ঠিক করতে করতে বলল,

— ” অনেকদিন ঘরে বন্দি অবস্হায় বোর লাগছে নিশ্চয়ই? তাই বাইরে থেকে একটু ঘুরিয়ে আনবো।”

অনিমা নিচু কন্ঠে বলল,

— ” কিন্তু রিক?”

আদ্রিয়ান হেসে অনিমার দুই বাহু ধরে রেখে বললো,

—- ” ভয় পেয়োনা আমি আছি তো। ব্রেকফাস্ট করে রেডি হয়ে নেবে হুম?”

অনিমা মাথা নাড়লো। আদ্রিয়ান মুচকি হেসে অনিমাকে নিয়ে ব্যালকনির ফ্লোরে বসল। অনিমা আদ্রিয়ানের কাধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রইলো। দুজনেই নিরবে উপভোগ করছে এই মিষ্টি সকাল।

_____________________

রিক ওদের ফার্মহাউজে বসে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে আর ফোনে একটার পর একটা ছবি বার করে দেখছে। একটা ছবিতে চোখ আটকে গেলো রিকের। ছবিটাতে অনিমা গালে হাত দিয়ে হাসছে গালের টোল আর তিলটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। রিক ছবিটার কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হালকা হাসলো। অনিমাকে তো ও নিজের কাছে নিয়ে আসবেই সেটা যেকোনো কিছুর বিনিময়ে। কিন্তু আদ্রিয়ানের যেই রূপ ইতিমধ্যেই ও দেখেছে তাতে কাজটা সহজ হবেনা এটাও বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে। কবির শেখ এসে ওর পাশের চেয়ারে বসে বললেন,

— ” কিছু জানতে পেরেছো বাবাই?”

রিক ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই বলল,

— ” উমহুম। বাট এটুকু আমি সিউর যে আদ্রিয়ান কোনো সাধারণ রকস্টার নয়, হতেই পারেনা। ওর শুটিং স্কিল কতোটা পার্ফেক্ট তুমি ভাবতে পারবেনা মামা।”

কবির শেখ ভ্রু কুচকে রিকের দিকে তাকিয়ে বললেন,

— ” তাহলে খোজ লাগাও। ”

রিক বিরক্তির একটা শ্বাস ফেলে বলল,

— ” লাগিয়েছি মামা। কিন্তু কোনো ক্লু
পাচ্ছিনা। ওর অন্য কোনো পরিচয়ের কোনো চিন্হও পাচ্ছিনা কোথাও।”

দুই হাত একত্র করে থুতনির নিচে রেখে চিন্তিত কন্ঠে বললেন,

— ” খুব পাকা লেভেলের খেলোয়ার এই আদ্রিয়ান। ওকে প্রথমে যতোটা সহজ সরল ভেবেছিলাম সেরকম ও নয়। খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে।”

রিক সামনের টি-টেবিলে একটা লাথি মেরে উঠে দাড়িয়ে চিৎকার করে বলল,

— ” আমি অতো কিছু জানিনা। জানতে চাই না। আমি ব্যাস এটুকুই জানি যে আমার ওকে চাই। যে ভাবেই হোক, যা কিছু করে হোক আই জাস্ট ওয়ান্ট হার।”

কবির শেখ রিকের হাত ধরে বসিয়ে বলল,

— ” কাম অন বাবাই শান্ত হও। মাথা গরম করে কিচ্ছু হবেনা যা করার ঠান্ডা মাথায় করতে হবে।”

রিক বিরক্ত হয়ে ওর মামার দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” কিন্তু করবোটা কী?”

কবির শেখ বাঁকা হেসে বললেন,

— ” সঠিক সময়ের অপেক্ষা।”

রিক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো ওনার দিকে। উনি রিকের কাধে হাত রেখে বললেন,

— ” আপাদত চুপ থাকো। সঠিক সময় আর সুযোগ বুঝে আসল কাজটা করতে হবে।”

রিক কিছু না বলে চুপ করে রইলো ও বুঝতে পেরেছে ওর মামা কী বলতে চাইছে।

__________________

ফার্মহাউজ থেকে ফিরে রুমে গিয়ে চেঞ্জ করে রিক ঘড়ি পরতে পরতে সিড়ি দিয়ে নেমে বেড়িয়ে যেতে নেবে তখনি মিসেস লিমা ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,

— ” রিক স্নিগ্ধাকে হসপিটালে ড্রপ করে দিয়ে আয়।”

রিক থেমে গিয়ে বিরক্ত হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো?

