বালির নীচে জলের শব্দ #পর্ব ৬,৭

0
371

#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ৬,৭


নিকশ কৃষ্ণ আধারে ঢাকা সিঁড়ি। এদিকের আলো এখনো জ্বালানো হয়নি। সন্ধ্যার পর কেউ মনে হয় এখনো সিঁড়ি বেয়ে ছাদে ওঠে নি অথবা তিন তলা থেকে নামেনি। তাই আলোটা জ্বালানো হয়নি। মোবাইলের আলোটা জ্বালিয়েই খুব সন্তর্পণে সিঁড়ি বেয়ে উঠছিল কুমু। উপর তলা থেকে ধুপধুপ পায়ের আওয়াজে সেখানেই থেমে গেলো। কেউ খুব ব্যস্ত ভঙ্গীতে নেমে আসছে। আর কয়েকটা সিঁড়ি মাড়িয়ে উঠলেই আলোটা জ্বালাতে পারতো। কিন্তু ব্যস্ত পায়ের আওয়াজে সেই দায়িত্বটা নিজের কাঁধে নিলো না। পায়ের শব্দে বুঝতে পারলো মানুষটা খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। পা জোড়া থেমে সুইচ চাপতেই চারিদিকে আলোকিত হয়ে উঠলো। বেখেয়ালিভাবে মানুষটার দিকে চোখ ফেরাতেই হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে গেলো কয়েকগুন। চোখ গুলো অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। এই তো সেই মানুষ যাকে সে গত দুইদিন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছে। দেখার তৃষ্ণায় ভেতরটা খা খা করছে। চোখ জোড়া একে অপরের উপরে স্থির। কুমুর দৃষ্টি অনুভুতিসম্পন্ন। কিছুটা গোলমেলে, কিছুটা অস্থির। কিন্তু হিমেলের দৃষ্টি স্বাভাবিক। অনুভুতিশুন্য। হাত পা অল্প বিস্তর কাঁপতেই হিমেল কুমুর সেই তীব্র অনুভূতি সম্পন্ন দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ রুপে উপেক্ষা করে অপরিচিতের মতো চোখ নামিয়ে চলে গেলো। মোবাইলের আলোটা নিভিয়ে দেয়ার কথা ভুলে গেলো কুমু। পুরো দৃশ্যটাই তার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হল। প্রতিদিনের মতো স্বপ্ন দেখছে না তো? হুট করেই আবার ঘুম ভেঙ্গে দেখবে না তো সে তার ঘরে শুয়ে আছে আর সেই মানুষটা বাস্তবে নেই? নিস্তব্ধ সিঁড়িতে পায়ের শব্দটা ক্রমশ কমে যেতেই মেইন গেট লাগানর জোরালো শব্দে কেঁপে উঠলো। ঘোরটা কেটে গেলো কুমুর। অপরিচিত কিন্তু ভীষণ মহনীয় সুগন্ধির রেশটা এখনো মো মো করছে। সেই সুঘ্রান নাকের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করতেই নিউরন জানিয়ে দিলো পুরো ঘটনাই সত্যি। সেটা মস্তিস্ক ধরে ফেলতেই মন খারাপটা গায়েব হয়ে গেলো। ফিকে স্বপ্ন গুলো প্রাণ ফিরে পেলো। সাথে সাথেই জন্ম নিলো আরও কয়েক গুচ্ছ স্বপ্ন। নতুন উদ্যমে অনুভূতিগুলো জেগে উঠতেই দ্রুত পা ফেলে ছাদের দিকে গেলো। আজ মনে হচ্ছে জ্যোৎস্না বিলাসটা সার্থক!

