বালির নীচে জলের শব্দ #পর্ব ২২,২৩

0
300

#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ২২,২৩

২২
হিমেল নিজের কথা শেষ করে সেখানে আর দাড়ালো না। নির্বাক শ্রোতা হয়ে পুরো কথাটা শুনেছে কুমু। বলার মতো কিছুই খুঁজে পেলো না। হিমেল এর কথার অর্থ মস্তিষ্ক বুঝেও যেনো বুঝতে পারছে না। অনুভূতির শেষটা কোথাও একটা ঠেকে যাচ্ছে। বাঁধন খুলে ছড়িয়ে দিতে পারছে না সে কিছুতেই। কিন্তু কেনো এই জড়তা? শুধুই কি জড়তা নাকি আরো অন্যকোন কারণ আছে? এক সময় এই মানুষটাকে এক পলক দেখতে দিগ্বিদিক ছুটে বেড়িয়েছে। কারো পরোয়া করে নি। অবিশ্রান্ত ভেবে চলেছে তাকে নিয়ে। তাকে ঘিরে অগোছালো অনুভূতি গুলো ডাইরির পাতায় খুব যত্ন করে গুছিয়েছে। কিন্তু এখন? এই মানুষটা যখন নিজে থেকেই সাড়া দিচ্ছে তখন সে কেনো পারছে না সমস্ত বাধা পেরিয়ে তার কাছে নিজেকে প্রকাশ করতে। কেনো এতো সংকোচ তার? চলন্ত রিক্সা থেকে মাথা বাড়িয়ে পেছনে দেখলো। বৃষ্টির মাঝেই হেঁটে যাচ্ছে হিমেল। কুমুর ভীষন কষ্ট হলো। সে মানুষটাকে কষ্ট দিয়েছে। অনেক বেশি কষ্ট দিয়েছে। তার কাছ থেকে হিমেলের এতটাও কষ্ট প্রাপ্য নয়। বৃষ্টির পানি মুখে লেপ্টে গেছে। এর মাঝেই চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা পানি। বৃষ্টির পানির সাথে মিলেমিশে একাকার। নিজের মধ্যে তীব্র অপরাধবোধ কাজ করছে। কিছুতেই মেনে নিতেই পারছে না যে হিমেল তার জন্য কষ্ট পাচ্ছে। এক সময় হিমেল ঝাপসা হয়ে যেতেই কুমুর ভেতরটা কেমন দুমড়ে মুচড়ে গেলো। প্রিয় মানুষটাকে হারানোর ভয় গ্রাস করে ফেললো মুহূর্তেই। শ্বাস প্রশ্বাস অস্থির হয়ে উঠতেই নিয়ে ফেললো কঠিন সিদ্ধান্ত। হিমেল এর সাথে কথা বলতে হবে। যতো দ্রুত পারা যায় ততই ভালো। নিজের সংকোচ বাধা পেরিয়ে হিমেলের কাছে নিজেকে প্রকাশ করবে সে। বালির নীচে জলের শব্দ চেপে রাখার সিদ্ধান্তটা পরিবর্তন করে ফেললো। সেই প্রেম সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের শব্দ শোনাবে সে হিমেলকে। বলবে নিজের মনের কথা। আর কোনভাবেই কষ্ট দেবে না তাকে।

———-
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমেছে। ঘড়ির কাঁটা ৮ টা ছুঁইছুঁই। শহর জুড়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি তখনো অব্যাহত। লোড শেডিং আর নিস্তব্ধতার দরুন মনে হচ্ছে অনেক রাত হয়েছে। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাস্তার দোকান গুলো প্রায় সব গুলোই বন্ধ। যে দুই একটা খোলা আছে সেগুলোতে মিটমিটিয়ে আলো জ্বলছে। বাতাসের ধাক্কায় সেগুলোও নেভার পর্যায়ে। হিমেল সিড়ি ভেংগে নিচে নেমে দেখলো কুমুদের বাড়ির দরজা খোলা। মেইন গেটে রাফি দাড়িয়ে চিন্তিত হয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। হিমেল তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। রাফির সেদিকে কোন খেয়াল না দেখে বলল
— এখানে দাড়িয়ে কি করছো?

