#বর্ষণের সেই রাতে পর্ব ৩৬+৩৭

0
304

#বর্ষণের সেই রাতে পর্ব ৩৬+৩৭
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব: ৩৬
.
এদিকে নিউস চ্যানেলে বারবার করে ব্রেকিং নিউস হিসেবে টেলিকাস্ট হচ্ছে। ” রাস্তা থেকে রকস্টার আদ্রিয়ান আবরার জুহায়ের কিডন্যাপড” খবরটা ইতোমধ্যে শহরে তোলপাড় বাঁধিয়ে দিয়েছে। আসলে রাস্তায় ওকে যারা যারা তুলে নিয়ে যেতে দেখেছে তারাই খবরটা ছড়িয়েছে। কথায় আছেনা খারাপ খবরগুলো বাতাসের আগে ছড়িয়ে যায়, আর সেটা যদি হয় কোনো সেলিব্রিটির খবর তাহলেতো কথাই নেই। অনিমা জুস খেতে খেতে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে টিভি দেখছিলো হঠাৎ করেই নিউস চ্যানেলে এই খবরটা দেখার সাথে সাথে অনিমার হাত থেকে জুসের গ্লাসটা পরে গেলো। অনিমার হাত পা সব অসম্ভব রকম কাঁপতে শুরু করলো। ওর কানে রিকের বলা সেই কথাটাই বাজতে লাগল ” আমার জিনিসে হাত দিয়েছে, মরতে তো ওকে হবেই।” অনিমার শ্বাস আটকে আসার উপক্রম হয়েছে। সারাশরীর ইতিমধ্যেই ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। আদ্রিয়ানকে ওরা তুলে নিয়ে গেছে এটা ভাবতেই ওর হৃদস্পন্দন থেমে যেতে চাইছে। ওর চোখের সামনে ওর আব্বুর ঝুলন্ত লাশটা ভেসে উঠছে, যদি আদ্রিয়ানকেও ওরা? এসব চিন্তা করতেই ওর শরীর পুরো অবস হয়ে যেতে লাগলো। গ্লাস ভাঙ্গার আওয়াজে সার্ভেন্টরা সব ছুটে এলো। অনিমা সেন্সলেস হয়ে পরে যেতে নিলেই সার্ভেন্টরা এসে ধরে ফেললো ওকে। ওকে ধরে আদ্রিয়ানের রুমে নিয়ে শুইয়ে দিয়ে আদ্রিয়ানের নাম্বারে ডায়াল করলো কিন্তু ফোনটা বন্ধ পেলো। একজন বলল,

— ” স্যারের ফোনটা তো বন্ধ। এখন কী করবো?”

আরেকজন বলল,

— ” ম্যামের অবস্হা তো ভালো না। ডক্টরকে কল করো নইলে স্যার এসে ভীষণ রাগ করবেন।”

প্রথমজন অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” ঠিকি বলেছো।”

আদ্রিয়ানের পার্সোনালি যেই ডক্টরের সাথে এপোয়েন্ট করা তার নাম্বার সব সার্ভেন্ট দের কাছেই থাকে। ওরা তাড়াতাড়ি সেই ডক্টরকে ফোন করে আসতে বলল।

____________________

আদ্রিয়ান যেই চেয়ারটায় ওকে বেঁধে রেখেছিলো সেই চেয়ারটা টেনে পায়ের ওপর পা তুলে বসল। তারপর হাতের গানটা কপাল স্লাইড করে কিছু বলবে তারআগেই ওদের মধ্যে একজনের ফোন এলো। লোকটা ভয়ে ভয়ে আদ্রিয়ানের দিকে তাকাতেই আদ্রিয়ান উঠে গিয়ে হাত বাড়িয়ে ফোনটা দিতে ইশারা করল। লোকটা ফোন আদ্রিয়ানের দিকে এগিয়ে দিতেই আদ্রিয়ান স্ক্রিনে ভাই লেখা দেখেই বুঝে গেলো এটা রিকের ফোন। আদ্রিয়ান হেসে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে রিক বলে উঠলো,

— ” শোন আমার আসতে আরো খানিকক্ষণ সময় লাগবে। ততোক্ষণ প্রাণে মারার ভয় দেখিয়ে ওর মুখ থেকে কথা বের করার চেষ্টা কর। আর যদি না বলতে চায় তো হাতে পায়ে দু একটা শুট করে দিবি, ঠিক বলে দেবে।”

কথাগুলো শুনে আদ্রিয়ান নিঃশব্দে হেসে লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো। লোকগুলো আবারো একটা ঢোক গিলল। আদ্রিয়ান কানে ফোন নিয়ে বলল,

— ” হাতে, পায়ে, হাটুতে কবজিতে শুট করা হয়ে গেছে আর কোথাও করতে হবে?”