————
একটা খামখেয়ালি রাত। কাজ কর্মে অমনোযোগী। শহর জুড়ে অন্ধকারের মাতম চলছে। সব কয়টা জানালা খোলা। বাতাসে পর্দা গুলো ফড়ফড়িয়ে উড়ছে। শুকনো ঝড়ে পুরো শহর এলোমেলো। দূর আকাশে মেঘের আড়ালে চলছে আলোক সজ্জা। থেমে থেমে খানিকবাদে তীব্র শব্দে কেঁপে উঠছে ধরণী। অম্বর জুড়ে চলছে আঁকা বাকা নকশা। নির্মল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কুমু। চোখ জোড়া এই অপার্থিব দৃশ্যে আটকে থাকলেও অক্ষিপটের প্রতিচ্ছবি কিন্তু ভিন্ন। সেই স্বপ্ন পুরুষের ছবি। ঠোঁটের কোণে হাসির রেশটা লেগেই আছে সেই সন্ধ্যা থেকে। চোখের সামনে তাকে দেখার পরেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে সেটা সত্যি। বৃষ্টি এখনো নামেনি। তবে তোড়জোড় চলছে বেশ। আশেপাশেই কোথাও বাজ পড়লো। কুমু চমকে ঘুমিয়ে থাকা মৌয়ের দিকে তাকাল। কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে আবারো ঘুমিয়ে গেলো সে। চোখ মেললো না। তবে আগের থেকে হাত পা আরও একটু গুটিয়ে নিলো। ঠাণ্ডায় না ভয়ে বোঝা গেলো না। অনেক হয়েছে আর জেগে থাকার সাধ্য নেই। জানালার পর্দা টেনে দিয়ে উঠে গেলো বিছানায়। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে তার। মৌকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই চোখে ঘুম ভর করলো। হালকা ঘুমের মাঝেই কানে এলো প্রিয় গানের কিছু লাইন।

হৃদয়ের জানালায় চোখ মেলে রাখি
বাতাসের বাঁশীতে কান পেতে থাকি
তাতেই কাছে ডেকে, মনের আঙিনা থেকে
বৃষ্টি তোমাকে তবু ফিরিয়ে দিলাম
আমার সারাটি দিন
মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম

চোখ খুলে গেলো। সদ্য আসা ঘুমটা মস্তিস্কে কিছুটা প্রভাব ফেললো। বুঝে উঠতে সময় লাগলো কয়েক সেকেন্ড। আবারো শব্দ তরঙ্গ কানে বাজতেই ঘুম ছুটে গেলো নিমেষেই। কান আরও খাড়া করে ফেললো সে। সেই কণ্ঠস্বর। আশ্চর্য! গত দুইদিন ধরে কুমু তার সেই স্বপ্ন পুরুষের বিরহে গানের কথা ভুলেই বসেছিল। সেই কণ্ঠস্বর মাঝরাতে কোন গান গেয়েছিল কিনা সেটাও খেয়াল করে নি। আজ স্পষ্ট কণ্ঠ শোনার পর সে বুঝতে পারলো এই দুইদিন কোন গান শুনতে পায়নি। নিস্তব্ধ রাত্রিতে ঝঙ্কার তুলে বেজে উঠলো সেই খালি গলায় ধরা সুরটা। ঘরে থাকতে পারলো না কুমু। নিঃশব্দে বেরিয়ে ফোনের আলো জ্বালিয়ে ধির পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দিকে গেলো। শেষ সিঁড়িটা অতিক্রম করতেই চোখ পড়লো ছাদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা এক অন্ধকার ছায়ামূর্তি। ভয়ে কেঁপে উঠলো। এই সময় তো কাউকে এতদিনে সে ছাদে উঠতে দেখেনি। তাহলে এটা কে? ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। ঠিক সেই সময় হিমেল নিজের ফোনের দিকে তাকিয়েই দরজার দিকে ধির পায়ে এগিয়ে আসছে। ফোনের আলোটায় তার চেহারা স্পষ্ট। চেহারাটা চোখের সামনে স্পষ্ট হতেই কুমু নিশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে গেলো। এতক্ষন যার কথা ভাবছিল তাকে চোখের সামনে দেখছে। অবিশ্বাস্য কোন ঘটনার সাক্ষী হয়ে গেলো যেন। মনটা খুশীতে নেচে উঠলো। আটকে রাখা দমটা ফেলতেই ভুলে গেলো সে। হিমেলের মনে হল কেউ তার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখ তুলে তাকাতেই আচমকা এমন একটা মেয়েকে নিস্পলক চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভয় পেলো। ফোনটা হাত থেকে নীচে পড়ে গেলো। শব্দ হতেই কুমু সম্ভিত ফিরে জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস ছাড়ল। নিজের হাতের ফোনটা হিমেলের দিকে তাক করতেই দেখল সে গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে। কুমু বুঝতে পারল সে ভয় পেয়েছে। নিজের বোকামির জন্য নিজেকে কয়েকটা গালি দিলো। চোখের পলক ফেলে হিমেলের দিকে তাকিয়ে থেমে থেমে বলল
–আমি…আমি দো তলায় থাকি।

