বালির নীচে জলের শব্দ #পর্ব ১৮,১৯

0
431

#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ১৮,১৯
১৮

চমৎকার মুহূর্ত আর কিছু মুল্যবান অনুভুতির সঞ্চার হয়েছিলো হৃদয়ের গভীরে। দুদিকেই হাওয়াটা জোরালো হয়ে লেগেছিল। কিন্তু এমন বাজখাই কণ্ঠস্বর সবটা নষ্ট করে দিলো। দৃষ্টির মুগ্ধতা নিমেষেই হাওয়ায় মিলিয়ে যেতেই হিমেল দূরত্ব বাড়াল। কণ্ঠের মালিকের দিকে তাকাতেই রাগ আর বিরক্তি চেপে বসল মস্তিস্কে। শ্রাবণের চোখ দুটো অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। একবার ভাইকে দেখছে তো আরেকবার কুমুকে। তার চেহারা প্রমান করে দিচ্ছে যেন সে কোন অসম্ভব কিছু চোখের সামনে দেখছে। কুমুর লজ্জায় সেখান থেকে এক দৌড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। হিমেলের উপরে রাগ হচ্ছে। কেন এই মানুষটা এখানে এলো। তাদেরকে এভাবে দেখে না জানি কি ভেবে বসলো। ঘটনার সাথে তাল মেলাতে না পেরেই কুমু সেখান থেকে চলে গেলো। শ্রাবণ বিস্ময়মাখা কণ্ঠে বলল
–ভাইয়া আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছি না। মানে আমি যা দেখেছি সেটা কি সত্যি ছিল? মানে তুমি কুমুর সাথে ওভাবে দাঁড়িয়ে ঠিক কি করতে চাইছিলে? কোন সিরিয়াস ব্যাপার না তো? আমার কিন্তু মাথা ঘুরছে।

হিমেল বুঝতে পারলো শ্রাবণ স্বাভাবিক ঘটনাকে অস্বাভাবিক বানিয়ে ফেলেছে। তার কথার মাঝে নিষিদ্ধ কিছুর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বিষয়টা মাথায় ঢুকতেই হিমেল দ্রুত তার কাছে এসে দাঁড়ালো। ঘাড়ে হাত রেখে বলল
–তুই যা ভাবছিস সেরকম কিছুই না।

শ্রাবণ কথাটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলো না। অবিশ্বাসের সুরে বলল
–তবে আমি যে দেখলাম। আমি নিজের চোখকে কিভাবে অবিশ্বাস করতে পারি।

হিমেল অসহায়ের মতো তাকাল। বলল
–তেমন কিছুই না শ্রাবণ। তুই একটু বেশীই ভাবছিস। আমরা তো শুধু কথা বলছিলাম।

শ্রাবণ সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাল। ঘাড় থেকে হাত নামিয়ে দিয়ে হতাশ কণ্ঠে বলল
–এভাবেও কথা বলা যায়? শুভ্রা তো আমার সাথে এভাবে কখনো কথা বলেনি। ১ বছর ধরে আমাদের পরিচয় তবুও কেমন করে কথা বলে। আর অল্প কয়দিনের পরিচয়েই কুমুর এতোটা কাছে গিয়ে কথা বলছ তুমি। ও কিছু বলল না তোমাকে?

শ্রাবণের কথা শুনে হিমেলের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো। কোনভাবে এই কথা যদি সৌরভের কানে যায় তাহলে তার রক্ষা নেই। যে করেই হোক শ্রাবণকে আটকাতেই হবে। আবারো শ্রাবণের ঘাড়ে হাত রেখে বলল
–দেখ তুই বিষয়টাকে একটু অন্যরকম ভাবছিস। সেরকম কিছুই না। আমরা শুধু কথা বলছিলাম। এর থেকে বেশী কিছু না। আমাকে তোর বিশ্বাস হয়না? জানিস তো আমি মিথ্যা বলি না।

শ্রাবণ অনুভুতিশুন্য দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকাল। সত্যি তো হিমেল কখনো মিথ্যা বলেনা। সে হিসেবে তার কথা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করাই যায়। কিন্তু সে যা নিজের চোখে দেখল। সেটাকে কিভাবে অবিশ্বাস করে। নিজের কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বলল
–তাহলে তুমি কুমুর উপরে ঝুঁকে গিয়ে কি করছিলে? আর এতো কাছ থেকেই বা ওর সাথে কি এমন কথা বলছিলে? বিষয়টা কিন্তু তুমি যত স্বাভাবিক প্রমান করতে চাইছ কোনদিক থেকেই তেমন মনে হচ্ছে না।