রাফি চমকে উঠলো। পেছন ঘুরে হিমেলকে দেখে কিছুটা সস্তি পেলো। কিন্তু তার চেহারার চিন্তিত ভাবটা গেলো না। হিমেল কৌতূহলী হয়ে বলল
— কোন সমস্যা হয়েছে? মানে কোন সমস্যা হলে আমাকে বলতে পারো। আমি চেষ্টা করবো হেল্প করার।

রাফি ভীষন চিন্তিত কণ্ঠে বললো
— আপা এখনো আসেনি। এতো দেরি হয়না। ফোনটাও বন্ধ।

চিন্তাটা এবার হিমেলের মস্তিষ্ক গ্রাস করে ফেললো। রাফির মতো তারও চিন্তা হচ্ছে এখন। সন্ধায় ফেরার কথা থাকলেও ২ ঘন্টা আগেই সন্ধ্যা হয়েছে। আর পুরো শহর এখন অন্ধকার। এই অবস্থায় কুমু একা কোথায় যাবে? তার কথায় রাগ করেনি তো? কিন্তু সে তো রাগ করার মতো কোন কথা বলেনি। তাহলে মেয়েটা গেলো কোথায়? আর ফোন অফ রাখার কারণ কি হতে পারে? তার ভাবনার মাঝেই একটা রিক্সা এসে থামলো। দুজনেই সচেতন দৃষ্টিতে সেদিকে তাকাল। পলিথিন টা সরে যেতেই কুমু রিক্সা থেকে নামলো। চারটা চোখ মুহূর্তেই চকচক করে উঠলো। চিন্তিত ভাবটা কেটে গিয়ে সস্তির নিশ্বাস ফেললো দুজনেই। রাফি হাতে থাকা ছাতাটা মেলে মাথায় চেপে দ্রুত কুমুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। অস্থির কণ্ঠে বললো
— এতক্ষণ কই ছিলে আপা? আর তোমার ফোন বন্ধ কেন?

কুমু ভিজে যাওয়া কাপড়ের অংশটা ঝাড়তে ঝাড়তে বলল
— ফোনের চার্জ শেষ। তাই ফোনটা…

বাক্যটা সম্পূর্ণ করার আগেই হিমেলের শান্ত দৃষ্টিতে গিয়ে দৃষ্টিটা ঠেকলো। মুহূর্তেই অনুভূতিগুলো সজাগ হয়ে উঠলো। মস্তিষ্ক সেই বৃষ্টিভেজা দুপুরের কথোপকথন হুবহু আওড়ালো। পুরো শরীর কেমন শিরশির করে উঠলো কুমুর। রাফির প্রশ্নের গোছানো উত্তর গুলো আচমকাই হারিয়ে গেলো। রাফি চাতকের মতো তাকিয়ে আছে নিজের উত্তরের আশায়। চারিদিকে এত জলবহরের মাঝেও নিজের ভেতরটা মরুভূমি মনে হলো। শুকনো ঢোক গিলে দৃষ্টি নত করে মিনমিনে সরে বাক্যটা সম্পূর্ণ করলো
— বন্ধ হয়ে গেছে।

রাফি উৎসুকের মতো আবারও প্রশ্ন করে বসলো
— এতো দেরি তো তোমার কখনো হয়না আপা। আজ কেন হলো?

একই অবস্থায় একই সরে পরের উত্তরটাও এলো
— রিক্সা পাচ্ছিলাম না। আর চারিদিকে অন্ধকার বলে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম রিক্সার জন্য।

ঠিক তখনই ভেসে এলো গম্ভীর কণ্ঠস্বর
— বৃষ্টি বাড়ছে রাফি। ভেতরে এসে কথা বলো।

রাফি বাধ্য ছেলের মতো ভেতরে চলে এলো সাথে কুমুও। হিমেল দাড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। রাফি ভেজা ছাতাটা গুছিয়ে পানিগুলো ঝেড়ে ফেলে হিমেলের দিকে তাকাল। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল
— আপনি কোথাও যাচ্ছেন ভাইয়া?

হিমেল বাইরে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাফির হাতের ছাতার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো
— হুম।

— বাইরে কিন্তু এখন অনেক বৃষ্টি হচ্ছে। এই সময় কোথায় যাচ্ছেন? আর আপনার সাথে তো ছাতাও নেই ভিজে যাবেন।

হিমেল এবার রাফির মুখের দিকে তাকাল। ছেলেটাকে নিঃসন্দেহে ভদ্র ছেলেদের দলে ফেলে দেয়া যায়। কথার মাঝে বিনয়ী ভাব আছে। মৃদু হেসে বললো
— ভিজতেই চাচ্ছি।