হিমেল লম্বা একটা শ্বাস ছাড়ল চোখ বন্ধ করে। সামনের জন যে মানুষ সেটা নিশ্চিত হতেই ভয়টা কেটে গেলো। ঢোক গিলে ফোনটা তুলে নিলো হাতে। ভ্রু কুচকে এদিক সেদিক ঘুরিয়ে ফোনটা ভালো করে দেখে নিলো কোন ক্ষতি হয়েছে কিনা। ক্ষতি হয়নি নিশ্চিত হতেই আরেকটা শ্বাস ছেড়ে কুমুর দিকে তাকাল। কুমু পুরো দরজাটা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। নিস্পলক দৃষ্টি হিমেলের দিকে স্থির। হিমেল কিছুটা বিরক্ত হল। কিছুটা অপ্রস্তুত হল। সেটা অসস্তিতে গড়াতেই বলল
–নীচে যাবো।

পলক ফেললো কুমু। একটা সিঁড়ি নীচে নেমে দাঁড়ালো। হিমেল আবারো নিচের দিকে তাকিয়ে কুমুকে পাশ কেটে নেমে গেলো। সাথে সাথেই নাকে আসলো সেই সুগন্ধির ঘ্রাণ। কুমু চোখ বন্ধ করে ঠোঁটের কোন প্রসারিত করে লম্বা শ্বাস টানল। অনুভূতিটা আরও গাড় হল। ঠিক সেই সময় কানে এলো তখনকার থেমে যাওয়া সুরটার বাকি অংশ।

তোমার হাতেই হোক রাত্রি রচনা
এ আমার স্বপ্ন-সুখের ভাবনা
চেয়েছি পেতে যাকে, চাইনা হারাতে তাকে
বৃষ্টি তোমাকে তাই ফিরে চাইলাম

চোখ খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল পেছনে। বুকটা কেঁপে উঠলো। প্রশ্নবধক তির্যক চাহুনি তার। সেই কণ্ঠ! সেই মানুষ! গোলমেলে অস্থির দৃষ্টি। হিমেল তিন তলায় বাড়িটার ভেতরে ঢুকে যাওয়া অব্দি কুমুর বিস্ময় কাটল না। দরজাটা লাগিয়ে দিতেই কুমু বুকে হাত রাখল। হৃদপিণ্ডের তীব্র আঘাতে রন্ধ্রে রন্ধ্রে বহমান রক্তের স্রোতটাও বেড়ে গেল কয়েক গুন হারে। হাত পা কাঁপছে তার। মস্তিস্ক জানিয়ে দিলো তার সেই স্বপ্ন পুরুষ আর মাঝরাতে গান গাওয়া সেই নেশাল কণ্ঠস্বরের মালিক একজনই। ভেতরটা তীব্র অস্থিরতায় নিস্তেজ হয়ে গেলো। এমন অস্থির অনুভুতির ভার বহন করা তার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। কিছুতেই না।

চলবে….