হিমেল হতাশ শ্বাস ছাড়ল। শ্রাবণের এক বন্ধু এসে তাকে ডেকে গেলো। ওদিকে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। শ্রাবণ কিছুটা সন্দিহান দৃষ্টিতে হিমেলের দিকে তাকাল। কঠিন গলায় বলল
–চলো ওদিকে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। আমরা এটা নিয়ে পরে কথা বলবো।

হিমেল একদম বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়তেই শ্রাবণ সরু চোখে তাকিয়ে বলল
–কথা কিন্তু বলবই। আমার তো কিছুতেই বিষয়টা এতো সহজ মনে হচ্ছে না। কেমন যেন লাগছে। কিছুটা রহস্য।

হিমেল অসহায়ের মতো তাকাল। সে বেশ বুঝতে পারছে শ্রাবণ তার কথা কোনভাবেই বিশ্বাস করবে না আর সে এটা নিয়ে অবশ্যই সৌরভের সাথে আলোচনা করবে। আর বিষয়টা কোথা থেকে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা ভেবেই ভেতরটা শুকিয়ে গেলো। শুকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে একটা শ্বাস ছাড়ল। কি থেকে কি হয়ে গেলো। হিমেলকে দাঁড়িয়ে ভাবতে দেখে শ্রাবণ আবারো থেমে গেলো। পেছন ঘুরে বলল
–কই আসো। আমরা পরে কথা বলবো তো।

হিমেল ফুস করে একটা শ্বাস ছেড়ে শ্রাবণের পিছু পিছু চলে গেলো। দুর্ভাগ্যবশত পুরো অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ হিমেলের হল না। জরুরী একটা ফোন আসায় অনুষ্ঠান মাঝপথেই ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিলো তাকে। কুমুর নাচটাও তাই দেখার সুযোগ হয়নি। হিমেল চলে গেছে সেটা রাফির কাছ থেকে নিশ্চিত হয়েই কুমু সস্তি পেয়েছিল। অন্তত নাচের দিকে পরিপূর্ণ মনোযোগ দিতে পারবে। কিন্তু সেটা বেশীক্ষণ স্থায়ী হল না। বারবার শ্রাবণের তির্যক চাহুনির সম্মুখীন হতেই তার অসস্তি বেড়ে যাচ্ছিল। সে যে তাকে মারাত্মক রকমের সন্দেহ করছে সেটা তার দৃষ্টি দেখেই ভালোভাবে বোঝা সম্ভব হচ্ছে। গুছিয়ে রাখা সমস্ত কাজ কর্ম এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল কুমুর। এর কারণে অবশ্য শুভ্রা তার উপরে খুব বিরক্ত হয়েছে। কিন্তু এই সবকিছুর জন্য কুমু আরেকজনের উপরে বিরক্ত। তার কাছ থেকেই দূরত্ব বজায় রাখতে সে একাকীত্ব বেছে নিয়েছিলো। কিন্তু মানুষটা যে সেই একাকীত্বর সুযোগ নেবে সেটা তো সে ভাবেই নি। বাইরে থেকে দেখতে যতটা ভদ্র সেরকম মোটেই না। ভীষণ বিরক্তি নিয়ে সারাটা দিন কেটে গেলো তার। ক্লান্তি আর বিরক্তিকর একটা দিন শেষে বাসায় ফিরে আরামের ঘুম দিলো কুমু।

———–
পর পর দুইটা দিন কেটে গেলো ব্যস্ততায়। এই দুইদিনে হিমেল কুমুর একবারও দেখা হয়নি। তবে শ্রাবণের সেই তির্যক সন্দিহান দৃষ্টি থেকে কিছুতেই বাঁচতে পারে নি সে। বাসায় ভার্সিটিতে যেখানেই দেখা হয়েছে শ্রাবণের ঐ দৃষ্টি তার উপরে বহাল ছিল। দুইদিন পর অপ্রত্যাশিতভাবে গোধূলি বেলায় ঠিক বাড়ির সামনে দেখা হয়ে গেলো হিমেলের সাথে। কুমুর হাত ধরে মৌ হেটে আসছিল। আর হিমেল বাড়ি থেকে বের হয়ে একটা কাজে যাচ্ছিল। হুট করেই সামনা সামনি হওয়ায় এক পলক দেখেই কুমু হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো। কিন্তু লাভ হল না। হিমেল তার ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালো। কুমুকে দেখে নিয়েই মৌয়ের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে মুচকি হেসে বলল
–কেমন আছো?

