#নিখোঁজ_প্রেমের_শহরে
#পর্ব_১১,১২
#আতিয়া_আদিবা
১১
শিহাব নীলক্ষেতের একটি বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি অশ্লীল একটি বইয়ের দিকে। এ ধরনের বই বিক্রি করা হয় এ বিষয়ে শিহাবের ধারণা ছিল না। কাজেই তার চাহনীতে বিস্ময় ঝরে পরছে।
দোকানে উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েদের ভিড়। যদিও বইয়ের অভাব নেই। ভিন্ন ভিন্ন ক্যাটাগরির বই ঢালাওভাবে ছড়িয়ে রাখা আছে। তবুও ছেলেমেয়েগুলো অশ্লীল নাম লিখা বইগুলো হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে। মাঝে মাঝে খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে। যেন এসব বইয়ে মজার কোন গল্প লিখা আছে।
শিহাবকে বিচলিত দেখাচ্ছে। দশ দিনে বাংলায় বাঘ অথবা সিংহ হওয়া যায় এই টাইপের বই তাকে সংগ্রহ করতে হবে। কিন্তু এই ধরনের বইয়ের দেখা এ দোকানে মিলছে না। এই দোকানে আসার আগে বেশ কয়েকটি দোকান সে ঘুরে দেখেছে। সেসকল দোকানেও এরকম বইয়ের হদিস মিলে নি। গোটা নীলক্ষেত চষে বেড়ালেও এমন বই পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে!
দোকানদার অনেকক্ষণ ধরে শিহাবকে লক্ষ করছিলো। কোনো বই হাতে নিয়ে দেখছে না বলে সে তাকে জিজ্ঞেস করল,
ভাই কি বই নিবেন?
শিহাব অনুনয়ের সুরে বলল,
আপনার কাছে কি এমন কোন বই আছে যে বই পড়লে দশ দিনে বাংলার বাঘ হতে পারবো?
বাংলার বাঘ তো একটাই ভাই। রয়েল বেঙল টাইগার। আপনি রয়েল বেঙল টাইগার হতে চান?
না। না। আমি ভালো বাংলা শিখতে চাই।
দোকানদার ক্ষণিক কাল বিস্মিত চোখে শিহাবকে পর্যবেক্ষণ করল। তারপর বলল,
ভাই আপনিতো অনেক সুন্দর বাংলা বলতে পারেন। বাংলায় বাঘ হবার বই লাগবে কেন?
শিহাব হাসিমুখে বলল,
আমি মোটামুটি বাংলা বলতে পারি। পুরোপুরি পারিনা। That’s why I need the book.
দোকানদার মাথা চুলকে বলল,
বাঘ-সিংহ হওয়া যাইব এমন বই নাই ভাই। তবে শুদ্ধ বাংলা শিক্ষার বই আছে। নিবেন?
শিহাব বলল,
এই বইটা নিলে কাজ হবে কিনা বুঝতে পারছি না। যে আমাকে বইটা নিতে বলেছে তার কাছে শুনে তারপর জানাচ্ছি। প্রবলেম হবে?
দোকানদার অবাক দৃষ্টি মেলে বললো,
প্রবলেম হবে কেন?
থ্যাংকস।
শিহাব দোকান থেকে বেরিয়ে গেল। দোকানদার সন্দেহের চোখে শিহাবের দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলেটার কথাবার্তা পাগলের মত। সে পাগল কিনা তা ১০০ ভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যাচ্ছে না। তবে মানুষটা যে স্বাভাবিক না এতে কোন সন্দেহ নেই। দোকানদার গলা থেকে গামছা সরিয়ে বইগুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বিড় বিড় করে বললো,
পাগল-ছাগল কাস্টমার।
বর্ষা ঘরে শুয়ে ছিল। তার জ্বর এখনো পুরোপুরি সারেনি। অসুস্থতা নিয়ে বর্ষার মাঝে বিরক্তি ভাব চলে এসেছে। যতটা আগ্রহ নিয়ে সে অসুস্থ হতে চেয়েছিল, সেই আগ্রহের ছিটেফোটাও এখন তার মাঝে নেই। নিয়াজ করিম হাঁটতে বেরিয়েছেন। সাথে ফারুককে নিয়ে গেছেন। বাড়িতে মালা আছে। তাকে এক মগ গরম পানি দিয়ে যাওয়ার কথা বলতে হবে। গলা দিয়ে ফ্যাসফ্যাস শব্দ বের হচ্ছে। হালকা কুসুম গরম পানিতে নুন মিশিয়ে গরগরা করতে হবে। মালাকে ডাক দেওয়াটাও এই মুহুর্তে বর্ষার জন্য কঠিন বিষয়। সে এখন রান্নাঘরে। তাকে দিনের বেশিরভাগ সময় রান্নাঘরেই পাওয়া যায়। অদ্ভুত বিষয়, কাজকর্ম শেষ করেও সে রান্নাঘরেই বসে থাকে।
বর্ষা মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করেছিল,
কিরে মালা? সারাদিন রান্না ঘরে বসে বসে কি করিস? কাজকর্ম শেষ হলে একটু এদিকটাতেও তো আসতে পারিস!
