বালির নীচে জলের শব্দ #পর্ব ১০,১১

0
325

#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ১০,১১

১০
সরল রোদের রশ্মিটা সরাসরি এসে মুখে পড়তেই চোখ বন্ধ করে ফেললো হিমেল। কয়েক সেকেন্ডেই চোখ খুলে কপালে গাড় ভাঁজ ফেলে সামনে তাকাল। দুই ভাই সামনে তাকিয়ে পাশাপাশি হাঁটছে। কারো মুখেই কোন কথা নেই। হিমেলের মাথায় প্রশ্নের সমাহার। ক্ষণে ক্ষণে নতুন নতুন প্রশ্ন জন্ম নিচ্ছে। কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বলল
–মেয়েটাকে চিনিস?

শ্রাবণ নিজের মতো ভাবনায় ব্যস্ত ছিল। ভাইয়ের প্রশ্ন ধরতে না পেরেই বলল
–কোন মেয়ে?

–ঐ যে দো তলার মেয়েটা।

শ্রাবণ প্রশস্ত হেসে বলল
–ওহ! কুমু! চিনি তো। আমাদের ভার্সিটিতেই পড়ে। থার্ড ইয়ার স্টুডেন্ট।

হিমেল মনে মনে কয়েকবার নামটা আওড়াল। আনমনেই বিড়বিড় করে বলে ফেললো
–শুধু কুমু? আগে পিছে কিছু নেই?

শ্রাবণ ভাইয়ের কথা শুনে ফেললো। মৃদু হেসে বলল
–ওর পুরো নাম কুমুদিনী চৌধুরী।

হিমেলের ভ্রু জোড়ায় গাড় ভাঁজ পড়ে গেলো। নামটা অদ্ভুত! নামের মাঝে কেমন একটা সাহিত্য সাহিত্য ভাব আছে। ‘কুমুদিনী চৌধুরী’ নামটা শুনেই মনে হচ্ছে রবিন্দ্রনাথের কোন উপন্যাসের নায়িকা। নিজের এমন ভাবনায় হেসে ফেললো হিমেল। শ্রাবণ আবারো বলে উঠলো
–মেয়েটা ভার্সিটিতে বেশ ফেমাস।

হিমেল কৌতূহল দেখাল। বলল
–কেন? ভালো রেজাল্ট বলে?

শ্রাবণ হেসে ফেলে বলল
–ভালো রেজাল্ট তো বটেই। আরেকটা বিশেষ কারণ আছে। ছেলেদের ফ্রিতে বখাটে উপাধি দেয়। ভার্সিটিতে এমন ছেলে হাতে গোনা কয়েকজন যে ওর কাছ থেকে এই উপাধিটা পায়নি। কেউ ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেলেও বলে সেটা নাকি বখাটের লক্ষণ।

শ্রাবণের কথা শুনে হিমেলের মনে পড়ে গেলো তাদের প্রথম দেখার কথা। সেদিন সে তাকে বখাটে বলেই আখ্যা দিয়েছিলো। হিমেলের মস্তিস্ক সচকিত হয়ে উঠলো। সেদিন মেয়েটাকে সে প্রথম দেখেছে। তাই তার বারবার মনে হয়েছিলো কোথাও তো মেয়েটাকে আগে দেখেছে। কিন্তু মনে করতে পারেনি। এখন সবটা বুঝতে পারছে ভালো করেই।

