#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ৩৪,৩৫
৩৪
সল্প পরিসরে কুমু আর হিমেলের বিয়েটা সম্পন্ন হয়ে গেলো। রুশা সেলিম আর সেখানে কর্মরত লোকজনের সহায়তায় খুব একটা কষ্ট হয়নি সব কিছু ঠিকঠাক করতে। এতো কিছুর মাঝে কুমু কোন কথা বলতে পারেনি। কারণ হিমেল তাকে কথা বলার সুযোগ দেয়নি। যখনি কোন কথা বলার চেষ্টা করেছে তখনই হিমেল স্পষ্ট করে বলেছে ‘ তোমার সব কথা শুনবো কিন্তু বিয়ের পর।’ তাই আর কথা বলা সম্ভব হয়নি। কাজী ডেকে শেষমেশ বিয়েটা ভালোভাবে দিতে পেরে সেলিমও এক প্রকার সস্তি অনুভব করছে। অনেকদিন হলো মেয়েটা তার বাড়িতে এসেছে। যখন এসেছিলো তখন বিদ্ধস্ত অবস্থায় ছিলো। সে অবস্থায় একটা মেয়েকে দেখে সবার মনে তার জন্য সহানুভূতি কাজ করবে ঠিকই কিন্তু তাকে এভাবে সম্মান দিয়ে নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে নেয়ার সাহস কেউ করবে না। হিমেল কে দেখে বারবার শ্রদ্ধায় তার মাথা নিচু হয়ে আসছে। এই দুঃসাহস হয়তো সেও করতে পারতো না। কিন্তু হিমেল সত্যিই অমায়িক একজন মানুষ। সে নিজের মনের সুপ্ত ভালোবাসাকে সবার উপরে অগ্রাধিকার দিয়েছে। সেই ভালোবাসাকে শ্রদ্ধা জানাতে যে কারো মাথা নত হয়ে যাবে তার সামনে। মেয়েটার কথা ভেবে এতদিন সেলিমের খারাপ লাগতো। কিন্তু আজ মনে কোন আক্ষেপ নেই। সে খুব খুশি। কুমু এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেনি বলেই একটুতেই হাপিয়ে ওঠে। অনেকটা দুর্বলতা এখনো রয়েই গেছে। সকাল থেকে বিয়ের ব্যস্ততায় আজ আরো বেশি হাপিয়ে উঠেছে। তাই এখন রেস্ট নিচ্ছে। হিমেল তার ঘরে কুমুকে শুয়ে দিয়েছে। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিবে। বিকেল গড়াতেই সব কাজ শেষ করে দো তোলার বারান্দায় সবাই হাফ ছেড়ে বসলো। রুশার কিছু কাজ থাকায় সে নিজের ঘরে চলে গেছে। হিমেল আর সেলিম বসে গল্প করছে। কথা বলার এক পর্যায়ে হিমেল জিজ্ঞেস করলো
— কুমুর সাথে যে ইনসিডেন্ট হয়েছিলো সেটা নিয়ে কতদূর এগিয়েছেন সেলিম সাহেব?