মালা হেসে উত্তর দিলো,
আমার পাকঘরে থাকতেই ভালো লাগে।
কেন?
এই বাড়ির পাকঘরের বাসনা, আর আমগো বাড়ির পাকাঘরের এর বাসনা একই রকম। নিজের বাড়ি বইলা মনে হয়।
বাড়ির কথা অনেক মনে পরে?
পরে।
তাহলে যাস না কেন? দাদাজানকে বলে কয়দিন ঘুরে আসলেই পারিস।
মালা বিষন্ন হাসি হেসে বলে,
বাড়িতে জায়গা হইলে তো যামু! সৎ মায়ের যা অত্যাচার, সহ্য করা যায় না। এইখানেই ভালো আছি আমি।
তোর বাবা কিছু বলেনা?
বাপে কি কইবো। ওই মহিলা তো ডাকাইত। আমারে ঘরে রাখলে ডাকাইত মহিলা বাপেরে খাবার দিব না। তাই আমিও যাই না। তাছাড়া স্যারে আমারে মেলা আদর করে। আমি এইখানেই হাসিখুশি আছি।
তোর বাবা তোকে দেখতে আসে না?
আগে প্রতিমাসে আসতো। বেতন নিবার। এখন আর আসে না। ওই ডাকাইত মহিলা বাপেরে এইখানে আসবার দেয় না। আইসা কি করব? দাদাজান আমার বেতনের টাকা ব্যাংকে রাখতেছে। কইছে এই টাকা আমার ভবিষ্যতে কামে লাগবো। টাকাও পায়না, তাই দেখবার আসে না।
বড় দাদার প্রতি শ্রদ্ধায় বর্ষার মাথা নুয়ে আসে। হয়তো নিয়াজ করিমের মন এতটা নরম ও পবিত্র বলে তার চেহারায় নূরানী ভাব আছে। বর্ষা মায়ের কাছে শুনেছে, তার দুইজন দাদা যুবক বয়স থেকেই মানুষের জন্য নিঃস্বার্থভাবে করে গেছেন। হেফাজত করিমের বাবা যখন খেতে বসতেন তখন কোন ভিখারি যদি দুয়ারে কড়া নাড়তো, তিনি তার প্লেটের অর্ধেক ভাত তাকে খেতে দিতেন।
তাদের দুই ভাইয়ের দানের হাত ছিল প্রশস্ত।
বর্ষার গলায় হালকা ব্যথা করছে। সে গরম পানির কথা মালাকে বলতে রান্নাঘরে যেতে চাইল। গায়ের চাদর শক্ত করে জড়িয়ে বিছানা থেকে নামল। ঠিক এমন সময়, টেলিফোনটা বিচ্ছিরি ক্রিংক্রিং শব্দে বেজে উঠলো। পুরোনো মডেলের টেলিফোন। বেজে উঠলে শব্দটা কানে গিয়ে লাগে। এমন অদ্ভুত শব্দে বর্ষার মেজাজ কয়েক ডিগ্রী উপরে উঠে গেল। চোখেমুখে বিরক্তি নিয়ে সে রিসিভার উঠালো,
আসসালামু আলাইকুম কে বলছেন?
অপর পাশ থেকে পুরুষ কন্ঠে সালামের উত্তর শোনা গেল,
বর্ষা?
জি বলছিলাম। আপনি কে?
