বালির নীচে জলের শব্দ #পর্ব ৩৬,৩৭

0
347

#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ৩৬,৩৭

৩৬
পরের দিন সকাল থেকেই চেয়ারম্যানের নির্দেশে মেম্বারকে সাথে নিয়ে রুশা আর হিমেল গ্রামের মোটামুটি প্রভা’বশা’লীর প্রতিটা বাড়িতে যায়। পরিবারের সব সদস্যের ডি’টে’ইল নিতে। কিন্তু কোন যুক্তিযুক্ত কারণ ছাড়া কেউই এভাবে নিজেদের প্রয়োজনীয় ত’থ্য আর ছ’বি দিতে রাজি হয়নি। মেম্বার শেষে মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে সবাইকে রাজি করায়। বলে গ্রামের উন্নয়নের লক্ষ্যে শহর থেকে এ’ন জি ও’র লোকজন এসেছে জ’রি’প করতে। আর উন্নয়নের কথা শুনেই কেউ আর দ্বিমত পোষণ করেনি। প্রায় সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর কাজটা মোটামুটি শেষ করতে পেরে রুশা আর হিমেল খুব খুশি। তারা সন্ধ্যার দিকে ফিরে এলো চেয়ারম্যান বাড়িতে। ফিরে এসেই ফ্রেশ হয়েই চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসে পড়লো সেই বারান্দায়। সেলিম ঝুম কে দেখতে গেছিলো। একটু আগেই ফিরে এসেছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রুশা সেলিমকে জিজ্ঞেস করলো
— ঝুম এখন কেমন আছে?

সেলিম চায়ের কাপটা হাতে ধরে আছে। এখন অব্দি একটা চুমুকও দেয়নি। সামনের দিকে তার দৃষ্টি স্থির থাকলেও মস্তিষ্ক জুড়ে অন্য চিন্তার বিচরণ। রুশা বিষয়টা খেয়াল করলো। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বলল
— সেলিম সাহেব কোন সমস্যা?

সেলিম নড়েচড়ে বসল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
— না না সমস্যা নেই। আপনি কিছু বলছিলেন?

রুশা অপেক্ষা না করে বলতে শুরু করল
— আমরা যথেষ্ট তথ্য সংগ্রহ করেছি। এখন কুমুকে দেখানো বাকি। সেটা দেখালেই কুমু নির্ধারণ করবে অ’প’রা’ধীকে।

কথাটা শুনেই সেলিম বেশ উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠলো
— তাহলে কুমুকে ডাকেন। আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই।

হিমেল এতক্ষণ চুপ করে ছিলো। সেলিমের কথা শুনে কুমুকে ডাকতে গেলো ভেতরে। ঘরের ভেতরে ঢুকেই দেখলো জানালায় মাথা ঠেকিয়ে কুমু কাদঁছে। হিমেল কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। তারপর এগিয়ে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
— কি হয়েছে তোমার? কাদছ কেনো?

কুমু চমকে উঠলো। ভীত চোখে তাকাল হিমেলের দিকে। শুকনো ঢোক গিলে বলল
— আপনি কখন এসেছেন?

হিমেল বুঝলো কুমু তার অতীতের কথা ভাবছিল এতক্ষণ। তার মনের ভ’য়’টা এখনো জীবন্ত। সেটা থেকে কিছুতেই সে বের হতে পারছে না। হিমেল এর উচিৎ এখন কুমুকে সময় দেয়া। তাকে আগলে রাখা। যাতে এই অতীতের কথাগুলো সে সহজে ভুলে যেতে পারে। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে সেরকম ভাবে সময় দিতে পারছে না সে। নিজেকে হিমেলের ভীষন অসহায় লাগছে। কুমু চোখের পানি মুছে হিমেলের দিকে তাকিয়ে বলল
— কোন সমস্যা হয়েছে নাকি?

হিমেল আলতো করে কুমুর মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলল
— কোন সমস্যা হয়নি। তুমি কাদছিলে কেনো?