সেলিম হতাশ শ্বাস ছাড়লো। আকাশের দিকে উদাসীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
— এখনো তেমন প্রগ্রেস নেই। তবে আমি এটা বুঝে গেছি যে কুমুর সাথে যে বা যারা এমনটা করেছে তারাই পরীকে খু’ন করেছে। তাই একটা সুরাহা হলেই ওদের হদিশ পাওয়া যাবে। পু’লি’শ বিষয়টা নিয়ে এখনো তদন্ত করছে। এখনো তেমন কোন ক্লু পেয়েছে বলে মনে হয়না।
হিমেল হতাশ হলো সাথে বিরক্ত। কিছুটা কাঠিন্য বজায় রেখে বলল
— আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে পু’লি’শ ঠিক ভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছে না। যদি করতো তাহলে কখনোই এতো সময় লাগতো না। কারণ গ্রামটা অনেক ছোট। আর এখানকার প্রতিটা লোকের স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করা যায়। সেক্ষেত্রে পু’লিশে’র জন্য এসব খুঁজে বের করা কঠিন কিছু নয়। একটা খু’ন হয়ে গেলো অথচ পু’লি’শ এখনো কোন ক্লু পেলো না এটা আমি মানতে পারছি না।
সেলিম মাথাটা নিচু করে ফেললো। নত কণ্ঠেই বলল
— আপনার ধারণাটা ঠিক। দায়িত্ব গ্রহণ করা আমার বেশিদিন হয়নি। এর আগে আমি বাইরেই থেকেছি। তাই গ্রাম সম্পর্কে এতো বিস্তারিত ধারণা আমার নেই। তবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে এটা বুঝতে পেরেছি যে সাধারণ মানুষ বিষয়টা যতটা সহজ ভাবে ততটা সহজ নয়। ভেতরে অনেক কিছুই আছে যা অজানা। হয়তো গ্রামের মানুষের কাছে জানা। কিন্তু আমার কাছে অজানা। ভয়েই হয়তো কেউ মুখ খুলে না। আর একটা খু’নে’র ব্যাপার কিন্তু নয় হিমেল সাহেব। এর আগেও এমন ভাবেই অনেক খু’ন হয়েছে। এই গ্রামে কোন কিশোরী মেয়ে হা’রি’য়ে গেলেই বাবা মা তার আশা ছেড়ে দেয়। হয় সে ফিরে আসবে না আর আসলেও তাকে স’মা’জে গ্রহণ করার মতো কোন অবস্থা থাকবে না।
হিমেল ভ্রু কুঁচকে ফেললো। কিছুটা অবাক হয়েই বলল
— যারা বেচেঁ থাকে তারা তো সব কিছুই জানে। তারাই তো পু’লিশ’কে সাহায্য করতে পারে। তাহলেই তো সহজ হয়ে যায়।
সেলিম হেসে উঠলো। বলল
— বিষয়টা দুঃখজনক হলেও সত্যি যারা বে’চেঁ ফিরে তাদের হ’দিশ আজ অব্দি পাওয়া যায়নি। কেনো পাওয়া যায়নি সেটা নিয়ে পরিবারের সাথে কথা বলেও লাভ হয়নি। তারা কিছু জানে না বলেই বিষয়টাকে বাড়তে দেয়না। আর সরাসরি এভাবে না বললে আর কি বলার থাকে সেখানে।
— স্ট্রেঞ্জ!
ভীষন অবাক হয়ে বলল হিমেল। এমন আচরনের কারণটা ঠিক কি হতে পারে। এরকম পরিস্থিতিতে বাবা মায়ের মেয়ের পাশে দাঁড়ানো কর্তব্য। কিন্তু সবাই এভাবে এড়িয়ে যায় কেনো হিমেল কিছুতেই বুঝতে পারলো না। অনেক ভেবে বলল
— তাহলে কি এসবের পেছনে গ্রামের প্রভা’ব’শালী কোন পরিবার….
কথাটা শেষ করার আগেই সেলিমের ফোন বেজে উঠলো। সে পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রিনে নাম্বার টা দেখে নিয়ে হিমেলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল
— হিমেল সাহেব পু’লিশ’কে ম্যানেজ করা সহজ ব্যাপার না। সে থেকেই বোঝা যায় আপনার ধারণা কতোটা যুক্তিযুক্ত।
সেলিমের আর ফোনটা ধরা হলো না। তার কথার রেশ ধরেই হিমেল বলল
— তাহলে তো খুঁজে বের করা খুব কঠিন কিছু নয়।
সেলিম ফোনটা পুনরায় পকেটে রেখে বলল
— কিন্তু আমার জন্য বেশ কঠিন।
হিমেল কিছুটা সময় নিয়ে ভাবলো। মুচকি হেসে বললো
— আমার জন্য তো নয়। আমি তো চাইলেই বের করতে পারি। আপনার একটু হেল্প দরকার। তাহলেই খুব একটা কঠিন হবে না বিষয়টা।
সেলিম হিমেলের আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠের উপরে ভরসা করে উঠতে পারলো না। সন্দিহান কণ্ঠে বলল
— কিন্তু ঠিক কি করবেন আপনি?
