#”মালিনী”পর্ব-২৪+২৫+২৬+২৭

0
653

#”মালিনী”পর্ব-24+25+26+27
#(নূর নাফিসা)
.
.
নিরিবিলি বাড়িটাতে আজ শুধু হুহু কান্নার আওয়াজ আছে। এতোদিন সবাই যার খেয়াল রাখতো, যাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতো আজ সে নেই! সবার কাজের ছুটি দিয়ে পাড়ি জমিয়েছে পরপারে! ঘর শূন্য, মন শূন্য! শূন্য হয়ে গেছে ভাবনার ভুবন! এখন আর কাউকে হসপিটাল দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না, বাজার লিস্টের আগে ওষুধের লিস্ট করতে হবে না। অপারেশনের জন্য টাকা জোগাড় করতে দিনরাত কাজ করতে হবে না। নিয়মমাফিক খাবার ওষুধ দেওয়ার জন্য সময় খুজতে হবে না। সব কিছুর মুক্তি দিয়ে লোকটা চলে গেছে না ফেরার দেশে!
এতটা সময় পেরিয়ে গেছে এখনো মলির কোনো প্রতিক্রিয়া নেই! মুহিতও চেষ্টা করলো কিন্তু ব্যর্থ সে! অবশেষে সবাই পরামর্শ দিলো তাকে ও বাড়ি থেকে নিয়ে চলে যেতে। ফরহাদ তা-ই করলো। মলিকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো চিটাগং এর উদ্দেশ্যে। ফরহাদ নিয়ে যাচ্ছে আর সে যাচ্ছে চুপচাপ। কোনো দিকের খেয়ালও নেই! ফরহাদ তাকে নিয়ে এয়ারপোর্টে এলো কিন্তু বিমানের টিকেট বুক করতে পারছে না। কনফিউশনে আছে ট্রেন ধরবে কি-না! পরক্ষণে পরিচিত ব্যাক্তির সাথে কথা বলে অনেক চেষ্টা করে বিমানের টিকেটই বুক করে ফেললো। রাত এগারোটার দিকে ফিরেছে বাসায়। ডাক্তারের সাথে ফোনে কথা বলেছে ফরহাদ। ডাক্তার জানালো সে প্রচন্ড শকড হয়েছে! কথাবার্তা বলে স্বাভাবিকভাবে চেষ্টা করতে। এতেই সতেজ হয়ে যাবে আশা করা যায়। ডাক্তারের কথামতো সে তাই করে যাচ্ছে। মলিকে বারবার বলে যাচ্ছে,
– মলি, এভাবে আছো কেন! একটু কথা বলো। দেখো, এমন করে থেকো না তুমি। স্ট্রোক হয়ে যাবে! তোমার প্রব্লেম হবে, বাচ্চারও প্রব্লেম হবে তুমি এমন করলে। আমাদের বাচ্চা আছে তুমি জানো না! এতো প্রেশার নিচ্ছো কেন তুমি! একটু চেষ্টা করো না স্বাভাবিক হওয়ার! সব ঠিক আছে। কিছু হয়নি। মলি..!
অনেকক্ষণ চেষ্টা করলো। অত:পর সে হাতমুখ ধুয়ে কিচেনে এলো। খাবার নষ্ট হয়নি তাই সেগুলো গরম করার জন্য চুলায় বসালো। হঠাৎ করেই এক আর্তনাদ ভেসে এলো তার কানে। সে ভয় পেয়ে গেছে! দ্রুত চুলা বন্ধ করে রুমে এসে দেখলো মলি ফ্লোরে বসে চিৎকার করছে! ফরহাদ দৌড়ে এসে তার পাশে বসে পড়লো। মলি তাকে ঝাপটে ধরে খুব জোরে পাগলের মতো চিৎকার করতে লাগলো! ফরহাদ দেখতে পারছে না তার এই অবস্থা! কিন্তু কিছু করতেও পারছে না। শুধু ঝাপটে ধরে রেখেছে।মলি কান্না করতে করতে বলছে
– আমি বাবার কাছে যাবো। আমার বাবা একা আছে। আমি বাবার কাছে যাবো! কোথায় রেখেছে আমার বাবাকে! আমি যাবো! বাবা বলেছে আমাকে যেতে!
মলির বুকে চেপে থাকা কষ্ট আর্তনাদ হয়ে বেরিয়ে আসছে। ফরহাদের দুচোখে গড়াচ্ছে অশ্রু। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলছে,
– মলি চুপ থাকো। সমস্যা হবে তোমার। শান্ত হও। কিছু হয়নি বাবার। আল্লাহ ভালো রেখেছেন উনাকে।
– একটুও ভালো নেই বাবা! একা একা ভালো থাকতে পারছে না। আমি গেলাম, বাবা আমার সাথে একটু কথাও বলেনি! রাগ করেছে আমার উপর!
– মলি শান্ত হও! কেউ কারো উপর রাগ করে যায় না। আল্লাহ যখন যাকে ইচ্ছে নিয়ে যায়। যার হায়াত যতদিন আছে তিনি ততদিনই থাকবেন পৃথিবীতে। কার দিন কখন ফুরিয়ে আসে কেউ বলতে পারবো না আমরা।
মলি ফরহাদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললো,
– আপনার জন্য। আপনার জন্য আমি বাবার সাথে কথা বলতে পারিনি! আপনার জন্য আমি বাবার কাছে থাকতে পারিনি। আপনার জন্য আমি একবারও দেখা করতে পারলাম না বাবার সাথে!
কেন নিয়ে এলেন এখানে! আমি সেখানেই তো ভালো ছিলাম! না আপনি আমাকে নিয়ে আসতেন আর না আমি বাবার কাছ থেকে দূরে থাকতাম! গতদিন গুলোও তো বাবার সাথে কাটাতে পারতাম! বাবার চিকিৎসা করাতাম। বাবা ভালো থাকতো।
প্রথমে কথায় তেজ থাকলেও শেষ দিকে কান্নায় ভেঙে পড়লো। ফরহাদ হতাশ হয়ে আবার তাকে ধরলো। মলি তার গলায় ঝাপটে ধরে কান্না করতে লাগলো।
– মলি, এভাবে ভেঙে পড়ছো কেন! কেউ তো চিরদিন থাকার জন্য আসেনি পৃথিবীতে। বাবার চিকিৎসা তো হয়েছেই। উনি আগের চেয়ে যথেষ্ট সুস্থও ছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা উনার হায়াত আল্লাহ এ পর্যন্তই রেখেছেন। নিজেকে শক্ত করো তুমি। বিয়ের পর তো রেখেছিলামই সেখানে। ছিলে না তো ভালো। বাধ্য হয়েই নিয়ে এসেছি তোমাকে। এমন আরও অত্যাচারের সম্মুখীন হতে অনেকের কাছেই। কোন দিক থেকেই ভালো ছিলে না তুমি সেখানে। এই মেয়ে, কান্না বন্ধ করো। কাদতে হলে নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে কেদে দোয়া করো বাবার জন্য। এভাবে নিজেরসহ বাচ্চার ক্ষতি করে ফেলবে! তুমি না বুঝতে চাইলে আমি বোঝাব কি করে! তুমি তো আর অবুঝ না। বুঝতে চেষ্টা করো একটু। তোমাকে নিয়ে ওদিকে তোমার পরিবারের বাকিরাও টেনশনে আছে। নিজেকে সামলাও।
মলি আরও কিছুক্ষণ ফরহাদের গলা ঝাপটে ধরেই কান্না করলো। কান্নার বেগ কমেছে কিন্তু থামেনি। ফরহাদের কথায় মলি ইশার নামাজ পড়ে নামাজে বসেই কাদলো। খাওয়ানোর চেষ্টা করলো কিন্তু মলি খেতে পারলো না। ফরহাদও খায়নি, সেই যে সকালে নাস্তা করেছে আর খাওয়া হয়নি। রাত কেটে গেলো মলির শুয়ে শুয়ে কান্না করেই। ফরহাদও ঘুমাতে পারেনি তার জন্য। ফজরের আযান দিলে উভয়ই নামাজ পড়ে নিলো। অত:পর ফরহাদ আবার তাকে খাটে এনে ঘুমাতে বললো। অনেক চেষ্টার পর এবার ঘুম নেমে এসেছে তার চোখে। ফরহাদ সস্তির নিশ্বাস ফেলে নিজেও ঘুমানোর চেষ্টা করলো। কেননা অফিসে আজ ছুটির দিন।
অনেক্ক্ষণ ঘুমিয়েছে সে। ঘুম ভেঙেছে দুপুরে। মলি এখনো ঘুমাচ্ছে। পুরো একদিন পর এখন পরিবেশটা শান্ত লাগছে তার কাছে। মলির মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুমন্ত মলির কপালে চুমু দিয়ে বিছানা ছাড়লো ফরহাদ। মুহিতের কাছে কল করে কথা বললো কিছুক্ষণ। কথা শেষ হতেই দেখলো এদিকে মলির ঘুম ভেঙে গেছে। চোখের পানি গড়িয়ে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। ফরহাদ তার দিকে আসতে আসতে বললো,
– গোসল করবে না? উঠো।
– মায়ের সাথে কথা বলবো।
– আগে গোসল করে এসো, তারপর কথা বলো। উঠো।
ফরহাদ জোর করেই তাকে নিয়ে গেলো গোসল করতে। অত:পর নিজেই রান্না সেড়ে নিলো। এদিকে মলি মা, ভাইয়া, ভাবির সাথে কথা বলে কাদতে লাগলো। ওদিকের লোকদেরও একই অবস্থা। শান্তনাও দিচ্ছে আবার নিজেই কাদছে। ইচ্ছে নেই তবুও ফরহাদের জোড়াজুড়িতে খাবার খেতে হলো। বিকেলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো চেকাপের জন্য। দুদিন ধরে যে অবস্থায় আছে মলি, তাকে নিয়ে ফরহাদ খুব টেনশনে আছে। ডাক্তার জানালো তেমন কোনো সমস্যা হয়নি কারোই কিন্তু মলি যেন প্রেশার মুক্ত থাকে সবসময়। এ বিষয়ে তিনি সতর্ক করে দিলেন। সবসময় তাকে হাসিখুশি থাকতে হবে। কিন্তু এদিকে মলি সারাক্ষণ মনমরা হয়ে ভাবে আর চোখের জল ফেলে! পরদিন ফরহাদ অফিসে গেলো তাও মাত্র দুঘন্টার জন্য। যতটা সম্ভব কাজ অন্যদের বুঝিয়ে দিয়ে সে ছুটে এসেছে বাড়িতে। বিকেলে মলিকে নিয়ে ঘুরতে বের হলো। বাইরে থেকে ঘুরে এলে মনটা ফ্রেশ হবে এটা ফরহাদের বিশ্বাস। নিয়ে গেলো সমুদ্রের তীরে। বেশ কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করলো। মলিকে বিভিন্নভাবে কথা বলা ও হাসানোর চেষ্টা করছে। হাসছে না কিন্তু টুকটাক কথা বলছে। আর ফরহাদের কৌশলগুলোও মলির কাছে পরিষ্কারভাবে ধরা দিচ্ছে। সে নিজেও চাইছে স্বাভাবিক থাকার কিন্তু পারছে না!