কুমু কথা বলতে পারলো না। তার বুক ভেংগে কান্না আসছে। সে হিমেলকে দেখাতে চায়না। তাই নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আটকাবার বৃথা চেষ্টা করলো। চোখের কোন বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে হিমেলের শার্টে লেগে গেলো। কুমু কাদঁছে বুঝতে পেরেই হিমেল বলল
— শেষবার কেঁদে নাও কুমু। আর তোমাকে কাদতে দেবো না।

কুমুর কান্না এবার বাঁধ মানলো না। ফুপিয়ে উঠলো সে। হিমেল বাধা দিলো না। মেয়েটার মনের অবস্থা ভালো না। ভেতরে ভেতরে সে ভীষন কষ্ট পাচ্ছে। সেই কষ্টটা চোখের পানির সাথে বের হয়ে যাওয়াই ভালো।

———–
নিরব দর্শকের মতো তাকিয়ে আছে সবাই। উৎসুক দৃষ্টি তাদের। রুশা একের পর এক ছবি দেখাচ্ছে কুমুকে। নিশ্চুপ কুমু সচেতন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কোথাও যেনো কোন কিছু বাদ না পড়ে। সব ছবি দেখেও কুমুর প্রতিক্রিয়ার কোন পরিবর্তন হলো না। সবাই হতাশ হলো। এই একটা উপায় ছিলো অ’প’রা’ধীকে ধরার। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে তারা এতদূর এসেছে। কিন্তু কোন লাভ তো হলো না। রুশা কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলল
— তুমি কাউকেই চিনতে পারলে না?

কুমু মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো। মিনমিনে কণ্ঠে বললো
— এদের মধ্যে কেউ নয়।

রুশা হতাশ হয়ে বলল
— তুমি কি সিওর কুমু? তুমি দেখলে চিনতে পারবে তো?

কুমু জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে। উত্তেজিত হয়ে বলল
— আমি ভালো করে সবাইকে দেখেছি। আমার চিনতে ভুল হবে না। ওই চেহারা গুলো আমি কি করে ভুলে যাই।

বলতে বলতেই আবারও কেঁদে ফেললো সে। হিমেল মাথায় হাত দিয়ে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করে বলল
— কেঁদো না কুমু। সব ঠিক হয়ে যাবে।

কুমুর কথা শুনে সবাই হতাশায় ডুবে গেলো। শেষ একটা উপায় ছিলো। সেটাও কোন কাজে দিলো না। এখন কিভাবে সমাধান হবে। কোন কুল কিনারা পেলো না কেউ। সব থেকে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো গ্রামের মধ্যে কেউ যদি নাহয় তাহলে সেই ডা’কা’ত দল কোথায় থাকে। কুমুর ভাষ্যমতে তারা এই গ্রামের লোকজন। তাদের কথোপকথন থেকে এতটুকু ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে সে। রুশা হতাশ একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
— তুমি কি কোনভাবেই আর কোন ক্লু দিতে পারবে না কুমু? একটু মনে করবে আর কোন কিছু শুনতে পেয়েছো কিনা। যেকোন একটা ক্লু পেলেই আমরা এগিয়ে যেতে পারতাম।