———–
বর্ষার মতো কালো মেঘে ঢেকে গেছে অম্বর। এলোমেলো বাতাস শুরু হয়েছে। শুকনো ঝড়ে এপাশ থেকে ওপাশে সব কিছু লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে। জানালার বাইরে দিয়ে উঁকি ঝুকি মেরে তাকাতেই কুমু বুঝে গেলো আবহাওয়া ভালো না। যে কোন সময় ঝুম বৃষ্টি হতে পারে। ছাদে কাপড় আছে তাই তুলতে চলে গেলো দ্রুত। নিজেদের সমস্ত কাপড় তোলার পর দেখল আরও কিছু কাপড় দড়িতে ঝুলছে। ঝুলানো শার্টটা দেখেই চিনে ফেললো সে। হিমেলের সাদা শার্টটায় যত্ন করে হাত বুলিয়ে মুচকি হাসল। এদিক সেদিক তাকিয়ে বাকি কাপড় গুলোও তুলে নিলো। সিঁড়ি বেয়ে তিন তলায় নেমে এসে দরজায় ধাক্কা দিলো। কয়েক সেকেন্ড বাদেই দরজা খুলে শান্তি বেগম বেশ ভারী কণ্ঠে বললেন
–কে?

কুমু একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। সেদিন ভাড়া দিতে এসেই তো কত সুন্দর কথা হল। আর আজ ভুলে গেলো সব? কি আজব মানুষ! নিজের পরিচয় দেয়ার আগেই শান্তি বেগম আবার বললেন
–তুমি দোতলায় থাকো না?

কুমু মনে মনে কিছুটা খুশী হল। অবশেষে তাকে চিনতে পেরেছে। মুচকি হেসে মাথা নাড়তেই শান্তি বেগমের চোখ গেলো তার হাতে ধরে থাকা কাপড়ের দিকে। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল
–ওগুলো তো আমাদের।

–জি আনটি। বাইরে অনেক জোরে বাতাস হচ্ছে। বৃষ্টি আসবে মনে হয়। আমাদের কাপড় তুলতে গিয়েছিলাম। আপনাদের কাপড়গুলো দেখে তুলে আনলাম।

কুমু কাপড় গুলো বাড়িয়ে দিয়ে বলল। শান্তি বেগমের মেয়েটার কথা আর আচরন খুব ভালো লাগলো। তিনি মুচকি হেসে কাপড় গুলো না নিয়ে কুমুর হাত ধরে ফেললেন। টেনে আনতে আনতে বললেন
–ভেতরে আসো।

ঘটনার আকস্মিকতায় কুমু কোন কথা বলার সুযোগ পেলো না। শান্তি বেগম তাকে এনে একদম সোফায় বসিয়ে দিলেন। শান্তি তার সামনে বসে ঘাড় ফিরিয়ে উচ্চ স্বরে বললেন
–রহিমা দুই কাপ চা বানিয়ে আন।

কুমু ইতস্তত করে বলল
–আমি শুধু কাপড় দিতেই এসেছিলাম আনটি। চা খাবো না।

–এক কাপ চা খেলে খুব বেশী দেরি হবে না। একটু বসো আনটির কাছে। আমি তো একাই থাকি। মেয়েটার বিয়ে দিয়েছি। সে শ্বশুর বাড়িতে থাকে। আর দুই ছেলে নিজেদের কাজে সারাদিন ব্যস্ত। তোমার আঙ্কেলও বাসায় থাকে না খুব একটা।

কুমু একটু কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো
–আপনার সময় কিভাবে কাটে?

শান্তি মলিন হেসে বলল
–টিভি দেখে। তাছাড়া আর কাজ নেই। শরীর ভালো থাকে না যে কাজ করে সময় পার করবো।

কুমুর মায়া হল। তার কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে তার একাকীত্ব সময় কাটে। রহিমা চা নিয়ে এলো। চায়ে চুমুক দিয়ে শান্তি বললেন
–তুমি মাঝে মাঝে আসতে পারো। আমার সাথে গল্প করবে।

কুমু হেসে বলল
–আসবো আনটি। অবশ্যই আসবো।

দুজনে আরও কিছুক্ষন গল্প করলো। এর মাঝেই আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামল। তুমুল ঝড়ে পুরো শহর এলোমেলো হয়ে যাওয়ার উপক্রম। পুরনো বাড়ি বলেই ভেতর থেকে বৃষ্টির আওয়াজ কানে আসছে। বাইরের তাণ্ডবের অবস্থাটাও আওয়াজ শুনেই আন্দাজ করা সম্ভব হচ্ছে। কুমু চায়ের কাপটা রেখেই বলল
–আজ আসি আনটি। আরেকদিন আসবো।