হিমেল কিছু বলার আগেই আবারও ফোন বেজে উঠলো সেলিমের। ব্যস্ত হয়ে ফোনটা ধরার আগে বলল
— আমাকে যেতে হবে হিমেল সাহেব। আপনারা রেস্ট নেন। রাতে দেখা হচ্ছে। একসাথে রাতের খাবার খাবো।
হিমেল মুচকি হেসে বিদায় জানালো। সেলিম উঠে চলে গেলো নিজের কাজে। হিমেল লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে সিগারেট জ্বালালো। সেটা অর্ধেক শেষ না হতেই ফোন বেজে উঠলো। হাতে নিতেই ঠোঁটে ফুটে উঠলো মুচকি হাসি। ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে উঠলো শ্রাবণের গুরুগম্ভীর চেহারা। সে মনোযোগ দিয়ে ক্যামেরার এপাশে থাকা হিমেলের দিকে তাকিয়ে আছে। হিমেল এর হাস্যোজ্জ্বল চেহারা দেখেই বলল
— ভাইয়া তোমার কোন খবর নাই কেনো? কোথায় আছো?
হিমেল হেসে উঠে বলল
— যেখানে থাকার কথা ছিল সেখানেই আছি।
হিমেল কে এভাবে হাসতে দেখে শ্রাবণ অবাক হয়ে গেলো। কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললো
— এভাবে হাসছো কে…
কথাটা শেষ করতে পারলো না। তার আগেই চোখ পড়লো হিমেলের পেছনে দাড়িয়ে থাকা রমণীর উপরে। প্রথম দেখায় চিনতে পারলো না শ্রাবণ। সেই মেয়েটা যে রুশা নয় সেটা অন্তত বুঝেই সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাল। মেয়েটি এলোমেলো পা ফেলে এগিয়ে একদম হিমেলের পেছনে দাড়াতেই প্রতিচ্ছবি টা স্পষ্ট হয়ে গেলো। শ্রাবণ চোখ বড়ো করে চেয়ে অস্পষ্ট আওয়াজে বলল
— কুমু।
হিমেল শুনতে পেলো। পেছন ঘুরে দেখলো সদ্য ঘুম থেকে জেগে ওঠা কুমু অনেক কষ্টে চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। ঘুম জড়ানো এমন চেহারা দেখেই হিমেল হেসে ফেলে বলল
— ঘুম হলো?
কুমু উপর নীচে মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো। হিমেল পাশের চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে বলল
— বসো এখানে।
কুমু বসতে চেয়েও ফোনের দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাল। হিমেল তার দৃষ্টির অর্থ বুঝেই বলল
— শ্রাবণ। কথা বলবে?
কুমু চেয়ারে বসে ফোনের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। অনেকদিন পর শ্রাবণকে দেখে হেসে উঠে বলল
— কেমন আছেন শ্রাবণ ভাইয়া?
শ্রাবণ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। অনেকটা সময় হা করে তাকিয়ে থেকে বলল
— তুমি কি সত্যিই কুমু?
কুমু হিমেল দুজনেই হেসে ফেললো। হাসি থামিয়ে কুমু বলল
— আমি সত্যিই কুমু। বিশ্বাস হয়না।
শ্রাবণ এবার কৃত্রিম রাগ করে বলল
— এই মেয়ে এতদিন তুমি কোথায় ছিলে? তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে আমরা সবাই হয়রান। আর আমার ভাই তো তোমার খোঁজ না পেয়ে মরার মতো সারাদিন ঘরে পড়ে থাকে। কি একটা অবস্থা। চারিদিকে শুধু হাহাকার আর কষ্ট। ভাই আর বউকে সামলাতে আমার বারোটা বেজে যায়।
শ্রাবণের কথা বলার ভঙ্গি দেখে কুমু হেসে ফেললো। শ্রাবণ বিরক্ত হয়ে বলল
— তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? হুট করেই আবার কোথা থেকে আসলে? ভাইয়া কোথায় পেলো তোমাকে? এবার হারিয়ে যাবে না তো? এবার হারালে কিন্তু..
হিমেল শ্রাবণকে থামিয়ে দিয়ে বলল
— এতো প্রশ্ন একবারে করলে কোনটারই উত্তর পাবিনা। শুধু শুনে রাখ আর হারাবার কোন চান্স নেই। একবারেই পেয়ে গেছি কুমুকে।
শ্রাবণ কথার অর্থ ধরতে পারলো না। বলল
— একবারেই মানে?
হিমেল হেসে উঠে বলল
— বিয়ে করে ফেলেছি। এখন আর চাইলেও হারাতে পারবে না।
ক্যামেরার ওপাশে নিশ্চুপ শ্রাবণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো কয়েক সেকেন্ড। তারপর বলল
— বিয়ে করে ফেলেছো তুমি?