#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ৭

“তোমাকে দেখার পর থেকে অসম্ভব বদলে গেছে
আমার ভূবন
বদলে গেছে জলবায়ু, দিনরাত্রি, ঋতু।
কেবল তোমারই মুখ দেখি বৃক্ষপত্রে, জ্যোতিস্কমণ্ডলে
উচ্ছল ঝর্নার জলে, বুকশেলফে, পড়ার টেবিলে,
টেলিভিশনের উজ্জ্বল পর্দায়-

মহদেব সাহার “আমূল বদলে দাও আমার জীবন” কাব্যগ্রন্থের “তোমাকে দেখার পর থেকে” কবিতার পাতাটা চোখের সামনে উন্মুক্ত। পুরো কবিতাটা কয়েকবার পড়ে শেষ করেছে কুমু। বলতে গেলে মুখস্ত করে ফেলেছে। পাশেই ফোনে বাজছে পরিচিত একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত। প্রেমময় সুর। চারিদিকে অনুভুতির ছড়াছড়ি। বাইরে থেকে মা ডাকতেই কুমু সব ঠিক করে বাইরে চলে গেলো। টেবিলে সবাই নাস্তার জন্য বসে পড়েছে। কুমুকে দেখেই বাবা ফয়েজ উদ্দিন বললেন
–এতো দেরি করলে যে? শরীর খারাপ নাকি?

কুমু মিষ্টি হেসে বলল
–না বাবা। ঐ…

–আপা পড়ছিল।

কুমুর কথা শেষ হওয়ার আগেই ছোট্ট মৌ জবাব দিলো। সে দেখেছে তার আপাকে টেবিলে বই খুলে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে। আর মুচকি হাসতে। তাই আবারো বলল
–জানো বাবা আপা না পড়তে পড়তে হাসে।

তার কথা শুনে সবাই হেসে দিলো। কুমু একটু লজ্জা পেলেও সেটা চেপে গিয়ে সেও হেসে দিলো। খাবার শেষ হতেই ফয়েজ উদ্দিন পকেট থেকে টাকা বের করে সামনে এগিয়ে দিয়ে বললেন
–আজ তো এক মাস হল এই বাড়িতে। প্রথম মাসের ভাড়াটা তাড়াতাড়ি দেয়া ভালো। আমাকে তো এখনই বের হতে হবে। কুমু তুমি কি ভাড়াটা দিয়ে আসতে পারবে?

কুমু মাথা নাড়ল। সে খাওয়া শেষ করেই ভাড়া দিয়ে আসবে। তার বাবা বের হয়ে চলে গেলেন। কুমু নিজের খাওয়া শেষ করে হাত মুখ মুছে ওড়নাটা লম্বা করে টেনে দিলো। বের হয়ে গেলো মালিকের বাড়ির উদ্দেশ্যে। তিন তলায় গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গেলো। এক মাস হল এই বাড়িতে এসেছে তারা। তিন তলা পার হয়ে ছাদেই যায় সে। কিন্তু এই জায়গাটায় সেভাবে কখনো খেয়াল করা হয়নি। আশেপাশে তাকাল কুমু। সেকেলে বাড়ি। দেয়ালের রঙ চটে গেছে। জায়গায় জায়গায় ফাটল ধরেছে। সিঁড়িগুলোতে কেমন ময়লা। বাইরেটা ভীষণ স্যাঁতস্যাঁতে, শেওলা পড়া। দেয়ালের ফুটোয় জন্মে ওঠা লতাপাতা যুক্ত আগাছা গুলো অযত্নে কেমন দ্রুত বেড়ে উঠছে। পুরনো রংচটা কাঠের দরজাটায় হাতের সাহায্যে কয়েকবার ধাক্কা দিয়েই থেমে গেলো কুমু। এপাশ ওপাশ তাকাতেই পেরিয়ে গেলো কয়েক সেকেন্ড। ঠিক তখনই খুলে গেলো দরজা। ভীষণ ভারী গম্ভীর আওয়াজে কেউ বলে উঠলো
–কাকে চাই?

চোখ ফিরে তাকাতেই থমকে গেলো দৃষ্টি। শরীর ঝমঝম করে উঠে ঘাম ছুটে গেলো। শীতল চাহুনি ভেতরটা তৃষ্ণার্ত করে তুলল কুমুর। পলকহীন দৃষ্টি দেখে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা ভীষণ অসস্তিতে বিরক্ত হয়ে উঠলো। হালকা কেশে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে বলল
–কিছু বলবেন?