কথাটা কর্ণপাত হতেই কুমু দাড়িয়ে গেলো। ঘুরে তাকাল হিমেলের দিকে। রাফি কি ভেবে হেসে ফেলে বলল
— অসময়ে ভিজলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন। এক কাজ করেন ছাতাটা আপনি নিয়ে যান। উপরে ওঠার সময় রেলিঙে ঝুলিয়ে রাখলেই হবে। আমি পরে নিয়ে নিবো।

হিমেল রাফির মায়াভরা চেহারার দিকে তাকিয়ে হাসলো। বলল
— আমি আসলে ভিজতে চাচ্ছি। তাই কিছুটা ইচ্ছা করেই ছাতাটা বাসায় ফেলে এসেছি। বাইরে গিয়ে দেখি বৃষ্টি কতটা পড়ছে।

রাফি হুট করেই অন্যরকম একটা প্রশ্ন করে বসলো
— একা ভিজতে খারাপ লাগবে না? এখন তো রাস্তায় তেমন মানুষও নেই।

হিমেল মুচকি হেসে বললো
— ভিজতে হলে কি সঙ্গীর প্রয়োজন হয়? বর্ষণ সঙ্গিনী ছাড়া কি ভেজা যায়না?

বলেই শব্দ করে হেসে ফেললো। রাফি কিছুটা লজ্জা পেলো। তার কথার মানে টা যে এমনও হতে পারে সেটা সে ভেবেই দেখেনি। হিমেল এর হাসি তাকে আরো অসস্তিতে ফেললো। হিমেল হাসি থামিয়ে কিছুটা কৌতুক মিশিয়ে বললো
— আসলে ভেজার জন্য সঙ্গী চাইলে পাওয়া অসম্ভব কিছু না। অনেকেই ইচ্ছা পোষণ করেছে। আমিই সেরকমভাবে গুরুত্ব দেইনি। এখন দেখছি গুরুত্ব দেয়া উচিৎ। আমারও তো ধৈর্যের একটা সীমা আছে। বাইরে গিয়ে দেখি খুঁজে নেবো কাউকে। সবাই তো কঠিন আর নিষ্ঠুর হয়না। নিজের মনে চেপে রাখা অনুভূতিটা প্রকাশ করার সাহস অনেকেরই আছে। তাদের মধ্যে থেকেই বেছে নেবো একজনকে।

কুমু সচেতন দৃষ্টিতে তাকাল। কথাটা যে তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে সেটা ভালভাবেই বুঝে নিলো। কিন্তু কিছুই বলল না। বলার মতো কিছু খুঁজেও পেলো না। হিমেল এক পলক তাকাল কুমুর দিকে। দৃষ্টি ফিরিয়ে রাফির দিকে তাকিয়ে বলল
— বাসায় যাও। আমি আসছি।

রাফি আর কথা বাড়ালো না। দ্রুত সিড়ি বেয়ে উঠে গেল ভেতরে। কুমু দাড়িয়ে থাকলো। হিমেল সেটা বুঝেও সেদিকে তাকাল না। সামনে তাকিয়ে বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই পেছন থেকে কানে এলো মিহি কণ্ঠস্বর
— ছাতাটা নিয়ে গেলেই কিন্তু পারতেন।

হিমেল ঘাড় ঘুরিয়ে একবার পেছনে তাকাল। কোন কথা বলল না। তার সেই দৃষ্টি কুমুকে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিল যে সে তার সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। কুমু বুঝেই হতাশ শ্বাস ছাড়লো। হিমেল আবারও সামনে ঘুরতেই কুমু বলল
— দয়া করে এই অসময়ে ভিজবেন না। অসুস্থ হয়ে যাবেন তো। আমার কথা শুনুন।

হিমেল এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি কুমুর উপরে ফেললো। সেই দৃষ্টি দেখে আবারও কুমুর ভেতরটা শুকিয়ে গেল। এই মানুষটা তার দিকে তাকালেই এমন কেনো হয়? গোছানো সব কথা গলার মাঝে জটলা পাকিয়ে যায়। মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে উল্টা পাল্টা নির্দেশনা দেয়া শুরু করে। প্রয়োজনীয় সমস্ত কথা ভুলে অপ্রয়োজনীয় কথা বের হয়। আর হিমেল তার এমন আচরনে বরাবর রাগ করে। হিমেল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলেই কঠিন গলায় বলল
— কেনো শুনতে হবে তোমার কথা? এমন কোন সম্পর্ক আছে কি যার কারণে তোমার উপরে দয়া করে আমি তোমার কথা শুনবো? আমার জন্য এতো চিন্তা করা বন্ধ করো। আমার এসব অসহ্য লাগে।