আরও এক সপ্তাহের মতো এভাবেই অতি শোকে কাটলো। আস্তে আস্তে বিলীন হতে চলেছে সেটা। এতোদিন অফিসে একটু আধটু সময় ব্যয় করলেও এখন সম্পূর্ণ সময় অফিসে কাটাচ্ছে ফরহাদ। সাথে মলির দিকটাও খেয়াল রাখছে। একটু পরপরই কল করে খোঁজ নেয় তার। সময় অতিবাহিত হচ্ছে আর ফরহাদের টেনশন বেড়ে যাচ্ছে। ডাক্তার খুব সতর্ক থাকতে বলছে। এসময় তার খেয়াল রাখার জন্য পাশে কাউকে রাখা দরকার। সে থাকে অফিসে, কখন কি হয়ে যায় বলা তো যায় না। তাই চিন্তা করলো ওই মহিলাকে কিছুদিনের জন্য এনে রাখবে।
এখন ওই মহিলাই এসে থাকে মলির কাছে, যতক্ষণ পর্যন্ত ফরহাদ অফিসে। মলি তিনটি নকশিকাথা বানিয়ে রেখেছে বাচ্চার জন্য। অবসর সময় তার এগুলো নিয়েই কেটেছে।
একদিন দুপুরে ফরহাদ বাসায় এলে আন্টি চলে গেলেন। খেয়েদেয়ে মাত্রই উঠেছে দুজন। মলিকে বসিয়ে ফরহাদই থালাবাটি কিচেনে নিয়ে যাচ্ছে। মলিও টেবিলের আসবাবপত্র গুছিয়ে এগিয়ে দিচ্ছে। এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো। ফরহাদ দরজা একটু খুলে বাইরে উঁকি দিতেই কেউ তাকে ঠেলে ভেতরে ঢুকে উচ্চ কন্ঠে বললো, “সারপ্রাইজ!!!”
অতি আহ্লাদে কথাটা বলে ভেতরে এসে অন্যদিকে মলিকে দেখে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেছে জেনিফা! মলিও তাকে দেখে অবাক! একবার জেনিফার দিকে তাকাচ্ছে একবার ফরহাদের দিকে! আর জেনিফা স্তব্ধ হয়ে শুধু তাকিয়ে আছে মলির দিকে! ফরহাদ এবার উল্লাসিত হয়ে জোর গলায় বললো,
– ওয়াও! হোয়াট এ ওয়ান্ডারফুল সারপ্রাইজ, জেনিফা! কাম এন্ড মিট উইথ মাই বেবি’স মম।
ফরহাদ মলির কাছে এসে মলির দু কাধে দুহাত রেখে হাসি মুখে বললো,
– সি, জেনিফা। সি ইজ মাই বেবি’স মম, মাই লাইফ পার্টনার মিসেস মলি ফরহাদ।
মলি কোনোরকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে দাড়িয়ে আছে শুধু। এদিকে জেনিফার চোখের কোটরে পানি চলে এসেছে! সে অবাকের চরম পর্যায়ে গিয়ে বললো,
– ফরহাদ, কি বলছো এসব তুমি!
– তুমি যা শুনছো আমি তো তা-ই বলছি! সে আমার জীবনসঙ্গী। বিয়ে করা বউ আর আমার বাচ্চার মা। বিয়ে করেছি আমরা আরও আটমাস আগে। ও বাড়িতেই তো আমাদের বাসর হলো! তুমি বুঝতেও পারোনি! ওহ্! তুমি তো সেদিন ছিলে না বাড়িতে। তোমার বোন ছিলো, জেরিন। তাছাড়াও আরও রাতদিন কাটিয়েছি একসাথে। কিন্তু দেখো, কেউই বুঝতে পারলো না সেটা! মনে পড়ে তোমার? হাত পুড়িয়ে দিয়েছিলে! এই যে দেখো, কিছুটা দাগ এখনো আছে। খুব কষ্ট লেগেছিলো আমার। ব্যাথা পেয়েছে ও, কষ্ট পেয়েছি আমি। মনে হলে এখানো আমার শরীর কেপে উঠে! ঠিক ওই মুহুর্তটায় তার কেমন লেগেছিলো! কতটা যন্তুজানোয়ার তোমরা ভেবে দেখেছো! তোমাদের ভাগ্য ভালো ছিলো বিধায় তোমরা বেচে গেছো। কেননা আমি সেদিন মলিকে নিয়ে চিটাগং চলে আসি। তা না হলে ওবাড়িতে তোমাদের দাফন করে আসতাম আমি!
– ফরহাদ! এটা করতে পারো না তুমি! ওকে বিয়ে! সব মিথ্যে বলছো! এভাবে আমাকে ধোকা দিতে পারো না! আমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। আংকেল বলেছে তোমার সাথে আমার বিয়ে হবে।
– রাখো তোমার আংকেলের কথা! আংকেল বললেই হবে নাকি! সংসার হবে আমার আর সংসারীনী ঠিক করবে আংকেল! এমন বিয়েতে আমি মত দিলে তো কখনো! বিয়ে তাও আবার তোমার মতো মেয়েকে! মেয়ে তো বলা যায় না, মেয়ে নামের কলঙ্কিনী একটা!
– ফরহাদ!
– গলা নিচে নামিয়ে! হুম! এটা তোমার বাবার বাসা নয়। সত্য বলতে তোমাকে আমার কখনোই পছন্দ নয়। পছন্দ হলে বিয়ে কবেই হয়ে যেতো! আর ভাবি হিসেবেও না পছন্দ তোমার বোনকে! জল্লাদ তোমরা।
– ফরহাদ আমি জানি না তুমি সত্য বলছো না মিথ্যে বলছো। এই মেয়ের জালে ফেসে গেছো তুমি। ও ফাসিয়েছে তোমাকে। এমন হলে বলো আমরা আইনের আশ্রয় নিবো। আর যদি সত্যিও হয়ে থাকে, তাহলে তাকে টাকা পয়সা দিয়ে বিদায় করে দাও। ও খুব লোভী। তোমার রুমের টাকা চুরি করেছিলো সে। টাকা দেখেই তোমার কাছে এসেছে সে।
– টাকা দেখে ও আমাকে ফাসায়নি বরং আমি তাকে ফাসিয়েছি আমার জালে। সে আসেনি আমার কাছে, আমি বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছি তাকে। বুঝতে পেরেছো? বাড়ি থেকে তুলে এনে কাজি অফিসে বিয়ে করেছি। চুরি করেনি সে টাকা। ওই টাকা আমিই রেখে এসেছিলাম তার জন্য আর ফোনে মেসেজ করে বলে দিয়েছি নিয়ে নিতে। কিন্তু এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়েও এই বোকা মেয়ে মুখ ফুটে সত্যটা বলতে পারেনি সেদিন আমার কথা ভেবে। রুম তো তারই ছিলো। যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারতো সে। যখন ইচ্ছে তখন যেতে পারতো। সেখানে তুমি তদন্ত করার কে! লোভী তো তুমি। টাকার জন্য আমার পেছনে লেগে আছো। বিয়ে না হতেই আমার কাছে তোমার এই দাবি সেই দাবি! আর ও, আজ পর্যন্ত একটা আবদারও রাখেনি আমার কাছে। একটা পয়সায়ও হাত দেয়নি সম্পূর্ণ অধিকার থাকা সত্ত্বেও। তাহলে সে কি করে লোভী হয়!
– বাহ! দারুণ সাপোর্টার তুমি! ফ্রেন্ডদের সাথে বেড়াতে এসেছি এখানে। ভাইয়ার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে ভেবেছি সারপ্রাইজ দিবো তোমাকে। কিন্তু এখানে এসে তো আমি নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেছি! ফরহাদ, এটা কিভাবে সম্ভব! একটা কাজের লোকের সাথে! ছি!