আদ্রিয়ানের গলা শুনে রিক চমকে গেলো। কান থেকে ফোন সরিয়ে নাম্বারটা চেক করে দেখলো ঠিকি আছে। তারপর ফোনটা আবার কানে গিয়ে বলল,

— ” তুমি? এই ফোন তোমার হাতে কেনো? ওরা কোথায়?”

আদ্রিয়ান মুচকি হেসে বলল,

— ” আসলে এদের একেকজন একেকভাবে ঘায়েল হয়ে আছেন। আমি আবার মানুষের কষ্ট দেখলে দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনা ছুটে হেল্প করতে চলে আসি। ওরা সবাই চরম আহত তাই আমিই ফোন টা ওদের হয়ে রিসিভ করলাম। এদের সবাইকে সিটি হসপিটালে সিফট করে দিচ্ছি ওখান থেকে কুড়িয়ে নিয়ে যাবেন।”

রিক তো অবাকের চরম পর্যায়ে পৌছে গেছে। কিছুই মেলাতে পারছেনা। ও শকের মধ্যে থেকেই বলল,

— ” আহত মানে কী করেছো তুমি ওদের সাথে?”

আদ্রিয়ান বাঁকা হাসি দিয়ে বলল,

— ” যেটা আপনি আমার সাথে করতে চেয়েছিলেন।”

রিক আদ্রিয়ানের কথার মানেটা বুঝতে পারলেও হজম করতে পারলোনা। তাই বিষ্মিত কন্ঠে বলল,

— ” মানে?”

আদ্রিয়ান এবার হতাশার একটা শ্বাস ফেলে বলল,

— ” কাম অন রিক চৌধুরী। আমি আপনাকে আগেও বলেছি আমাকে জিজ্ঞেস করে টাইম ওয়েস্ট না করে অনিকে খুজুন। তা না করে আপনি সেই আমার পেছনেই পরে আছেন। আমি কিন্তু বেশ এনজয় করছি। বাট সময়টা কিন্তু আপনারি নষ্ট হচ্ছে। বাই দা ওয়ে রাখছি হ্যাঁ? ওদের হসপিটাল থেকে নিয়ে যাবেন কিন্তু। হ্যাভ আ গুড ডে।”

বলেই ফোনটা কেটে দিলো। তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” কী রে ভাই, আমার ফোন কোথায়?”

ওদের মধ্যে একটা লোক বহুত কষ্টে পকেট থেকে আদ্রিয়ানের ফোনটা বের করে আদ্রিয়ানের দিকে দিলো। আদ্রিয়ান ফোনটা সুইচড অফ দেখে রাগী চোখে তাকালো ওদের দিকে। ওরা হকচকিয়ে গিয়ে একসাথে বলল,

— ” সরি ভাই।”

আদ্রিয়ানকে কিছু না বলে ফোনটা ওন করে অাদিবকে ফোন করে বলল,

— ” হ্যাঁ চলে আয়।”

বলার কিছুক্ষণের মধ্যেই আদিব আর আশিস চলে এলো। ওদের সাথে কিছু লোক এসে গুলি যেই পাঁচজনের লেগেছে তাদেরকে নিয়ে হসপিটালে নিয়ে গেলো। বাকি একজন ওদের সাথেই গেলো। আদিব ভ্রু কুচকে বলল,

— ” ওই একটাকে ছাড়লি কেনো?”

আদ্রিয়ান হেসে গানগুলো ফেলে দিয়ে বলল,

— ” ভয় পেয়ে গেছিলো। আর আমাকে কেউ ভয় পেলে আমি তার ওপর আঘাত করিনা।”

আদিব আশিস দুজনেই হাসলো। হঠাৎ করেই আদ্রিয়ান এর ফোনে ফোন এলো স্ক্রিনে অরুমিতার নাম্বার দেখে ভ্রু কুচকে গেলো ওর। এই সময় হঠাৎ অরুমিতা কেনো ফোন করবে? ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে অরুমিতা উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

— ” ভাইয়া আপনি ঠিক আছেন?”