— ” আমি কেনো?বাড়িতে গাড়ি আর ড্রাইভার এর অভাব পরেছে নাকি।”

স্নিগ্ধা একটু ঢং করে মিসেস লিমাকে বললেন,

— ” বাদ দাও মামনী। আমি একাই যেতে পারবো। আমার অসুবিধা হবেনা। তাছাড়া তোমার ছেলেও তো নিয়ে যাবেনা আমাকে।”

মিসেস লিমা রাগী গলায় বললেন,

— ” চুপ কর তো। ও বললেই হলো নাকি? রিক ওকে দিয়ে এসো যাও। আজকে মেয়েটা প্রথম এই রোড দিয়ে যাবে তুমি যখন ওদিক দিয়েই যাবে তো ড্রপ করে দাওনা।”

রিক স্নিগ্ধার দিকে একবার তাকিয়ে তারপর রেগে বলল,

— ” আমার ওতো ফালতু সময় নেই আমি পারবোনা।”

বলে রিক চলে গেলো। স্নিগ্ধা বেশ কষ্ট পেলো। কী এমন হতো ড্রপ করে দিলে? অনেক কষ্টে নিজের চোখের পানি আটকে রেখে বেড়িয়ে গেলো। মিসেস লিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কী আর করবেন? ছেলেতো আর তার হাতে নেই।

বাইরে বেড়িয়ে স্নিগ্ধা দেখলো যে রিক গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধা পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই রিক বলল,

— ” ওই ড্রামাকুইন গাড়িতে ওঠ।”

স্নিগ্ধা রেগে গিয়ে বললো,

— ” আমি এমনিতেই যেতে পারবো। ধন্যবাদ আপনার করুণার জন্যে।”

রিক হাত ভাজ করে বললো,

— ” মমকে বলে এতো ড্রামা তো আমার সাথে যাবি বলেই করলি। এখন আবার নতুন ড্রামা করছিস কেনো?”

স্নিগ্ধা ঘুরে রিকের সামনে গিয়ে হাত জোর করে বললো,

— ” ভূল হয়ে গেছে আমার। এবারের মতো ক্ষমা করে দাও। আর জীবণেও বলবোনা। ”

বলে স্নিগ্ধা চলে যেতে নিলেই রিক ওর হাত ধরে বললো,

— ” তুই নিজে উঠবি নাকি আমি টেনে তুলবো?”

স্নিগ্ধা জানে যে এখন ও নিজে থেকে না উঠলে সত্যিই রিক টেনেই তুলবে ওকে তাই চুপচাপ ফ্রন্ট সিটে গিয়ে বসে পরলো। রিকও গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিলো। দুজনেই অনেক্ষণ চুপ ছিলো। নিরবতা ভেঙ্গে স্নিগ্ধা বলল,

— ” রিক দা তোমারও তো ডাক্তারি লাইসেন্স আছে অথচ তুমি জয়েন কেনো করোনা?”

রিক রাগী চোখে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” নিজের চরকায় তেল দে আমাকে নিয়ে ভাবতে হবেনা।”

স্নিগ্ধা একটা ভেংচি কেটে সামনের দিকে তাকালো তারপর বিড়বিড় করে বললো,

— ” হুহ সাইকো একটা।”

রিক ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

— ” কিছু বললি? ”

স্নিগ্ধা দাঁত কেলিয়ে একটা কেবলাকান্ত হাসি দিয়ে বললো,

— ” ইয়ে বলছিলাম যে তুমি খুব বুদ্ধিমান একজন মানুষ নইলে কেউ ডাক্তারি পড়া কম্প্লিট করে লাইসেন্স থাকা সত্ত্বেও বেকার ঘুরে বেড়ায়?”

রিক চোখ কটমট করে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে বললো,

— ” আর একটা কথা বললে সোজা ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে ফেলে দেবো।”

স্নিগ্ধা হুহ বলে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলো আর রিক ও ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিলো। আর কোনো কথা কেউ বলেনি।

____________________

এভবেই আরো কয়েকটা দিন চলে গেলো। রিক আর অনিমাকে খোজেনি শুধু অপেক্ষা করছে একটা সঠিক সময়ের ঠিক ওর মামা যেভাবে বলেছে। একয়েকদিনে অনেককিছুই বদলে গেছে তীব্র আর স্নেহার সম্পর্কটা আগের মতো হয়ে গেছে। অরু আর আশিস ও টম এন্ড জেরী থেকে মটু পাতলু জোরি হয়ে গেছে। আর স্নিগ্ধা রিক কে সারাক্ষণ নানাভাবে জ্বালিয়ে মারে আর রিক যথাসম্ভব ওকে ইগনোর করার চেষ্টা করে কিন্তু সবসময় পারেনা। ছোটবেলার বেস্ট ফ্রেন্ড এর প্রতি ওর মনে যেই টান আছে সেটা চাইলেও অস্বীকার করতে পারেনা ও। আর অনিমা এখন আদ্রিয়ানকে স্বাভাবিকভাবে নিতে শুরু করেছে। এখন আর আদ্রিয়ানকে এরিয়ে চলার চেষ্টা করেনা। তবে অনিমার মুখ থেকে ভালোবাসি কথাটা শোনার সৌভাগ্য আজও আদ্রিয়ানের হয়নি।

আকাশটা বেশ পরিস্কার এখন যার কারণে পূর্ণিমার রুপের থালার মতো গোল চাঁদটা আকাশে স্পষ্ট দৃশ্যমান। আদ্রিয়ানের বাড়ির ছাদের দোলনাতে আদ্রিয়ানের কাধে মাথা রেখে ওর বাহু দুইহাতে জরিয়ে বসে আছে অনিমা। দোলনাটা হালকা দুলছে। অনিমা অনেকক্ষণ ধরেই খেয়াল করছে যে আদ্রিয়ান বেশ চুপচাপ বসে আছে। অনিমা চোখ খুলে কাধ থেকে মাথা তুলে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” কী হলো আজ এতো চুপচাপ যে?”