হিমেল মাথা নাড়তেই শ্রাবণ চিৎকার করে উঠে বসে গেলো। অস্থির হয়ে বলল
— কি বললে ভাইয়া? সত্যিই বিয়ে করেছো?
হিমেল ধমকে উঠে বলল
— চিৎকার করিস না একদম। এখনই কাউকে বলবি না। পরে আমি সব বুঝে বলবো।
শ্রাবণ চুপ তো হয়ে গেলো। কিন্তু হিমেল তার উপরে কিছুতেই ভরসা করতে পারছে না। তার পেটে একদম কথা থাকে না। সে কাউকে না বললেও সৌরভ কে অন্তত বলবেই। সৌরভ কে বললে তেমন সমস্যা নেই। তাই আর কথা বাড়ালো না। আরো কিছুক্ষণ চলল কথাবার্তা। এর মাঝেই রুশা কোথা থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বলল
— হিমেল ঝুম সু’ইসা’ইড এটে’ম্পট’ করেছে।
চলবে….
#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ৩৫
গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিকের একটা ছোট্ট ঘরে বিছানায় লেপ্টে আছে ঝুমের অ’চে’তন দেহটা। তার পরিবারের লোকজন আশেপাশে ভীড় জমিয়ে কাদঁছে। সেলিম দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ভেতরের দিকে। ঝুম এখনো অ’চে’তন অবস্থায় আছে। ডাক্তার বলেছে জ্ঞান ফিরতে একটু সময় লাগবে। যদিও সেলিম শহরে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু ডাক্তার বলেছেন সমস্ত বি’প’দ কেটে গিয়েছে। এখন শুধু জ্ঞান ফেরার পালা। তাই সবাই অপেক্ষা করছে। সেলিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেখান থেকে সরে একপাশে দাঁড়ালো। চোখটা বন্ধ করতেই কোন বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল তার। এই মেয়েটাকে সে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসে। সেই ছোটো বেলা থেকেই ঝুমকে সবার থেকে আলাদা মনে হয়েছে তার। এই অনুভূতির পেছনে অবশ্য তার মায়ের হাতটাই বেশি ছিলো। ছোটো থেকেই সেলিমের মা ঝুমকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতেন। মাঝে মাঝে অন্যায় আবদার করে বসতেন যে তিনি ঝুম কে একবারেই রেখে দেবেন নিজের কাছে। কিন্তু ঝুম তার বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে হওয়ায় সেটা সম্ভব হয়নি। তাই তিনি বিকল্প পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। এই মেয়ের সাথে তার ছেলের বিয়ে দিলেই মেয়েটা তার বাড়িতেই থেকে যাবে। কারোরই কোন আপত্তি থাকবে না। তাই সেলিম যখন নিজের পড়াশোনা শেষ করতে শহরে যায় তখন তার মায়ের মাথায় দুশ্চিন্তা ভর করে। ছেলে যদি কোন শহুরে মেয়ে পছন্দ করে ফেলে। সেই চিন্তা থেকে মুক্তি পেতেই তিনি এক প্রকার জোর করেই ঝুম আর সেলিমের এনগেজ করে রাখেন। যাতে কেউ তাদের জীবনে দ্বিতীয় কাউকে প্রবেশ করাতে না পারে। সেই থেকেই সেলিমের মনে ঝুম এর জায়গাটা সবার থেকে আলাদা হয়ে যায়। সেলিম আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস হাওয়ায় মিলিয়ে দিলো। মেয়েটা হুট করেই এমন একটা সিদ্ধান্ত কেনো নিলো সেটাই কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না সেলিমের। ঝুম এমন মেয়ে না। সে খুব ভালো ভাবেই তাকে চিনে। অযথা কেনো সুইসাইড করার সিদ্ধান্ত নেবে ঝুম। বিষয়টা কেমন এলোমেলো লাগছে। এর মাঝেই রফিক শিকদার এসে তার পাশের চেয়ারে বসলো। সেলিম কিছুটা সময় গভীর দৃষ্টিতে তাকে পর্যবেক্ষণ করলো। তার চেহারায় কষ্টের চেয়ে রাগের ছাপটা বেশি মনে হলো। কার উপরে এই রাগ? সেলিম নিজের মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্ন গুলোর উত্তর খুঁজতেই তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। কাধে হাত রেখে বলল
— চাচা? কি এমন হইছিলো যে ঝুম এমন করলো? আপনাকে কিছু বলছে?