–আসবে কিন্তু।

শান্তির কথা শুনে হেসে মাথা নাড়ল কুমু। তারপর সেখান থেকে বের হয়ে এলো। সিঁড়ি বেয়ে দো তলা পর্যন্ত নেমে আসতেই দেখা হয়ে গেলো হিমেলের সাথে। ভেজা টি শার্টটা শরীরের সাথে লেপটে আছে। পানির ফোঁটা গড়ে পড়ছে মুখ বেয়ে গলা পর্যন্ত। চূলগুলো থেকে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। কুমুর মনে হচ্ছে সে পৃথিবীর সবথেকে মহনীয় দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে গেলো। এতো সুন্দর অপার্থিব দৃশ্য দেখার সুযোগ পাওয়ার জন্য নিজেকে অত্যন্ত সুখী একজন মনে হল। এমন নিস্পলক তাকিয়ে থাকায় হিমেল বিরক্ত হয়ে উঠলো। বৃষ্টিতে ভেজায় এমনিতেই তার ঠাণ্ডা লাগছে। তার উপর কুমু একদম তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যার জন্য সে যেতেও পারছে না। হিমেল হালকা কেশে কুমুর ধ্যান ভাঙ্গার চেষ্টা করলো। এমন অবস্থায় কুমু লজ্জা পেলো। কয়েকবার অস্থির পলক ফেলে পাশ কাটিয়ে নিচের সিঁড়িটাতে নেমে গেলো। কিন্তু হিমেলের ভেজা কাপড় বেয়ে পানি ততক্ষণে সিঁড়ি উপছে নীচে পড়ছে। কুমু বেখেয়ালি ভাবে পা দিতেই স্লিপ করে দুম করে পড়ে গেলো। হিমেল তখন দুটো সিঁড়ি পেরিয়ে উপরে চলে গেছে। পেছন থেকে শব্দ কানে আসতেই ঘুরে তাকাল। কুমু সিঁড়ির উপরে বসে আছে। পা চেপে ধরে। হিমেল কিছুক্ষন সেদিকে তাকিয়ে থেকে দ্রুত নেমে কুমুর পাশে দাঁড়িয়ে একটু ঝুঁকে বলল
–আপনি ঠিক আছেন?

কুমু পায়ের তীব্র ব্যাথায় চোখ মুখ খিঁচে বসে ছিল। হিমেলের শীতল কণ্ঠে চোখ মেলে তাকাল। হিমেলের দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকাতেই পায়ের ব্যাথাটা আরও তীব্র ভাবে জানান দিতেই নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। হিমেলের দৃষ্টি আপনা আপনি সেদিকে চলে গেলো। কোমল ঠোঁট দুটো অনবরত কাঁপছে। হিমেল নিজের ভেতরে এক অজানা তৃষ্ণা আশংকা করলো। পুরুষালী অনুভূতিটা জাগ্রত হতেই মস্তিস্ক অসভ্য কিছু চিন্তার সংকেত দিয়ে দিলো। সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে নিজের অবাধ্য অনুভূতিগুলোকে নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করে আবারো চোখ খুলে কুমুর পায়ের দিকে তাকাল। শান্ত কণ্ঠে বলল
–খুব বেশী ব্যাথা করছে?

কুমু কথা বলতে পারলো না। ব্যাথায় তার চোখে পানি চলে এসেছে। দুই ঠোঁট ভাঁজ করে জোরে একটা শ্বাস টেনে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল
–নাহ।

হিমেল গভীর দৃষ্টিতে তাকাল তার চোখে। কুমু অস্থির হয়ে উঠলো। চোখ নামিয়ে নিলো। হিমেল দৃষ্টি ফিরিয়ে তার পায়ে হাত দিতেই কুমু চমকে উঠে হাত সরিয়ে দিয়ে বলল
–কি করছেন?