আদ্রিয়ান দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,

— ” কিছুনা এমনিই।”

অনিমা আদ্রিয়ানের মুখের দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে বললো,

— ” কিছুতো একটা হয়েছে। বলুননা কী হয়েছে?”

আদ্রিয়ান আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,

— ” আজ মায়ের কথা খুব মনে পরছে।”

আদ্রিয়ানের কথা শুনে অনিমা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর একটা শ্বাস ফেলে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,

— ” একটা কথা বলবো?”

আদ্রিয়ান অনিমার দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে বলার সম্মতি দিলো। অনিমা সম্মতি পেয়ে মুখে হাসি এনে বললো,

— ” আপনি তো আপনার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। জানি আঙ্কেল একটা ভূল করে ফেলেছে কিন্তু তার শাস্তিতো এতো বড় হতে পারেনা তাইনা? আমি সিউর আন্টির সাথে আঙ্কেল ও আপনাকে খুব মিস করছে। তাই আপনার উচিত ওনাদের কাছে ফিরে যাওয়া।”

আদ্রিয়ান চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস নিয়ে অনিমার দিকে তাকিয়ে বললো,

— ” ড্যাড আমার কথা ভাবেনা অনি ভাবলে…”

আদ্রিয়ানকে থামিয়ে দিয়ে অনিমা বললো,

— ” ভাবে। আর ভাবে বলেই আপনাকে ওনার চেয়ারে বসাতে চেয়েছিলেন নিজের বিজনেস দেখতে বলেছিলেন। আপনি যেটাকে নিজের প্রফেশন হিসেবে বেছে নিয়েছেন সেটাতেতো সবাই দাঁড়িয়ে যেতে পারেনা সেটাতে কোনো সিকিউরিটি নেই। কিন্তু আপনি পেরেছেন নিজের যোগ্যতায় এই প্রফেশনে দাঁড়াতে কিন্তু সেটাতো নাও হতে পারতো তাইনা? উনি তো আপনার ফিউচার সিকিউর করতেই চেয়েছিলেন। তবে হ্যাঁ ওনার ভুল ছিলো এটাই যে আপনাকে চেষ্টা করার একটা সুযোগ দিতে চায়নি উনি। কিন্তু একটা কথা বলুনতো আমরাও তো ছোটবেলাতে অনেক কারণে অনেক ভুল করি আর আমাদের বাবা মা ক্ষমা করে দেয় তাহলে আমরাও তো পারি আমাদের বাবা মায়ের দুই একটা ভুল ক্ষমা করে দিতে রাইট?”

আদ্রিয়ান চুপ করে আছে অনিমা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

— ” যাদের বাবা মা থাকেনা তারাই বুঝতে পারে তারা না থাকার শূণ্যতা কতোটা। আপনার তো আছে তাদের দূরে সরিয়ে রাখবেন না। কারণ অনেকে আছে যারা চেয়েও নিজের বাবা মা কে কাছে পায়না।

কথাটা সময় অনিমার চোখ ছলছল করছিলো গলাটাও ধরে আসছিলো। আদ্রিয়ান আনিমাকে নিজের সাথে জরিয়ে ধরে মাথায় চুমু দিয়ে বললো,

— ” আচ্ছা ফিরে এসেই ওদের সাথে কথা বলবো আর তোমাকেও নিয়ে যাবো ওদের কাছে। হ্যাপি?”

অনিমা আদ্রিয়ানের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললো,

— ” ফিরে এসে মানে?”

আদ্রিয়ান একটু গলা ঝেড়ে বলল

— ” আসলে একটা রিয়ালিটি শো এর জাজিং এর জন্যে একটা এগ্রিমেন্ট সাইন করে রেখেছিলাম আরো আগেই। মাঝখানে একটা প্রবলেমের জন্যেই শুটিং বন্ধ ছিলো। তো এখন এক সপ্তাহের জন্যে সুইজারল্যান্ড যেতে হবে আমাকে।”

অনিমা কাঁপা গলায় বললো,

— ” কবে ফ্লাইট?”

আদ্রিয়ান কিছুক্ষণ চুপ থেকে তুতলানো আওয়াজে বলল,

— ” কালকে।”

অনিমা অবাক হয়ে বলল,

— ” আপনি আমাকে এখন বলছেন?”

আদ্রিয়ান ইতস্তত করে বললো,

— ” সরি বাট কীকরে বলবো বুঝতে পারছিলাম না তাই..”

অনিমা কিছু না বলে আদ্রিয়ানের বাহু জরিয়ে ধরলো। বেশ কিছুক্ষণ পর আদ্রিয়ান বুঝতে পারলো যে অনিমা কাঁদছে। আদ্রিয়ান মুচকি হেসে অনিমাকে বুকে নিয়ে বললো,

— ” আরে পাগলি কাঁদছো কেনো? এক সপ্তাহের ব্যাপার। দেখতে দেখতে কেটে যাবে।”

অনিমা কিছু বলছেনা আদ্রিয়ান ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

— ” আর রিকের ভয় পেয়োনা। এই বাড়িতে এসে তোমাকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা ওর নেই। কিন্তু হ্যাঁ যাই হয়ে যাক তুমি এই বাড়ি থেকে বেরোবেনা মনে থাকবে?”