মৌ ছোট ছোট চোখে তাকাল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল
–ভালো।

কথার মাঝে তেজ নেই। নেই কোন উচ্ছ্বাস। হিমেলকে দেখলেই আগে যেমন কথা বলতে উদ্দত হতো সেসবের কিছুই চোখে পড়লো না। হিমেল মাথায় হাত রেখে আদুরে কণ্ঠে বলল
–মন খারাপ কেন?

মৌ চোখ তুলে তাকাল। অভিমানী কণ্ঠে বলল
–আপা বকেছে।

কথাটা বলেই সচেতন দৃষ্টিতে কুমুর দিকে তাকাল। সে সরু চোখে তার দিকে তাকাতেই মন খারাপ করে চোখ নামিয়ে নিলো। হিমেল হতাশ শ্বাস ছেড়ে মৌয়ের চূলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল
–ঠিক আছে আমি তোমার আপাকে বকে দেবো। আর বকবে না। কিন্তু কেন বকেছে আপা?

মৌ গম্ভীর কণ্ঠে বলল
–জেদ করেছিলাম। আচ্ছা তুমিই বলো সবাই তো একটু করে জেদ করেই তাহলে কেন আমাকেই শুধু বকে।

হিমেল হাসতে গিয়েও চেপে গেলো। হেসে ফেললে হয়তো মৌ মন খারাপ করবে। তাই আদুরে কণ্ঠে বলল
–তুমি তো ছোট। কোথায় জেদ করতে হয় সেটা বোঝ না। সব জায়গায় তো জেদ করা ঠিক নয়। তাই তোমাকে সেটা বুঝিয়ে দেয় যে সব জায়গায় জেদ করতে হয় না। তবে আমি বলছি না তোমার আপা তোমাকে বকে ঠিক কাজ করেছে। একদম করে নি।

মৌ অভিমানী চোখে তাকাল হিমেলের দিকে। কুমু এতক্ষন একটা কথাও বলেনি। হিমেল কুমুর দিকে তাকাল। কিছু একটা বলার আগেই মৌ আবারো বলল
–তুমি যখন বকে দাও তখন আর আপা আমাকে বকে না। তারপর তোমার সাথে দেখা না হলে আবারো ভুলে যায়। তখন বকে। এর একটা সমাধান করা দরকার।

হিমেল অবাক হয়ে তাকাল। মৌয়ের কথা শুনে তার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। চেপে রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে হেসে ফেললো। মৌ অদ্ভুত ভাবে তাকাল। হিমেল হাসি থামিয়ে বলল
–খুঁজে পেলে কোন সমাধান?

মৌ মন খারাপ করে মাথা নাড়ল। সে কোন সমাধান খুঁজে না পেয়ে হতাশ হল। হিমেল একটু ভেবে বলল
–তাহলে এর সমাধান কি হবে? তুমি আজ ভেবে কাল আমাকে জানাবে কেমন?

মৌ একটু বিচক্ষনের মতো ভাবল। বলল
–তুমি ভাইয়া হলে ভালো হতো। আপা যখন বকত তুমিও আপাকে বকে দিতে। কিন্তু ভাইয়া তো আছে। তাই তুমি কিভাবে ভাইয়া হবে?

হিমেল মুচকি হেসে বলল
–তাই তো। তাহলে এখন কি হবে? খুব কঠিন সমস্যা হয়ে গেলো মনে হচ্ছে।

হিমেল হাসি চেপে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মৌ কিছুটা সময় নিয়ে ভেবে বলল
–আর একটা উপায় আছে।

–কি উপায়?

মৌ ভীষণ আদুরে কণ্ঠে বলল
–তুমি আমার দুলাভাই হবে?

কুমু হিমেলের দিকেই তাকিয়ে ছিল। মৌয়ের কথা শুনে হিমেল বিস্মিত হল। সেই বিস্ময়কর দৃষ্টি নিয়ে কুমুর দিকে তাকাতেই চোখে চোখ মিলে গেলো। অসস্তিতে কাঁটা দিয়ে উঠলো কুমুর শরীর। লজ্জায় গাল ভারী হয়ে এলো। চোখ নামিয়ে হাতের ভাঁজে ধরে থাকা মৌয়ের ছোট্ট তুলতুলে হাতে হালকা চাপ দিয়ে বলল
–বেশী কথা বলতে মানা করেছি না? কোথায় শিখেছ এসব পাকা কথা?