আদ্রিয়ান অবাক হলো একটু অরুমিতা কীকরে জানলো? তবুও নিজেকে সামলে বলল,

— ” কেনো কী হয়েছে?”

অরুমিতা জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বলল,

— ” আপনাকে নাকি কিডন্যাপ করা হয়েছে? সব চ্যানেলে নিউসটা দেখাচ্ছে। আমাদের টায় ও।”

অাদ্রিয়ান চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস নিয়ে বিরক্তিকর কন্ঠে বলল,

— ” উফফ দিস মিডিয়া।”

অরুমিতা এখনো জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। আদ্রিয়ান নিজেকে শান্ত করে বলল,

— ” রিলাক্স! আমি একদম ঠিক আছি। আর তীব্রকেও বলে দিও এটা। চিন্তার কিচ্ছু নেই, রাখছি।”

ফোনটা রেখে আদ্রিয়ান আদিব আর আশিস দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” তোরা জানতিস না যে মিডিয়াতে আমার কিডন্যাপড হওয়ার নিউস লিক হয়েছে?”

আদিব বলল,

— ” আরে আমরা তো নিউস দেখিইনি। এসব কাজ নিয়ে ব্যাস্ত ছিলাম।”

হঠাৎ কিছু একটা ভেবে আদ্রিয়ান বলল,

— ” ওহ সিট। জ্ জানপাখি।”

বলেই আদ্রিয়ান একপ্রকার ছুটেই বেড়িয়ে গেলো ওখান থেকে। আশিস অবাক হয়ে আদিবের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” কী পাখি? আর পাখি কোথাথেকে এলো?”

আদিব চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই আশিস চুপ হয়ে গেলো। এরপর দুজনেই বেড়িয়ে পরল কারণ ওদের প্রেস সামলাতে হবে এখন।

____________________

আদ্রিয়ান হুড়মুড়িয়ে নিজের বাড়িতে ঢুকলো। তারপর সামনে একজন সার্ভেন্ট পরতেই জিজ্ঞেস করলো,

— ” হয়ার ইজ ইউর ম্যাম?”

মেয়েটি মাথা নিচু করে আছে। সেটা দেখে আদ্রিয়ান ধমকে বলল,

— ” আই আসকড হয়ার ইজ ইউর ম্যাম?”

মেয়েটি একটু কেঁপে উঠলো। আদ্রিয়ানের চিৎকারে আরো দুজন মেয়ে সার্ভেন্ট চলে এলো। মেয়েটি মাথা নিচু করেই বলল,

— ” স্যার ম্যাম আপনার কিডন্যাপ হওয়ার খবরটা শুনেই অজ্ঞান হয়ে গেছে।”

আদ্রিয়ান এবার চিৎকার করে বলল,

— ” আর সেটা তোমারা আমাকে এখন বলছো ডেম ইট।”

অপর একটা মেয়ে বলল,

— ” স্যার আসলে আমরা যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু আপনার ফোন বন্ধ ছিলো। আমরা ডক্টর কল করেছি। উনি এসে দেখে গেছেন ভয়ের কিছু নেই।”

আদ্রিয়ান চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস নিলো। কার রাগ কাদের ওপর দেখাচ্ছে ও? নিজেকে শান্ত করে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” আ’ম সরি। মাথাটা একটু গরম ছিলো তাই।”

মেয়েগুলোর মধ্যে একজন মুচকি হেসে বলল,

— ” বুঝতে পেরেছি স্যার।”

আদ্রিয়ানও উত্তরে হেসে বলল,

— ” হুমম যাও তোমরা।”

ওরা চলে গেলো। আগে বাড়িতে একটাই মেয়ে মেট সার্ভেন্ট ছিলো কিন্তু অনিমাকে আনার পর আরো দুজন এপোয়েন্ট করেছে। আদ্রিয়ান রুমে গিয়ে দেখলো অনিমা ঘুমিয়ে আছে। আদ্রিয়ান বেডে বসে অনিমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। মেয়েটা মুখে স্বীকার না করলেও ওর প্রতিটা কাজে বুঝিয়ে দেয় ও আদ্রিয়ানকে কতো ভালোবাসে। ও চাইলেই আমাকে আকড়ে ধরে রিকের কাছ থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে পারতো কিন্তু ও সেরকম কিছু করেনি। বরং আমাকে বাঁচাতে নিজে ওই নরকে যেতেও রাজী ছিলো। সব ভালোবাসা মুখে প্রকাশ করা জুরুরী নয়। ভালোবাসা তো প্রকাশ করার জিনিস নয়। ভালোবাসা অনুভব করার জিনিস। আল আদ্রিয়ান অনিমার ভালোবাসা প্রতি মুহূর্তে অনুভব করতে পারে।