অনিমা নিচু কন্ঠে বললো,

— ” হুম।”

আদ্রিয়ান হেসে অনিমার চোখ মুছে দিয়ে বলল,

— ” একটা জিনিস আছে তোমার জন্যে।”

অনিমা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আদ্রিয়ান পকেট থেকে একটা ফোন বের অনিমার হাতে দিয়ে বললো,

— ” এই ফোন দিয়েই কথা বলবো আমরা দুজন দুজনের সাথে ওকে? আর এখানে মাদার অরু তীব্র ওদের নাম্বার আছে। ওদের সাথে কথা বলে সময় কাটিও। আর ভয় একদম পাবেনা কারণ এই বাড়িতে রিক ঢুকতে পারবেনা, তাই এখানে তুমি একদম নিরাপদ।”

অনিমা আদ্রিয়ানের দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে বলল,

— ” যাওয়াটা কী খুব জরুরী?”

আদ্রিয়ান অনিমার হাত মুঠোয় নিয়ে মাথা নাড়লো অর্থাৎ হ্যাঁ। অনিমা মাথা নিচু করতেই অাদ্রিয়ান অনিমার মাথা উঁচু করে ধরে বলল,

— ” সব কিছুরই একটা পরীক্ষা থাকে। ধরে নাও আমাদের এই দূরত্বটাও আমাদের ভালোবাসার একটা পরীক্ষা। যার দ্বারা আমারা আমাদের ভালোবাসার গভীরতা বুঝতে পারব?”

অনিমা কেঁদেই যাচ্ছে আদ্রিয়ান অনেক কষ্টে নিজেকে শক্ত রাখছে কারণ ওও যদি ইমোশনাল হয়ে পরে তাহলে অনিকে কে সামলাবে? তাই ও অনিমাকে শক্ত করে নিজের বুকে জরিয়ে ধরে বলল,

— ” আরে পাগলি আমি তো তোমার সাথেই থাকবো সবসময়। আমার শরীর দূরে থাকলেও মনটা তো তোমার কাছেই থাকবে। প্রতি মুহূর্তেই ফিল করতে পারবে তুমি আমাকে। আর মাত্র সাতটা দিনই তো।”

আদ্রিয়ানের কোনো কথাই অনিমার কান্না থামাতে পারছেনা ও নিরবে চোখের জর ফেলেই যাচ্ছে। এমন মনে হচ্ছে যেনো এই বিচ্ছেদ অনেক বেশিই দীর্ঘ হবে।

#পর্ব- ৪১
.
আদ্রিয়ান সকাল বিভিন্নভাবে অনিমার মন ভালো করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কারণ অনিমার মনটা কাল রাত থেকেই খুব খারাপ হয়ে আছে। আদ্রিয়ানের আজ সন্ধ্যায় ফ্লাইট সেই নিয়েই মন খারাপ অনিমার। আদ্রিয়ান আজ আর কোথাও বের হয়নি সারাদিন আজ অনিমার সাথে থাকবে তাই। কিন্তু অনিমা কিছু বলছেনা একদম চুপচাপ এককোনায় বসে আছে। আদ্রিয়ান গার্ডেন এরিয়াতে একটু কাজের জন্যে গেছিলো ফিরে এসে দেখে অনিমা রুমে নেই। আদ্রিয়ান একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে ছাদে চলে গেলো কারণ ও জানে যে অনিমা এখন ওখানেই আছে। ছাদে গিয়ে দেখলো যে ওর ধারণাই ঠিক অনিমা দোলনায় বসে আছে আর শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। আদ্রিয়ান মুচকি হেসে অনিমার পাশে গিয়ে বসলো। অনিমা আদ্রিয়ানের উপস্থিতি বুঝতে পেরেও বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। অাদ্রিয়ান অনিমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,

— ” তুমি যদি এরকম মুখ করে রাখো তাহলে আমি কীকরে যাবো বলোতো?”

আদ্রিয়ানের কথায় অনিমা কোনো পতিক্রিয়া দেখালো না একই ভঙ্গিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। আদ্রিয়ান এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,

— ” জানপাখি?”

অনিমা হালকা নড়ে উঠলো। আদ্রিয়ানে এই ডাক উপেক্ষা করার ক্ষমতা নেই ওর মধ্যে। ও ছলছলে চোখে তাকালো আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ান অনিমাকে এক হাতে জরিয়ে ধরে বলল,

— ” কাল রাত থেকে মুড অফ করে রেখে দিয়েছো। তোমাকে এভাবে দেখতে আমার ভালো লাগে বলোতো? এক সপ্তাহেরই তো ব্যাপার, তাছাড়া আমি যতোটুকু সময় ফ্রি থাকবো তোমাকে কল করবো, ভিডিও কলেও কথা বলবো। দেখবে একদম একা লাগবেনা।”

অনিমা আদ্রিয়ানকে আলতো হাতে জরিয়ে ধরে আবারও নিঃশব্দে কেঁদে দিলো। আদ্রিয়ান অনিমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

— ” আবার কাঁদে! এভাবে কান্না করলে আমার খারাপ লাগে তো।”

অনিমা মাথা তুলে আদ্রিয়ানের হাতেল বাহু দুই হাতে জরিয়ে ধরে বলল,

— ” না গেলে হয়না?”