কুমু নিজের মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করেও কোন লাভ হলো না। সে অল্প কয়েকটা কথা ছাড়া কিছুই বলতে পারছে না। সেসব পূর্বেও বলেছিলো। কিন্তু সেগুলো মিলিয়ে আসলে কোন গুরুত্বপূর্ণ কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি। সবাই ভীষন চিন্তিত। এতদূর এসে হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হবে ভাবতেই রুশার খারাপ লাগছে। পরিবেশটা থমথমে নিরব হয়ে গেলো। কেউ কোন কথা বলছে না। থেমে থেমে শুধু কুমু কেপে উঠছে। নিঃশব্দে কাদছে সে। হিমেল নিরব দর্শকের মতো কুমুর চোখের পানির দিকে তাকিয়ে আছে। তার ভেতরটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে কিন্তু দাতে দাত চেপে সহ্য করছে। সে কুমুকে থামাতে চায়না। কারণ কাদলে কিছুটা হালকা হবে সে। নয়তো ভেতরে ভেতরে এভাবে কষ্ট পেতে থাকলে মানসিক ভাবে বি’ধ্ব’স্ত হয়ে পড়বে। এই নিরব শীতল সান্ধ্য পরিবেশে একটা খবর হুট করেই সব উত্তপ্ত করে দিলো। খবরটা শুনেই সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলো কিছুক্ষণ। বিশেষ করে সেলিম কি করবে বুঝতে পারলো না। তার এক ভৃত্য এসে জানিয়ে দিলো মেম্বারের ছেলে শামীম মা’রা’ গেছে। নদীর ঘাটে তার হা’ত পা বাঁ’ধা লা’শ ভেসে উঠেছে। কেউ একজন সেটা দেখেই খবর পাঠায় চেয়ারম্যানের কাছে। সেলিম খবরটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করেই বসে থাকলো। মস্তিষ্ক খবরের সত্যতা খুঁজে পেতেই দৌড়ে চলে গেলো লা’শ দেখতে। সেলিম নদীর পাড়ে পৌঁছানোর আগেই পুরো গ্রাম হুড় হুড় করে সেখানে উপস্থিত হয়। মুহূর্তেই খবরটা ছড়িয়ে পড়ে সারা গ্রামে। ভীড় ঠেলে সেলিম লা’শে’র’ কাছে যাওয়ার পর দেখলো মেম্বার ছেলের ‘লা’শ জড়িয়ে ধরে কাদছে চিৎকার করে। ‘লা’শে’র অবস্থা বি’ভ’ৎ’স। হা’ত পা বাঁ’ধা। শরীরে কা’প’ড় ঠিক নেই। জায়গায় জায়গায় ক্ষ’ত’। সেলিমের পিছু পিছু হিমেল আর রুশাও এসে পড়েছে। রুশা এগিয়ে একদম লা’শে’র কাছে গিয়ে দাড়ালো। আলো জ্বালিয়ে খুব ভালোভাবে ‘লা’শ’টা পর্যবেক্ষণ করলো। উপস্থিত সবাই রুশার কর্মকাণ্ড দেখে অবাক হচ্ছে। যেখানে এই বি’ভ’ৎ’স লা’শে’র চেহারা দেখে পুরুষ মানুষের ভ’য়ে আ’ত্মা কে’পে উঠছে। সেখানে একটা মেয়ে মানুষ কিভাবে এসব স’হ্য করছে। রুশা অনেকটা সময় নিয়ে দেখে উঠে এলো সেলিমের কাছে। কিছুটা হতাশ হয়ে বলল
— মা’রা’র আগে নি’র্যা’ত’ন করা হয়েছে। চো’খ তু’লে ফে’লা হয়েছে। হা’তে’র র’গ কে’টে দিয়েছে। আ’ঙ্গু’ল গু’লোও গু’ড়ি’য়ে দিয়েছে। গ’র’ম শি’ক শ’রী’রে প্র’বে’শ করা’নো হয়েছে। নি’র্যা’ত’নে’র চূ’ড়া’ন্ত প’র্যা’য়ে যখন জ্ঞা’ন হারি’য়ে ফে’লেছে তখন গ’লা কে’টে জ’বা’ই করেছে।

সেলিম শুকনো ঢোক গিলে ফেললো। এর আগে মেয়েদের বি’ভ’ৎ’স লা’শ’ প্রায়শই দে’খা গেলেও কোন পুরুষের এম’ন লা’শ এই প্রথম। এরকম কেনো হচ্ছে? ভীড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলল
— চেয়ারম্যান সাব। এখন তো আমাগো ভ’য় লাগতাছে। এমনে ম’র’তে থাকলে আমাগো কি হইবে। কোনদিন না জানি আমা’গো লা’শ এমনে ভা’ই’সা ওঠে।