__________________

রিক গম্ভীর মুখ করে বসে আছে সোফায়। একটু আগে হসপিটাল থেকে এসছে। আদ্রিয়ান যে এসব করেছে ও ভাবতেই পারছেনা। কবির শেখ ওর পাশেই বসে আছে কিন্তু আজ কিছু বলছে না। কিছুক্ষণ পর রিক নিজেই বলল,

— ” মামা ওকেতো একটা সাদাসিদে রকস্টার ভেবেছিলাম। কিন্তু আজ ও যা করে গেছে সেটা ওর পক্ষে করা কী করে সম্ভব হতে পারে?”

কবির শেখ নিজেও চিন্তিত উনি নিজেও ভাবছেন যে আদ্রিয়ান এরকম কীকরে হতে পারে? ওনার জানা মতে তো আদ্রিয়ান এসবের ধারে পারেও নেই। উনি চিন্তিত কন্ঠে রিককে বলল,

— ” তুমি সিউর ওগুলো আদ্রিয়ানই করেছে?”

রিক অস্হিরতার একটা শ্বাস নিয়ে বলল,

— ” ওরাতো সেটাই বলল।”

কবির শেখ আবার ভাবনায় মগ্ন হলেন আর রিক ভাবছে নাহ এবার নিজেই ওই আদ্রিয়ানের মুখোমুখি দাড়াবে। ও নিজেই দেখবে এবার ব্যাপারটা। অনিমাকে ও ছাড়বেনা যাই হয়ে যাক।

____________________

আদ্রিয়ান সোফায় বসে কাজ করছিলো হঠাৎ করেই অনিমা চিৎকার করে উঠে বসলো আর আদ্রিয়ান বলে ডাকতে লাগলো। অাদ্রিয়ান তাড়াতাড়ি উঠে অনিমার সামনে বসে বললো,

— ” কী হয়েছে? অনি?”

অনিমা হাফাতে হাফাতে বলল,

— ” ওরাহ আদ্রিয়ানকে মেরে ফেলবে, আব্বুর মতো ওকেও…”

আদ্রিয়ান অনিমার দুইগালে হাত রেখে ওর দিকে ঘুরিয়ে বলল,

— “এইতো আমি এখানে দেখো? কিচ্ছু হয়নি আমার কেউ কিচ্ছু করে নি। সি?

আদ্রিয়ান কথা শুনে অনিমা একটুও শান্ত হলোনা বরং আরো অশান্ত হয়ে উঠলো। ওর খেয়ালই নেই ওর সামনে আদ্রিয়ান আছে। অনিমা একি কথা বারবার বলে যাচ্ছে আর হাইপার হয়ে উঠছে। আদ্রিয়ান কিছুতেই ওকে শান্ত করতে পারছেনা। কিছুতেই ওকে সামলাতে না পেরে আদ্রিয়ান এবার ওকে জোরে ধমকে বলল,

— ” অনি?”

আদ্রিয়ান ধমকে অনিমা চুপ হয়ে গেলো, ছলছলে চোখে তাকালো আদ্রিয়ানের দিকে। যখন ও বুঝতে পারলো যে এটা আদ্রিয়ান তখন কেদে দিয়ে আদ্রিয়ানকে জরিয়ে ধরল। আর আদ্রিয়ানও ওকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে বলল,

— “আই এম সরি। এতো ভয় কেনো পাও তুমি। আমি বলেছি না আমার কিছুই হবে না?”