আদ্রিয়ান স্হির দৃষ্টিতে তাকালো অনিমার দিকে। ওর এমনিতেই অনিমাকে ছেড়ে যেতে মোটেও ইচ্ছে করছেনা তার ওপর মেয়েটার করুণ অনুরোধ যে ওর মনে আরো ঝড় তুলে দিচ্ছে কিন্তু ও তো নিরুপায়। ওকে যেতেই হবে। এমন নয় যে ও না গেলে কেউ ওকে জোর করে নিতে পারবে কথাটা হলো ও না গেলে প্রডিউসারের প্লাস চ্যানেলের অনেকটা লস হয়ে যাবে। মাত্র একসপ্তাহের জন্যে কারো এতো বড় ক্ষতি করতে চায়না ও। অনিমার চোখের জল মুছে দিতে দিতে মুচকি হেসে বলল,

— ” দেখো কনট্রাক্ট টা অনেক আগের সাইন করা, আমি চাইলেই এটা ক্যান্সেল করতে পারবোনা। হয়তো আমার তেমন কিছু করতে পারবে না ওনারা, কিন্তু ওনারা এডভারটাইস করে ফেলেছেন। এখন যদি আমি না যাই তো ওনাদের অনেক বড় লস হয়ে যাবে। তুমি কী চাও সেটা?”

অনিমা আদ্রিয়ানের কাধে মাথা এলিয়ে দিয়ে চুপচাপ বসে রইলো আদ্রিয়ানের অনিমাকে এভাবে মন খারাপ করতে দেখে খুব বেশিই খারাপ লাগছে তাই কিছুক্ষণ ভেবে আদ্রিয়ান বলল,

— ” আমার কাছে তোমার চেয়ে বেশি ইম্পর্টেন্ট কিচ্ছু না। তাই যদি তুমি না চাও আমি যাবোনা। আমি ক্যান্সেল করে দিচ্ছি।”

বলে ফোনটা হাতে নিতেই অনিমা ওকে আটকে দিয়ে বললো,

— ” নাহ প্লিজ। সাতটা দিন তো আমি ঠিক কাটিয়ে দেবো। কিন্তু শুধু শুধু কারো ক্ষতি হলে সেটা ভালো হবেনা।”

আদ্রিয়ান মুচকি হেসে অনিমার মাথায় একটা চুমু দিলো। অনিমা চুপচাপ আদ্রিয়ানের বুকে মাথা রেখে বসে রইলো।

বিকেল বেলা আদ্রিয়ান রেডি হচ্ছে আর অনিমা আদ্রিয়ানের লাগেজ চেক করছে। আদ্রিয়ান রেডি হয়ে এসে বললো,

— ” সব ঠিক আছে?”

আদ্রিয়ান মাথা নিচু করেই নিচু আওয়াজে বলল,

— ” হুম।”

আদ্রিয়ান মুচকি হেসে বলল,

— ” তাহলে চলো?”

আদ্রিয়ান আর অনিমা নিচে নেমে এলো। আদ্রিয়ান বাড়ির মেইন ডোর এর কাছে এসে অনিমার দিকে তাকিয়ে দেখলো অনিমা মুখ অন্ধকার করে দাড়িয়ে আছে। আদ্রিয়ান অনিমার দুই বাহু ধরে বলল,

— ” এখনো মন খারাপ করে থাকবে?”

অনিমা কিছু বলছেনা মাথা নিচু করে আছে চোখ ছলছল করছে ওর। আদ্রিয়ান অনিমার মুখটা তুলে উঁচু করে ধরল। আর সাথে সাথেই চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরল। আদ্রিয়ান অনিমার চোখ মুছে দিতে দিতে বলল,

— ” যাওয়ার আগে তোমার এমন মুখ দেখে গেলে আমার জার্নিটাও খারাপ যাবে আর এই সাতটা দিনও। যাওয়ার আগে তোমার হাসি মুখটা দেখে যেতে দেবেনা আমাকে?”

অনিমা কোনোরকমে হাসার চেষ্টা করলো। আদ্রিয়ান মুচকি হেসে অনিমার কপালে বেশ সময় নিয়ে একটা চুমু দিয়ে বলল,

— ” বাই। সাবধানে থাকবে। আর বাড়ির বাইরে একদম বেড়োবেনা যা লাগবে সার্ভেন্টদের বলবে ওরা এনে দেবে, কিন্তু তুমি ভুলেও বাইরে যাবেনা। ”

