#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ১৬,১৭
১৬
হিমেল এর সামনে না যাওয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েই তিন দিন বাড়িতেই কেটে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কুমু। নিজের অবাধ্য অনুভূতিগুলোকে লুকানোর অযাচিত প্রয়াস। সেসব কোনভাবেই যাতে হিমেলের সামনে না আসে। শুধু যে হিমেলের সামনে না যাওয়ার কারনেই বাড়িতে থাকা তা না। আরো একটি বিশেষ কারণ হলো নিজের ভাঙ্গা মনটাকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য কিছু সময় প্রয়োজন ছিল। নিজেকে কিছু সময়ের জন্য একা থাকতে দেয়ার দরকার ছিল। সব মিলিয়ে পুরো তিনটা দিন একেবারেই ঘরবন্দি হয়ে কাটিয়ে দিল সে। অবশ্য এই তিনটা দিন বাড়িতে থাকতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে তাকে। কেউ না কেউ কিছু সময় পর পর এসে জিজ্ঞেস করেছে কি হয়েছে। এসব হাবিজাবি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েই কিছুটা বিরক্ত হয়ে উঠেছে সে। আর কোনভাবেই বাড়িতে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। আর দুই একদিন বাড়িতে থাকলে সে এসব প্রশ্নের চক্করে পাগল হয়ে যাবে। গোসল সেরে এসে ভেজা চুলগুলো তে তোয়ালে চেপে হালকা হাতে মুছে নিল। এর মাঝে মৌ এসে বলল তার মা ছাদে যেতে বলেছে শুকনো কাপড় গুলো তুলে আনতে। কুমু ভেজা চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে একটা ঝাড়া মেরে সেই ভেজা তোয়ালে হাতে নিয়ে চলল ছাদের দিকে। সিঁড়ি বেয়ে তিন তলা পর্যন্ত উঠতেই পায়ের শব্দে থেমে গেল। হিমেল পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে ব্যস্ত ভাবে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। সামনে চোখ পড়তেই কুমুকে দেখে থেমে গেল। চমকিত দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকালো সে। কিছুটা অবাক হয়েছিল এভাবে কুমুকে দেখে। পুরো তিনটা দিন পর মেয়েটা কে দেখতে পেল। এই তিনটা দিন তার যাওয়া-আসার সময় হিসেব করে হিমেল রাস্তায় অপেক্ষা করেছিল। কিন্তু কোনভাবেই মেয়েটার সাথে দেখা হয়নি তার। কেন হয়নি এই কারণটা সে এখনো বুঝতে পারছে না। কুমুর সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে এমন কখনো হয়নি যে তাদের এক দিনে দুই থেকে তিনবার দেখা হয়নি। কিন্তু এই তিন দিনে মেয়েটার ছায়া দেখতে পায় না সে। বিষয়টা সত্যিই অন্যরকম মনে হয়েছে তার কাছে। আর এর কারণটা একমাত্র কুমুই বলতে পারবে। হিমেল এর এমন গভীর দৃষ্টিতে তাকানো দেখে কুমু চোখ ফিরিয়ে নিচের দিকে তাকালো। ভেজা চুলগুলো আলতো করে কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে তোয়ালেটা শক্ত করে চেপে ধরল। যত কিছু হয়ে যাক এই মানুষটার সামনে তাকে অত্যন্ত স্বাভাবিক আচরণ করতে হবে। কোন ভাবে এমন কোন আচরণ করবে না যাতে মানুষটা অন্য কিছু ভেবে বসে। গত তিনদিন আগে হিমেল এর কথার উত্তরে যে ধরনের আচরণ করেছিল তার সাথে সেটা নিয়ে সে নিজের উপর খুবই বিরক্ত। হিমেল এর সাথে এমন কোন আচরণ করার যুক্তিযুক্ত কারণ নেই। বিষয়টি শুধুই বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়। না জানি তার সেই আচরনের কারণ হিসেবে হিমেল ঠিক কি ভেবে বসেছে। তাই এবার থেকে সে নিজেকে যথাসম্ভব সংযত রাখার চেষ্টা করবে। অনুভূতিগুলোকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করবে। আর হিমেলের সাথে আর দশটা মানুষের মতোই আচরণ করবে। দৃষ্টি নত করে হিমেল কে পাশ কাটিয়ে দুটো সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল কুমু। আরো একটি সিঁড়ি মাড়াতেই গম্ভীর কণ্ঠ কানে এলো
–দাঁড়াও।
হৃদপিন্ডের গতিটা তীব্র ভাবে বেড়ে যেতেই থেমে গেল কুমুর পা। বুকের ভিতর লুকিয়ে রাখা গোপন অনুভূতিটুকু নড়েচড়ে উঠতেই চোখটা বন্ধ করে খুব জোরে একটা শ্বাস ফেলল সে। কোনভাবেই এই অনুভূতিকে আর হাওয়া লাগবে দিতে চায় না সে। গোপন অনুভূতিটা গোপন থাকাই শ্রেয়। এক তরফা এই অনুভূতিটা ভীষন জন্ত্রণা দায়ক সেটা অন্তত এই কয়দিনে বুঝেছে সে। এই যন্ত্রণা এভাবে সহ্য করে নেয়ার কোন কারণ নেই। তাই পিছন ফিরে খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল
–জি?