অনিমা কিছু না বলে কেঁদেই যাচ্ছে আদ্রিয়ানকে জরিয়ে ধরে। আদ্রিয়ান ও আর কিছু বললোনা। বেশ অনেক্ষণ সময় কাঁদতে কাঁদতে অনিমা আদ্রিয়ানের বুকেই ঘুমিয়ে পরলো শরীর ক্লান্ত ছিলো তাই । আদ্রিয়ান যখন বুঝতে পারলো যে অনিমা ঘুমিয়ে গেছে তখন ওকে বেডে শুইয়ে দিলো। কিন্তু একটু পর অনিমা ঘুমের ঘোরে উল্টো ঘুরে গেলো আর তখন আদ্রিয়ান খেয়াল করল যে অনিমার ড্রেসের জিপ টা খোলা অনেকটা। আদ্রিয়ান জিপটা লাগাতে গিয়েই অনিমার পিঠে একটা দাগ চোখে পরল। দাগটা দেখে আদ্রিয়ানের কেমন সন্দেহ হলো। কিন্তু জিপ খুলে দেখাটা ঠিক হবেনা ভেবে ও জিপটা লাগাতে গিয়েও থেমে গেলো নিজের কৌতুহলটা কিছুতেই দমাতে পারছেনা। তাই আস্তে করে জিপটা খুলে অনিমার পিঠ খানিকটা উন্মুক্ত করলো আর তারপর যেটা দেখলো তাতে আদ্রিয়ানের চোখ মুখ লাল হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আপনা আপনিই এক ফোটা জল গড়িয়ে পরল চোখ দিয়ে। অনিমার পিঠে অসংখ্য মারের দাগ আর একটা পোড়া দাগ এর চিন্হ এখোনো বোঝা যাচ্ছে। তাহলে আঘাতগুলো কতো গভীর ছিলো ভেবেই আদ্রিয়ানের রাগ আর কষ্ট দুটোই চরমে পৌছে যাচ্ছে। ও ড্রেসের জিপটা লাগিয়ে একটা শ্বাস নিয়ে বলল,

— ” এবার সময় এসে গেছে। ওদের প্রত্যেককে ওদের কর্মের ফল তো পেতেই হবে। আর তার সূচনা তোমার ওই সো কলড মামা,মামী আর অর্ক কে দিয়েই হবে। ”

তারপর বাঁকা হেসে বলল,

— “বি রেডি মামা এন্ড মামী আপনাদের জামাই আসছে।”

#পর্ব- ৩৭
.
অনিমা আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকানোর পর ফিল করলো যে কেউ ওর হাত ধরে রেখেছে। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো আদ্রিয়ান ফ্লোরে বসে ওর হাত ধরেই বেডে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরেছে। অনিমা একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল যে আদ্রিয়ান ঠিক আছে। কিন্তু ওরা যদি আদ্রিয়ানকে তুলে নিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে আদ্রিয়ান কীকরে ফিরে এলো? ওরা ওকে ছেড়ে দিলো কেনো? এসব নানারকমের কথা ভাবতে ভাবতে আদ্রিয়ানের দিকে তাকাতেই অনিমার চোখ আটকে গেলো। বেডের ওপর শুধু মাথাটা কাত করে শুয়ে আছে আদ্রিয়ান, সিল্কি চুলগুলো কপালে পরে আছে, বাচ্চা বাচ্চা লাগছে পুরো কিউটনেস উপচে পরছে একেবারে। অনিমার ঠোঁটের কোণে ওর অজান্তেই হাসি ফুটে উঠলো। আদ্রিয়ানের চুলগুলো নিজের হাত দিয়ে নেড়ে দিলো অনিমা, এরপর নিজের হাত আস্তে করে আদ্রিয়ানের হাত থেকে সরিয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে আদ্রিয়ানের দিকে ঝুকে আদ্রিয়ানের চুলগুলো নাড়তে নাড়তে বলল

— ” এতোটা ভালো কেনো বাসেন আমাকে? সত্যিকি এতোটা ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য আমি? আপনি কী সত্যিই আমার ভাগ্যে আছেন? আমার ভাগ্য কি সত্যিই এতোটা ভালো হতে পারে?”

আদ্রিয়ান হঠাৎ করেই একটু নড়ে উঠলো। অনিমা সাথে সাথেই হাতটা সরিয়ে ফেললো। আদ্রিয়ান উঠে বসে চোখ পিটপিট করে অনিমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,

— ” উঠে পরেছো তুমি।”

অনিমা কিছু না বলে চুপ করে রইলো। আদ্রিয়ান ফ্লোর থেকে উঠে বেডে বসে অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” কী হয়েছে তোমার? তখন ওভাবে হাইপার হয়ে গেছিলে কেনো?”

অনিমা মাথা তুলে আদ্রিয়ানের দিকে ছলছলে চোখ তাকিয়ে বলল,

— ” আপনাকে ওরা..”