ধ্যান ভাঙল কুমুর। অপ্রস্তুত হয়ে নিচের দিকে তাকাল। উত্তর দেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে খেয়াল করলো গলার স্বর নিস্তেজ হয়ে এসেছে। ঠোঁট নাড়ালেও শব্দ উচ্চারিত হবে কিনা সেটা নিয়েই দ্বিধা। তবুও চুপ করে থাকা সম্ভব নয় ভেবেই মিনমিনে স্বরে বলল
–ভাড়াটা।

ভাইকে এমন দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শ্রাবণ এগিয়ে এসে বলল
–কে এসেছে ভাইয়া?

ভাইয়ের পেছনে দাঁড়াতেই কুমুর উপরে চোখ পড়লো। ভূত দেখার মতো চমকে গেলো শ্রাবণ। বজ্রাহতের মতো দৃষ্টি। কুমুও একই দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। হিমেল কুমুর এমন দৃষ্টি দেখে পেছন ফিরে শ্রাবণের দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাল। কুমু কৌতূহলী দৃষ্টি ফেললো দুজনের দিকেই। সমীকরণটা মিলে ফেললো কয়েক সেকেন্ডেই। বাড়ীওয়ালার দুই ছেলে। সামনের টা বড় আর পেছনের টা ছোট। দুই ছেলের পেছন থেকে শান্তি বেগম গম্ভীর আওয়াজে বললেন
–কে তুমি?

সবার দৃষ্টি পরিবর্তন হল। শ্রাবণ চোরা দৃষ্টি ফেলে একবার কুমুর দিকে তাকায় তো আরেকবার মায়ের দিকে তাকায়। কিন্তু সেখান থেকে নড়ল না এক ফোটাও। হিমেল সেখানে দাঁড়ালো না। অপরিচিতের মতো চলে গেলো সেখান থেকে নিজের ঘরে। কুমুর মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মানুষটা এমন কেন? আর কিছু সময় দাঁড়ালে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেতো? শান্তি দুই কদম এগিয়ে আসতেই কুমু সেদিকে তাকিয়ে বলল
–আমি দো তলায় থাকি। এই মাসের ভাড়াটা দিতে এসেছি।

হাত বাড়িয়ে দিতেই শান্তি মুচকি হেসে বললেন
–দো তলার নতুন ভাড়াটিয়া?

কুমু মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–জি।

শান্তি টাকাটা হাতে নিয়ে বললেন
–তুমি ফয়েজ ভাই সাহেবের কে হও?

–আমি ওনার মেয়ে।

শান্তি হেসে বলল
–ওহ! আচ্ছা। ভেতরে আসো।

কুমু মৃদু হাসল। মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–আরেকদিন আসবো আনটি। আজ আসি।

যাওয়ার আগে তির্যক দৃষ্টিতে একবার শ্রাবণকে দেখে নিলো। কুমুর সেই দৃষ্টি দেখেই শ্রাবণের ভেতর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। ঢোক গিলে অসহায়ের মতো তাকাল তার দিকে।

————-
দুপুরের পরে মৌকে নিয়ে ছাদে উঠেছে কুমু। গাছের খুব সখ তার। তাই কয়েকটা টবে নিজের পছন্দের কিছু গাছ লাগিয়ে সেগুলো ছাদে রেখে দিয়েছে। রোজ তাদের পরিচর্যা করে সে। সরাসরি মেইন লাইনের সাথে একটা পাইপ আটকে দিয়েছে। সেটা দিয়েই গাছে পানি দেয়। খুব যত্ন করে সেটা দিয়ে গাছে পানি দিচ্ছে সে। ছাদে কিছু পানি পড়ে যাওয়ায় অসাবধানতা বশত সেখানে পা পড়তেই পড়ে যেতে লাগে কুমু। হাত থেকে ছুটে যায় পাইপ। রেলিঙের ধার ঘেঁষে ঝুলে থাকা পাইপটা দিয়ে তখনও পানি পড়ছে নীচে। সড়সড় আওয়াজ আসছে নিচ থেকে। ছোট্ট মৌ এক দৌড়ে রেলিঙের ধারে গিয়ে দাঁড়ালো। হাত দুটো রেলিঙ্গে রেখে যতটা সম্ভব গোড়ালি উঁচু করে পায়ের আঙ্গুলে ভর দিয়ে মাথা ঝুঁকে নিচের দিকে তাকাল। কালো শার্ট পরা ছেলেটির মাথার উপরে সম্পূর্ণ পানিটা পড়ছে। আর ছেলেটি রাস্তায় দাঁড়িয়ে অসহায়ের মতো ভিজছে। মৌ আর্তনাদ করে উঠে বলল
–আপা দেখো ভিজে যাচ্ছে।