কুমু অসহায়ের মতো তাকাল। তার কথা কেনো বুঝতে চাইছে না। তখনো বৃষ্টিতে ভিজেছিল। আর এখনো জেদ করে একই কাজ করতে যাচ্ছে। এতে লাভ নেই ক্ষতি আছে। হিমেল আর দাড়ালো না। বৃষ্টিতে ভিজেই চলে গেলো বাইরে। কুমু হতাশ শ্বাস ছাড়লো। দুঃখে চোখে পানি চলে এলো। এই মানুষটাকে সে কিভাবে বোঝাবে জতো কথা বলার প্রস্তুতি নিয়ে আসুক না কেন তার সামনে আসলেই সে সব আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। নিজেকে অসহায় মনে হয় ভীষন। তখন হিমেলের কথা শুনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মনের কথাটা তাকে জানানোর। কিন্তু তার সামনে আসা মাত্রই সঞ্চয় করে রাখা সাহসটুকু কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো। কিভাবে এসব বোঝাবে সে? তার এমন উদ্ভট আচরণ মানুষটা কি বিশ্বাস করবে? নাকি হেসেই উড়িয়ে দেবে।

চলবে

#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ২৩

শান্তিনীড় আজ কোলাহল পূর্ণ। সেই সকাল থেকে হইচই চলছে। ব্যস্ততায় শান্তি বেগম হাপিয়ে উঠেছেন। দারোয়ানকে এক বেলায় কয়েকবার বাজারে যেতে হয়েছে। সবাই আজ বাসায় উপস্থিত। দুপুরে বেশ কয়েক পদের রান্না হচ্ছে। সবকিছুই শান্তি বেগমের ছেলে মেয়ে আর জামাইয়ের পছন্দের। বেশ হইচই করে খাবারের টেবিলে বসে পড়লো সবাই। শান্তি বেগম আজ নিজে হাতে সবাইকে বেড়ে খাওয়াবে। টেবিলে বসেই হিমেল সবার দিকে তাকাল। কিন্তু শ্রাবণকে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করেই বসলো
— শ্রাবণ কোথায়? খাবে না?

সৌরভ একটু কৌতূহলী হয়ে বলল
— সত্যিই তো। আমরা এতো কথা বলছিলাম। অথচ শ্রাবণকে দেখলাম না। ইনফ্যাক্ট আমি তাকে সকাল থেকেই মনে হয় দেখিনি।

তাদের সবার কৌতূহল দমন করতেই নিলু বলল
— ওর শরীরটা একটু খারাপ। তাই রেস্ট নিচ্ছে। আমি ডাকতে গেছিলাম। বলল পরে খাবে।

সবাই বিষয়টাকে সহজভাবে নিলেও হিমেল সেরকম ভাবে কিছু ভাবতে পারলো না। কারণ শ্রাবণের জতই শরীর খারাপ হোক না কেনো সে এভাবে ঘরে শুয়ে থাকে না। বরং বাইরে এসে শরীর খারাপের অজুহাতে সবাইকে বিরক্ত করে। এটা মনে হয় তার প্রিয় কাজগুলোর মধ্যে একটা। হিমেল বিষয়টা শুধু নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলো অন্য কাউকে কিছুই বুঝতে দিলো না। চুপচাপ খাওয়া শেষ করে উঠে গেলো শ্রাবণের ঘরে। গুমোট অন্ধকারে ঢাকা ঘরটায় ফ্যানের মৃদু আওয়াজ কানে আসছে। শ্রাবণ কোথায় আছে সেটাও দেখা যাচ্ছে না। হিমেল দরজাটা খুলে মাথাটা বাড়িয়ে মৃদু আওয়াজ করে ডাকলো
— শ্রাবণ?

নিকষ অন্ধকারের মধ্য থেকেই ক্ষীণ দুর্বল কণ্ঠের আওয়াজটা কানে আসলো
— আমি ঘুমাচ্ছি। তোমরা খেয়ে নাও। পরে খাবো।

হিমেল অবাক হলো। শ্রাবণের কণ্ঠস্বর বলে দিচ্ছে সে অসুস্থ নয়। অন্যকোন ব্যাপার আছে। হিমেল ভেতরে ঢুকে গেলো। সুইচ টিপে আলো জ্বালালো। গুমোট অন্ধকারটা দুর হয়ে তীব্র আলো চোখে পড়তেই শ্রাবণ এক হাত চোখের উপরে রেখে বলল
— কিছু বলবে ভাইয়া?