ইয়ে মানে! আমি শিহাব।
আপনি এবাড়ির নাম্বার পেলেন কিভাবে?
অফিস থেকে কালেক্ট করেছি।
অফিস থেকে নাম্বার কালেক্ট করে ফোন দিয়েছেন? কেন মনে রং লেগেছে?
শিহাব থতমত খেয়ে গেল। সে আমতা আমতা করে বলল,
আমি আসলে একটা ইমপোরটেন্ট কথা বলতে ফোন দিয়েছিলাম।
বর্ষা বিস্মিত স্বরে বলল,
ইম্পরট্যান্ট কথা? কি ইম্পরট্যান্ট কথা। বলুন শুনি!
আপনি বলেছিলেন না ১০ দিনে বাংলার বাঘ অথবা সিংহ হওয়া যায় এমন বই কিনতে? আমি আজ ভোরবেলায় বইটা কিনতে ঢাকায় এসেছি। নীলক্ষেতে। Trust me ! I could not find any book with this name here! দোকানদার অন্য একটা বইয়ের কথা বলল। what did he say ‘শুদ্ধ বাংলা শেখা’ নাকি কি জানি এমন বইয়ের কথা বলল। কি করব বল দেখি?
শিহাবের করুণ কণ্ঠে এমন প্রশ্ন শুনে বর্ষা রাগতে গিয়েও হেসে ফেললো। তার মেজাজ স্বাভাবিক তাপমাত্রায় ফিরে এলো। মুখ চাপিয়ে খানিকক্ষণ সে হেসেও নিল।
তারপর গলায় গম্ভীরতা ফিরিয়ে এনে বলল,
আপনি কি দোকানে দাঁড়িয়ে আমাকে ফোন করছেন?
শিহাব আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে ফোন করেছি।
আপনি দোকানে যান। দোকানদারের সাথে আমাকে কথা বলিয়ে দিন। আমি তাকে বুঝিয়ে বলছি। কোন বই দিতে হবে।
শিহাবের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে আপ্লুত গলায় বলল,
থ্যাংকস বর্ষা।
বর্ষা হাসল মাত্র।
দোকানদারকে ফোন দেওয়ার পর বর্ষা তাকে জিজ্ঞেস করল,
আপনার কি মনে হয় না আপনার সামনে যে কাস্টমার দাঁড়িয়ে আছে তার মাথায় সমস্যা আছে?
দোকানদার শিহাবের দিকে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে থেকে বলল,
হ আফা। মনে হচ্ছে।
শোনেন, আমি তার চিকিৎসক। একটি বিশেষ ট্রিটমেন্ট করছি। আপনার দোকানে সবচেয়ে কঠিন যে বাংলা শিক্ষার বই আছে তা উনাকে দিন। কঠিন উপায় বাংলা শিখিয়ে তার মস্তিষ্ক কে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এটি চিকিৎসার অংশ। বুঝেছেন?
জ্বী আফা বুঝেছি।
বইটা উনাকে দিয়ে বলবেন এই বইটি বাংলা শেখার সবচেয়ে সহজ মাধ্যম। ঠিক আছে?
জ্বী আফা ঠিক আছে।
দোকানদার শিহাবকে ফোন ফিরিয়ে দিল। সে ফোন কানে নিয়ে বলল,
সরি বর্ষা। তোমাকে ডিস্টার্ব করলাম।
বর্ষা মুখে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে বলল,
কোনো ব্যাপার নয়, ইংলিশ বাবু। শুভকামনা রইল।
শিহাব ফোন রেখে দিল।
দোকানদার ভেতর থেকে ধুলো ঝেড়ে মোটা একটি বই নিয়ে এলো। শিহাবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
এই বই পড়লে আপনার মস্তিষ্কে শুধুমাত্র বাংলায় ইন আর ইংলিশ আউট হয়ে যাবে। ডোস বেশি পড়লে ব্রেনই আউট হয়ে যাবে। হে হে। এইটা নিয়া যান।
শিহাব দোকানদারের কথার মানে বুঝতে পারলো না। হাসিমুখে তাকে টাকা দিয়ে বই হাতে নিয়ে বের হয়ে এলো।
চলবে….
