বালির নীচে জলের শব্দ #পর্ব ২

0
460

#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ২

শান্তিনীড়ে আজ ব্যস্ততা ভর করেছে। শান্তি বেগম কোনভাবেই স্থির হতে পারছেন না। পারবেন বা কি করে। তার এক মাত্র মেয়ে আসছে জামাইসহ। আর তাকে জানানো হল ঘণ্টা দুয়েক আগে। শ্রাবণ বলে গেছে দুই ঘণ্টার মধ্যে তারা পৌঁছে যাবে। ঘড়ির দিকে তাকাতেই হাত চালানো আরও বাড়িয়ে দিলেন। দুই ঘণ্টা হয়ে গেছে। যে কোন সময় এসে পড়বে। কলিং বেল বেজে উঠতেই তিনি সব ফেলে চলে গেলেন দরজা খুলতে। দরজা খুলেই হিমেলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সস্তির নিশ্বাস ফেললেন। মাকে এতো চিন্তিত আর অস্থির দেখে হিমেল জিজ্ঞেস করলো
–কি হয়েছে মা?

শান্তি ব্যস্ত ভঙ্গীতে বললেন
–নিলু আর জামাই আসছে। শ্রাবণ নিতে গেছে ওদেরকে। তুই আয়। তাড়াতাড়ি গোসল করে রেডি হয়ে নে।

হতভম্ব হিমেল তাকিয়ে থাকলো মায়ের দিকে। তার ছোটবোন আসছে। সেজন্য তাকে কেন রেডি হতে হবে সেটাই বুঝে উঠতে পারলো না। শান্তি দরজা ছেড়ে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বললেন
–দেরি হয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি নে।

হিমেল হেসে ফেললো। নিজের ঘরে গিয়ে মায়ের কথার সবটাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করলো। তিন ছেলে মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে হিমেলকে মা বেশী পছন্দ করেন। দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে পড়ালেখা শেষ করে দেশে এসেছে। তবুও সেই ছোটবেলার মতোই মায়ের কথা সবটা মেনে চলে। আর মারও ছেলের বুদ্ধির উপরে অগাধ বিশ্বাস। তাই তার সাথে কথা বলেই সব সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বাড়িতে। তার সম্মতি ছাড়া শান্তি বেগম বাড়ির কোন কাজই করতে দেন না। শুধু মায়ের কাছেই নয় ছোটবেলা থেকেই হিমেল কাছের মানুষদের অত্যান্ত প্রিয়। তার প্রখর ব্যক্তিত্ব আর পরোপকারী গুনের কারনেই সবাই তাকে খুব বেশী পছন্দ করে। আবারো দরজায় শব্দ হতেই শান্তি বেগম এক প্রকার দৌড়ে চলে গেলেন দরজা খুলতে। মেয়ে নিলু আর জামাই সৌরভকে দেখেই সহাস্যে মেয়েকে বুকে টেনে নিলেন। জড়িয়ে রাখলেন কিছু সময়। দুই ভাইয়ের মাঝখানে নিলু। অল্প বয়সেই তার বিয়ে হয়ে যায়। মেয়েকে তখন বিয়ে দেয়ার ইচ্ছা শান্তি বেগম বা করিম সাহেব কারো ছিল না। কিন্তু হিমেলের কথায় তারা না করতে পারেনা। কারণ সৌরভ হিমেলের খুব ভালো বন্ধু। সে আর নিলু একে অপরকে পছন্দ করে। কথাটা জানার পর থেকেই হিমেল তাদের বিয়ে দেয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করে বাসায়। কারণ হিমেল আর সৌরভ একসাথে বিদেশে পড়তে যাচ্ছিল। আর বিদেশে যাওয়ার আগে অন্তত তাদের কাবিনটা করে রাখার ব্যবস্থা করে হিমেল। তার কথা ফেলতে না পেরেই বাবা আর মা রাজি হয়ে যায়। হিমেল আর সৌরভ দেশে ফেরার পর আয়োজন করে অনুষ্ঠান করা হয় সবাইকে জানানোর উদ্দেশ্যে।