রফিক সামনের দিকে তাকিয়ে বলল
— মাইয়াডার প্যাটে ব্যাথা। আজ সারাদিন ঘর থেইকা বাইর হয়নি। দুপুরে অর মায়ে ঘরে যাইয়া দেখে মাইয়া ম’রা’র মতন পইড়া আছে মাটিত। নড়াচড়া করেনা। তুইলা দেখে হ্যার হাত দিয়া র’ক্ত পইড়া মাখামাখি হইয়া গেছে। চিৎকার দিয়া সবাইরে ডাকলে আমরা যাইয়া এইহানে আনি।
সেলিমের ভ্রু কুঁচকে এলো। কোন কারণ ছাড়া এমন কেনো করবে ঝুম। আর কারণ থাকলেও বা কি এমন গুরুতর কারণ হতে পারে। কিছুই আন্দাজ করতে না পেরে আবারও জিজ্ঞেস করে বসলো
— ঝুমের সাথে কি বাসায় কারো ঝগড়া হইছিলো?
রফিক না সূচক মাথা নাড়লো। বলল
— দুই দিন হ্যায় একদম চুপ আছিলো। কয় শরীরডা ভালা না। ঘরেই থাকে। বাইর খুব কম হয়।
সেলিমের কপালে আরো গাঢ় ভাঁজ পড়ে গেলো। গতকাল ঝুমের সাথে তার দেখা হয়েছিলো। অনেক লোকজন থাকায় কথা হয়নি। কিন্তু ঝুমকে দেখে সেলিমের একবারও মনে হয়নি তার শরীর খারাপ কিংবা মন খারাপ। সেলিম রফিকের কাছ থেকে সরে এসে আবারও ঝুমের ঘরের সামনে দাঁড়ালো। ভালো করে চেহারাটা খেয়াল করলো। বুকের ভেতরটা যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠলো তার। এই মেয়েটার যদি কিছু হয়ে যেতো তাহলে তার কি হতো। নিজেকে অসহায় মনে হতেই চোখ বন্ধ করে ফেললো। ঠিক তখনি ঘাড়ে কারো স্পর্শ পেয়ে চোখ মেলে তাকাল। হিমেল পেছনে দাড়িয়ে আছে। খবর পেয়েই রুশা আর হিমেল ছুটে আসে। সেলিম আহত দৃষ্টি ফেলতেই হিমেল বলল
— এখন কেমন আছে?
সেলিম মাথা নেড়ে আশ্বস্ত করল ঠিক আছে। হিমেল চিন্তিত সরে বলল
— এমন করার কারণ জানতে পেরেছেন কিছু?
সেলিম আবারও মাথা নাড়লো। জানিয়ে দিলো এখনো কিছু জানতে পারেনি। ঠিক সেই সময় জানতে পারলো ঝুমের জ্ঞান ফিরেছে। সবার মাঝে সস্তি ফিরে এলো। সেলিম দ্রুত ঘরের ভেতরে গেলো। সেখানে আগে থেকেই তার বাড়ির লোকজন বসে আছে। ঝুম সবার দিকে এক পলক দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলো। সামনে তাকাতেই সেলিমের চোখে চোখ পড়তেই কেমন যেনো ফ্যাকাশে হয়ে গেলো চেহারা। ডাক্তার এতো লোকজন একসাথে ঘরে দেখে বলল
— আপনারা এতো জন একসাথে থাকবেন না। ওর রেস্ট প্রয়োজন।
ডাক্তারের কথা শুনে সবাই বাইরে চলে গেলো। শুধু সেলিম থেকে গেলো। সে ধীর পায়ে ঝুমের কাছে গেলো। পাশে বসে আলতো করে মাথায় হাত রাখতেই ঝুম কেমন অদ্ভুত ভাবে কেপে উঠলো। মুখটা দ্রুত সরিয়ে নিতে চাইলে সেলিম নরম কণ্ঠে বলল
— এখন কেমন আছো?
ঝুম উত্তর দিতে পারলো না। চেহারায় অস্বাভাবিক রকমের আতংক তার। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে। সেলিম আবারও জিজ্ঞেস করলো
— খারাপ লাগছে?