কুমু ভ্রু কুচকে তাকাল। মৌয়ের কথা বুঝতেই এগিয়ে গেলো। নিচের দিকে তাকাতেই চোখ ছানাবড়া। বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গেলো তার। দুই হাতে মুখ ঢেকে বড় চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকলো। তার ভুলের কারণে মানুষটার শরীরের দামী চকচকে শার্টটা ভিজে একাকার। সেটা নিয়ে আক্ষেপটা ঠিক কতটুকু সেটা বুঝতে পারলো না কারণ ঐ মানুষটার চেহারাটাই তখন মুখ্য ভুমিকা পালন করছে। অন্যকোন মানুষ হলে হয়তো ভেতর থেকে এতো আহত হতোনা কুমু। কিন্তু এই মানুষটা যে তার সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি। তার সাথে এমন ভুলের ফলাফল কেমন হতে পারে সেটা ভেবেই শঙ্কিত সে। পরিচয় হওয়ার আগেই মনে হয় সব শেষ হয়ে যাবে। সেটা ভেবেই অসহায় মনে হল নিজেকে। মৌ চিৎকার করে বলল
–এই, তুমি তো ভিজে গেছো।

ভীষণ রকম বিরক্ত নিয়ে উপরের দিকে তাকাল হিমেল। কিন্তু চোখের সামনে নিষ্পাপ আদুরে একটা চেহারা দেখেই বিরক্তিটা কেটে গেলো নিমেষেই। রাগটা যেমন দ্রুত চাড়া দিয়ে উঠেছিল। ঠিক তেমনই দ্রুত সেটা হারিয়ে গেলো। কুমু ততক্ষনে নিজের বিস্ময় কাটিয়ে পাইপটা টেনে নিয়েছে। হিমেল ফুস করে একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–সমস্যা নেই পিচ্চি। আমি কাপড় বদলে নেবো।

মৌ আদুরে কণ্ঠে বলল
–তাড়াতাড়ি। নাহলে কিন্তু তোমার জ্বর হবে।

হিমেল মৃদু হাসল। এমন আদুরে কণ্ঠ শুনে তার চাহুনি শান্ত, শীতল হয়ে গেলো। এমন আদুরে কথা রাগ ভাঙ্গাতে যথেষ্ট। দৃষ্টি ফিরিয়ে কুমুর দিকে তাকাল। কুমু ভয় পেলো ভীষণ। মৌ ছোট বলেই কিছু বলল না। কিন্তু তাকে কি ছেড়ে দেবে? অসহায়ের মতো কান্না জড়িত কণ্ঠে আমতা আমতা করে বলল
–আ…আমি ই…ইচ্ছা করে করিনি। হাত থেকে ছুটে গিয়েছিল। আমি খুবই দুঃখিত।

স্থির, শান্ত আর শীতল চাহুনির মানুষটা কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলো তার দিকে। তারপর ভীষণ সুন্দর করে বলল
–ঠিক আছে। আমি বুঝতে পেরেছি। এটা দুর্ঘটনা।

দুই হাতে শার্ট ঝেড়ে ফেলে দ্রুত চলে গেলো বাড়ির ভেতরে। কুমু বেশ অবাক হল। সে শুনেছে বাড়ীওয়ালার বড় ছেলে নাকি দীর্ঘদিন বিদেশে ছিল। এতো বছর বিদেশে থাকার পরও এতো সুন্দর বাংলা! মানুষটা যেন আস্ত এক ইন্দ্রজালের সমন্বয়!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here