– কাজের লোকের সাথে সংসার কি যে মজার সেটা তুমি কিভাবে বুঝবে জেনিফা! তবে বুঝার একটা উপায় আছে। তুমিও কাজের লোককে বিয়ে করে নাও। ওহ্! তোমার বাড়িতে তো আবার কাজের লোক নেই! এক কাজ করো, তুমি আমাদের বাড়ির দারোয়ানকে বিয়ে করে নাও।
– ছি! এই মালিনীর বাচ্চাকে তো খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে!
– মাইন্ড ইওর ল্যাংগুয়েজ! ওকে নিয়ে আর একটা কথা বললে জ্বিভ ছিড়ে ফেলবো। কপাল ভালো থাকতে থাকতে বিদায় হও এখান থেকে।
– হুহ্, যাচ্ছি। এমন কিছু দেখতে হবে, আগে জানলে কখনোই আসতাম এখানে! আমাকে ধোকা দিয়েছো, খুব পস্তাবে! কেড়ে নেওয়া জিনিস টিকে না মালিনী।
জেনিফা কাদতে কাদতে বেরিয়ে যেতে লাগলো আর ফরহাদ পেছন থেকে উঁচু গলায় বললো,
– কেড়ে নেয়নি, ভাগ্যের জোরে পেয়ে গেছে। তাছাড়া আমাদের নিউজটা বাসায় জানিয়ে দিও। আমার জন্য একটু সুবিধা হবে। আমার সাহস হচ্ছে না জানানোর!
মলি বললো,
– এভাবে বলা কি ঠিক হয়েছে! জেনিফা ম্যাডাম কষ্ট পেয়েছে।
– চুপ থাক তুই! কিসের ম্যাডাম হ্যাঁ? কোন জনমে সে তোর ম্যাডাম ছিলো! সে কষ্ট পায় সেটা চোখে পড়ে আর নিজের কষ্ট চোখে পড়ে না! রুমে যা! বেশি ভালোগীরী দেখাতে আসবি না একদম!
ফরহাদের ধমকে একটু কেপে উঠেছে মলি। মুখটা মলিন করে রুমে চলে গেলো সে। এদিকে জেনিফার চোখে পানি দেখে মানবিকতার খাতিরে একটু খারাপ লাগলেও মনটা আজ খুব শান্তি পাচ্ছে ফরহাদের। এমন একটা দিনের খুব অপেক্ষায় ছিলো যেদিনটাতে উপযুক্ত একটা ডোজ দিতে পারবে। একটাকে তো দেওয়া হলো, বোনের শোকে হয়তো ওই জেরিনেরও শোক পালন হবে। দুই বোনের কষ্ট ভাবতেই আনন্দ লাগছে। এবার বুঝবে মানুষের আশা ও মন ভাঙার পরিণাম। নিজের বেলায় ষোল আনা আর অন্যের বেলায় কিছুই না। নিজের কষ্ট তাদের চোখে পড়ে আর অন্যেরটা চোখে পড়ে না।”মালিনী”

পর্ব- ২৫
(নূর নাফিসা)
.
.
দরজা লক করে ফরহাদ রুমে এসে দেখলো মলি জানালার পাশে দাড়িয়ে আছে। গাল বেয়ে ধীর গতিতে পড়ছে দুএক ফোটা অশ্রু। ফরহাদ এগিয়ে এসে পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললো,
– এতো পানি কোথা থেকে আসে চোখে! একটু কিছু বললেই বৃষ্টি পড়া শুরু হয়ে যায়!
মলি নিজ হাতে চোখের পানি মুছে নিলো। সেখান থেকে চলে আসতে চাইলেও ফরহাদ বাধা দিলো। তার সাহস নেই তাকে উপেক্ষা করার। চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। ফরহাদ তার কানে আলতো কামড় দিয়ে বললো,
– এই মনে এতো মায়া কেন অন্যের জন্য? অন্যের মনে তো এই মনটার জন্য বিন্দু পরিমাণও মায়া নেই। একটু স্বার্থপর হও। শুধু অন্যের দিক না দেখে নিজের দিকটাও দেখো। নিজের ভালোটা তো পাগলও বুঝে!
– কফি খাবেন?
– না।
কেউ আর কোনো কথা বললো না। দুজনেই তাকিয়ে আছে জানালার ওপ্রান্তে যতদুর চোখ যায়। দৃষ্টি ধাপে ধাপে অতিক্রম করেছে জানালার গ্রিল কড়ই গাছের ডালগুলো অত:পর কিছু ভবন। পরন্ত বিকেলের পরিবেশটা পাখির কলোরবে নতুন রূপে সেজে ওঠে এবং সোনালী রোদে ঝলমল করে চারিদিক। জানালার গ্রিলের ফাঁকে সোনালী আলো এসে পড়েছে একসাথে জড়ো হয়ে থাকা দেহ দুটির উপর। চলমান তাদের শ্বাসক্রিয়া আর কথোপকথন মনে মনে নিশব্দে। কি আলাপন হচ্ছে তাদের মাঝে কে জানে! না আছে কোনো শব্দ আর না আছে ইঙ্গিত। মালিনী তার মালিকের বুকে মাথা হেলান দিয়ে শুধু দিচ্ছে শব্দহীন সাড়া।
ফরহাদ ৫০ ভাগ নিশ্চিত ছিলো জেনিফা জানাবে না কাউকে। কেননা ফরহাদ যদি নিষেধ করতো তাহলে হয়তো আরও দ্রুত জানিয়ে দিতো। এখন উল্টো সে ই বলে দিয়েছে জানিয়ে দিলে তার উপকার হয়, আর জেনিফা কষ্ট পেয়ে নিশ্চয়ই কারো উপকার করবে না। তবুও ফরহাদ অপেক্ষায় আছে বাসায় খবরটা জানানো হয়েছে কিনা! রাত দশটা বেজে গেছে, এ পর্যন্ত তার বাসা থেকে কোনো কল আসেনি৷ সুতরাং সে নিশ্চিত কেউ জানেনি আর জেনিফা জানাবেও না।
ঘুমানোর সময় ফরহাদ মলিকে বললো,
– একটা দিন একা থাকতে পারবে? ঢাকা যাওয়ার প্রয়োজন ছিলো।
– হুম, পারবো। আপনি যান।
– আচ্ছা, আন্টিকে বলে যাবো কাল থাকতে।
মলি আর কিছু বললো না। চুপচাপ শুয়ে আছে। ফরহাদ কিছু একটা ভেবে বিছানা ছেড়ে উঠে এলো। মলি তার দুরত্ব অনুভব করতে পেরে চোখ খুলে তাকালো। দেখলো ফরহাদ কাউকে কল করছে। কথাবার্তা শুনে বুঝে নিলো বিমানের টিকেট বুক করেছে। সময়টা সকালের। তাহলে কি সে খুব সকালেই চলে যাবে! ফোনে কথা শেষ করতেই মলি উঠে বসে বললো,
– আপনি কি কাল সকালেই চলে যাবেন?
– হ্যাঁ।
– ব্যাগ গুছিয়ে রাখবো?
– না, ব্যাগ গুছাতে হবে না। ঘুমাও তুমি।
ফরহাদ মোবাইলে এলার্ম দিয়ে নিজেও শুয়ে পড়লো। এলার্ম বেজে উঠার আগেই তাদের ঘুম ভেঙে গেলো। মলি নাস্তা রেডি করার জন্য কিচেনে গেলে ফরহাদ কাজের মহিলাকে আনতে গেলো। মহিলাকে মলির পাশে রেখে সে হালকা নাস্তা করে বেরিয়ে গেলো ঢাকার উদ্দেশ্যে। মলির সারাদিন কাটলো মহিলার সাথে গল্প গুজব করে। বিকেলের দিকে মহিলাটি রান্না করছিলো আর মলি তার সাথেই কিচেনে ছিলো। এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো। তাদের বাড়িতে কে আসবে! মলি একটু ভয় পেয়ে গেলো! কেননা ফরহাদ প্রতিবারই তাকে সাবধান করে দিয়ে যায়। বাসায় একা থাকলে যেন দরজা খুলে বাইরে না যায়। আর যে কোনো সমস্যা হলে যেন ফরহাদকে জানায়। মহিলাটি দরজা খুলতে গেলে মলি নিষেধ করলো। অত:পর সে রুমে এলো ফরহাদকে কল করে জানানোর জন্য। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো ফরহাদ বেশ কয়েকবার কল দিয়েছে। অথচ সে আড্ডায় পড়ে রিংটোন শুনতেই পায়নি! শুনবেই কিভাবে, রুমের দরজা চাপানো ছিলো। মলি ব্যাক করতেই ফরহাদ রিসিভ করে বললো,
– কোথায় ছিলে এতোক্ষণ!
– কিচেনে ছিলাম। কে যেন কলিং বেল বাজাচ্ছে বাইরে!
– আমিই বাজাচ্ছি। দরজা খুলো।
– এতো তারাতাড়ি ফিরে এলেন যে!
– দরজা তো খুলবে আগে।
– ওহ্! হ্যাঁ, আসছি।
মলি রুম থেকে বেরিয়ে এসে দরজা খুলতেই ওপাশের মানুষদের দেখে অবাক! ফরহাদের সাথে ফাহিমা আন্টি! তাদের দেখে মলি দুকদম পিছিয়ে এলেই ফরহাদ ব্যাগ নিয়ে ঢুকে পড়লো এবং রুমের দিকে যেতে লাগলো। পরপর মুখে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে ফাহিমা আন্টি প্রবেশ করলো।
– কেমন আছে আমার মেয়েটা?