আপার চাপা ধমক খেয়ে ঠোঁট উল্টে নিচের দিকে তাকাল মৌ। হিমেল কুমুর লজ্জায় রক্তিম চেহারা আর অসস্তি বুঝেই ঠোঁট চেপে হেসে মৌয়ের সামনে বসে পড়লো হাঁটু মুড়ে। কুমুর হাত থেকে তার তুলতুলে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আলতো করে দুটো হাত দুই হাতে চেপে ধরে বলল
–আমাকে তোমার ভালো লাগে?

মৌ ভীত চোখে আপার দিকে তাকাল। চাপা ধমকটা কাজে দিয়েছে। হিমেল বিষয়টা বুঝেই সাহস দিয়ে বলল
–ভয় পেওনা। কেউ কিছুই বলবে না। বলো। ভালো লাগে?

মৌ প্রশস্ত হেসে অকপটে স্বীকারোক্তি দিয়ে দিলো
–লাগে।

–আমি তোমার দুলাভাই হলে তুমি খুশী হবে?

মৌ চমৎকার হেসে মাথা নাড়ল। হিমেল হেসে ফেললো শব্দ করে। মৌয়ের ছোট্ট তুলতুলে হাতে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বলল
–ঠিকাছে। তোমার জন্য বিষয়টা ভেবে দেখবো।

কুমুর চোখ অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। ঘাম ছুটে যাচ্ছে তার। হিমেলের ঠোঁটে বিস্তর হাসি। কুমু সেই হাসির অর্থ বুঝতে চেষ্টা করলো। তবে কি এই মানুষটাও তার মতো অনুভুতির স্বীকার?

চলবে…

#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ১৯

কুমুর শরীরটা ভালো লাগছে না। তাই আজ ভার্সিটি যায় নি। সারা সকাল বিছানায় এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি দিয়েই পার করেছে। ঘড়িতে ১১ টা বাজতেই টনক নড়ল। তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো। মৌকে স্কুল থেকে আনতে যেতে হবে। তাই দেরি না করে যেমন ছিলো তেমনি ওড়নাটা মাথায় টেনে দিয়ে বের হয়ে গেলো। বাসা থেকে স্কুল খুব বেশি দূরে না তাই হাঁটার জন্য মনস্থির করে ফেললো। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো বাসা থেকে বের হয়ে কিছুদূর হেঁটে যাওয়ার পরই। অপ্রত্যাশিত ভাবে হিমেলের সাথে দেখা হয়ে গেলো। হিমেলকে দেখা মাত্রই কুমুর বুকের ভেতরে কেপে উঠলো। নিজেকে যথেষ্ট সাভাবিক প্রমাণ করতেই চোখ নামিয়ে জোরে হাটা শুরু করলো। কিন্তু লাভ হলো না। হিমেল সামনে এসে দাড়ালো। ভীষন শান্ত ভাবে বলল
— কোথায় যাচ্ছো?

কুমু কিছুটা বিরক্ত হলো। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
— যাচ্ছি কোথাও। আপনাকে কেনো জানতে হবে?

হিমেল অবাক হলো না। মুচকি হেসে বলল
— জানলে কি কোন ক্ষতি হবে? যদি ক্ষতি নাহয় তাহলে তো জানতে বাধা নেই।

কুমু কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে সাভাবিক ভাবেই বলল
— মৌকে আনতে যাচ্ছি।

হিমেল মুচকি হেসে বললো
— ওহ! তাহলে তো দেরি হয়ে যাচ্ছে। মৌ অপেক্ষা করছে নিশ্চয়। চলো তাহলে যাওয়া যাক।

— যাওয়া যাক মানে? আপনি কোথায় যাবেন?

হিমেল ভাবলেশহীন ভাবে বলল
— মৌকে আনতে।

কুমুর চেহারা রক্তিম হয়ে গেলো। ঝাঁঝালো গলায় বলল
— আপনাকে যেতে হবে না। আমি যেতে একাই যেতে পারবো। আর আপনার কি কোন কাজ নেই? এভাবে সময় নষ্ট করছেন কেনো?