হিমেল বিরক্ত হয়ে কঠিন গলায় বলল
–নিশ্চয় এখানে বসে আপনার সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছি না। বুঝতে চাইছি ঠিক কতোটা ব্যাথা পেয়েছেন। এরকম আচরন করলে আমি নিজেও অসস্তিতে পড়ে যাচ্ছি। আপনি কিন্তু কারণ ছাড়াই আমাকে বিব্রত করছেন।

কুমু অসহায়ের মতো তাকাল। কিন্তু কোন কথা বলতে পারলো না। হিমেল তার সেই অসহায় দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়েই পায়ে হাত রাখল। কুমু চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো। ভেতরে তার তোলপাড় শুরু হয়েছে। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। অথচ মানুষটার সেদিকে কোন খেয়াল নেই। হিমেল তার হাতের উপরে পা তুলে নিয়ে কুমুর দিকে তাকাল। এদিক সেদিক নাড়াচাড়া করে বলল
–এখন ঠিক আছে নাকি এখনো ব্যাথা করছে?

কুমুর অবস্থার কোন পরিবর্তন হল না। হিমেল বুঝতে পারলো না তার ব্যাথা এখনো আছে কিনা। আরও কিছু বলার আগেই কুমুদের দরজায় শব্দ হল। হিমেল তাকে ছেড়ে দিয়ে একটা সিঁড়ি উপরে দাঁড়িয়ে গেলো। রাফি দরজা খুলে মাথা বের করে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে বলল
–আপা তুমি ওখানে বসে কি করছ?

কুমু চমকে চোখ মেলে তাকাল। অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে বলল
–হুম?

রাফি ভ্রু কুচকে হিমেলের দিকে তাকাল। হিমেল একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল
–উনি পায়ে ব্যাথা পেয়েছেন। হাঁটতে পারছেন না।

রাফি এগিয়ে এসে কুমুর পা ধরে অস্থির হয়ে বলল
–কি হইছে? ভেঙ্গে গেছে?

হিমেল মৃদু হেসে বলল
–সেরকম কিছু না। একটু ব্যাথা পেয়েছে। ঔষধ খেলেই ব্যাথা কমে যাবে।

কুমু কোন উত্তর না দিয়ে রাফিকে ধরে ওঠার চেষ্টা করলো। দাঁড়িয়ে হালকা চাপ দিয়ে পা ফেলার চেষ্টা করতেই খেয়াল করলো আগের মতো তীব্র ব্যাথাটা নেই। রাফির হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে দরজা পর্যন্ত যেতেই হিমেলের গলার আওয়াজ কানে এলো।
–এভাবে হাঁটাহাঁটি করবেন না। রেস্ট নিবেন। নাহলে কিন্তু ব্যাথা কমবে না। খেয়াল রাখবেন।

কুমু তাকাল। ঠোঁটের হাসিটা প্রশস্ত হয়ে উঠলো। সেই হাসি দেখেই হিমেল মুচকি হেসে উপরে উঠে গেলো। কুমু তখনও দাঁড়িয়ে তাকেই দেখছে। দিন দিন মানুষটার প্রতি তার এভাবে আকর্ষণ বেড়ে যাওয়াটা কি ভালো লক্ষণ? সে যখন জানতে পারবে এই মেয়েটা গভীর ভাবে তার প্রেমে পড়েছে তখন কি ভাববে? তার সম্পর্কে কোন খারাপ ধারনা করে বসবে না তো? আচ্ছা শুধু কি ছেলেরাই প্রেমে পড়তে পারে? মেয়েদের কি এভাবে প্রেমে পড়ার অধিকার নেই?