অনিমা মাথা নেড়ে কাঁপা গলায় বাই বলল। আদ্রিয়ান অনিমাকে শক্ত করে নিজের সাথে জরিয়ে ধরে রেখে গালে আরেকটা চুমু দিয়ে বেড়িয়ে গেলো। অনিমা ফিরে সিড়ি পার করে দোতালায় উঠেও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার দৌড়ে নিচে নেমে ছুটে বাইরে চলে গেলো। গিয়ে দেখলো অাদ্রিয়ানের গাড়ি অলরেডি স্টার্ট হয়ে গেছে। অনিমা হতাশ ভাবে দাড়িয়ে রইলো। হঠাৎ আদ্রিয়ান গাড়ি থেকে মাথা বেড় করে হাত নেড়ে বাই বললো অনিমাকে। অনিমাও মুচকি হেসে হাত নেড়ে বিদায় নিলো ওকে ।

_____________________

এভাবেই তিনটা দিন কেটে গেলো। আদ্রিয়ান আর অনিমা দুজনেই দুজনকে ভীষণ মিস করেছে। প্রতি সেকেন্ডে একে ওপরকে মনে পরেছে। খেতে, শুতে সব কাজেই একে ওপরকে ভীষণভাবে মিস করে। তবে ফোনে যোগাযোগ হয় ওদের। আর এরমধ্যে রিক আগেই খবর পেয়েছে আদ্রিয়ানের বিদেশ যাওয়ার কথা টানা দুদিন চেষ্টা করেও আদ্রিয়ানের ঐ বাড়ির খোজ পেলেও ওখানে ঢুকতে পারেনি ও। এতটাই কড়া সিকিউরিটি যে ওর পক্ষেও ঢোকা সম্ভব নয়। রিক গম্ভীর ভাবে বসে ভাবছিলো এটাই সুযোগ অনিকে নিজের কাছে আনার কিন্তু কীকরে? ও তো ঢুকতেই পারছেনা ঐ বাড়িতে। পাশ থেকে কবির শেখ বলে উঠলেন,

— ” অনিকে কীকরে তুলে আনবে সেটাই ভাবছো তো?”

রিক ওর মামার দিকে স্হির চোখে তাকালো অর্থাৎ হ্যাঁ। কবির শেখ বললেন,

— ” দেখো বাবাই আমরা ঐ বাড়িতে ঢুকতে পারবোনা ঠিকি কিন্তু ওকে তো বেড় করতেই পারি তাইনা?”

রিক একটা শ্বাস ফেলে বলল,

— ” সেটা সম্ভব না মামা অনেক গার্ড আছে। এতোগুলো গার্ডকে কেনা সম্ভব নয়।”

কবির শেখ বললেন,

— ” এতোজনের কী দরকার দুই একজন যথেষ্ট।”

রিক অবাক হয়ে বললো,

— ” কীভাবে? মানে কী করে বের করবো ওকে?”

কবির শেখ বাঁকা হেসে রিকের দিকে তাকালেন আর রিক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো কবির শেখ এর দিকে। কবির শেখ রিককে এমন একটা প্লান বললেন যাতে রিকের মুখেও হাসি ফুটে উঠলো। এরপরেই ওনাদের প্লানমাফেকই কেটেছিলো আরো তিনটে দিন।

______________________

অনিমা খাটে হেলান দিয়ে কানে হেডফোন গুজে গান শুনছে আর ফোনে গেইম খেলছে। আদ্রিয়ানকে এই ছয়দিন ভীষণভাবে মিস করেছে ও এখনও করছে। তাই যতোটা সম্ভব ব্যাস্ত রাখার চেষ্টা করে থাকে নিজেকে। আদ্রিয়ানের সাথে একটু আগেই কথা হয়েছে ওর কিন্তু ফোন রাখার পর আরো বেশি মিস করছে তাই গেইম খেলে মন অন্যদিকে নিতে চাইছে। হঠাৎ করেই ওর ফোন বেজে উঠলো। ফোন হাতে নিয়ে আশ্রমের নাম্বার দেখে অনিমার ভ্রু কুচকে গেলো। হঠাৎ এই সময় মাদার কেনো ফোন করবে? কাল রাতেই তো কথা হলো? অনিমা ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে একটা বাচ্চা মেয়ের কন্ঠস্বর ভেসে এলো। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে বলল,

— ” আপি!”

বলে আবারো শব্দ করে কাঁদতে শুরু করল মেয়েটি। অনিমা কন্ঠ শুনেই বুঝতে পারলো এটা তিন্নির কন্ঠ। তিন্নি ঐ আশ্রমেরই একজন মেয়ে। অনিমা যেই দেড় বছর ওখানে ছিলো তখন ওর সাথে বোনের মতোই সম্পর্ক হয়ে গেছে। অনিমা অবাক হয়ে বলল,

— ” তিন্নি কী হয়েছে সোনা? এভাবে কাঁদছিস কেনো?”

তিন্নি হিচকি দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

— ” আপি মাদার.. মাদারের..”

অনিমা উত্তেজিত হয়ে বলল,

— ” মাদারের কী হয়েছে? মাদার ঠিক আছেতো? হ্যাঁ? এই তিন্নি?”

তিন্নি এবারেও কাঁদতে কাঁদতে কোনোরকমে বললো,

— ” মাদার অনেক অসুস্হ হয়ে পরেছে প্লিজ আপি তুমি তাড়াতাড়ি এসো প্লিজ।”

অনিমা অবাক হয়ে বলল,

— ” তোরা মাদারকে হসপিটালে কেনো নিচ্ছেস না? আশ্রমে কেউ নেই?”