হিমেল গম্ভীর কণ্ঠে বলল
— আপাতত আমার কোন কাজ নেই। এই মুহূর্তে তোমাকে সঙ্গ দেয়াটাই বড়ো কাজ। এভাবে কথার পৃষ্টে কথা বলে কিন্তু লাভ নেই। শুধু শুধু সময়টাই নষ্ট হচ্ছে। আমি তো যাবই। তুমি জত দেরি করবে সেটার দায়ভার তোমার।

কুমু কোন কথা বলতে পারলো না। প্রচন্ড রেগে গেলো। বুঝতে পারলো হিমেল কথা শুনবে না। তাই আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই। সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। হিমেল মুচকি হেসে তার সাথে চলে গেলো। অল্প কিছুক্ষণ হাঁটার পরেই তারা স্কুলে পৌঁছল। ক্লান্ত মৌ দরজায় দাড়িয়ে এদিক সেদিক দেখছিল অস্থিরভাবে। পরিচিত চেহারা চোখে পড়তেই অভিমানী কণ্ঠে কিছুটা গলা তুলে বলল
— তুমি এত দেরি করলে কেনো আপা? কখন থেকে দাড়ায় আছি।

কুমু হিমেলের দিকে তাকাল। তার জন্য যে দেরি হয়েছে সেটাই বোঝাতে চাইলো। হিমেল বুঝেও না বোঝার ভান করে মৌয়ের হাত ধরে বলল
— আমি তো আগেই আসতে চেয়েছিলাম। অযথা তোমার আপা সময় নষ্ট করেছে। আমার কিন্তু কোন দোষ নেই।

মৌ সরু চোখে তাকাল কুমুর দিকে। কিছু না বলে হিমেলের হাত ধরে বলল
— চলো ভাইয়া।

মৌয়ের এমন আচরনে কুমুর রাগ হলো। সমস্ত রাগ হিমেলের উপরে ঢেলে দিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে এগিয়ে গেলো। হিমেল বুঝতে পেরে মুচকি হাসলো। কিছুদূর হেঁটে যেতেই ক্লান্ত মৌ মুখের ঘাম মুছে বলল
— আমার পা ব্যাথা হয়ে গেছে। আর হাঁটতে পারবো না।

কুমু পলক ফেলে তাকাল। কিছুটা কঠিন গলায় বলল
— এইটুকু হাঁটতেই পা ব্যথা হয়ে গেলো? আর একটু হাঁটলেই চলে যাবো তো।

চোখ মুখ শক্ত করে তাকাল মৌ। ভ্রু জোড়ায় গভীর ভাঁজ ফেলে কঠিন গলায় বলল
— এইটুকু বলছো? কতদূর হাঁটলাম। পারবনা বলছি মানে আর পারবো না। তুমি বোঝনা কেন আপা?

পিচ্চি মৌয়ের এমন রাগ দেখে দুজনেই বেশ অবাক হলো। হিমেল ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে হাত নাড়িয়ে একটা রিক্সা থামিয়ে মৌকে নিয়ে রিক্সায় উঠে বসলো। ঘটনার আকস্মিকতায় কুমু ভাষা হারিয়ে বোকার মতো চেয়ে থাকলো। অনেকক্ষণ পর মৌ বিরক্ত হয়েই বললো
— আপা উঠে আসো। দেরি হচ্ছে।

কুমু কি করবে বুঝতে না পেরে বলল
— আর একটু হাঁটলেই পৌঁছে যাবো। রিক্সায় উঠতে হবে না।

হিমেল শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
— রিক্সায় উঠতে অসুবিধা না আমার সাথে রিক্সায় উঠতে অসুবিধা?

কুমু কোন উত্তর খুঁজে পেলো না। অগত্যা রিক্সায় উঠে বসলো। বসন্তের সহনীয় রোদ্দুর আর মাতাল করা ফুরফুরে হাওয়ায় ভেসে আসছে বিদেশী সুগন্ধির ঘ্রাণ। মনটা আনন্দে ভরে উঠলো। ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠতেই আনমনেই বলে উঠলো
— আপনি অযথাই রিক্সাটা নিলেন। আমরা হেঁটে গেলেই পারতাম।

হিমেল সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার কোলে মৌ বেশ আরাম করে বসেছে। সে সামনে তাকিয়েই বলল
— দুলাভাই হতে চেয়েছি দায়িত্ব নিতে আমি বাধ্য।

কুমু বিস্ময় মাখা দৃষ্টি ফেললো তার দিকে। গাল লজ্জায় ভারী হয়ে আসছে। বাড়ির কাছাকাছি রিক্সা যেতেই সদর দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে সদ্য দাড়িয়ে যাওয়া নিলুর চোখে পড়ে গেলো। বিস্ময়ে অভিভূত নিলুর মুখ হা হয়ে গেলো। সেদিকে তাকিয়ে সৌরভকে বলল
— আমাকে একটা চিমটি কাটো তো।

সৌরভ তার দিকে তাকিয়ে আবেগে টলমল হয়ে বলল
— এতো সুন্দর করে তো কখনো আদর করতেও বলোনা জান। আজ যে চিমটি কাটতে বলছো?