আদ্রিয়ান অনিমার দুই বাহুতে হাত রেখে বলল,

— ” কাম অন অনি। আমি তোমাকে বলেছিলাম না আমার কিচ্ছু হবেনা। তবুও তুমি?”

অনিমা মাথা নিচু করে চোখের জলটুকু ছেড়ে দিয়ে বলল,

— ” আসলে নিউসটা দেখে আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম।”

অনিমাকে কাঁদতে দেখে আদ্রিয়ান আর কিছু না বলে ওকে আলতো করে জরিয়ে ধরে বলল,

— ” আচ্ছা ওকে ডোন্ট ক্রাই। যা হওয়ার হয়েছে। বাট আমি তো তোমাকে প্রমিস করেছি তাইনা? তবুও এতো ভয় কেনো পাচ্ছো? ইউ ট্রাস্ট মি না?”

অনিমা অস্ফুট স্বরে বলল,

— ” হুম”

আদ্রিয়ান অনিমাকে ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” আটটা বেজে গেছে। যাও হাত মুখ ধুয়ে এসো ডিনার করবো।”

অনিমা মাথা নেড়ে উঠে ওয়াসরুমে চলে গেলো। আদ্রিয়ান অনিমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,

— ” আমার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা তুমি ছাড়া আর কারোর নেই। ওই জায়গাটা শুধুই তোমার। অার ভাগ্য? কারো ভাগ্যে কী আছে সেটা কেউ না জানলেও আমি জানি‍ যে তুমি শুধু আমার আর আমারই থাকবে।”

____________________

নিজের রুমে বেডে বসে হিসেব মেলানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে রিক। কিছুই মেলাতে পারছেনা শুধু এটুকু বুঝতে পারছে যে আদ্রিয়ান সম্পর্কে এমন কিছু আছে যা ও জানে না। কিন্তু সেটা কী? যদি ধরেও নেই যে ও গান চালাতে জানে। তাই বলে এতোটা পার্ফেক্ট? যে ছয়জন মানুষকে একাই ধরাসাই করে দিলো, যেখানে সবার হাতেই গান ছিলো? এটা যে কারো পক্ষে করা সম্ভব না। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই ওর ঘরে একটা মেয়ে এলো হাতে খাবারের ট্রে নিয়ে। দরজার কাছ থেকে বলল,

— ” আসবো রিক দা।”

রিক মেয়েটাকে দেখে বেশ অবাক হলো সাথে বিরক্ত ও হলো, ভ্রু কুচকে বলল,

— ” তুই কখন এসছিস?”

মেয়েটা মাথা নিচু করে নিচু কন্ঠে বলল,

— ” আজকেই এসছি সন্ধ্যায় ।”

রিক বিরক্ত হয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রল করতে করতে বলল,

— ” তো এখানে কী?”

মেয়েটি করুণ চোখে একবার তাকালো রিকের দিকে তারপর ইতোস্তত করে বলল,

— ” তোমার ডিনারটা নিয়ে এসছিলাম।”

রিক ফোন থেকে চোখ সরিয়ে ভ্রু কুচকে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” তো কী বাড়িতে মেড সার্ভেন্ট ছিলোনা তুই কেনো?”

মেয়েটা অসহায়ভাবে রিকের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” তুমি আমার সাথে এভাবে কেনো কথা বলো?”

রিক এবার উঠে দাঁড়িয়ে রাগী গলায় বলল,

— ” দেখ সিগ্ধা আমি তোকে আগেও বলেছি আমার থেকে দূরে থাকবি। তবুও আমার পেছনে ঘুরঘুর কেনো করিস বলবি?

সিগ্ধা এবার নিজেও রেগে গেলো। রেগে গিয়ে খাবারের ট্রে টা টি টেবিলে শব্দ করে রেখে বলল,

— ” কী সমস্যা কী তোমার আমাকে নিয়ে বলোতো? কী করেছি আমি যে এখন আমাকে সহ্যই করতে পারোনা? আগেতো এমন করতে না? প্রপোজ করেছি বলে? সে তো আরো আগেই করেছিলাম। তখন না করে দিলেও এরকম ব্যবহার তো করতে না? এখন কেনো করো এরকম?”