কথাটা শুনেই ভেতরটা কেপে উঠলো সেলিমের। এক অজানা ভ’য়ে’র আ’শং’কা। উত্তর দিতে পারলো না সে। এই মুহূর্তে তার ক’ন্ঠ’না’লী থেকে কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না। এখন তার সত্যিই ভ’য় হচ্ছে। গ্রামের মানুষদের নিয়ে। নিজেকে নিয়ে। ধীরে ধীরে গ্রামের পরিবেশ ভ’য়ং’ক’র হয়ে পড়ছে। এ থেকে নিস্তার পাওয়া কি আদৌ সম্ভব? গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো সেলিমের। হিমেল লা’শে’র দিকে তাকিয়ে হতাশ কণ্ঠে বললো
— আর কতো? এবারও কি প্র’শা’স’ন হস্তক্ষেপ করবে না? এবার আমার মনে হয় উপর থেকে প্র’শা’স’নে’র উপরে চাপ প্র’য়ো’গ করা উচিৎ। নাহলে অ’প’রা’ধী’রা আ’স্কা’রা পেয়ে যাবে। আর আরো জ’ঘ’ন্য কাজ করতেই থাকবে।

সেলিম একেবারেই বা’করু’দ্ধ। তার কথা বলার শক্তি সে হারিয়ে ফেলেছে। শামীমের এমন মৃ’ত্যু তাকে ভেতর থে’কে বি’দ্ধ’স্ত করে ফেলেছে। শামীম তার খুব কাছের একজন ছিলো। বয়সের অল্প ব্যবধান তাদের মাঝে। তাই এটা মানতে সেলিমের খুব কষ্ট হচ্ছে। মেম্বার ছেলের লা’শ আ’ক’ড়ে ধরে কেঁ’দে’ই যাচ্ছে। পুরো গ্রামের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। কেউ একজন বলল লা’শ’ টা নদীর পাড় থেকে গ্রামের ভেতরে নিয়ে যাওয়া দরকার। সবাই সায় দিতেই কয়েকজন শামীমের নি’থ’র দে’হ’টা তুলে নিলো। আর দুইজন মেম্বারকে ধ’রে নি’য়ে এলো। ধীরে ধীরে তারা গ্রামের ভেতরে একদম চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে এসে দাড়ালো। কুমু তখন ঘরে শুয়েছিল। সেও লা’শে’র কথা শুনে কিছুটা ঘা’ব’ড়ে গেছে। বাতাসে হা’হা’কা’র ভে’সে কানে আসতেই বিছানা ছাড়লো সে। জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। পর্দাটা হালকা সরিয়ে তার আড়ালে দাড়িয়ে উকিঝুকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো। প্রথমেই চোখ পড়লো হিমেলের উপরে। তাকে দেখেই কিছুটা সস্তি পেলো। কিন্তু পরক্ষণেই তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তির উপরে চোখ পড়তেই আ’ত’কে উঠলো কুমু। উত্তেজিত হয়ে গেলো স্না’য়ুত’ন্ত্র। মস্তিষ্ক অতিরিক্ত উত্তেজনার ভার বহন করতে না পেরে শরীরের সাথে সং’যো’গ বি’চ্ছি’ন্ন করলো। চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসতেই লু’টি’য়ে পড়লো সে।

চলবে…..

#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ৩৭

‘ এই মাইয়ারে ছা’ইড়া দিলে আমাগো বিপদ। হেরে মা’ইরা দে।’

‘ নাহ!’

চিৎকার করে উঠলো কুমু। সাথে সাথেই হিমেল বুকে জড়িয়ে ধরে অস্থির কণ্ঠে বললো
— কি হয়েছে কুমু? ভয় পেয়েছো?

হিমেল এর কথা গুলো কানে বাজলেও মস্তিষ্ক সেগুলোকে ধরতে পারলো না। তাই সময় মত উত্তরটাও দিতে পারলো না। সচল হতে বেশ কিছুটা সময় নিলো মস্তিষ্ক। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে সে। হিমেল মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
— তুমি ঠিক আছো?

কুমু কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো। হিমেল মুখটা আলতো করে তুলে বলল
— কি হয়েছিলো? তুমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলে কেনো?