#পর্ব_১২
#আতিয়া_আদিবা
সকালের বাতাসে ভিটামিন আছে। কিন্তু এবাড়ির ছাদে সেই ভিটামিনের পরিমাণ দ্বিগুণ। সম্প্রতি এরকমটা মনে করছেন হেফাজত করিম। কেননা, বাড়ির ছাদে বেশ কিছু সবজির গাছ লাগানো হয়েছে। আর সবজি হলো নানাবিধ ভিটামিনের উৎস। এর প্রভাব এ বাড়ির ছাদের বাতাসে রয়েছে। বাতাসে ভিটামিন ভেসে বেড়ায়।
এজাতীয় আবিষ্কার সম্প্রতি হওয়ার কারণ হেফাজতের ছাদে হাঁটাহাঁটি করার অভ্যাস ছিলো না। দিন কয়েক ধরে তিনি ছাদে হাঁটছেন। নিয়ম করে হাঁটলে শরীর-মন দুটোই ভালো থাকে। ছাদের এ মাথা থেকে ও মাথা তিনি চড়কির মত ঘুরেন। আর ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলেন। ঘেমে জবজবে অবস্থায় নিচে ফিরে আসেন। তারপর খালি পেটে এক গ্লাস চিরতার পানি পান করেন। এই পর্বে তাকে রুমানা এবং ঈর্ষা সংগ দেয়। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে নয়। ইচ্ছার বিরুদ্ধে। প্রথম দিন ঈর্ষা অর্ধেক গ্লাস চিরতার পানি পান করে মুখ চাপিয়ে মিনিট পাঁচেক বসে রইলো। তারপর বাথরুমের দিকে ছুটে গেলো। চোখ বড় বড় করে হড়হড় করে বমি করে ঘরে ফিরে এলো। হেফাজত নির্বিকার। বললেন,
প্রথম প্রথম এডজাস্ট করতে সমস্যা হবে। পরবর্তীতে আর হবে না। কথায় আছে না? ‘শরীরের নাম মহাশয়, যাহা সহাও তাহাই সয়’। আজ বমি হয়েছে। আগামীকাল হবে না।
ঈর্ষা গোমড়া মুখে বলল,
বাবা আমি শরীরে চিরতার পানি সহাতে চাইছি না।
হেফাজত শান্ত গলায় বললেন,
আমি দুঃখিত। এক্ষেত্রে তোমাকে সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা দেওয়া হয় নি। আমি যেহেতু বলেছি প্রতিদিন খালি পেটে চিরতার পানি খেতে হবে। তার মানে খেতেই হবে।
রুমানা নিচু স্বরে বলল,
মেয়ে যখন চাইছে না কি দরকার জোর করে খাওয়ানোর?
দরকার আছে। অবশ্যই দরকার আছে। চিরতা হলো মহৌষধ। তুমি জানো চিরতার আদি নিবাস কোথায়?
রুমানা বলল, না।
চিরতার আদিনিবাস হলো ভারতে। এর উৎপত্তিস্থল হলো হিমালয়ের পদতলে। প্রাচীণকাল থেকেই ভারতে চিরতা ব্যবহার করা হয় গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ হিসেবে। কত বড় বড় রোগ চিরতার কাছে বাচ্চার সমতুল্য জানো?
না। আজ জানলাম।
ঈর্ষা বিরক্তি ভরা কণ্ঠে বলল,
চিরতা অত্যাধিক তিতকুটে।
ভালো জিনিস তিতকুটেই হয়। যেমন ধর চিরতা তিতা। এটি তিতা বলেই এর আয়ুর্বেদিক নাম কিরাততিক্তা। করল্লাও তিতা। আবার সত্যি কথা বলা ভালো অথচ সত্য শুনতেও তিতা লাগে।
এটুকু বলে হেফাজত করিম হো হো করে উচ্চস্বরে হাসতে লাগলেন। যেনো সে মজার কোনো কথা বলে ফেলেছেন।
ঈর্ষা মনে মনে দোয়া করছে তার বর্ষা আপা যেনো দ্রুত ফিরে আসে। তার বিশ্বাস আপা ফিরে এলে বাবার এসব পাগলামি বন্ধ হবে। তবে আপা কবে ফিরবে তা ঠাহর করা যাচ্ছে না। আপা কই গিয়েছে তাও পরিবারের কেউ জানে না। মাকে চিন্তিত দেখায়। রোজ জায়নামাজে বসে চোখের জল ফেলেন। হেফাজত বিরক্ত হোন। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলেন,
এত কান্নাকাটি করার কি আছে? কেউ কি মারা গিয়েছে?