————
বঙ্গাব্দ ১৪২৮, ১৯ ই ফাল্গুন

“আমিও প্রেমে পড়তে চাই। কোন এক বসন্তে বৃষ্টি মুখর দিনে এই শরীরের সাথে মনও ভেজাতে চাই প্রেমের বৃষ্টিতে। কয়েক বসন্ত কেটেছে তোমার অপেক্ষায়। এই বসন্তে প্রেমে পড়তে চাই খুব করে। বসন্তের শিশির ভেজা ঘাসের উপরে সকালের মিষ্টি রোদ্দুর ঝুপ করে নেমে এলে যেমন মিইয়ে পড়ে লজ্জায়। তেমন লজ্জা আমিও পেতে চাই। লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে উঠতে চাই বসন্তের কোন এক মধ্যরাতের বৃষ্টির ছোঁয়ায়। আলগোছে আমার ভেজা চুল সরিয়ে দেবে তুমি। ভেজা মুখশ্রীর পানে তাকিয়ে থাকবে কয়েক মুহূর্ত। আদর করে দেবে বিশেষ কিছু নাম। সে নামের ডাকে আমি লজ্জায় ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাবো। আমিও প্রেমে পড়তে চাই খুব করে।“

–ওহে কুমু! কি জীবন্ত অনুভূতি। এখন আফসোস হচ্ছে আমি ছেলে হলাম না কেন? আমার যে তোর প্রেমে পড়তে ইচ্ছা করছে খুব করে। কি করি বলতো?

নিজের কথা শেষ করেই শুভ্রা কুমুকে জড়িয়ে ধরল। কুমু ডাইরিটা ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলো। সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলল
–অসভ্য মেয়ে! কতদিন বলেছি আমার সাথে এমন অসভ্যতামি করবি না। আমি এসব একদম পছন্দ করি না।

শুভ্রা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে অভিমানী কণ্ঠে বলল
–ঠিক আছে না ধরলাম তোকে। কিন্তু ডাইরির পাতায় যার জন্য এমন অনুভূতিগুলো লিখে লিখে সাজিয়ে রাখিস সে ধরলেও কি এমন ভাবে সরিয়ে দিবি?

কুমু অগ্নিমূর্তি ধারন করে ফেললো মুহূর্তেই। শুভ্রাকে এই মুহূর্তে তার দুনিয়ার সব থেকে অসভ্য আর বাজে মেয়ে মনে হচ্ছে। এর সাথে আর বসে থাকা চলে না কোনভাবেই। ডাইরিটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিঃশব্দে সেখান থেকে উঠে হাটা ধরে সামনের দিকে। শুভ্রা পেছন থেকে কয়েকবার চিৎকার করে ডাকলেও সে সেদিকে কান দেয়না। শুভ্রা বুঝতে পারে কুমু রাগ করেছে। তাই সেও উঠে দৌড় দেয় কুমুর পেছন পেছন। সামনেই রাস্তার পাশেই একটা ফটোকপির দোকানে এসে কুমু দাঁড়িয়ে যায়। কিছু শিট ফটোকপি করতে হবে। শুভ্রা হাপাতে হাপাতে এসে পাশে দাঁড়িয়ে বলে
–রাগ করিস না প্লিজ কুমু। আমি আর কখনো এমন করবো না।

কুমু রাগান্বিত চেহারায় ঘুরে তাকায়। ডাইরির এসব লেখা অন্যকারো পড়ার বিষয়টা তার একদম অপছন্দ। যেটা বলার মতো সেটা সে নিজে থেকেই বলে দেয়। কিন্তু কিছু না বলা কথা থাকে প্রতিটা মানুষের। কিছু জিনিস একান্ত ব্যক্তিগত। যার উপরে শুধু নিজের অধিকার। অসাবধানতা বশত ব্যাগ থেকে ডাইরিটা পড়ে যায় কুমুর। আর শুভ্রা সেটাই তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করে। শুভ্রার উপরে মনে মনে ক্ষুণ্ণ হলেও তার চেহারা দেখে মুখে কিছু বলল না। শুভ্রা কাঁদো কাঁদো চেহারায় বলল
–আমি সত্যিই আর তোর ডাইরি পড়বো না। হাত দিয়ে ছুয়েও দেখবো না। তবুও এমন রাগ করিস না। তুই রাগ করে থাকলে আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করে। আমি তো অপরাধ স্বীকার করছি। আর করবো না। প্রমিস!