অনিমার কথার কোনো উত্তর না দিয়েই তিন্নি বললো,

— ” আপি তুমি প্লিজ তাড়াতাড়ি এসো। প্লিজ।”

অনিমা বেশ ঘাবড়ে গেলো, তারপর নিজেকে কোনোমতে সামলে বলল,

— ” তুই কান্না করিস না। মাদারকে তোরা দেখে রাখ আমি এক্ষুনি আসছি।”

অনিমা ফোন কেটে দিয়ে যেভাবে আছে ওভাবেই শুধু পার্স আর ফোনটা নিয়ে দৌড়ে বেড়িয়ে গেলো। ঐমুহূর্তের জন্যে ও ভুলে গেলো আদ্রিয়ানের সতর্কবার্তা, রিকের কথা। ওর মাথায় এখন শুধু মাদারের কথাই চলছে। আজ ও বেঁচে আছে শুধু মাদারের জন্যেই সেদিন যদি মাদার ওকে রাস্তা থেকে তুলে নিজের কাছে না নিতো তাহলে সেদিন ওর সাথে কী হতো সেটা কল্পনা করলেও কেঁপে ওঠে ও। আর আজ সেই মাদারের বিপদে ও কীকরে বসে থাকবে? গেইটের কাছে যেতেই ঐ দুজন গার্ড বলল,

— ” ম্যাম কোথাও যাবেন?”

অবাক করা বিষয় অনিমা জায়গার নাম বলতেই তারা অনিমাকে আটকালো না বরং ওকে দাঁড়াতে বলে একজন ড্রাইভার ডেকে গাড়িতে উঠিয়ে দিলো। অনিমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ও শুধু ভাবছে কতোক্ষণে আশ্রমে পৌছাবে। মাদারকে খুব বেশিই ভালোবাসে ও, ওনার কিছু হয়ে গেলে ও সেটা নিতে পারবে না। আশ্রমের সামনে গাড়ি থামতেই গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে ভেতরে চলে গেলো অনিমা। ভেতরে গিয়ে দেখে তিন্নি আর কিছু বাচ্চারা বসে বসে কাঁদছে। অনিমা দৌড়ে ওদের কাছে গিয়ে বলল,

— ” কী হয়েছে? মাদার কোথায় বল? মাদার ঠিক আছে তো?”

কিন্তু ওরা কেউ কিছু বলছেনা শুধু কেঁদে যাচ্ছে। সেটা দেখে অনিমা রেগে গিয়ে বলল,

— ” চুপ করে আছিস কেনো? মাদার কোথায়? বল?”

তিন্নি কাঁদতে কাঁদতে অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” সরি আপি।”

অনিমা কিছুই বুঝলোনা যে কী হচ্ছে এখানে।টেনশনে অনিমা কেঁদেই দিয়েই। এরমধ্যেই মাদার ভেতর থেকে মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলেন। মাদারকে দেখেই অনিমা চোখ মুছে উঠে দৌড়ে মাদারের কাছে গিয়ে ওনাকে ধরে বলল,

— ” মাদার তুমি ঠিক আছো তো? কি হয়েছিলো তোমার? ওরা কাঁদছে কেনো?”

মাদার মাথা নিচু করে আছে ওনার চোখ দিয়ে নিরবে জল পরছে। অনিমা অধৈর্য হয়ে বলল,

— ” তোমার সবাই চুপ করে কেনো আছো? প্লিজ কিছু বলো?”

হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বলে উঠল,

— ” ওরা কিছু বলতে পারবেনা। আমাকে জিজ্ঞেস করো বেইবি সবটা বলছি।”

কন্ঠস্বর শুনেই অনিমা চমকে উঠলো। কন্ঠটা চিনতে ওর একটুও দেরী হয় নি। একরাশ ভয় নিয়ে পেছনে তাকিয়ে ওর রুহ কেঁপে উঠল কারণ রিক বাঁকা হাসি দিয়ে জিন্সের পকেটে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। আর এখন সবটাই পরিষ্কার হয়ে গেলো ওর কাছে, ঐ ফোন, গার্ডদের না আটকানো সব কিছুই একটা প্লান ছিলো? অনিমা কান্নাভেজা চোখে করুণদৃষ্টিতে মাদারের দিকে তাকালো। যেই দৃষ্টি এটাই জিজ্ঞেস করছে যে কেনো করলে এটা? মাদার অনিমার দিকে তাকিয়ে হাত জোর করে বললেন,

— ” আমাকে ক্ষমা করে দে মা। আমি এটা না করলে ওরা এই বাচ্চাগুলোর ক্ষতি করে দিতো। দেখ প্রথমে রাজি হয়নি বলে বৃষ্টির হাতে গুলি করে দিয়েছে। হসপিটালেও নিতে দিচ্ছেনা।”

অনিমা চমকে তাকালো বৃষ্টির দিকে সাত বছরের বাচ্চা মেয়েটা যন্ত্রণায় ছটফট করছে। অনিমা রিকের দিকে তাকাতেই দেখলো রিক পকেটে হাত ঢুকিয়েই ওর দিকে এগিয়ে আসছে। অনিমা ভয়ে পেছাতে পেছাতে বলল,