রুমানা ভাঙ্গা গলায় বলেন,
মেয়েটা কই গেলো, কোথায় আছে, কেমন আছে কিছুই জানি না অথচ তুমি একটু খোঁজও নিলে না। কিভাবে এত নিশ্চিন্তে বসে আছো? কেমন বাবা তুমি?
বাবাদের আবার প্রকারভেদ আছে নাকি?
আছে। তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে এতক্ষণে থানা পুলিশ করে ফেলতো।
আমার একটা মান সম্মান আছে। এই বয়সে এসে থানা পুলিশ করবো?
মেয়ের জীবনের থেকে মান সম্মান তোমার কাছে বড়?
এর উত্তর তুমি জানো রুমানা। খামোখা প্রশ্ন করো না। মন খারাপ হবে।
রুমানার ভেজা চোখ আরো ভিজে ওঠে। বিস্মিত চোখে স্বামীর দিকে তাঁকিয়ে থাকে সে। তার চোখে মুখে চিন্তার অত্যল্প পরিমাণও নেই! সে আছে তার সংসারে নতুন নতুন বিধান জারি করায়। সকালে নিয়ম করে হাঁটা, চিরতার পানি পান করা, বারোটার মাঝে দুপুরের খাবার শেষ করা, রাতের খাবারের ম্যানু পরিবর্তন করা ইত্যাদি!
সে দুহাত তুলে আল্লাহর কাছে সাহায্য চান,
ইয়া আল্লাহ! আমার মেয়েটা যেখানেই থাকুক তাকে তুমি সুস্থ রেখো। ভালো রেখো।
রেহনুমা সাধারণত শিহাবের ঘরে আসেনা। তবে মাসের বিশেষ একটি দিনে তিনি এ বাড়ির প্রতিটি ঘরের আনাচে কানাচে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে পরিদর্শন করেন। এই বিশেষ একটি দিন তার বাড়ি পরিষ্কার করা হয়। গ্রাম থেকে কমলার মাকে খবর দিয়ে আনা হয়। জানালার গ্রিল মোছা হয়। থাই গ্লাস পরিষ্কার করা হয়। ছাদের বাগানের আগাছা ফেলে দেওয়া হয়। পুরো বাড়ি একদম নতুনের মত লাগে। ঝকঝকে তকতকে।
আজকে সেই বিশেষ দিন। রেহনুমা প্রতিটি ঘর পরিদর্শনের পর শিহাবের ঘরে ঢুকলো। ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত খুব মনোযোগ দিয়ে দেখল। কোথাও ময়লা ছিটেফোঁটা আছে কিনা। কিন্তু না প্রতিবারের মতোই কমলার মা তাকে হতাশ করেনি।
ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি নিয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় সে হঠাৎ লক্ষ্য করল বিছানার পাশের টেবিলে একটি বই রাখা।
শিহাবের বই পড়ার অভ্যাস নেই। তার অবসর কাটে কার্টুন দেখে। তাহলে কিসের বই রাখা?
মনে কৌতুহল নিয়ে রেহনুমা টি টেবিলের কাছে গেল। অবাক হয়ে দেখল সেখানে বাংলা ব্যাকরণের বই রাখা আছে!
শিহাবের ঘরে বাংলা ব্যাকরণ বই কি করছে তা রেহনুমার বোধগম্য হলো না। তার ছেলের বাংলা শেখার প্রতি কোন আগ্রহ আছে বলে তো কখনো মনে হয়নি। এছাড়া ভাল চাকরি-বাকরি করতে আমাদের দেশে ইংরেজির ব্যাপক প্রসার। ভালো করে দু চারটি ইংরেজি শব্দ উচ্চারণ করতে পারলেই চাকরির বাজারে ব্যাপক ডিমান্ড!
এসব চিন্তা করেই না তিনি ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িয়েছেন। এর মাথায় নতুন করে বাংলা শেখার ভূত কবে থেকে চাপল?
আচমকা রেহনুমার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। সাথে মাথা চরকির মতো ঘুরতে লাগলো। তার মনে হচ্ছে, শিহাব বদলে যাচ্ছে। তার মাঝে বেশ কদিন ধরেই পরিবর্তন লক্ষণীয়। কিন্তু কেন?