ঝুম সেলিমের দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকাল। চেহারাটা ভয়ে কালো হয়ে আছে। সেলিমের চেহারাটা নিশ্চিত হতেই চোখের পানি ছেড়ে দিলো। সেলিম তপ্ত নিশ্বাস ফেলে পানিটা মুছে দিয়ে বলল
— রেস্ট নাও। আমি আছি।
ঝুম সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে ফেললো। রুশা এতক্ষণ দরজা থেকে এই সব কিছু খেয়াল করছিলো। ঝুমের আচরণ তার কাছে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। কিছু তো একটা বিষয় আছেই।
———
সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে অল্প সময় আগেই। দো তোলার বারান্দায় বসে রুশা চা খাচ্ছে। দৃষ্টি তার উদাসীন। গভীর ভাবে কিছু একটা ভাবছে। হিমেল এসে আরেকটা চেয়ারে বসতেই ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেলো তার। সচেতন দৃষ্টিতে তাকাল হিমেলের দিকে। হিমেল রুশার সেই দৃষ্টি দেখেই ভ্রু নাচিয়ে বলল
— কি হয়েছে? নিশ্চয় নতুন কোন রহ’স্যের গন্ধ পেয়েছো।
রুশা অতিশয় চিন্তিত হয়ে বলল
— আচ্ছা তোমার কী মনে হয়? কেনো ঝুম সু’ইসা’ইড করতে যাবে?
হিমেল কিছুটা হতবাক হলো। তারপর বলল
— কিশোরী বয়সের মেয়ে। আবেগে সব কিছুই সম্ভব। হয়তো বাসায় কোন ঝামেলা হয়েছে। তার কারণেই এমন ঘটনা ঘটাতে পারে। অস্বাভাবিক কিছু না।
হিমেল এর সাভাবিক কথাটাকে সম্পূর্ণ হাওয়ায় উড়িয়ে দিলো রুশা। তারপর বলল
— ডান হাত দিয়ে বা হাতের পা’ল’স কা’টা’র বিষয়টা সাভাবিক। কিন্তু খেয়াল করলেই বুঝতে পারতে এতোটা ডি’প কা’টা ওর মতো মেয়ের পক্ষে অসম্ভব। মেয়েটা অতটাও সাহসী নয়। সু’ইসা’ইড করার আরো অনেক পদ্ধতি ছিলো। গ্রামের মেয়েরা সাধারণত এভাবে পা’ল’স কাটে না। তারা গ’লা’য় দ’ড়ি দেয়ার ব্যাপারটাকে সহজ ভাবে নেয়। আর কেউ যদি ম’র’তে চায় তাহলে ফাঁ’স দেয়াই কার্যকরী উপায়। তারপরেও মেয়েটার মধ্যে অস্বাভাবিক একটা ভয় কাজ করছে। এতো বড়ো একটা সু’ইসা’ই’ড এটে’ম্প’ট করার পর এভাবে ভয় পাওয়া অস্বাভাবিক।
হিমেল রুশার কথাটা মাথাতেই নিলো না। কারণ তার প্রতিটা বিষয়ে এভাবে সন্দেহ করার বাতিক আছে। কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করেই বলল
— কামান রুশা। এভাবে ভাবার কিছু নেই। একটা মানুষের মনে যখন কষ্ট তৈরি হয় আর মাথায় যখন সু’ইসা’ই’ড করার ব্যাপারটা ঢুকে যায় তখন আর এতো কিছু ভাবার সময় থাকে না। তুমি বিষয়টাকে অযথাই অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছো।
— তুমি আমার কথা বুঝতে পারছো না হিমেল। সু’ইসা’ই’ড করার ব্যাপারটা হুট করেই মাথায় আসেনা। অনেক কষ্ট পেয়ে যখন কেউ হাপিয়ে ওঠে। নিজেকে একদম অসহায় মনে হয় তখন সু’ইসা’ই’ড করার সিদ্ধান্ত নেয়। আর এটা এক মিনিটের কোন সিদ্ধান্ত নয় যে হুট করেই নিয়ে নেবে। অনেক সাহস সঞ্চয় করতে হয়। যার ফলে খুব সহজ কোন পরিকল্পনা বেছে নেয় ওই পারসন। যেই পন্থা অবলম্বন করলে কষ্ট কম হয় আর বেঁ’চে যাওয়ার কোন উপায় থাকে না। সাধারণত সেটাই বেছে নেয়। কিন্তু ঝুমের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একদম আলাদা। তার মধ্যে কোন কষ্ট নেই। কিন্তু ভয় আছে। আর ভয় থেকে কেউ কখনোই সু’ই’সাই’ড করার সিদ্ধান্ত নেবে না।
— তাহলে আপনার মতে বিষয়টা কি হতে পারে?