হিমেল ততক্ষণে তার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তার গভীর দৃষ্টি কুমুর চোখের দিকে নিবদ্ধ। সেই দৃষ্টি কুমুকে দুর্বল করে তুলছে ক্রমশই। ভেতরটা আবেগে টলমলে হয়ে ওঠার আগেই নিজেকে সামলে নিয়ে কোমল স্বরে বলল
–কিছু বলবেন?
–তুমি ঠিক আছো তো?
হিমেলের এমন অদ্ভুত প্রশ্নের ঠিক কি উত্তর দেবে সেটা কোনভাবেই বুঝে উঠতে পারল না সে। আর এমন প্রশ্নের কারণটাও অস্পষ্ট। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে কুমু নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে ছোট্ট করে বলল
–হ্যাঁ।
হিমেল আপাদমস্তক ভালো করে কয়েকবার দেখে নিয়ে বলল
–কোন সমস্যা?
কুমু এবার হিমেলের দিকে তাকালো। এবার তাকানোর পরেই বিষয়টা খেয়াল করল এই সুদর্শন পুরুষের চোখের মাঝে তার সর্বনাশ। সেদিকে তাকিয়ে সে কোনভাবেই নিজের অনুভূতি গুলোকে গোপন করে রাখতে পারবে না। সাথে সাথে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। আবারও ছোট্ট কথায় উত্তর দিল
–না।
–তাহলে পুরো তিনটা দিন কোথায় ছিলে?
কুমু নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলেও হিমেলের গম্ভীর কণ্ঠসর আর তীব্র অধিকারবোধ তাকে আরেকবার দুর্বল করতে সক্ষম হয়ে উঠল। হাতে ধরে থাকা ভেজা তোয়ালেটা শক্ত করে চেপে ধরলো। সে যে তিনদিন ধরে বাসা থেকে বের হয়নি মানুষটা সেটাও খেয়াল করেছে। অথচ এটা কুমুর কাছে অপ্রত্যাশিত একটা ব্যাপার। কিন্তু কেনো? এতো কিছু খেয়াল করার কারণটা ঠিক কি হতে পারে? কয়েক সেকেন্ডেই অনেক কিছু ভেবে বসলো সে। কিন্তু কোন উত্তর খুঁজে পেলো না। তাই নিচের দিকে তাকিয়ে উত্তরটা দিলো
–বাসায় ছিলাম।
–কারণটা জানতে পারি কি?