রেহনুমা ঠিক করলো শিহাব বাড়ি ফিরলে এ বিষয়ে তার সাথে কথা বলবে।
সে তার ঘরে ফিরে জানালার ভারী পর্দা গুলো টেনে দিলো। দিনের আলো পর্দাগুলো ভেদ করে খুব একটা ঢুকতে পারে না। তাই পুরো ঘরে আবছা আলো আবছা অন্ধকার। রেহনুমা দরজা ভিরিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। তার ক্লান্ত লাগছিল কিন্তু ঘুম এলো না। বারবার একটি কথাই মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল,
তার ছেলেটা কি সত্যি পাল্টে যাচ্ছে? যদি পাল্টেও বা যায় তবে তা কার সংস্পর্শে এসে?
সখিপুরের তক্তারচালা এলাকাটি আজ বেশ উত্তাল। সকাল থেকে রাজনৈতিক দুটি দলের মাঝে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলছে। চলছে ইটপাথর ছোঁড়াছুঁড়ি। ঠিক সেসময়ই অফিসের গাড়ি নিয়ে শিহাব নিয়াজ করিমের ফার্ম হাউজে আসছিল। রাস্তায় কোথা থেকে একটি ইট উড়ে এসে অফিসের গাড়ির গ্লাস ভেঙ্গে সোজা শিহাবের মাথায় লাগলো। ঘটনার আকস্মিকতায় শিহাব বোকা বনে গেলো। খুব গভীর ক্ষত সৃষ্টি না হলেও বেশ রক্তপাত হয়।
ভাগ্যিস ড্রাইভার তুফান গাড়িটা তুফানের গতিতেই দিয়েছিল এক টান! নয়তো আরো চার পাঁচটি ইট পাথর গ্লাস ভেঙ্গে গাড়িতে এসে পড়তো।
বর্ষা বাড়ির সামনে পাটিতে বসে গল্পের বই পড়ছিল। এমন সময় ফারুক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। বর্ষা বিস্মিত স্বরে বলল,
আপনি এভাবে হাঁপাচ্ছেন কেন? আপনার হাঁপানি রোগ আছে নাকি?
ফারুক বলল,
না আপা। হাঁপানি রোগ নাই। শিহাব স্যার আসছেন। কপালে রক্ত। গল গল করে পড়তেছে।
কী বলছেন এসব?
সত্যি বলতেছি। আপনি আসেন আমার সাথে।
বর্ষা ফারুকের সাথে এগিয়ে গেল। কিছুদুর যাওয়ার পর দেখল শিহাবের অফিসের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কাঁচ ভাঙ্গা। পাশেই হালকা আকাশি রংয়ের ফরমাল শার্টে শিহাব দাঁড়িয়ে আছে। একটি রুমাল কপালে চেপে রেখেছে। রুমালটি লাল রঙের। ভেজা। সম্ভবত রক্তে ভিজে গেছে। বর্ষাকে দেখে শিহাব হাসার চেষ্টা করে বলল,
বাড়িতে ফার্স্ট এইড বক্স আছে? আসলে অনেক ব্লিডিং হচ্ছে তো।
বর্ষা বলল,
আছে। আসুন আমার সাথে।
শিহাব বর্ষার পিছে পিছে হাঁটতে লাগলো।
বর্ষা বলল,
আজকের দিনটায় এদিকে এসে ভালো করেন নি। সামনে ইলেকশন। এই এলাকা ভালো না। শুনেছি ইলেকশনের আগে দু চারটি লাশও ফেলে দেয়।
শিহাব আঁৎকে উঠলো,
বলেন কি? ডিরেক্ট মার্ডার?
হু। মার্ডার। এর মাঝে আসার কি প্রয়োজন ছিলো?
শিহাব অসহায় ভঙ্গিতে বলল,
মিস্টার নিয়াজকে রাজী না করাতে পারলে আমার জব চলে যাবে। I don’t want to lose my job. That’s why, I started learning Bangla.
শিহাবের কথা শুনে বর্ষার মায়া লাগলো। মজার ছলে ছেলেটার সাথে অন্যায় করা হচ্ছে কিনা তা নিয়েও সে খানিকটা চিন্তায় পরে গেলো।
চলবে…