কুমু সচেতন দৃষ্টিতে হিমেলের দিকে তাকাল। অল্প কিছু সময়ের ব্যবধানে মনে পড়ে গেলো সেই কথা। জানালা দিয়ে সেই ব্যাক্তির চেহারা দেখার পরেই সে তার দুর্বল স্নায়ুর উপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। আর জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায়। আবারও চোখের সামনে সেই বি’ভ’ৎস দৃশ্য ভেসে উঠতেই হাপাতে শুরু করে কুমু। কুমুকে এমন উত্তেজিত হতে দেখে হিমেল তাকে আগলে নেয়। মাথায় হাত রেখে অসহায় কণ্ঠে বলে
— ভয় পেওনা কুমু। সব ঠিক হয়ে যাবে। সময়ের সাথে প্রতিটা ক্ষ’ত নিরাময় হয়ে যায়।

কুমু শান্ত হলো না। বরং আরো অস্থির হয়ে উঠলো। হিমেল এবার কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লো। এই মাঝরাতে কুমু যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে ডাক্তার কোথায় পাবে। আর গ্রামের ডাক্তারের উপরে তার বিন্দুমাত্র ভরসা নেই। এই সময় তো শহরেও নেয়া যাবে না। কুমুকে একা রেখে গিয়েছিলো বলেই সে বাইরে খুব একটা সময় নষ্ট করে নি। সেখান থেকে ফিরে এসে দেখে
কুমু মেঝেতে পড়ে আছে। প্রথমে একটু ভয় পেয়ে গেলেও পরে বুঝতে পারে দুর্বলতার জন্য এমনটা হয়েছে। তাই তাকে আর ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়নি। কুমু প্রচন্ড কেপে উঠে বলল
— আমি তাকে দেখেছি।

হিমেল প্রথমেই কথাটা ধরতে পারলো না। চুপ করে থাকলো। কুমু আবারও উত্তেজিত হয়ে বলল
— আমি ওই লোকটাকে দেখেছি।

এবার হিমেলের মস্তিষ্ক সজাগ হলো। কথাটা ধরতে পেরেও নিস্তেজ কণ্ঠে বললো
— কোন লোকটাকে দেখেছো?

— ওই যে ডা’কা’ত দ’লের স’র্দা’র।

হিমেল থমকে গেলো। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো
— কোথায় দেখেছো? কিভাবে দেখেছো?

কুমু বড়ো করে একটা নিশ্বাস ফেললো। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
— বাইরে আওয়াজ শুনে আমি জানালায় দেখছিলাম। সেখান দিয়ে আপনাকে দেখতে পাই। আর আপনার পাশেই লোকটা ছিলো। ওই যে মাঝ বয়সী লোকটা। যিনি…

কুমু কথা শেষ করার আগেই দরজায় করাঘাত শোনা গেলো। প্রচন্ড ভ’য়ে হিমেলের বুকে মুখ লুকালো কুমু। হিমেল মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
— ভয় পায়না। আমি দেখছি। তুমি এখানেই বসো।

হিমেল দরজা খুলতেই রুশা অস্থির হয়ে বলল
— কুমু কেমন আছে?

হিমেল কিছুটা অবাক হলো। এই সময় রুশাকে সে কোনভাবেই আশা করেনি। কিছুটা ভাবুক কণ্ঠে বললো
— ভালো আছে। তুমি এই সময়? কি হয়েছে?