এবার কুমু নিজের ধৈর্য হারিয়ে ফেলল। হিমেলের এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকলে সে আর কোনভাবেই নিজেকে আটকাতে পারবেনা। তাই নিয়ে ফেললো একটা কঠিন সিদ্ধান্ত। হিমেল এর এভাবে সব প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব না। তবে হিমেল যে অযথাই এসব প্রশ্ন করে তার উপরে অধিকার দেখাচ্ছে সেটাও তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে এমন আচরণ করার আগে সে একটু ভেবে দেখে। তাই কিছুটা অধৈর্য হয়েই কণ্ঠে কাঠিন্য বজায় রেখে হিমেলের চোখে চোখ রেখে বলল
–এত প্রশ্নের উত্তর আপনাকে কেন জানতে হবে? আমি কোথায় যাই কি করি কতক্ষণ কোথায় থাকি এই সবকিছুর প্রতি আপনার এত আগ্রহ কেন? আমি সেদিনও বলেছি আমার জীবন আমার ইচ্ছা। আর আমি আমার জীবনে খুব কাছের মানুষ ছাড়া কাউকে কৈফিয়ৎ দিই না। আর আমার মনে হয় না আপনার সাথে আমার এমন কোনো সম্পর্ক আছে যার জোরে এসব কৈফিয়ৎ আমি আপনাকে দিতে পারি। আশা করি আমার কথা বুঝতে পারছেন। আপনি যথেষ্ট ভালো মানুষ। তাই ভালোভাবেই বলছি। আমার কথা বুঝতে পারলেই ভালো হবে। আর একটা কথা বিশেষ ভাবে অনুরোধ করবো। যেখানে সেখানে আমাদের এভাবে কথা বলার ব্যাপারটা যদি কারো নজরে পড়ে তাহলে বিষয়টা খারাপ দেখাবে। প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়ে এভাবে কথা বললে সমাজ সেটাকে ভালো চোখে দেখে না। আশা করবো আপনি বিষয়টা খেয়াল রাখবেন।
কুমুর কথার প্রেক্ষিতে হিমেল আর কোন কথা খুঁজে পেল না। অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল তার দিকে। কুমুর চেহারা বেশ স্বাভাবিক থাকলেও ভেতর থেকে হিমেল এর অসহায় দৃষ্টি তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। সে অসহনীয় যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা হয়তো তার নেই। তাই দ্রুত সিড়ি দিয়ে ছাদে উঠে গেল। হিমেল আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কুমুর এমন আচরণটা তার কাছে খুব একটা বিস্ময়কর ঠেকল না। কারনটা যে তার কাছে স্পষ্ট। হিমেল খুব ভালো করে বুঝতে পারছে তার ভুলের কারণে কুমুর এমন আচরণ তাকে মেনে নিতে হচ্ছে। কুমুর অভিমান কিভাবে ভাঙবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না। ছাদে ওঠার মুহূর্তে কুমুর বারবার পেছন ফিরে দেখতে ইচ্ছা করছিলো হিমেলের দিকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করতেই সেই অসহায় দৃষ্টি ভেসে উঠলো চোখের সামনে। বুকের ভেতরটা যন্ত্রণায় চিনচিন করে উঠলো। হিমেল যে তার আচরণে কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু কুমুর তো তাকে কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্য ছিলো না। সে তো পরিস্থিতির চাপে বাধ্য। তীব্র বিষাদের ছায়া নেমে এলো তার চেহারায়। পুরো মনটাই পড়ে আছে সেই মানুষটার কাছে। আবারও যেতে মন চাইছে তার সামনে। কিন্তু যাকে নিষিদ্ধ বলে আখ্যা দিয়েছে তার কাছে আবার ছুটে যাওয়ার কোন কারণ নেই। সেই নিষিদ্ধ ইচ্ছাটাকে পুনরায় দমিয়ে রেখে চোখের পানি ফেলল।
————-
হিমেল এর সাথে আবারও দেখা হলো পরের দিন সকালে। মৌয়ের হাত ধরে রাস্তায় হাঁটছিলো কুমু। হিমেল সেখানেই দাড়িয়ে কুমুর অপেক্ষা করছিলো। সে জতই অপমান করুক না কেনো হিমেল কিছুতেই হার মানবে না। কুমুকে মানিয়েই ছাড়বে। কতদিন কুমু তাকে এভাবে এড়িয়ে যায় সেটাই দেখার পালা। দাড়িয়ে থাকা হিমেলকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলো কুমু। কিন্তু খুব বেশিদূর এগোতে পারলো না। তার আগেই ডাক পড়লো
–কুমুদিনী একটু দাড়াও। একটা কথা বলেই চলে যাবো।
এমন আকুল আবেদন নাকচ করে চলে যাবার ক্ষমতা কুমুর নেই। না চাইতেও থেমে গেলো পা। হিমেল সামনে এসে দাঁড়াতেই কুমু আবারও নিজের করা ভুলটার অনুশোচনায় জর্জরিত হয়ে উঠলো। বারবার একই প্রশ্ন মাথায় খেলছে কেনো দাড়াতে গেলো। কিন্তু কোন লাভ হলো না। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল
–যা বলার তাড়াতাড়ি বলেন। আমার কাজ আছে। যেতে হবে।
হিমেল আবারও এমন ব্যবহারে বিস্মিত হলো না। সাভাবিক ভাবেই বলল
–কোন কারণে রাগ করেছো আমার উপরে? কারনটা জানালে বেশ উপকৃত হতাম।
কুমু তাকাল সুদর্শন পুরুষের চোখে। তীব্র অভিমান আর রাগে চোখে পানি টলমল করে উঠলো। কান্না গুলো কণ্ঠ নালিতে দলা পাকিয়ে সমস্ত শব্দগুলো আটকে দিল সেখানেই। সুদর্শন পুরুষটি ভীষন অসহায় কণ্ঠে বললো
–অভিমানের কারণটা জানতে পারি?