কথাটা বলে কাছে যেতেই মলি ফাহিমার পায়ের কাছে বসে পড়লো! এতে ফাহিমা চরম অবাক! মলি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে লাগলো,
– আন্টি, আমাকে ক্ষমা করে দিন। বিশ্বাস করুন, আমি স্বেচ্ছায় আসিনি এই পরিস্থিতিতে। আমি শুধু আপনাদের বাড়িতে কাজের উদ্দেশ্যেই গিয়েছিলাম। তাছাড়া অন্যকোনো উদ্দেশ্য ছিলো না! বিয়ের কোনো উদ্দেশ্যও ছিলো না! কিভাবে কি হলো সবটা আমার অজানা আন্টি!
– এই মেয়ে! পাগল হয়ে গেছিস! এসব কি শুরু করেছিস এ অবস্থায়! উঠ!
– আন্টি, বিশ্বাস করুন আমি সত্যি বলছি সবটা! কেন এমন হলো আমি জানিই না কিছু। আমি কখনো ভাবিওনি আপনার ছেলের বউ হবো!
– আরে কি শুরু করলি! আমি শুরু থেকেই সবটা জানি। উঠবি নাকি এবার! ফরহাদ…!
মলিকে বসে কাদতে দেখে ফাহিমা ফরহাদকে ডাকলো। কাজের মহিলাটিও কিচেন ছেড়ে বাইরে এসে দাড়িয়েছে। ব্যাগ রেখে ফরহাদ দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখলো মলি ফ্লোরে বসে আছে! তা দেখে তার প্রচুর রাগ উঠে গেলো! ধমকের সুরেই বললো,
– পাগল হয়ে গেছো তুমি! তোমার অবস্থা তোমার জানা নেই! উঠো!
মলি অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকালো ফরহাদের দিকে। অত:পর দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই পেটে ব্যাথা অনুভব করলো! সত্যি বলতে সে এই মুহূর্তের জন্য ভুলেই গিয়েছিল তার অবস্থার কথা! ফাহিমা তাকে উঠানোর জন্য টানতেই হাত সরিয়ে নিলো! এখন তো তার আরও ভয় হচ্ছে! ফরহাদ যেই রেগে আছে, যদি জানে সে উঠতে পারছে না তাহলে তো মেরেই ফেলবে! ফাহিমা আবার বললো,
– মলি, উঠ।
এদিকে মলি উপায় না পেয়ে ছলছল চোখে ফরহাদের দিকে তাকাতেই ফরহাদের মনে ভয় ঢুকে গেছে! সে দ্রুত হাটু ভেঙে মলির কাছে বসে পড়লো।
– কি হয়েছে? উঠছো না কেন?
মলি চুপচাপ আছে! কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। তার কান্না আসছে খুব! পেটে যে প্রচুর ব্যাথা লাগছে! সে ঠোঁট কামড়ে রেখেছে! ফরহাদ স্পষ্ট ভয় দেখতে পাচ্ছে মলির চেহারায়! তাই নিজে স্বাভাবিক হয়ে বললো,
– মলি বলো আমাকে। কি হয়েছে? উঠতে পারছো না তুমি? চুপ করে আছো কেন? বলো আমাকে। আমি কিছু বলবো না। বলো?
মলি মাথা ইশারা করে হ্যাঁ জবাব দিলো এবং কান্নার সাথে বলে উঠলো,
– পেটে ব্যাথা লাগছে আমার! উঠতে পারছি না আমি!
ফরহাদসহ সবার মনেই ভয় ঢুকে পড়লো! ফরহাদ তাকে ধরে বললো,
– আল্লাহ কি তোমার মাথায় একটু বুদ্ধিসুদ্ধি দেয়নি নাকি! আমি হেল্প করছি, দাড়াতে চেষ্টা করো তুমি।
ফরহাদকে ধরে আবার চেষ্টা করলো তবুও পারলো না। কান্না যেন তার আরও বেড়ে গেছে,
– পারছি না আমি উঠতে!
– ওকে, পা ছড়াও তুমি। পা ছড়িয়ে বসো।
ফরহাদ তাকে পা মেলে বসিয়ে বললো,
– একটুও নড়াচড়া করবে না! মা, তুমি থাকো ওর পাশে। আমি গাড়ি নিয়ে আসছি। হসপিটাল নিতে হবে।
ফাহিমা মলির কাছে বসে বললো,
– হ্যাঁ, দ্রুত যা। এই বোকা মেয়েকে নিয়ে আর পারা যায় না!
ফরহাদ এক প্রকার দৌড়ে বেরিয়ে এলো ফ্ল্যাট থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি রিজার্ভ করে আবার ফিরলো। আন্টিকে বাড়িতে রেখে ফরহাদ ও ফাহিমা মলিকে নিয়ে হসপিটাল চলে এলো। ডাক্তার তার অবস্থা দেখে বললো এই মুহূর্তে তাকে অপারেশন করাতে হবে। এমন অসাবধানতার কারণে সাথে তাদের একটু বকাঝকাও করলো। ফরহাদ অনুমতি দিয়ে দিলো অপারেশনের। বেডে করে মলিকে থিয়েটারের দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় মলির চেহারায় ভয় দেখছে ফরহাদ। তার নিজের মনেও আছে আজ পাহাড় সমতুল্য ভয়! তবুও মলিকে আশ্বাস দিতে মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে আলতো চুমু দিয়ে বললো,
– ভয় পাচ্ছো কেন? কিছু হবে না দেখো। সব ঠিক আছে।
মলির দুচোখের কোটর ভেদ করে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। ভয়ার্ত কন্ঠে সে ফরহাদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
– আমি মরে গেলে কি আপনি আরেকটা বিয়ে করবেন? জেনিফা ম্যাডাম হয়তো ভালো হয়ে গেছে। বিয়ে করলে তাকেই করবেন।
এই মুহূর্তে মলির মুখে এমন কথা শুনে ফরহাদের সর্বাঙ্গ রাগে ঝিমঝিম করছে! হঠাৎ করেই সে চিৎকার করে বললো,
– মালিনীর বাচ্চা! তুই বেডে শুয়ে জেনিফার চিন্তা করছ! আমাকে না জ্বালালে তোর ভালো লাগে না! খুন করে ফেলবো আমি তোকে! নিয়ে যান আমার চোখের সামনে থেকে, না হলে সত্যিই মেরে ফেলবো এখন।
মলি তার চিৎকারে চোখ খিচে বন্ধ করে রেখেছে। নার্সরাও ভয় পেয়ে গেছে ফরহাদের পাগলের মতো আচরণ দেখে। তারা দ্রুত থিয়েটারে নিয়ে যেতে লাগলো মলিকে। এদিকে ফাহিমা তার ছেলেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে! ফরহাদ ফাহিমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বললো,
– মা, দেখেছো কি বলে গেলো! আমি সর্বদা তাকে নিয়ে ভয়ে থাকি আর সে এই অবস্থায় থেকে আমার ভয় আরও বাড়িয়ে দিয়ে গেলো! অফিসে গিয়ে কাজ করতে পারিনা আমি তার জন্য! সারাক্ষণ মাথায় সে ঘুরে। গত কয়েকমাস আমি ঠিকমতো ঘুমাতেও পারিনি তার জন্য! কোথাও গিয়ে একটু শান্তিতে থাকতে পারিনা, পাগলের মতো ছুটে আসি তার কাছে! চোখে হারাই আমি তাকে। সে একটুও বুঝে না কেন আমাকে! ও মরে গেলে আমি বাচবো কি নিয়ে! দিনরাত এক করে এতোটা কেয়ার করি আমি আর সে আমাকে না বুঝে কেমন ভয় দেখিয়ে গেলো দেখলে তো তুমি! তুমিই বলো, থাকতে পারবো আমি ওকে ছাড়া!
ফাহিমা আচলে নিজের চোখ মুছে বললো,
– শান্ত হ তুই। কিছু হবে না ওর। আল্লাহ সব ঠিক রাখবেন। দোয়া কর আল্লাহর কাছে। ওই যে ডাক্তার আসছে।
ফরহাদ চোখ মুছে ডাক্তারের সামনে দাড়িয়ে বললো,
– মিস, প্লিজ ওদের যেন কিছু না হয়। কন্ডিশন যদি অনেক খারাপ হয়ে থাকে, বাচ্চা লাগবে না আমার। ওকে সুস্থ করে তুলুন। ওকে আমার সুস্থ অবস্থায় চাই। প্লিজ ওদের যেন কিছু না হয়!
– আপনি পুরুষ মানুষ হয়ে এভাবে ভেঙে পড়ছেন কেন! শান্ত হন। ডাক্তারের আসনে আমরা এমনিই বসিনি। আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে রোগীকে সুস্থ ভাবে ফিরিয়ে আনার। আপনারা ওদিকটায় গিয়ে অপেক্ষা করুন। আর ওপরওয়ালাকে ডাকুন। সব কিছুর মালিক তিনি। শুধু চেষ্টা আমাদের।
ডাক্তার চলে গেলো। কয়েক মিনিট পরেই থিয়েটারের লাল বাতিটা জ্বলে উঠলো। এদিকে তাদের মা-ছেলের মনে ভয় আরও চেপে গেলো। আল্লাহকে ডাকছে। ফরহাদ ফাহিমাকে এনে পাশের একটা কেবিনের বাইরে সিটে বসালো। নিজেও মায়ের কোলে মাথা রেখে মেঝেতে বসলো। হাত-পা যেন ঠান্ডা হয়ে আসছে তার! ভেতরটায় শুরু হয়ে গেছে উথালপাথাল! ধুকপুক শব্দ যেন কান পর্যন্ত চলে আসছে। কিছুটা সময় অতিবাহিত হতেই ফরহাদ তার মাকে বসিয়ে চলে গেলো মাগরিবের নামাজ পড়তে। হসপিটালের মসজিদে এসে সে মাগরিবের নামাজ আদায় করলো সাথে অতিরিক্ত দু রাকাআত নফল নামাজ আদায় করলো। ফাহিমা ওযু করে এসে এখানে বসে বসেই ইশারায় নামাজ পড়ে নিলো। এছাড়া কোনো উপায় পেলো না। ফরহাদ নামাজ শেষ করে এদিকে আসতেই দেখলো থিয়েটার থেকে ডাক্তার বের হচ্ছে। ফরহাদ দ্রুত পায়ে হেটে কাছে এগিয়ে এলো। ফাহিমাও উঠে দাড়ালো। ফরহাদ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ডাক্তার হাসিমুখে বললেন,
– টুইন বেবি হয়েছে আপনার। মম বেবি সবাই সুস্থ আছে। যথাসময়ে আপনারা হসপিটাল পৌছেছেন বিধায় কোনো প্রব্লেম হয়নি।
ফরহাদ মনে মনে “আলহামদুলিল্লাহ” বললো আর ফাহিমা প্রকাশ্যে। ডাক্তার ফাহিমাকে বললো,
– আপনি কি দাদু নাকি নানু?