হিমেল বিছানার উপরে গিয়ে বসলো। শ্রাবণের কোলে জড়িয়ে ধরে থাকা কোলবালিশটা টেনে নিয়ে সেটার উপরে আয়েশ করে হেলে পড়ে বলল
— তোর কি কোন সমস্যা হয়েছে?

শ্রাবণ ভাইয়ের দিকে তাকাল। মলিন হেসে বললো
— কি হবে?

হিমেল পুরো শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে বললো
— সেটা তো তুই বলবি। আমি এতো কিছু জানিনা। তবে আন্দাজ করতে পারছি।

শ্রাবণ উল্টা দিকে ঘুরে শুয়ে পড়লো। ক্লান্ত কণ্ঠে বললো
— কিছু হয়নি। আমার ঘুম পাচ্ছে।

হিমেল হতাশ শ্বাস ছাড়লো। বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে জানালার সামনে দাঁড়াল। জানালাটা খুলতেই গরম হাওয়া শরীরে এসে ছুঁয়ে দিলো। টানা দুইদিন বৃষ্টি হওয়ার পর আজ শরীর পোড়া রোদ উঠেছে। ভীষন তপ্ত পরিবেশ। জানালা থেকে সরে এসে পুনরায় বিছানার উপরে গিয়ে বসলো। ভীষন রকম শান্ত কণ্ঠে বলল
— আমি জিজ্ঞেস করছি ভালো লাগছে না? একটু পর যখন মা আসবে তখন উত্তর দিবি? তাহলে মা এসেই জানুক তোর এমন দুঃখ বিলাসের কারণ।

শ্রাবণ উঠে বসলো তৎক্ষণাৎ। এলোমেলো তাকিয়ে বলল
— মা আবার কেনো আসবে?

— তাহলে আমাকে বল। আমি মাকে ম্যানেজ করে নেবো। মা কিন্তু আসতেই চাইছিলো। আমিই আটকে দিয়েছি।

শ্রাবণ দৃষ্টি নত করে ফেললো। আহত কণ্ঠে বললো
— শুভ্রার জন্য ওর বাবা পাত্র দেখছে। যতদূর শুনলাম পছন্দ করে ফেলেছে। হয়তো খুব তাড়াতাড়ি শুনতে পাবো বিয়েও ঠিক হয়েছে।

হিমেল তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। শ্রাবণের মুখের দিকে তাকাতেই তার কষ্ট হচ্ছে। সে খুব ভালোমত শ্রাবণের কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারছে। কারণ কুমুকে ভালোবেসে ফেলার পর থেকে একদিনের জন্য হলেও এই যন্ত্রণাটা সে ভোগ করেছে। নিজের অজান্তেই এই মেয়েটা তার জীবনের অনেকটা দখল করে নিয়েছে। যদি কখনো হারিয়ে যায় তাহলে সে কোনভাবেই নিজেকে সামলে নিতে পারবে না। কুমুকে হারানোর কথা ভাবতেই হিমেলের ভেতরটা ভারী হয়ে উঠলো। সে খেয়াল করে দেখলো অল্প সময়ের ব্যবধানে তার শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। শ্রাবণেরও হয়তো এমন হচ্ছে। সান্ত্বনা দিতে চায়না সে। ভাইয়ের জীবনটা গুছিয়ে দিতে চায়। ভাইকে এভাবে কষ্ট পেতে সে কোনভাবেই দেখতে পারবে না। হিমেল ঠোঁট গোল করে নিশ্বাস ছেড়ে বলল
— কি করবি কিছু ভেবেছিস?

শ্রাবণ জোরে নিশ্বাস ছাড়ল। আহত কণ্ঠে বললো
— ভাবার মতো কিছু নাই ভাইয়া। শুভ্রা আমাকে পছন্দ করে কিনা সেটাই আমি এখনো জানিনা। আর ওর বিয়ে কিভাবে আটকাবো।

— জানিস না মানে?