রিক মুখ ঘুরিয়ে শক্ত গলায় বলল,

— “তোকে উত্তর দিতে বাধ্য নই আমি।”

সিগ্ধা গিয়ে রিকের কলার ধরে বলল,

— ” অবশ্যই বলতে হবে। কী দোষ করেছি আমি। আমার অপরাধটা কী?

রিক নিজের কলার ছাড়িয়ে সিগ্ধার দুই বাহু চেপে ধরে বলল,

— ” সবসময় মুখে মুখে কথা। একটুও ভয় পাস না আমাকে? হ্যাঁ? এতো সাহস কে দেয় তোকে? ”

সিগ্ধা ঝাড়া দিয়ে রিককে ছাড়িয়ে বলল,

— ” তোমাকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণই নেই। কারণ আমি জানি যে তুমি মানুষটা বাইরে দিয়ে বদলে গেলেও মনের দিক দিয়ে তুমি ঠিক সেই ছোটবেলার রিকদাই আছো। আর আমি জানি তুমি আবার আগের মতো হয়ে যাবে। তোমাকে আগের মতো হতেই হবে।”

রিক হাত মুঠো করে চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস নিয়ে বলল,

— “গেট লস্ট।”

সিদ্ধা রিকের হাত ধরে করুণ স্বরে বলল,

— ” রিকদা।”

রিক সিদ্ধার হাত ধরে ওকে টেনে রুম থেকে বের করে দরজা বন্ধ করে দিলো। সিদ্ধা চোখের জল মুছে চলে গেলো ওখান থেকে। সিদ্ধা হলো রিক এর মায়ের বান্ধুবীর মেয়ে। ও ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসে রিক কে। কিন্তু রিক এর মধ্যে তেমন কোনো অনুভূতি নেই। সিগ্ধা ওকে প্রোপজ করার পর ও সুন্দর ভাবেই না করে দিয়ছিলো তবে কখনো খারাপ ব্যবহার করেনি সিগ্ধার সাথে। কিন্তু অনিমা পালিয়ে যাবার পর থেকেই স্নিগ্ধাকে সহ্য করতে পারেনা ও। কারণ অনিমার সাথে সিগ্ধার চেহারার কোনো মিল না থাকলেও দুটো জিনিসের অদ্ভূত মিল আছে। ডান গালে পরা টোল আর বাম গালের তিল। যার কারণে হাসলে দুজনকে একি রকম লাগে। সেই হাসিটাই সহ্য করতে পারেনা রিক। তাই সবসময় ওর থেকে দূরে থাকতে বলে সিগ্ধাকে। কিন্তু সিগ্ধাও নাছড় বান্দা। যখনি এই বাড়িতে আসে সারাক্ষণ রিকের পেছনেই লেগে থাকে। কোনো বকা,ধমক এফেক্ট করেনা ওর ওপর। কারণ ও রিককে ভয়ই পায় না।

__________________

অনিমা বেডে শুয়ে আছে আর আদ্রিয়ান সোফায় শুয়ে ফোন টিপছে। কিছুক্ষণ পর আদ্রিয়ান তাকিয়ে দেখলো অনিমা ঘুমিয়ে পরেছে। অনিমার ঘুমিয়ে পরার অপেক্ষাই করছিলো আদ্রিয়ান। অনিমার কাছে গিয়ে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ফোন নিয়ে সোজা ব্যালকনিতে চলে গেলো আদ্রিয়ান। তারপর অনিমার মামার নাম্বারটা বের করলো। ওর লোক দিয়ে ওর মামা মামীর সব ইনফরমেশন ই যোগার করে নিয়েছে, এড্রেস ফোন নাম্বার সব। কল লাগিয়ে মোবাইলটা কানে নিলো আদ্রিয়ান। কিছুক্ষণ পর ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো,

— ” হ্যালো কে?”

আদ্রিয়ান মুচকি হেসে বলল,

— ” আসসালামু আলাইকুম মামা।”

ওপাশ থেকে আশরাফ মৃধা অবাক কন্ঠে বললেন,

— ” মামা? কে কার মামা? আমার একটাই বোন ছিলো আর সেই বোনের একটাই সন্তান তাও মেয়ে। আপনি কে?”

আদ্রিয়ান একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়ে বলল,

— ” কাম অন মামা। আপনার কোনো ভাগ্নী টাগ্নী আছে নাকি?”

আশরাফ মৃধা বিরক্ত হয়ে বলল,

— ” আজব কথা? থাকবেনা কেনো? না থাকলে কী আমি এমনি এমনি বলছি নাকি?”