– জ্বি, আল্লাহর রহমতে দাদুই হয়ে গেলাম।
– আচ্ছা! যেহেতু টুইন বেবি, মিষ্টি কিন্তু ডাবল খাওয়াতে হবে।
– তা অবশ্যই। কেবিনে শিফট করবেন কখন?
– এইতো কিছুক্ষণের মধ্যেই।
কিছুক্ষণ পরেই কেবিনে শিফট করা হলো তাদের। ফাহিমা ও ফরহাদ উভয়েই এলো। মলির জ্ঞান ফিরেনি এখনো। ফাহিমা মলির মাথায় হাত বুলিয়ে নার্সের কাছ থেকে একটা বাচ্চাকে কোলে নিলো। অন্যজনকে ফরহাদ। এক ছেলে এক মেয়ে। দুজনকে দেখেই ফরহাদের মুখে ফুটে উঠলো হাসির রেখা আর চোখে অশ্রু। মেয়ে বাবুটা বাবার কোলে থেকে মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে ঘুমাচ্ছে আর ছেলে বাবুটা দাদুর কোলে থেকে ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে আছে সাথে মুখ কাচুমাচু করে একটু আধটু কান্না করছে। ফাহিমা নিজের ছেলের খুশি দেখে প্রশান্তির নিশ্বাস ছাড়লো। তিনি হাসি মুখে ফরহাদের পিঠে হাত রাখলেন। ফরহাদ বললো,
– মা, বাচ্চারা কার মতো দেখতে হয়েছে বলোতো?
ফাহিমা একবার মলির ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
– বাচ্চারা তাদের বাবা মায়ের সংমিশ্রণে হয়েছে। ছেলেটা দেখিস, একটু বড় হলে অনেকটা জিহানের মতো দেখাবে। জিহানও নবজাতক থাকতে এমন ছিলো। তুইও এমনটাই ছিলি। জিহানের সময় বলতাম জিহান তোর মতোই দেখতে হবে। আর রাজকন্যা তো এই প্রথম এলো আমাদের ঘরে!
ছেলে বাবুটা একটু আধটু কান্না করছে তাই নার্স এসে নিয়ে নিলো। আর মেয়ে বাবুটা মায়ের মতো শান্ত হয়ে বাবার কোলে ঘুমাচ্ছে। ফরহাদ তাকিয়ে আছে ঘুমন্ত মেয়েটার দিকে। মলির অনেক বৈশিষ্ট্য লক্ষ করছে তার মেয়ের ঘুমন্ত চেহারায়।

,
– আমি জানি তোদের বিয়ের ব্যাপারে সবটা। আমার ছেলে আমাকে না জানিয়েই বিয়ে করবে নাকি! বিয়ের দিন সকালে আমাকে সালাম করে বলেছে, “মা, যাচ্ছি তোমার পছন্দের রানীকে বিয়ে করতে।” আমার অনুমতি নিয়েই বেরিয়েছে বাড়ি থেকে। আর ওদিকে তোর মায়ের অনুমতি নিয়ে সম্পন্ন করেছে বিয়ে।
মলির মনে পড়ে গেলো ফরহাদের সেই কথা! কাজী অফিসের বাইরে এসে বলেছিলো, “বিয়ে তো দু পরিবারের সম্মতিতেই হচ্ছে! তোমার পরিবার থেকে তুমি আর আমার পরিবার থেকে আমি।” তাহলে সম্মতি সেদিন দুপরিবার থেকে দুই মা দিয়েছে!
মলি বললো,
– এটা কিভাবে সম্ভব! আমরা তো বস্তিতে থাকি, আর আপনারা রাজমহলে!
– রাজমহল তোদেরও। তোর বাবা বাসায় না জানিয়ে পালিয়ে বিয়ে করেছে তোর মাকে। তাও আবার তোর মা অশিক্ষিত। এজন্য তোর চাচা অর্থাৎ ফরহাদের বাবা তোর বাবাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় বিয়ের দিনই! পিতার অবর্তমানে পিতৃত্বের স্নেহ দিয়ে মানুষ করে তুলেছিলো তোর বাবাকে। যার ফলে তিনি খুব কষ্ট পেয়েছেন তোর বাবার কর্মে, সম্মানে লেগেছিলো উনার। তাই মেনে নিতে পারেন নি সেদিন। ওদিকে তোর মায়ের বাড়িতেও নেই ঠাই! অবশেষে আশ্রয় নেয় বস্তিতে। বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে সেটা জানতে পারি আমি চার বছর পর। তোর মায়ের সাথে আমার দেখা হয়েছিলো একদিন। তখনই জানতে পারি। তখন মুহিতকে দেখেছিলাম তিন বছরের। আর এদিকে ফরহাদও দুবছর বয়সের। আর ফারদিন ফরহাদের তিন বছরের বড়। ফরহাদের বাবাকে সাধ্যমতো বুঝানোর চেষ্টা করেছিলাম আমি কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। এরপর আরও চার পাচ বছর পর আবার তোর মা ও বাবার সাথে দেখা। তখন তুই ছিলি তোর মায়ের কোলে। বয়স তোর দু-তিন বছর। সেদিন তোর বাবাকে না জানিয়ে তোর মাকে গোপনে বলেছিলাম তোকে আমার কোনো এক ছেলের বউ করে ঘরে তুলবো। ফারদিনকে জানানোর সুযোগ পাইনি, কেননা সে আগেই পাত্রী ঠিক করে ফেলেছে। অত:পর গত দেড়-দু বছর আগে জানাই ফরহাদকে। সে কাজের ফাকে ঢাকা ফিরে খুজে খুজে বের করে তোদের সন্ধ্যান। আমি তোদের ছোট থাকতে দেখেছি কিন্তু বড় হয়ে আর দেখিনি। ফরহাদই চিনিয়েছে আমাকে। তারপর থেকে তোকে চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করেছি সেই সুযোগও হয়ে গেছে তুই বাগানে কাজ করতে যাওয়ায়।
ফাহিমাকে থামিয়ে দিয়ে ফরহাদ বললো,
– মা, এসব বলে কোনো লাভ নেই শুধু শুধু! যা হবার ছিলো হয়েছে, ওদিকে আর ঘাটাঘাটি করো না।
– ঘাটাঘাটি না করলেও জানা দরকার। তুই না বাসায় যাবি। কি কি দরকার নিয়ে আয়, যা। বাবুকে আমার কাছে দিয়ে যা।
ফরহাদ মেয়ে বাবুটাকে দেওয়ার সময় নড়াচড়া পেয়ে ঘুম ভেঙে গেছে। ছোট ছোট চোখ মেলে তাকিয়েছে বাবুটা। তা দেখে ফরহাদের ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠেছে হাসির রেখা। ফাহিমার কোলে দিয়ে আবার নার্সের কাছে এসে ছেলে বাবুটাকে একটুখানি সময়ের জন্য কোলে নিলো অত:পর বেরিয়ে গেলো। নার্স এগিয়ে এসে ছেলে বাবুটাকে মলির কাছে রাখলো। মলি ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে তার ফুটফুটে দুই সন্তানের দিকে। ফাহিমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
– বড়মা, ওরা আপনার ছেলের মতো না দেখতে?
ফাহিমা মুচকি হেসে বললো,
– ওরা বাবা মা উভয়ের আকৃতি পেয়েছে।
মলি মনে মনে মাশাল্লাহ বলে ফাহিমাকে বললো,
– উনি লুকিয়ে কেন বিয়ে করলেন?