কুমু একটা শ্বাস ছাড়ল। ডাইরি পড়ার ব্যাপারটা তার কাছ থেকে চেপে গেলেও মন থেকে মেনে নিতে পারলো না। তাই মনের মাঝে অপ্রকাশিত রাগটা জমিয়ে রেখেই উপরে নরম কণ্ঠে বলল
–ঠিক আছে। আর ঢং করতে হবে না।

শুভ্রা মুচকি হেসে বলল
–ফটোকপি করবি?

কুমু মাথা নেড়ে ব্যাগ থেকে শিট গুলো বের করে দোকানদারের দিকে এগিয়ে দিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল। একটা ছোট্ট বাচ্চা তার বাবার হাত ধরে রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করছে অনেকক্ষণ ধরে। কিন্তু পারছে না। একবার সাহস করে পা বাড়িয়ে দেয় তো আবার পিছিয়ে আসে। মৃদু হাসল কুমু। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেলো। সেও এমনই ভয় পেত। বাবার হাত ধরে রাস্তা পার হতো। শিট ফটোকপি শেষ হলে দোকানদার তাকে ডেকে সেগুলো হাতে ধরিয়ে দেয়। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সদ্য ফটোকপি করা কাগজগুলোয় চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল। ঠিক সেই সময় একটা আওয়াজ আর সাথে সাথেই আশেপাশের লোকের চিৎকার কানে আসতেই চোখ তুলে সামনে তাকাল কুমু। ছোট্ট নিথর দেহটা রাস্তায় পড়ে রক্তে মাখামাখি হয়ে উঠেছে। চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখার পরেই ধড়াস করে বুকের ভেতরে হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠলো। সাথে সাথেই হাত পা অসাড় হয়ে দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে এলো। শরীর হালকা হয়ে উঠতেই পাতান বেঞ্চটাতে বসে পড়লো কুমু। শক্ত করে সেটা দুই হাতে চেপে ধরে ঘোলাটে দৃষ্টি স্থির করলো নিচের দিকে। জোরে জোরে শ্বাস নিতেই ভেতরটা পানির জন্য হাহাকার করে উঠলো। শুভ্রা চিৎকার করে বলে উঠলো
–কুমু? খারাপ লাগছে নাকি? এমন করছিস কেন? কি হয়েছে আমাকে বল?

উত্তর দেয়ার মতো কোন অবস্থাতেই নেই সে। পাশেই বসে তাকে দুই হাতে ধরে ফেললো শুভ্রা। তার চোখে মুখে কৌতূহলী দৃষ্টি ফেলে বলল
–পানি খাবি?

কুমু এবারো উত্তর দিতে ব্যর্থ হল। শুভ্রা ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ঢাকনা খুলে ধরল মুখের সামনে। কুমু পানিটা খেয়েই চোখটা বন্ধ করে ফেললো। নিজেকে শান্ত করেই আবারো চোখ তুলে তাকাতেই দৃষ্টি আটকে গেলো তার। তার ঠিক সামনে দিয়েই সেই বাচ্চাটার নিথর দেহটা পাজা কোলা করে হেটে যাচ্ছে এক সুদর্শন পুরুষ। তার পাশেই আরেকজন বাচ্চার মাথায় হাত চেপে ধরে সাথে সাথে হেটে চলেছে। কিন্তু তার হাত উপছে গলগল করে রক্ত বের হয়ে সেই পুরুষটির সাদা শার্ট ভেসে যাচ্ছে। সেদিকে কোন খেয়াল নেই। বিচলিত দৃষ্টি একবার সামনে আবার পরক্ষনেই বাচ্চাটার রক্তাক্ত মুখের দিকে বিচরন করছে। পুরুষটির মুখ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে শার্টের দিকে তাকাতেই আর সহ্য করতে পারলো না কুমু। নিস্তেজ হয়ে আসা শরীরটা আর সামলে উঠতে পারলো না। ছেড়ে দিলো তাকে নিজের মতো। শরীর ছেড়ে দিতেই চোখের সামনে ধীরে ধীরে অন্ধকার গ্রাস করে ফেললো আর খুব কাছ থেকেই ভেসে এলো শুভ্রার অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর
–কুমু। এই কুমু। কথা ব…।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here