চলবে…

#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ১১

পায়ের ব্যাথাটা ভালোভাবেই কাবু করেছে কুমুকে। গত দুইদিন একদম নড়াচড়া করতে পারেনি। বিছানা থেকেও নামতে পারে নি সেভাবে। ব্যথায় পা টনটন করে উঠে জ্বর চলে এসেছে। দুইদিন এমন অবস্থায় থাকার পর ফয়েজ উদ্দিন মেয়েকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন। এভাবে বাসায় বসে থেকে ব্যাথা কমছে না। ডক্টরের কাছে যেতে হবে। ফয়েজ উদ্দিন বিকেলের দিকে মেয়ের ঘরে গেলেন। জ্বর আর ব্যথার কারণে খুব প্রয়োজন ছাড়া বিছানা ছাড়ে নি সে। আজও শরীরটা ভালো নেই তার। ছোট্ট মৌ আপার এমন অসুস্থতায় ভীষণ কাতর হয়ে উঠেছে। আপাকে যেন ঘর আর বিছানায় দেখলেই সে অতিস্ট হয়ে যায়। তার ধারনা আপার জন্ম হয়েছে দাপিয়ে বেড়াতে। আর সেই আপা যদি এভাবে বাসায় থাকে তাহলে কি মানায়? ফয়েজ উদ্দিন মেয়ের কপালে হাত রাখতেই সে চমকে উঠলো। পাশ ফিরে বাবার দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত স্বরে বলল
–বাবা তুমি?

উঠতে চাইলে তিনি মেয়েকে শুইয়ে দেন। বলেন
–উঠতে হবে না। এখন কেমন আছো?

কুমু আবারো শুয়ে বলল
–এখন একটু ভালো আছি বাবা।

ফয়েজ সাহেব মৃদু হেসে বললেন
–ভাবছিলাম আজ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই তোমাকে। ব্যথা তো কমছে না। কিভাবে হবে?

কুমু ভাবুক হয়ে গেলো। কিছু একটা ভেবেই বলল
–ব্যাথা কমে গেছে বাবা। আগের মতো আর নাই। আজকের দিনটা গেলেই হাঁটতে পারবো।

ফয়েজ সাহেব একটু জোর করেই বসলেন। কিন্তু লাভ হল না। কুমু কিছুতেই রাজি হল না। সে যাবে না মানে যাবেই না। ব্যর্থ হয়ে তিনি বের হয়ে গেলেন ঘর থেকে। কুমু হতাশ শ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। এ মাসে অনেক খরচ হয়েছে। রাফির পরীক্ষার ফি মৌয়ের স্কুলের বেতন সবকিছুই দিতে হয়েছে। তার উপরে আবার নতুন বাসায় উঠতে অগ্রিম ভাড়া দিতে হয়েছে। ডাক্তারের কাছে গেলেই জতশত পরীক্ষা নিরিক্ষার ব্যাপার। অনেক টাকা খরচ। বাবার ছোট্ট দোকান দিয়েই তাদের সংসার চলে। বেহিসেবি কোন খরচ সামলে ওঠা তার বাবার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। কুমু কয়েকটা টিউশনি করেই নিজের খরচটা কোন রকমে চালায়। মাঝে মাঝে বাবার কাছ থেকেও নিতে হয়। বড় মেয়ে হিসেবে তার তো একটা দায়িত্ব থাকেই। সে তো বোঝে সংসারের অবস্থা। দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। খানিকবাদেই কলিং বেলের আওয়াজ আসলো কানে। সেদিকে গুরুত্ব না দিয়েই শুয়ে থাকলো নিজের মতো। চোখ বন্ধ করেই বুঝতে পারলো কেউ একজন দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ভাবল মৌ অথবা মা। তাই চোখ মেলে তাকাল না। অল্প সময়ের ব্যবধানে পরিচিত একটা গলা কানে আসতেই চোখ মেলে তাকাল। শুভ্রাকে তার পাশে বসে থাকতে দেখেই অবাক হয়ে বলল
–তুই কখন আসলি?

শুভ্রা কুমুর কপালে ঠাণ্ডা হাত রেখে বলল
–এই তো। তুই অসুস্থ তাই দেখতে এলাম।

কুমু উঠে বসতে বসতে বলল
–এখন ঠিক আছি।

শুভ্রা পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল
–কোন পায়ে ব্যথা পাইছিস? দেখি?