কিছুটা অবাক হয়ে প্রশ্নটা করলো হিমেল। কিন্তু পরক্ষণেই তার নিজের পরিস্থিতির কথা মনে পড়ে গেলো। সে তো নিজেই এখনো জানে না কুমু তাকে নিয়ে ঠিক কি ভাবে। বুঝতে পারে কুমুর মনে তার জন্য একটু হলেও অনুভূতি কাজ করে। কিন্তু সেটা শুধুই ভালোলাগা নাকি তার মতো ভালোবাসা সেটা এখনো নিশ্চিত নয়। শ্রাবণের অবস্থাটাও হয়তো তার মতই। তাই উত্তর দেয়ার আগেই প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে বলল
— জানিস না বলে চুপ করে বসে থাকলে তো বিয়ে ঠিক হবেই। কথা বল শুভ্রার সাথে। সে কি আদৌ বিয়েতে রাজি? নাকি জোর করে দিচ্ছে। শুভ্রার সাথে কথা না বলা পর্যন্ত কিছুই জানা যাবে না। তাই ওর ব্যাপারটা আগে জানতে হবে।

শ্রাবণ অসহায়ের মতো বলল
— কিন্তু কিভাবে? শুভ্রার সাথে আমি অনেকবার কথা বলার চেষ্টা করেছি। বারবার শুধু আমার উপরে রাগ করে। ওর আচরনে আমার কয়েকবার মনে হয়েছে একটু দুর্বলতা আছে। কিন্তু মুখে প্রকাশ করে না। এখন কি করতে পারি আমি।

হিমেল কপালে ভাঁজ ফেললো। গভীর ভাবনায় ডুবে গেলো সে। কিছুটা সময় নিয়ে ভেবে বলল
— আচ্ছা এমন কোন কমন ফ্রেন্ড নাই যার সাথে তোদের দুজনের ভালো সম্পর্ক। সেরকম কেউ থাকলে অন্তত শুভ্রার মনের কথাটা কিছুটা জানা যাবে।

হিমেল এর কথাটা শুনে শ্রাবণ একটুও সময় না নিয়ে বলল
— আছে না! ওই যে কুমু।

হিমেল ভ্রু কুঁচকে তাকাল। অস্পষ্ট স্বরে বলল
— কুমু?

শ্রাবণ লাফিয়ে উঠে বলল
— ভাইয়া তুমি যে আমার কি উপকার করলে বলে বোঝাতে পারবো না। যাই কুমুর সাথে কথা বলে আসি।

হিমেল ভাবনার মধ্য থেকেই আনমনে বলে উঠলো
— এখন ওকে পাবি না। বাসায় নেই।

শ্রাবণ থেমে ঘুরে তাকাল। অবাক কণ্ঠে বললো
— ভাইয়া তুমি?

হিমেল এর ধ্যান ভাঙলো। কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল
— আমি কি?

শ্রাবণ দাত কেলিয়ে হাসলো। বলল
— দেখছি কুমুর প্রতিটা কাজের আপডেট রাখো। তুমি যে এমন হবে আমি ভাবতেই পারছি না। প্রেমে পড়লে মানুষ কতো কিছু শিখে যায়। তোমার কাছ থেকে প্রতিটা প্রেমিকের অনেক কিছু শেখার আছে।

হিমেল নিজের উপরে বিরক্ত হলো। পরিস্থিতি সামাল দিতে বলল
— আমি ঠিক জানি না। কয়েকদিন এই সময় বাইরে যেতে দেখেছিলাম। তাই বললাম। তুই খোঁজ নিয়ে দেখ। আমি বললেই যে সেটা ঠিক হবে তা তো নয়।

শ্রাবণ এবার প্রশস্ত হাসলো। হাসি ঠোটের আগায় রেখেই বলল
— সেটা অন্যকারো কথা হলে আমি মেনে নিতাম। কিন্তু কুমুর ব্যাপারে তোমার কথা ভুল হবে সেটা মানতে পারছি না। যাই হোক। কুমু কখন ফিরবে সেটা জানো কি? তখন নাহয় কথা বলবো।

হিমেল কৃত্রিম রাগ দেখানোর চেষ্টা করে বলল
— আমি কি কুমুর পি এ? ওর যাওয়া আসার সব খবর রাখবো। যতটুকু চোখে পড়েছে সেটাই বললাম। এর বেশি আমি জানিনা।

শ্রাবণ দুর্বোধ্য হাসলো। কিন্তু তার সেই হাসির অর্থ হিমেলের বুঝতে কষ্ট হলো না। হিমেল বিরক্তিটা প্রকাশ করতেই শ্রাবণ কাছে এসে বসলো। হেসে ফেলে বলল
— ঝগড়া করেছো বুঝি?

বলেই শব্দ করে হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে ক্লান্ত হয়ে বলল
— তুমি যে একটা মেয়ের সাথে ঝগড়া করতে পারো এটা আমি কোনভাবেই মানতে পারছি না ভাইয়া। কেমন আজব লাগছে। তোমার দিকে তাকালেই কেমন লজ্জা পাচ্ছি।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here