– বিয়ে করবে সেটা জানতাম কিন্তু সেদিনই কেন বিয়ে করলো সেটা জানা নেই। তুই যখন তোর বাবা অসুস্থ হওয়ায় কাজে আসছিলি না তখন বারবার জিজ্ঞেস করেছিলো, “মা, মলি এসেছে?” তার দুদিন পর হুট করেই বললো, “বিয়ে আমি আজই করবো, তা না হলে কখনোই করবো না আর মলিও আসবে না।” আমি আর কি করবো, তোর মাকে বলেছি তোকে আমার ছেলের বউ করে নিবো তাই অনুমতি দিয়েই দিলাম। তোর মা ফরহাদের নাম শুনেই নাকি অনুমতি দিয়ে দিয়েছে। বাসায় কাউকে জানায়নি। ফরহাদের তো তার বাবার সাথে আগে থেকেই রাগ। তারপরও চেয়েছিলো সুযোগ বুঝে বলে দিবে আর তার বাবার রাগ ভাঙ্গিয়ে তোদের পরিবারকেও ওবাড়িতে তুলবে। কিন্তু ঘটে গেছে ভিন্ন কিছু! তোকে চোরের অপবাদ দিয়ে হাত পুড়িয়ে দেওয়ায় আমি তোর আঙ্কেলকে জানিয়েছি কিন্তু তিনি ফারদিন ও জেরিনকে কিছুই বলেনি। তা শুনে ফরহাদ তার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলে। সে আর ওবাড়িতে ফিরেও না, কাউকে কিছু জানানোর প্রয়োজনও মনে করে না। আমাকেও নিষেধ করে দিয়েছে কাউকে কিছু জানাতে। কিন্তু টাকা যে সে দিয়েছিলো সেটা কি আমি জানি! তুইও তো বললি না কিছু। তোর আংকেলই না জেনে কি বিচার করবে! তিনিও ভেবে নিয়েছে চুরি হয়েছে। কিন্তু ফরহাদ এতোকিছু বুঝতে চায় না। তার জেদ, তার বাবা তাদের কিছু বললো না। তাই সে তোকে নিয়ে দূরেই থাকতে চায়। ও বাড়িতে ফেরার কোনো ইচ্ছে নেই তার। তাই আর জানালো না কাউকে। আমাকে বলেছে চিটাগং চলে আসতে। বললেই কি আর সেটা সম্ভব! সংসার ফেলে কি আর চলে আসা যায়! তোর আংকেল জিদ্দি লোক একটা। সবসময় চায় নিজের মর্জিতেই চলতে। এদিকে ছেলে দুটোও একই রকম! যে যা বলে তা-ই! মাঝে পড়েছি আমি! তোর আংকেলকে বুঝিয়েছিলাম বেশ কয়েকবার তবুও গেলো না সেদিন তোর বাবাকে খুজে ফিরিয়ে আনতে। একটা মাত্র ভাই ছিলো, দূরে সরিয়ে দিয়ে নিজে কষ্ট পেয়েছে তবুও যায়নি খুজতে। অথচ তোর বাবার সম্পদ ভাগ করে আলাদা করে রেখে দিয়েছে এখনও। বাড়ির সামনের অর্ধেকটা ফাকা দেখেছিস না, এটা সম্পূর্ণই তোদের।
মলি ফাহিমার কথা শুনছে আর অবাক হচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে তার মাঝে কোনো আফসোসের রেশ নেই। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে করা ফরহাদের আচরণ দেখে সে ফাহিমাকে জিজ্ঞেস করলো,
– উনি এখন রেগে আছে কেন? কেমন করে যেন কথা বলে গেলো আপনার সাথে!
– রেগে থাকবে না! আমার ছেলেটাকে এতো জ্বালাতন করস কেন তুই! ছেলেটা তোর জন্য ভয়ে ভয়ে এমনিতেই আধমরা হয়ে গেছে! তার উপর থিয়েটারে যাওয়ার আগে কি বলে গিয়েছিস তুই মনে নেই! এই অবস্থায় আছিস বলে তো তুই বেচে গেলি! না হলে তোকে মাইর লাগাতাম আমি!
– কি করবো, আমিও তো ভয় পেয়েছিলাম। ভেবেছি মরেই যাবো!
– চুপ থাক। এসব বলিস না আর কখনো। ফরহাদ কান্না করেছে তোর কথা শুনে! বারবার বলছিলো, “মা, আমি থাকতে পারবোনা মলিকে ছাড়া। সে আমাকে একটুও বুঝে না কেন! সারাক্ষণ আমাকে ভয় দেখায়!” ডাক্তারকে গিয়ে বলছিলো যেন বাচ্চার আগে তোকে সুস্থভাবে ফিরিয়ে আনে।
মলি তার দৃষ্টি নামিয়ে পাশে থাকা বাচ্চার দিকে তাকালো। একটু পরেই ডাক্তার এসে তাকে ও বাচ্চাদের দেখে গেলো। মলিকে কিছু কিছু বিষয়ে সতর্ক করে দিলো। তার কিছুক্ষণ পরেই ফরহাদ আন্টিকে নিজেদের বাসায় রেখে কাপড়চোপড়সহ কিছু আসবাব নিয়ে ফ্ল্যাটে তালা লাগিয়ে হসপিটাল চলে এলো। রাতে ফাহিমাকে মলির সাথে থাকতে দিলো কিন্তু ফরহাদকে ওয়েটিংরুমে থাকতে হলো। সকালে ফাহিমাকে নাস্তা এনে দিলো নিজেও অল্প খেয়ে নিলো। আর মলির খাবার সেলাইন! এ পর্যন্ত ফরহাদ মলির কাছেও আসেনি এমনকি মলির সাথে কথাও বলেনি একবার! মেয়েটা কান্না করছে বিধায় ফাহিমা কোলে নিয়ে কেবিনে হাটছে। এদিকে ছেলে বাবুটাও নড়াচড়া করছে তাই ফরহাদকে কোলে নিতে বললো নার্স। ফরহাদ মলির কাছে এসে বাচ্চাকে কোলে নিতে গেলে মলি তার হাত বাড়িয়ে ফরহাদের দ

“মালিনী”
পর্ব- ২৭
(নূর নাফিসা)
.
.
রাতে ঘুমানোর সময় ফরহাদ বালিশ আর পাতলা কম্বল নিয়ে ড্রয়িং রুমে চলে গেলো। ফাহিমা আছে মলির কাছে। মাঝরাতে বাচ্চারা কান্নার রোল তুলেছে। একজনের কান্নার শব্দে অন্যজন জেগে উঠে আর শুরু হয় একসাথে! ওদিকে ফরহাদের চোখেও ঘুম নেই। একটু পরপরই এসে দেখে যায়। বাচ্চারা যখন কান্না করছিলো কান্নার শব্দ না পেলেও মন টেনে নিয়ে এসেছে এদিকেই। ফাহিমা একজনকে সামলাতে পারলেও আরেকজন মলির কোলে। মলির নড়াচড়া নিষিদ্ধ ফরহাদ এসে কোলে নিয়ে হাটাহাটি করছে। একটু পরপরই এতো কাদছে কেন ভেবে পাচ্ছে না মলি। ফাহিমা তুলে ধরলো নতুন জায়গায় এসেছে বিধায় এমন। মাত্র চারদিন থেকেছে হসপিটাল, এতেই যেন তারা হসপিটালের অভ্যস্ত হয়ে গেছে! যার ফলে এখানে মানিয়ে নিতে পারছে না! একটু পর আবার ঘুমিয়ে পড়লে ফাহিমার কথায় ফরহাদ কম্বল আর বালিশ নিয়ে আবার এ রুমে চলে এলো। সোফায় শুয়ে পড়লো সে। রাতভর কেউই তেমন ঘুমাতে পারেনি। বড়জোর দু-তিন ঘণ্টা ঘুমাতে পেরেছে। আর বাকি সময় তাদের ভাইবোনের ডিউটি!
সকালে আন্টি এলে বাচ্চাদের কাপড়চোপড় ধুয়ে দিলো, ফাহিমা রান্না করছে। মলির বসে থাকা ছাড়া কোনো কাজ নেই আর ফরহাদ দুই কোলে দুজনকে নিয়ে জানালার পাশে বসে আছে। একপাশ দিয়ে জানালার গ্রিল ভেদ করে সকালের তাজা রোদ এসে উঁকি দিচ্ছে আর ফরহাদ বাচ্চাদের গায়ে সেই প্রভাতের রশ্মি মাখাচ্ছে। মলি খাটে হেলান দিয়ে পলকহীন তাকিয়ে আছে দুই কোল ভরে নিয়ে বসে থাকা এক পিতার দিকে। কেন জানি মনে হচ্ছে পৃথিবীর বুকে থাকা সবচেয়ে বেশি সুন্দর দৃশ্য এটা। ফরহাদও পলকহীন তাকিয়ে আছে বাচ্চাদের দিকে। মুখে তার অস্পষ্ট হাসির রেখা। বাচ্চারাও যেন উষ্ণ আর্দ্রতায় কোমলতা অনুভব করছে। তাই শান্ত হয়ে বসে আছে বাবার কোলে। মাঝে মাঝে শুধু দৃষ্টি এবং ওষ্ঠ নড়াচড়া চলমান। ফরহাদও যেন দৃষ্টিতে খেলা করছে সন্তানদের সাথে।
মলি বেশ কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে দেখলো এই দৃশ্যটা। একসময় বলে উঠলো,
– বাচ্চাদের নাম কি রাখবেন?
ফরহাদ বাচ্চাদের থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই জবাব দিলো,
– মেহতাজ হোসাইন ফাইজা ও ফাইয়াজ হোসাইন মুবিন।
ফরহাদের বলার স্টাইল দেখে মলি বুঝে গেছে নাম আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে ফরহাদ। যাইহোক মলির খুব পছন্দ হয়েছে নামগুলো। তাই সেও হাসি মুখে একটু শব্দ করে উচ্চারণ করলো,
– মেহতাজ, ফাইয়াজ! ফাইজা, মুবিন!
ফাহিমা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে রুমে প্রবেশ করে বললো,
– ভাইবোন মিলে এতো শান্ত কেন এখন? ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি?
ফরহাদ জবাব দিলো,
– না। মিষ্টি রোদের সাথে দুষ্টু খেলা করছে।
– সারারাত সবাইকে জাগ্রত রেখে এখন দুষ্টুমি! একেবারে বাবার মতোই দুষ্টু হবে নাকি তার চেয়েও আরও বেশি! দেখি…
ফরহাদ ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটিয়ে তুললো ফাহিমার কথায়। আর এদিকে নিচু স্বরে মলির উক্তি,
– বেশি আর কি হবে! বাবা কম কিসে!