–ডান পায়ে। এখন ব্যথা নাই। ঠিক আছে।

শুভ্রা ভ্রু কুচকে তাকাল। সন্দিহান কণ্ঠে বলল
–সিঁড়িতে পড়লি কিভাবে বল তো? দেখে নামিস নি?

কুমুর মনে পড়ে গেলো সেই ঘটনা। হিমেলের গভীর চাহুনি। শীতল স্পর্শ। হৃদয় হরণ করা সেই সব বাক্য। হেসে ফেললো সে। শুভ্রা সরু চোখে তাকাল। মুখটা এদিক সেদিক ঘুরিয়ে নিয়ে বলল
–সত্যি কথা বল তো। কেমন যেন অন্যরকম কিছুর আভাস পাচ্ছি।

কুমুর হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। চোখের মণি অস্থির হয়ে এদিক সেদিক ঘুরছে। শুভ্রা তার অনুভূতি বুঝে গেলো নাতো? অস্থির পলক ফেলে বলল
–বৃষ্টির পানি সিঁড়িতে পড়েছিল। আর সেখানেই পা পিছলে পড়ে গেছি।

শুভ্রা রেগে গিয়ে বলল
–কে এই কাজ করলো? এমনি এমনি তো আর পানি আসেনি। নিশ্চয় কেউ ভিজে সিঁড়ি বেয়ে উঠেছে। তাই এমন হয়েছে। এসব অশিক্ষিত লোক যে কোথা থেকে আসে। নুন্যতম ভদ্রতাটাও শিখে না। এভাবে বেপরোয়া চলাফেরা করলে যে কারো অসুবিধা হবে সেটা তাদের কোন খেয়াল থাকে না। যতসব অসভ্য।

এভাবে অনেকটা সময় নিয়ে মন ভরে গালি দিলো শুভ্রা। কুমু সহ্য করতে না পেরে এক পর্যায়ে বলল
–হইছে থাম। আর কিছু বলিস না। এবার মাফ করে দে। উনি তো ইচ্ছা করে কিছু করে নি।

–উনি? তার মানে তুই জানিস কে করেছে? তাকে কিছু বলিস নি কেন? পা টা তো ভেঙ্গেও যেতে পারতো। সামনে তোর পরীক্ষা। পা ভেঙ্গে যদি পরীক্ষা দিতে না পারতিস তাহলে কি হতো ভেবেছিস।

কুমু অসহায়ের মতো বলল
–আমার মাথা ব্যাথা করছে। চুপ কর।

শুভ্রা চুপ করে গেলেও কুমু শান্ত হতে পারলো না। হিমেলকে এভাবে গালি দেয়াতে কুমু শুভ্রার উপরে ভীষণ বিরক্ত হল। রেগেও গেলো মনে মনে। কিন্তু মুখে প্রকাশ করলো না। কারণ হিমেল তো ইচ্ছা করে করে নি। হিমেলের মতো মানুষ ইচ্ছা করে এমন করতেই পারে না।