চমকে উঠলো কুমু। কোন ভয়ংকর চুরি ধরা পড়ার মতো অপরাধে ভেতরটা কেপে উঠলো। অভিমানটা ধরে ফেলেছে মানুষটা? তাহলে কি অনুভূতিটাও? শেষ গোপন অনুভূতিটুকু লুকিয়ে রাখার ব্যার্থ প্রচেষ্টা করতেই দ্রুত প্রস্থান করলো সেখান থেকে। কিন্তু পেছন থেকে ভেসে এলো ভয়ংকর অধিকার বোধ নিয়ে উচ্চারিত শব্দগুচ্ছ
–আমি কি তাহলে তোমাকে আমার উপরে অভিমান করার অধিকার দিয়ে দিলাম কুমুদিনী?
চলবে….
#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ১৭
–আমি কি তাহলে তোমাকে আমার উপরে অভিমান করার অধিকার দিয়ে দিলাম কুমুদিনী?
ছোটোখাটো একটা বজ্রপাত হল কুমুর উপরে। হিমেল তাকে বুঝতে পারে। তার অভিমান অনুভূতি সবটাই পরিষ্কার। কিন্তু সে কোনভাবেই হিমেলের এই ধারণাকে সত্য প্রমাণিত হতে দিতে পারে না। আকাশ পাতাল ভেবেও এই প্রশ্নের উপযুক্ত কোন জবাব খুঁজে পাওয়া গেলো না। অনেকটা সময় অযথাই নষ্ট হল। সময়টা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে না পেরে নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হল কুমুর। হিমেল এগিয়ে এসে কুমুর সামনে দাঁড়ালো। ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বলল
–চুপ কর আছো যে? কোন উত্তর খুঁজে পেলে না বুঝি?
আরেকদফা চমকে গেলো কুমু। মানুষটা কি তার মন পড়তে পারছে? এমনটা হলে খুব খারাপ হয়ে যাবে। এভাবে তার ডাকে সাড়া দেয়াটাই ভুল হয়ে গেছে। না দাঁড়ালেই এতো কিছু হতো না। যে করেই হোক এখান থেকে এখনই যেতে হবে। কিছুটা থেমে থেমে বলল
–দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমাকে যেতে হবে।
হিমেল একটুও নড়ল না। কিছুটা ধমকে উঠেই বলল
–অবান্তর কথা বার্তা না বলে সহজ প্রশ্নের সহজভাবে উত্তর দিলেই এতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকতে হতো না। খুব কঠিন প্রশ্ন করেছি বলে মনে হয়না।
কুমু বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকাল। কণ্ঠে অবাকের রেশ টেনে বলল
–আমি অবান্তর কথা বলছি? আপনি আমার রাস্তা আটকে সময় নষ্ট করছেন। এটা অবান্তর কাজ।
কিছুটা চেচিয়ে শেষের কথাটা বলল কুমু। হিমেল রেগে গেলো। ভ্রু কুচকে বলল
–এভাবে আমাকে অবহেলা না করলেই রাস্তা আটকে কথা বলতে হতো না। আগে তো কখনো হয়নি।
কুমু বড় বড় চোখে তাকাল। হিমেলের কথা তার মাথায় ঢুকছে না। কিন্তু এই মুহূর্তে তার সাথে তর্ক করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তাই নিজেকে কঠিন করে নিয়ে বলল
–অবহেলা করছি না তো।
–তাহলে কি করছ?