রুশা সচেতন দৃষ্টিতে একবার কুমুর দিকে তাকাল। তার শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে পরের কথাটা তার সামনে বলা ঠিক হবে কিনা সেটা নিয়ে একটা দ্বিধা চলছে মস্তিষ্কে। হিমেল হয়তো বুঝতে পারলো। তাই এক পলক কুমুকে দেখে নিয়ে বলল
— বাইরে চলো।

রুশা দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো। হিমেল বাইরে এসে দরজাটা একটু ভিড়িয়ে দিতেই রুশা একদম নামানো গলায় বলল
— ঝুমের বাবাকে পু’লি’শ নিয়ে গেছে। উনি নাকি শামীমের খু’নী।

হিমেল এর কপালে গাঢ় ভাঁজ পড়ল। ঘটনা কোথা থেকে কোথায় রূপ নিচ্ছে। ধীরে ধীরে পুরোটাই জটিল হয়ে পড়ছে। এর আসলে শেষ কোথায়। ঝুমের বাবার মতো মানুষ এমন নৃ’শং’স ভাবে কাউকে মা’র’তে পারে সেটাই বিশ্বাস হচ্ছে না। হিমেল চোখ বন্ধ করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল
— এটা কি কোন অথেনটিক নিউজ? আসলেই কি প্র’মা’ণ হয়েছে? নাকি আন্দাজে বলছে?

— শামীমের হাতের ঘ’ড়ি’তে ওনার স্প’ষ্ট ছা’প পাওয়া গেছে।

রুশার কথা এবার হিমেলের গোছানো সমস্ত ভাবনা এলোমেলো করে দিলো। একদম অগোছালো ভাবেই বলল
— তাহলে তো এখানে আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। তাহলে কি উনিই সব খু’নে’র সাথে জ’ড়ি’ত? এমন যদি হয় তাহলে ওনাদের বাড়ির মেয়েকে কেনো মা’র’লে’ন? শুনেছি শামীমের সাথে পরীর সম্পর্ক ছিলো। শুধু কি এই কারণে?

রুশাও বিষয়টা নিয়ে গভীর ভাবে ভাবছিলো। হিমেল এর কথার যুক্তি আছে। আসলেই তারা নিজেদের বাড়ির মেয়েকে কেনো মা’র’তে যাবে। আর এই কথা কি পরীর বাড়ির অন্য সদস্যরা জানে? আর ঝুমের সু’ই’সা’ই’ড এর কারণটাই বা কি হতে পারে। সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। হুট করেই হিমেলের কুমুর কথা মনে পড়ে গেলো। সে একটু আগেই বলছিলো লোকটাকে দেখেছে। তার পাশে দাড়িয়ে ছিলো। চোখ বন্ধ করে ফেললো। মস্তিষ্কে চাপ দিয়ে পুরো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর চেষ্টা করলো। তার পাশে কে দাড়িয়ে ছিলো? কিছুতেই মনে পড়ছে না। সেভাবে খেয়াল করেনি। সেটা কি ঝুমের বাবা? নাহ্! তার পাশে ঝুমের বাবা ছিলো না। তাহলে কে ছিলো? মস্তিষ্কে তীব্র চাপ পড়ায় মাথাটা চিনচিন করে ব্যাথা করে উঠলো। হিমেল চোখ খুলে ফেললো। মনে করতে না পেরে ভীষন বিরক্ত হলো। কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললো
— এতো তাড়াতাড়ি আপডেট কিভাবে পেলো? ফ’রে’ন’সি’ক রি’পো’র্ট ছাড়া কিছুই বলা সম্ভব না। আর মাত্র সন্ধ্যা বেলায় লা’শ’ পাওয়া গেছে। এখনই কিভাবে ফি’ঙ্গা’র প্রি”ন্ট ম্যাচ হলো?

রুশা উত্তেজিত হয়ে বলল
— একদম তাই। আমারও এটাই মাথায় এসেছিলো। আমি সেলিম সাহেব কে ফোন দিয়েছিলাম। উনি ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত করলেন। ফ’রে’ন’সি’ক রি’পো’র্ট নাকি তৈরি হয়েছে।

হিমেল অবিশ্বাসের সুরে বলল
— কিসব বলছো? মানলাম রি’পো’র্ট তৈরি হয়েছে কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি ফি’ঙ্গা’র প্রি’ন্ট ম্যাচ করলো কিভাবে? গ্রামে তো লোক আর কম না। এই দেখো আমরাই তো কয়েকদিন ধরেই খুঁজে বেড়াচ্ছি। তবুও পাচ্ছি না। তাহলে ধরে নিতে হবে ওনারা আগে থেকেই জানতো খু’ন’ হবে। তাই সব রেডি করে রেখেছিল। বিষয়টা কি হাস্যকর না? তুমি কিভাবে এটা বিশ্বাস করছো?