— ” প্লিজ বৃষ্টিতে হসপিটালে নিয়ে যেতে দিন। অনেক রক্ত বেড়োচ্ছে, ও একটা বাচ্চা।”

রিক হালকা হাসলো অনিমার কথায় তারপর লোক দিয়ে ইশারা করতেই কিছু লোক বৃষ্টিকে নিয়ে চলে গেলো সাথে মাদারকেও নিতে গেলে মাদার রিকের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” দয়া ওকে যেতে দাও। ওর সাথে কিছু করোনা।”

রিকের লোকগুলো আর কিছু বলতে না দিয়েই নিয়ে গেলো মাদারকে। রিক অনিমার দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই অনিমা দৌড়ে পালাতে শুরু করল। রিক হেসে পেছন থেকে বলল,

— ” শুধু শুধু এনার্জি লস করছো সুইটহার্ট বেশিদূর যেতে পারবেনা তুমি।”

হলোও ঠিক তাই। বেশিদূর যেতে পারলোনা অনিমা তার আগেই রিকের লোকেরা ওর পথ আটকে ফেললো সবদিক দিয়ে। অনিমা তাড়াতাড়ি পার্স খুলে ফোনটা বের করতে নিলেই রিক এসে ওর হাত ধরে ফেললো। তারপর হাতে চাপ দিয়ে ধরে বলল,

— ” আজ আদ্রিয়ান কেনো? কেউ তোমাকে আমার হাত থেকে বাঁচাতে পারবেনা।”

বলে অনিমার হাত থেকে ফোন আর পার্স দুটোই ছুড়ে ফেলে দিলো। অনিমা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে কান্না করছে। রিক অপর হাতে ওর চুলের মুঠি ধরে বলল,

— ” কী ভেবেছিলে? ঐ রকস্টারের সাথে থাকলেই আমার হাত থেকে বাঁচতে পারবে তুমি? হ্যাঁ?”

বলে আরো জোরে টান মারলো ওর চুলে ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলো অনিমা। রিক হেসে বলল,

— ” লাগছে হুম? সবে শুরু করলাম বেইবি। দেখো তোমার সাথে আর কী কী হয়। চলো!”

অনিমা চমকে গিয়ে শব্দ করে কেঁদে দিয়ে বলল,

— ” নাহ প্লিজ ছেড়ে দিন আমাকে। আমি যাবোনা কোথাও।”

রিক বাঁকা একটা হাসি দিয়ে অনিমার চুল ধরে আরো কাছে এনে বললো,

— ” তোমাকে ছাড়ার জন্যে এতো কিছু করিনি আমি। তোমাকে আমার কাছে আনতে কতোটা কাঠ খর পোড়াতে হয়েছে আমাকে কোনো ধারণা আছে তোমার?”

অনিমা অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছে রিকের দিকে। রিক সেদিকে পাত্তা না দিয়ে অনিমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। অনেকটা যেতেই অনিমা হাত ধরা অবস্হাতেই বসে পরে বললো,

— ” প্লিজ আমি যাবোনা।”

রিক ওকে টেনে তুলে জোরে একটা থাপ্পড় মারলো অনিমার গালে। রিকের থাপ্পড়টায় বরাবরের মতো এবারেও অনিমার ঠোঁট কেটে রক্ত বেড়িয়ে গেলো। কিন্তু রিক হাত ধরে রাখায় মাটিতে পরে যায়নি ও। রিক ওকে টেনে হিচড়ে আশ্রমের পেছনের বিশাল মাঠটায় নিয়ে গেলো। আর ওখানে গিয়েই চমকে উঠলো অনিমা। কারণ ওখানে একটা হেলিকপ্টার রাখা। অনিমা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল,

— ” নাহ প্লিজ।”

কিন্তু রিক অনিমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই টেনে নিয়ে হেলিকপ্টারে তুললো। আর ওরা সবাই উঠতেই হেলিকপ্টার ওপরে উঠে গেলো। অনিমা চেচামেচি করছে বলে রিক ওর মুখ বেঁধে দিলো। আর ওর দুই হাত নিজের দুইহাতের মুঠোয় ধরে রেখেছে। অনিমা নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে কারণ চাইলেও শব্দ করতে পারছেনা ও। শুধু রিকে হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্যে ছটফট করে যাচ্ছে। রিক বিরক্ত হয়ে আবারও থাপ্পড় মারলো অনিমাকে তারপর দড়ি দিয়ে হয় হাতটাও বেধে দিয়ে বলল,

— ” এবার তুমি খুব ভালোভাবে বুঝবে অামার হাত থেকে পালাতে চাওয়ার কতটা ভয়ানক হতে পারে। সারাজীবন আফসোস করবে এই কাজের জন্যে।”

অনিমা মাথা নিচু করে কেঁদে যাচ্ছে। রিকের বলা প্রত্যেকটা কথা ওর মনে তীব্র ভয়ের সৃষ্টি করছে। ও নিজেও আন্দাজ করতে পারছেনা যে এবার ঠিক কী হতে চলেছে ওর সাথে। শুধু আদ্রিয়ানের কথাই মনে পরছে বারবার।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here