হিমেল কিছুটা রেগে কথা বলতেই কুমু তাকাল তির্যক দৃষ্টিতে। কঠিন গলায় বলল
–আপনার সাথে তো আমার সম্পর্ক নেই তাহলে অবহেলা করার কথা আসছে কোথা থেকে?
হিমেল আরও রেগে গেলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল
–সম্পর্ক! কি বোঝ তুমি সম্পর্কের?
কুমু হিমেলের কথার কোন উত্তর দিতে পারলো না। কিন্তু মৌ তীব্র প্রতিবাদ করে বলল
–তুমি আপাকে কেন বকছ?
হিমেলের দৃষ্টির পরিবর্তন হল। শীতল দৃষ্টি মৌয়ের দিকে ফিরিয়ে অসহায় কণ্ঠে বলল
–এতো বড় দুঃসাহস আমি কখনই করতে পারি না। তোমার আপা তো মহা মানবী। একমাত্র সে ঠিক আর বাকি সবাই ভুল।
মৌ কথার অর্থ বুঝতে পারলো না। ভ্রু জোড়ায় গভীর ভাঁজ ফেলে হিমেলের দিকে তাকাল। তবে কথাটা কুমুর গায়ে লাগলো। রেগে গিয়ে বলল
–এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।
হিমেল কিছু বলার আগেই মৌ আবার বলল
–আপা তুমি ভাইয়াকে কেন বকছ?
কুমু নিজের রাগটা মৌয়ের উপরে ঝেড়ে দিলো। দরাজ গলায় বলল
–বারবার বলেছি বড়দের কথার মাঝে কথা বলবে না। তবুও কেন কথা বলছ? কথা শুনতে ইচ্ছা করে না?
কুমুর ব্যাবহার হিমেলের খারাপ লাগলো। তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল
–তুমিও তো কথা শোন না। বলেছি না ছোটদের সাথে এভাবে কথা বলবে না।
কুমু হতাশ শ্বাস ছাড়ল। ক্লান্ত কণ্ঠে বলল
–আমি খুবই বিরক্ত। আমাকে আর বিরক্ত করবেন না প্লিজ!
হিমেল আবারো হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে অস্পষ্ট আওয়াজে বলল
–যাও।
বলেই সেখান থেকে চলে গেলো। আর দাঁড়ালো না। কুমু পেছন ফিরে একবার তাকাল। হিমেল নিজের মতো সামনে হেটেই চলেছে। মৌ পেছনে একবার তাকিয়ে বলল
–ভাইয়া কিন্তু রাগ করেছে আপা।
কথাটা শুনেই কুমুর মন খারাপ হয়ে গেলো। সে নিজেই বুঝতে পারছে না কেন এমন করছে। আর হিমেল নিজেই বা তার সাথে এমন কেন করছে। তার মনে তো কুমুর জন্য কোন অনুভূতি নেই তাহলে এমন কেন। আর কিছুই ভাবতে পারলো না সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৌয়ের হাত ধরে সেখান থেকে চলে গেলো।
———-
বোতলের মুখ খুলে সদ্য পানিটা গলায় ঢেলেছে কুমু। কোথা থেকে তড়িৎ গতিতে শুভ্রা এসে হাপাতে হাপাতে বলল
–তোকে ম্যাম ডাকছে।
কুমু কিছুটা অবাক হল। একটু সময় নিয়ে ভাবল। ১৫ মিনিট আগেই ম্যামের ক্লাস শেষ করে বেরিয়েছে সে। কাঠ ফাটা রোদে মাঠে বসে শুকনো গলাটা ভিজিয়েছে মাত্র। এখনই আবার ম্যাম কেন ডাকল। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে শুভ্রা ঝাঁকিয়ে বলল
–তাড়াতাড়ি চল। ম্যাম বসে আছে।
ক্লান্ত শ্বাস ছেড়ে কুমু চলে গেলো শুভ্রার সাথে। ম্যামের সামনে দাঁড়াতেই তিনি চশমাটা নাকের উপরে ঠেলে দিয়ে বলল
–কুমু তোমাকেই খুজছিলাম। ভার্সিটিতে সামনে সপ্তাহে একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। নোটিশ পেয়েছ তো?