————
আকাশে ভরা জ্যোৎস্না। চারিদিকে শুভ্র আলোয় আলোকিত। সবাই মাত্র ঘুমিয়েছে। রাফি হয়তো এখনো জেগে পড়ছে। কুমু পুরো দুইদিন একদম বিছানায় শুয়ে থাকায় এখন আর পারছে না। তাই বিছানা থেকে নেমে টেবিলে বসেছে। বই নিয়ে পড়তে চেষ্টা করলেও পড়ায় মন বসছে না। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে। চাঁদটার পাশে কিছু শুভ্র মেঘ এসে ভিড় করেছে। চাঁদটাকে ছুঁয়ে দেয়ার প্রতিযোগিতা চলছে তাদের মাঝে। আজকের রাতটা অনেক সুন্দর। এই সময় ছাদে গেলে খুব একটা খারাপ হয় না। বই বন্ধ করে চূলগুলো ঢিলে খোপা করে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো ছাদের দিকে। খুব সাবধানে পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে উঠলো। ওঠার সময় তিন তলার দরজায় দৃষ্টি ফেলতে ভুল করলো না। সেদিকে তাকাতেই মনটা ছটফট করে উঠলো কাউকে দেখার প্রয়াশে। সেটাকে দমিয়ে রেখেই ছাদে উঠে গেলো সে। দাঁড়ালো ছাদের রেলিং ঘেঁষে। দুই হাত আলতো করে রেলিঙ্গে রেখে চাঁদের দিকে দৃষ্টি স্থির করলো। দৃশ্যটা অসম্ভব সুন্দর। কিন্তু কুমুর কিছু একটা নেই মনে হচ্ছে। উদাস দৃষ্টিতে সেদিকে কতক্ষন তাকিয়ে থাকলো তার মাথায় নেই। হঠাৎ এক দমকা হাওয়া এসে ঢিলে করে বাধা খোপাটা খুলে দিলো। আচলটাও পড়ে গেলো মাথা থেকে। পিঠ ভর্তি ঝলমলে চূলগুলো ছড়িয়ে গেলো বাতাসে। মুখে পড়লো। কুমু ঠিক করলো না। সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকলো। বাতাসে তার চুল আর ওড়না উড়ছে ক্লান্তিহীন এলোমেলো। খানিকবাদেই কানে এলো গম্ভীর আওয়াজ
–শুনছেন?

চমকে উঠলো কুমু। ভয়ে গা শিউরে উঠলো। বুকের ভেতরে কেঁপে উঠতেই ঘুরে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড স্থির তাকিয়ে থেকে পরিচিত মানুষটাকে দেখেই অনুভূতি পাল্টে গেলো। ভীত দৃষ্টি শান্ত হয়ে গেলো। বুকের ভেতরটা এখনো কাঁপছে। তবে ভয়ে নয়। ভালো লাগায়। এমন স্নিগ্ধ এক চন্দ্রিমা রাতে প্রিয় মানুষটার সাথে জ্যোৎস্না বিলাস! ভাবা যায়? মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যাবধানে পরিবর্তন হল তার দৃষ্টির। চোখ জোড়া নত হল। অসস্তি ঘিরে ধরল। কারণ তার চেয়েও গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের মানুষটা। তার চোখ জোড়া অদ্ভুত ভাবে বিচরণ করছে কুমুর চোখে মুখে। শ্যামকন্যা দাঁড়িয়ে আছে হিমেলের সামনে। ঘন কালো লম্বা চূলগুলো বাতাসে উড়ছে। তার ঠিক মাথার উপরেই আস্ত চাঁদ। চাঁদের আলোয় শ্যাম কন্যার রুপ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। সৌন্দর্য দুই রকমের হয়। কিছু সৌন্দর্য চোখ ঝলসে দেয়। তাদের দিকে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখ জালা করে। যেমন আলোক কোন উৎসের দিকে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। ঠিক তেমন। আর এক প্রকার সৌন্দর্য আছে যা দৃষ্টিতে ধীরে ধীরে সহনীয় হয়ে ওঠে। প্রথম দেখায় যতটা না ভালো লাগে দ্বিতীয়বার দেখলে তার থেকে ভালো লাগা কয়েকগুন বেড়ে যায়। প্রতিবার একটু একটু করে বেড়ে গিয়ে এক সময় চোখ ফেরানো ধায় হয়ে যায়। হিমেলের মনে হল মেয়েটা দ্বিতীয় পর্যায়ের সুন্দরী। প্রথম দেখায় খুব সাধারণ মনে হলেও কয়েকবার দেখার পর রুপ অসাধারণ হয়ে উঠছে। কুমুর অসস্তি চরম পর্যায়ে গিয়ে ঠেকল। লজ্জায় গাল লাল হয়ে উঠলো। চূলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–কিছু বলবেন?

হিমেলের দৃষ্টির পরিবর্তন হল না। বরং কণ্ঠে আরও আবেগ মিশিয়ে বলল
–চুল বাঁধো!

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here