গম্ভীর আওয়াজ কানে আসতেই দুজনেই পেছনে তাকাল। সেলিম কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হিমেল একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। না জানি সেলিম এমন কথা শুনে কি ভাবলো। কিন্তু তাদের অবাক করে দিয়ে সেলিম এসে আরেকটা চেয়ারে বসে বলল
— আপনার কাছে কেনো বিষয়টা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে?
রুশা কোন কিছু না ভেবেই বলল
— সরি টু সে মিস্টার সেলিম। আসলে আমার মনে হয়না ঝুমের মতো মেয়ে সু’ই’সা’ই’ড করতে পারে। আর এভাবে তো নয়ই। যেহেতু সে ঘরে একাই ছিলো সেক্ষেত্রে ‘ফাঁ’স’ দিতে পারতো। এই পদ্ধতি বেছে নেয়া টা আসলেই একটু সন্দেহ জনক।
হিমেল রুশার উপরে মনে মনে বিরক্ত হলো। তাই তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল
— কিছু মনে করবেন না। ওর সব বিষয়ে সন্দেহ করার বাতিক আছে। তাই একটু..
— ব্যাপারটা সেরকম কিছু না হিমেল সাহেব। সন্দেহ যে শুধু ওনার হচ্ছে তা কিন্তু নয়। আমারও কিঞ্চিৎ সন্দেহ তৈরি হয়েছে। ঝুম এমন করার মতো মেয়ে না। সে খুব স্বাধীন ভাবে চলাফেরা করতে পছন্দ করে। ওর ভালো না লাগলে সেই কাজ কখনো করেনা। এরকম একটা স্বাধীনচেতা মেয়ে এমন একটা কাজ করবে বিষয়টা কোন দিক থেকেই সাভাবিক মনে হচ্ছে না।
সেলিমের কথা শুনে হিমেলের কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো। হিমেল একটু ভেবে বলল
— তাহলে আপনার কি মনে হচ্ছে?
সেলিমের উত্তরটা রুশা দিয়ে দিলো
— আমার তো মনে হচ্ছে ওর বাড়ির লোকজন যা বলছে সেরকম কিছু নয়। কোন কিছু তো ওনারা লুকিয়ে যাচ্ছে। এখানে অন্যকোন ব্যাপার আছে যা শুধু তারাই জানে।
সেলিম চিন্তিত সরে বলল
— তাহলে ব্যাপারটা কি হতে পারে?
রুশা একটু ভেবে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললো। একটু সচেতন ভাবে বলল
— আচ্ছা কুমু যেহেতু ওই লোকগুলোকে দেখেছে সেহেতু আমরা যদি নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে গ্রামের প্রভাবশালী পরিবার গুলোর একটা জরিপ করি। চেয়ারম্যান সাহেব কোন একটা অজুহাত দেখিয়ে আমাদের সেসব বাড়িতে ভেতরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেই হবে। আমরা তাদের কৌশলে ছবি সহ ডিটেইল নেবো। আর সেটা কুমুকে দেখাবো। দেখলেই তো সে চিনতে পারবে। তাহলেই সবটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
রুশার আইডিয়াটা সবার পছন্দ হলো। চেয়ারম্যান আশ্বস্ত করলো এমন ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু এসব নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে হঠাৎই সেলিম ভাবুক হয়ে বলল
— আপনি কি ভাবছেন যে পরী, কুমু এদের ব্যাপারটার সাথে কোনভাবে ঝুমের ব্যাপারটার সূত্র আছে?
রুশা একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
— আমার সন্দেহ হচ্ছে। যে কোন একটা বিষয় যদি আমরা ক্লিয়ার হয়ে যাই তাহলেই বাকিগুলোও দ্রুত খুঁজে পাওয়া যাবে।
চলবে….