রুশার ভাবনা এবার ঘোলাটে হলো। এতক্ষণ বিষয় গুলো মাথায় থাকলেও নিজেকে সান্তনা দিয়েছিলো। কিন্তু হিমেলের কথাগুলো তার ভাবনায় পানি ঢেলে দিল। সব ঘটনা ঘোলাটে হয়ে গেলো। দূর দূরান্ত পর্যন্ত কোন হদিস পেলো না। হিমেল কিছু একটা ভেবে বলল
— সেলিম সাহেব কোথায়? ওনার সাথে একটু কথা বলা দরকার।

— উনি একটু পরেই আসবেন। ওদিকে কি যেনো কাজ করছেন।

হিমেল ভীষন চিন্তিত হয়ে পাশের চেয়ারে বসে পড়লো। তার চোখের সমস্ত ঘুম ছুটে গেছে। এখন র’হ’স্যে’র খোলাসা হওয়ার অপেক্ষা। অনেক্ষণ পর সেলিম আসলো। বি’দ্ধ’স্ত অবস্থায় এসেই বসে পড়লো চেয়ারে। মাথাটা দুই হাতে চেপে ধরে বলল
— রফিক কাকা এমন একটা কাজ করতে পারে কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। উনি নি’র্দো’ষ। ওনাকে ফাঁ’সা’নো হয়েছে।

হিমেল কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল
— এতো দ্রুত ফ’রে’ন’সি’ক রি’পো’র্ট কিভাবে আসলো?

সেলিম মাথাটা চেপে ধরেই বলল
— মেম্বার চাচার দুর সম্পর্কের কোন এক আত্মীয় ও’সি। ওনার নি’র্দে’শে’ই সব হয়েছে। উনিই ফ’রে’ন’সি’ক বি’ভা’গে’র লোকজন নিয়ে আসেন আর দ্রুত এর সু’রা’হা করেন। কিন্তু রফিক কাকাকে কে ফা’সা’বে? তার মতো ভালো মানুষের সাথে কার এমন শ’ত্রু’তা থাকতে পারে?

হিমেল গভীর ভাবে ভাবলো। তার মাথাটাও যন্ত্রণা করছে। এখন আর কোনভাবেই এই দুশ্চিন্তা নেয়া সম্ভব না। তাই ক্লান্ত গলায় বলল
— আপনি অনেক ক্লান্ত। শুয়ে পড়ুন। কাল দেখা যাবে। অবশ্যই ভালো কিছু হবে।

সেলিম মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। রুশাও নিজের ঘরে চলে গেলো। হিমেল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। ওই অদূরে জ্বলতে থাকা তারা দেখেই চোখ দুটোতে প্রশান্তি নেমে এলো। এখন কিছুটা ভালো লাগছে। ঘরের ভেতরে ঢুকেই কুমুর দিকে চোখ পড়লো। এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। কাছে গিয়ে তাকিয়ে থাকলো। ঘন নিশ্বাস পড়ছে। মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে। পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। কপালে একটা চুমু দিয়ে নিজেও পাশে শোয়ার প্রস্তুতি নিলো। ঘরের আলো নিভিয়ে দেয়ার জন্য সুইচ বোর্ডের কাছে যেতেই মস্তিষ্ক জানান দিলো সেই মানুষটার প্রতিচ্ছবি। যাকে তার পাশেই দেখেছিল কুমু। হিমেল এর টনক নড়ল। তীব্র রা’গ আর ঘৃ’ণা’য় শরীর কেপে উঠলো। দাতে দাত চেপে বলল
— এটা কিভাবে মাথা থেকে বেরিয়ে গেলো? সবার চেহারা কুমুকে দেখানো হয়েছে। বাকি ছিল শুধু এই কা’ল’প্রি’ট!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here