আদ্রিয়ান রেলিং এ ভর দিয়ে বলল,

— ” আচ্ছা বলুন তো আপনার ভাগ্নী বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে?”

আশরাফ মৃধা চমকে গেলেন এরপর তুতলিয়ে বললেন,

— ” অব্ জ্ জানিনা আমি।”

আদ্রিয়ান এবার শব্দ করে হেসে দিলো হাসতে হাসতেই বলল,

— ” আরে বাহ। নিজের আপন একমাত্র ভাগ্নি বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে আপনি সেটাই জানেনা। গ্রেট না?”

আশরাফ মৃধা রাগী গলায় বলল,

— ” ভাগ্নিটা আমার, আমার ব্যাপার। তুমি এসব বলার কে? কে তুমি?”

আদ্রিয়ানের চোখ মুখ এবার শক্ত হয়ে এলো। রেগে গিয়ে রেলিং এ একটা বারি মেরে চেঁচিয়ে বলল,

— ” লজ্জা করেনা আপনার? ভাগ্নি বলছেন ওকে? যে মুহূর্তে ওর আপনাদের সবচেয়ে বেশি দরকার ছিলো সেই মুহূর্তে পশুর মতো আচরণ করেছিলেন আপনারা ওর সাথে। মানসিক শারীরিক সবরকম ভাবে কষ্ট দিয়েছেন ওকে। আপনাদের সেই অন্যায়ের চিন্হ ওর শরীরে আজও আছে। এমনকি টাকার জন্যে ওকে বিক্রি করতেও আপাদের বিবেকে বাধেনি আর মামা বলে দাবী করছেন আপনি নিজেকে?”

আশরাফ মৃধা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

— “কে আপনি?”

আদ্রিয়ান এবার রাগ ছেড়ে মুচকি হেসে বলল,

— ” আপনাদের জামাই রাজা। আর আমি খুব তাড়াতাড়ি আসছি। আসলে কি বলুনতো শশুর শাশুড়ি নেই আমার। জামাই আদর তো আপনারাই করবেন না? তৈরী হয়ে থাকুন এই জামাই খুব স্পেশাল আছে কিন্তু। ”

আদ্রিয়ানের কথা শুনে আশরাফ মৃধা একটা ঢোক গিলে বললেন,

— ” মানে?”

আদ্রিয়ান এবার খুব ঠান্ডা গলায় বলল,

— ” মানে হলো পালান। যেখানে পারেন পালান। আমি এসে পরার আগেই যদি পালাতে পারেন তো। কারণ অনির শরীরের প্রত্যেকটা আঘাতের চিন্হ গুনে নিয়েছি আমি, যেদিন আসবো সেদিন ঐ প্রত্যেকটা আঘাতের গুনে গুনে শোধ তুলবো। আর আপনার ছেলে যা করেছে তাতে ওকে জ্যান্ত অবস্হায় পিসপিস করে কাটলেও আমার শান্তি হবেনা। তাই নিজের বউ আর ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে যান। তবে হ্যাঁ এমন জায়গায় পালাবেন যেখানে মাটি পানি বায়ু আর আকাশ নেই। কারণ এই চারটের মধ্যে যেখানেই পালাননা কেনো আমি খুজে নেবোই। আমি সবাইকেই সুযোগ দেই আপনাদেরকেও দিলাম, যদি পারেন তো বাঁচিয়ে নিন নিজেদের আমার হাত থেকে। এন্ড ইউর টাইম স্টার্ট নাও। টিকটিক টিকটিক টিকটিক।

বলেই আদ্রিয়ান সিটি বাজাতে বাজাতে ফোন কেটে দিলো। অপাশে আশরাফ মৃধার তো জান গেলো গেলো অবস্হা। আদ্রিয়ান এর কথাগুলোই ওনার হার্ট অ্যাটাক করানোর জন্যে যথেষ্ট ছিলো। ঘেমে একাকার হয়ে গেছেন উনি। আদ্রিয়ান ফোন কেটে পেছনে ঘুরতেই চমকে গেলো কারণ অনিমা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ান এর দিকে। আদ্রিয়ান এর মনে হালকা ভয় ঢুকে গেলো যে কিছু শোনেনিতো? আর শুনলেও কী আর কতোটা শুনেছে অনিমা?

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here