নিলু বিস্ময় কাটিয়ে কটমট চোখে তার দিকে তাকাতেই সে অপ্রস্তুত হেসে সামনে তাকাল। সাথে সাথেই আর্তনাদ করে বলে উঠলো
— আমি কি এখনো ঘুমিয়ে আছি নাকি নিলু? সামনের দৃশ্যটা কি সত্যি? সন্যাসব্রত গ্রহণ করতে চাওয়া ছেলেটা তবে কি মেয়ে ঠিক করে ফেললো নিজের জন্য!

নিলু অবাক হয়ে বলল
— এই মেয়েটা ওই দো তলার মেয়েটা না?

সৌরভ ভাল করে খেয়াল করলো। ভ্রু কুঁচকে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল
— হ্যা তো। ওই মেয়েটাই। যাহ ব্যাটা! আগেই আমার সন্দেহ হয়েছিলো। কিন্তু তোমার ধুরন্ধর ভাই আমার কাছে স্বীকার করেনি। কিন্তু দেখো গোপনে প্রেমলীলা ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছে। আজ আমিও দেখে নেবো।

তাদের কথোপকথনের মাঝেই যোগ হলো আরেক ব্যাক্তি। শ্রাবণ তড়িঘড়ি করে বাড়ি থেকে বের হয়ে দাড়ালো। দুজনকে এভাবে সামনে তাকাতে দেখেই কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল
— তোমরা এভাবে কি দেখছো?

সৌরভ এলোমেলো হয়ে বলল
— প্রেমলীলা দেখছি।

সৌরভের কথার অর্থ বুঝতেই তার দৃষ্টি তাক করে সামনে তাকাল। সামনের দৃশ্যটা চোখে পড়তেই তার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। সন্দেহটা এবার সত্যি হয়ে গেলো। রিক্সাটা এসে থামলো বাড়ির সামনে। এতক্ষণ হিমেল সেদিকে খেয়াল করেনি। রিক্সা থেকে নামতেই সবাইকে এভাবে তাকায় থাকতে দেখে হিমেল অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। কুমু বেখেয়ালি ভাবে তাকাতেই সবার সন্দিহান দৃষ্টি দেখে অবাক হয়ে গেলো। শ্রাবণের চোখে চোখ পড়তেই দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো। লজ্জায় হাত পা অসাড় হয়ে আসতেই মৌয়ের হাত শক্ত করে চেপে ধরে ভেতরে ঢুকে গেলো। হিমেল অসহায় হয়ে দাড়িয়ে থাকলো। নিলু আর সৌরভ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেও শ্রাবণের অমন সরু চোখের চাহুনি তাকে ভাবিয়ে তুলছে। শ্রাবণ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে থমথমে কণ্ঠে বললো
— সৌরভ ভাইয়া তোমার সাথে আমার কথা আছে।

সৌরভ সামনে তাকিয়ে বলল
— বলে ফেল।

শ্রাবণ হিমেলের দিকে তাকিয়েই গম্ভীর গলায় বলল
— গোপন কথা। এভাবে বলা যাবে না।

হিমেল বুঝতে পেরে অসহায়ের মতো তাকাল শ্রাবণের দিকে। কিন্তু সেই দৃষ্টি তার উপরে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারলো না। সে ঠিক করে ফেলেছে সেদিনের ঘটনা সৌরভকে জানাবেই। হিমেল এর আচরণ তার কাছে মোটেই সুবিধার মনে হচ্ছে না। হিমেল কপালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে ফেললো। এবার আর কোন রক্ষা নেই। শ্রাবণ যখন দায়িত্ব নিয়েছে তখন এই খবর তার মায়ের কান পর্যন্ত পৌঁছে যাবেই। তারপর ঠিক কি হতে পারে। সেটা ভেবেই শিউরে উঠলো সে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here