নিচু স্বরে বললেও দুরত্ব বেশি না হওয়ায় তাদের কান পর্যন্ত পৌছে গেছে মলির কথা। ফরহাদ তার দিকে তাকালো শুধু আর ফাহিমা হাসলো। ফরহাদের চাহনি দেখে মলি অপ্রকাশ্যে জ্বিভ কামড়ে ধরলো আবার মনে মনে বললো, “হুহ্! ভয় পাই নাকি উনাকে! বাঘ না ভাল্লুক উনি, যে আমাকে খেয়ে ফেলবে!”
ফাহিমা ফাইয়াজ হোসাইন মুবিনকে কোলে তুলতেই বাবুটা কেমন চোখ কাচুমাচু করে ফেললো। কান্না করে দিবে এমন ভঙ্গি প্রকাশ করলো তা দেখে ফাহিমার উক্তি,
– এ তো দেখছি দাদার মতো জিদ্দিও হবে! বাবার কোল থেকে উঠিয়ে নিয়েছি বলে এখনই এতো জেদ! হুম? মলি, অনেক্ক্ষণ ধরে না খেয়ে আছে। নে ধর। ফরহাদ, হুজুর দাওয়াত করেছিস?
– হ্যাঁ, সন্ধ্যায় আসবে।
– আচ্ছা, অফিস যাবি না? রান্নাবান্না শেষ আমার। নাস্তা করে রেডি হয়ে যা। দে ওকে আমার কাছে।
ফরহাদ মেহতাজ হোসাইন ফাইজাকে ফাহিমার কোলে দিয়ে চলে গেলো গোসল করতে।
আরও সপ্তাহখানেক পাড় হতেই ফাহিমা বললো ঢাকায় চলে যাবে। ফরহাদ বললো আরও কিছুদিন কাটাতে কিন্তু ফাহিমা বললো সে চলে যাবে। তাকে যেন ট্রেনে তুলে দিয়ে আসে। মলি এখন পুরোপুরি সুস্থ না হলেও চলাফেরা করতে পারে। বাকিসব ভারি কাজ থেকে তাকে দূরেই রাখা হয়েছে। ফরহাদ তার মায়ের উপর আর কথা বললো না। চলে যখন যেতে চাইছে আর আটকে রাখবে কিভাবে। যেদিনগুলো কাটিয়েছে সেগুলোই অনেক। ফরহাদ আন্টিকে মলির কাছে রেখে ফাহিমাকে নিয়ে ট্রেনে যাত্রা শুরু করলো। যাই হোক, একা ছাড়তে রাজি না সে। ইচ্ছে ছিলো বিমানে অল্প সময় ব্যয়ে তারাতাড়ি যাবে আবার তারাতাড়ি ফিরে আসবে। কিন্তু ফাহিমা বিমানে যেতে রাজি না। আসার সময়ও তিনি ট্রেনেই এসেছেন। সকালে রওনা দিয়ে দুপুরের শেষ দিকে ঢাকায় পৌছেছে তারা। ফাহিমাকে বাড়িতে রেখে সে আর অপেক্ষা করেনি এখানে, সাথে সাথেই আবার বেরিয়ে পড়েছে চিটাগং য়ের উদ্দেশ্যে। এবার তার যাত্রা বিমানে। সন্ধ্যার আগেই সে বাসায় হাজির। ফরহাদ এলে আন্টি চলে গেলেন। কাজকর্ম যা ছিলো আগেই সম্পাদন করে রেখেছেন। ফরহাদ এখনো মলির সাথে তেমন একটা কথাবার্তা বলে না। রাতে ফরহাদ খাবার এনে টেবিলে রাখলো। অত:পর রুমে এসে দেখলো বাচ্চারা ঘুমাচ্ছে। মলি বাথরুমে। সে বাচ্চাদের দুপাশে কোল বালিশ রেখে সোফার রুম থেকে টিটেবিল নিয়ে এলো। তার আর মলির খাবার এনে আবার টি টেবিলে রাখলো। মলি দেখে বললো,
– আমি এখন খাবো না। মাগরিবের একটু আগে খেয়েছি। আপনি খেয়ে নিন।
ফরহাদ তাকালো তার দিকে কিন্তু কিছু বললো না। মলি তার তাকানোর ভঙ্গি দেখেই বললো,
– পেট ভরা থাকলে খাবো কি করে!
অত:পর ফরহাদ একা একাই খেতে লাগলো। একপাশের কোলবালিশ সরিয়ে মলি বাচ্চাদের পাশে শুয়ে পড়লো। ঘুম পেয়েছে খুব তার। হঠাৎ মনে হলো সে শুন্যে ভাসছে! স্বপ্ন দেখছে ভেবে চোখ খুললো না। আবার মনে হলো কোথাও তলিয়ে যাচ্ছে এবার চোখ খুলে ফেললো। তাকিয়ে দেখলো ফরহাদ নামক লোকটা হেটে হেটে খাটের দিকে যাচ্ছে। সে দ্রুত উঠে বসে দেখলো তার অবস্থান সোফায়! এটা কি হলো! কেন করলো এমন! ভাত খায়নি বলে! ফরহাদ এসে বাচ্চাদের পাশে শুয়ে পড়লো। বাচ্চারা যে কখন জেগে গেছে মলি খেয়ালও করেনি। খেয়ালই বা করবে কিভাবে। তারা তো কান্না করেনি! কিন্তু ফরহাদের কীর্তি দেখে মলির খুব রাগ হলো! তাকে সোফায় রেখে কি সুন্দর করে বাচ্চাদের পাশে খাটে শুয়ে আছে! মলি বিরক্তি নিয়ে সোফায়ই হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লো। যাবে না সে তাদের কাছে। থাকুক যেভাবে ইচ্ছে! কতটা খারাপ লোক, একটা কাথাও দিয়ে যায়নি! মলি এভাবেই কাচুমাচু হয়ে শুয়ে আছে। আর ওদিকে ফরহাদ বাচ্চাদের সাথে খেলা করছে। এর মাঝে একবার মলির দিকে তাকাতেই মলি বিরক্তি নিয়ে চোখ বুজে ফেললো।
একটু পরেই বাচ্চাদের একটু আধটু কান্নার শব্দ আসছে মলির কানে। কিন্তু চোখ খুলে তাকালো না সে। যাবে না সেখানে। সামলাক এবার! পরপরই মনে হলো সে আবার শুন্যে ভাসছে! নিশ্চয়ই এখন আবার ফরহাদ তাকে উঠিয়ে নিয়েছে সোফা থেকে। ফরহাদ তাকে এনে খাটে বাচ্চাদের পাশে শুয়িয়ে দিলো। মলি এমন ভঙ্গিতে আছে যেন সে গভীর ঘুমে মগ্ন। বাচ্চাদের কান্না যেন আস্তে আস্তে বেড়ে যাচ্ছে। ফরহাদ দেখলো মলি তাকাচ্ছে না তাই মলিকে ঝাকিয়ে ডাকতে শুরু করলো।
– মলি, এই? মলি উঠো। বাচ্চারা কাদছে তুমি শুনতে পাচ্ছো না!
মলি চোখ কুচকে তাকালো তার দিকে। ফরহাদ বললো,
– অনেক্ক্ষণ ধরে না খেয়ে আছে। তোমার ক্ষুধা না থাকলেই কি ওদের ক্ষুধা আছে।
মলি তার উপর থেকে ফরহাদের হাত সরিয়ে দিয়ে একজনকে কাছে টেনে নিলো। আর বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
– অযথা মেজাজ দেখায় আমাকে। বিনা অপরাধেই সর্বদা শাস্তি লেখা আমার কপালে! প্রয়োজন হলেই আমার ডাক পরবে শুধু আর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে ছুড়ে ফেলে দিবে। যেন খেলনার পুতুল আমি!
কথা বলতে বলতে মলির চোখে অশ্রু ভীড় জমিয়েছে। এদিকে কথাটা ফরহাদের বুকে বিধলো। শুনলো কিন্তু কিছু বললো না। অন্যজনকে কোলে নিয়ে একটু হাটাহাটি করলো রুমের মাঝেই।
বাচ্চাদের ক্ষুধা মেটাতেই মলি সোফায় চলে যাওয়ার জন্য বিছানা ছেড়ে নামতে লাগলো। ফরহাদ অন্যপাশে থেকে তার হাত টেনে ধরে বাধা দিলো। মলি তার দিকে তাকিয়ে বললো,
– আবার কি! শেষ তো আমার কাজ।
ফরহাদ এক হাতে তার নিজের জায়গায় কোলবালিশ রেখে মলির পাশে চলে এলো। মলিকে খাটে শুতে ইশারা করতেই মলি বললো,
– হাত ছাড়ুন, আমি সোফায়ই থাকতে পারবো। আপনার এখানে আশ্রয় পেয়েছি আমি সেটাই তো সাত কপালের ভাগ্য!
মলির অভিমান একটু কড়া-ই হয়ে যাচ্ছে তাই ফরহাদ জোর করেই শুয়িয়ে দিলো সাথে সে-ও পেছন থেকে ঝাপটে ধরে কম্বল টেনে শুয়ে পড়লো। মলি আর উঠার জন্য বৃথা চেষ্টা করলো না। চেষ্টা করে কি হবে! ফরহাদ তার হাত পা মলির উপর তুলে দিয়ে আটকে রেখেছে। সাথে চলছে অভিমান ভাঙ্গানোর খুনশুটি!
সকালে মলি গোসল করতে গেছে আর ফরহাদ বসে আছে বাচ্চাদের পাশে। বাচ্চারা কিছুক্ষণ খেলা করে ঘুমিয়ে পড়েছে। এখন তাদের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আঠারো থেকে বিশ ঘন্টা কাটে ঘুমে। মলি এতোদিন পর আজ মেক্সি নামক ড্রেস ছেড়ে আবার শাড়ি পড়েছে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো ফরহাদ জানালায় হেলান দিয়ে দুহাত ভাজ করে দাড়িয়ে আছে এবং তার দিকেই তাকিয়ে আছে। খাটের দিকে তাকিয়ে দেখলো বাচ্চারা ঘুমাচ্ছে। মলি মাথা মুছতে মুছতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এলো। মাথা আঁচড়াতে গেলে আয়নায় ফরহাদকে দেখলো। সে এখনো সেভাবেই পলকহীন তাকিয়ে আছে মলির দিকে! এই মুহূর্তে তার চাহনীর ধরন ভিন্ন রকম! কেমন যেন নেশা লাগানো দৃষ্টি! মলি তার শাড়ি টেনেটুনে ঠিক করে দ্রুত মাথা আচরানো শেষ করলো। অত:পর আবার বাথরুমে এলো। বাথরুমে এসে মনে হলো তার, “বাথরুমে কেন এলো!” মলি আবার বেরিয়ে গেলো। ফরহাদের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে এখনো তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মলি রুম থেকে বের হওয়ার জন্য দরজার কাছে যেতেই মনে হলো, “সেদিকে কোথায় যাবে! কিচেনে তো তার কোনো কাজ নেই! ফরহাদের ছুটির দিন হওয়ায় সে নিজেই রান্না করেছে।” তা ভেবে আর মলি বের হলো না রুম থেকে। আবার সে ফরহাদের দিকে তাকিয়ে দেখলো এখনো তার দিকেই দৃষ্টি! মলির অসস্তি লাগছে খুব! সে হেটে হেটে বাচ্চাদের কাপড়চোপড়ের তাকের দিকে এলো। ভাজ করা কাপড়চোপড়ই নেড়েচেড়ে আবার ভাজ করলো। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো ফরহাদ এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে! মলি মনে মনে বললো, ” এটা কি আদৌ কোন মানুষ নাকি রোবট! অন্যকোনো প্রতিক্রিয়া নেই শুধু দৃষ্টিতে কাজ করছে তাও আমাকেই তাক করে রেখেছে! ওফ্ফ! আমার কেমন লাগছে সেটা কি একটুও বুঝতে পারছে না! এভাবে তাকিয়ে আছে কেন!”
মলি আবার বাথরুমে চলে গেলো। অযথা দুতিন মিনিট কাটিয়ে আবার বেরিয়ে এলো। এখনো ফরহাদ তাকিয়ে আছে! ফরহাদ এবার নিজ হাতের বাধন ছেড়ে দিয়ে মুখে অস্পষ্ট হাসির রেখা ফুটিয়ে মলির কাছে এলো। মলি স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে। ফরহাদ তার হাত ধরে জানালার পাশে এনে দাড় করালো এবং ফোন নিয়ে ছবি তুলে নিলো। মলি নিজের দিকে একবার তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলো আজ তাকে অন্যদিনের চেয়ে বেশি সুন্দর লাগছে কিনা! তা না হলে ছবি তোলার কারণ কি!
মলিকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে ফরহাদ এবার তার মুখে স্পষ্ট মুচকি হাসির রেখা ফুটিয়ে ফোন পকেটে রাখলো। অত:পর মলিকে টেনে জানালার পাশে দাড় করিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাধে থুতনি রাখলো। মলির অসস্তি যেন মুহুর্তেই দূর হয়ে গেছে এবং ভালো লাগা কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে। তার মুখেও ফুটে উঠেছে মুচকি হাসির রেখা! কিছুটা সময় অতিবাহিত হতেই একজনের ঘুম ভেঙে কান্না শুরু হয়ে গেছে। তারা দুজনেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো বাচ্চার দিকে অত:পর মলি মুচকি হেসে এগিয়ে গেলো আর ফরহাদ কাউকে কল করে বললো, “পাঠিয়ে দিয়েছি। কাজ করে রাখুন, দুপুরে নিতে আসবো।”
বাকিটা সময় বাসায় থেকেই দুপুরে ফরহাদ বের হয়েছে। বাসায় ফিরেছে সাথে ২/৩’ আকৃতির এক ফ্রেম নিয়ে! মলি অবাকই হলো, কেননা সেদিনও এক ফ্রেম নিয়ে এসেছে, আজও আবার একটা নিয়ে এসেছে! এটা দিয়ে কি করবে শুধু শুধু! বাচ্চাদের দোলনায় রেখে ফরহাদ মলিকে এনে দাড় করালো দেয়ালে টানানো সেই সাদা ফ্রেম বরাবর। অত:পর আজকে আনা ফ্রেমটা সাদা ফ্রেমের পাশে টানিয়ে দিলো। মলি এবার আরও বেশি অবাক! কেননা আজ আনা ফ্রেমের মধ্যে তার ছবিটা বড় করে আটকানো। যেটা আজ সকালে তুলেছে! এদিকে ফরহাদ সাদা ফ্রেম থেকে টিস্যুর আবরণ তুলে নিলো আর দৃশ্যমান হলো এক চমৎকার দৃশ্য! সেটাতেও মলির ছবি! কিন্তু সেটা ছিলো বিয়ের আগের ছবি! তোলা হয়েছে যখন সে বাগানে কাজ করছিলো! ফরহাদ তার কাজ শেষ করে সোফা থেকে নিচে নেমে দাড়ালো। ফরহাদ কেন দুটি ছবির ফ্রেম পাশাপাশি আটকে দিয়েছে সেটা বুঝতে মলির খুব কম সময়ই লেগেছে। ছবি দুটির মধ্যে বেশ তফাত রয়েছে! আগের ছবিটা দেখে মনে হচ্ছে যে এটা কোনো এক বস্তির অগোছালো, অপরিচ্ছন্ন মেয়ে! আর আজকের তোলা ছবিতে দেখাচ্ছে কোন এক বিত্তশালী ও মার্জিত মেয়ে। যে কিনা সর্বদা সৌহার্দপূর্ণভাবে চলাচল করে। মলি খুবই অবাক হচ্ছে। সে তার নিজের দিকে একবার তাকাচ্ছে আবার ছবি দুটোর দিকে! আগের চেয়ে তার স্বাস্থ্য অনেকটা ভালো হয়েছে, আগে ছিলো জীর্ণশীর্ণ আর এখন পরিপূর্ণ অর্থাৎ পারফেক্ট! আগে ছিলো শ্যামাকালো পেত্নী আর এখন ফর্সা ধবধবে! এতোটা পরিবর্তন কিভাবে সম্ভব! তার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! সবটাই কি তাহলে ফরহাদের কেয়ারনেস! সে এতোকিছু ভাবতে ভাবতে ফরহাদের কাছে এগিয়ে এলো এবং ফরহাদের হাত টেনে নিয়ে তার হাত পাশাপাশি রেখে দেখলো সে ফরহাদের মতোই ফর্সা! এতোটা ফর্সা কবে হলো, সে তো খেয়ালই করেনি! ফরহাদ তার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। মলি উৎফুল্ল হয়ে ফরহাদকে বললো,
– আমি এতো ফর্সা হয়ে গেলাম কেন?
– ফর্সা হয়ে যাওনি, ফর্সা আগেই ছিলে কিন্তু যত্ন ছিলো না। যত্নের অভাবে ছিলে পেত্নী!
– হুহ্!
মলি খুশিতে একটু ভেঙচি কেটে বাচ্চাদের কাছে এসে বললো,
– তোরা তোদের বাবার মতোই শুধু ফর্সা হসনি, মায়ের মতোও ফর্সা হয়েছিস! তোদের মা-ও ফর্সা!
কথাটা বলে মলি অল্প শব্দে হিহিহি করে হাসলো। সেই হাসি দেখে ফরহাদ তার মুখে হাসি ফুটিয়ে বাচ্চাদের কোলে নিতে নিতে বললো,
– হুহ্! ফর্সা হয়ে গেছে! কার যত্নে ফর্সা হয়ে গেছে তার আর খবর নেই!
– আপনি দুজনকে একসাথে নিলে আমি নিবো কাকে!
– আয়না দেখেই তো সময় পাড় করবে, বাচ্চাদের নেওয়ার সময় হবে নাকি!
– আমি আয়না দেখেছি একবারও! শুধু বেশি বেশি! আমার কাছে একজনকে দিন।
– ডাক্তার পুরো একমাস বেড রেস্টে থাকতে বলেছে। একমাস হয়নি এখনো।
বাচ্চাদের একসাথে কোলে নেওয়া ফরহাদের যেন অভ্যাস হয়ে গেছে! মলিকে আর কোলে নিতে দিলো না। তাই মলি দাড়িয়ে দাড়িয়েই ফরহাদের কোলে থাকা বাচ্চাদের সাথে হাত নেড়ে কথা বলে খেলছে সাথে যেন বাচ্চারাও তার সাথে তাল মিলিয়েছে। আর ফরহাদ তাদের তিনজনকেই দেখছে।
.
.
ভয় পেয়েছি আমি!😵😵 তাই করলাম না আজ সবার আগে মন্তব্য! 😅 😅
যাইহোক, বাচ্চাদের নাম পছন্দ হয়েছে?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here