কুমু মাথা নাড়ল। যার অর্থ সে জানে। ম্যাম আবারো বলল
–সেই প্রোগ্রামে নাচের জন্য তোমাকে সিলেক্ট করা হয়েছে।
কুমু অস্থির পলক ফেলে তাকাল। বিস্ময়কর কণ্ঠে বলল
–আমাকে?
ম্যাম কুমুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন
–তুমি কত ভালো নাচ করো সেটা সবাই জানে। সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আপত্তি করো না। প্রস্তুতি নাও। এখনো অনেক সময় আছে।
কুমু কিছু বলতে চেয়েও লাভ হল না। একবার ভার্সিটির একটা প্রোগ্রামে বন্ধুদের সাথে নেচেছিল। সেই থেকে পুরো ভার্সিটিতে সবাই জানে সে কত ভালো নাচতে পারে। কুমু খুব একটা খুশী না হতে পারলেও শুভ্রা খুশী হল। উতফুল্য কণ্ঠে বলল
–আপনি একদম ভাববেন না ম্যাম। কুমু রেডি হয়ে যাবে।
কুমু একটা হতাশ শ্বাস ছাড়ল। ক্লান্ত কণ্ঠে বলল
–ঠিক আছে ম্যাম।
———-
স্বাভাবিক কিছু ঘটনার মধ্য দিয়েই কেটে গেলো একটা সপ্তাহ। যে যার মতো ব্যস্ত। কুমু তার নাচ নিয়েই একটা সপ্তাহ ব্যস্ত ছিল। তাই তার অধিকাংশ সময় ভার্সিটিতেই কেটে যেতো। প্র্যাকটিস শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় দিনই সন্ধ্যা হয়ে যেতো। এদিকে হিমেল সারাদিন নিজের ঘরে ছবি আঁকে। সামনেই তার একটা স্থিরচিত্র প্রদর্শনী আছে। সেটারই প্রস্তুতি স্বরূপ ছবি আকছে একটা সপ্তাহ ধরে। এই কয়দিনে সেও খুব একটা বের হয়নি বাড়ি থেকে। তাই কুমুর সাথেও দেখা হয়নি। হিমেল কয়েকদিন একটানা ঘরের মধ্যে থাকতে গিয়ে হাপিয়ে উঠেছে। তাই আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই বাইরে বেরিয়েছে। হিমেলকে দেখে তার মা এক কাপ চা পাঠিয়ে দিলেন। সবে চায়ে চুমুক দিতেই শ্রাবণ নিজের ঘর থেকে বের হয়ে এসে হিমেলের পাশে বসলো। কোনদিকে না তাকিয়েই নিজেকে গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে। হিমেল কয়েকবার তাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে নিলো। বেশ রঙ্গিন একটা পাঞ্জাবী পরেছে। বেশ পরিপাটি করে চূলগুলো গোছানো। কৌতূহল বশত বলেই ফেললো
–সকাল সকাল এমন সেজে গুঁজে কই যাচ্ছিস?
শ্রাবণ স্থির দৃষ্টিতে তাকাল। বেশ কয়েকদিন পর ভাইকে ঘরের বাইরে দেখতে পেয়ে কিছুটা অবাক হল। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল
–আজকে ভার্সিটিতে একটা প্রোগ্রাম আছে। সেখানেই যাচ্ছি।
হিমেল ছোট্ট করে ‘ওহ’ বলেই আবার চায়ে চুমুক দিলো। কি ভেবে শ্রাবণ উতফুল্য কণ্ঠে বলল
–তুমি যাবে?
হিমেল শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে বলল
–কোথায়?
–ভার্সিটির প্রোগ্রামে। চলো না। তুমি তো আমার বন্ধুদেরকে চেনই। একটুও খারাপ লাগবে না।
হিমেল ক্লান্ত সরে বলল
–যাবো না। তুই যা। আমি রেস্ট নেবো।
শ্রাবণ কি ভেবে জেদ করে বসলো। সে ভাইকে নিয়েই যাবে। হিমেল বেশ বিরক্ত হল। এক পর্যায়ে নাছোড়বান্দা শ্রাবণের কাছে হার মেনে অগত্যা যেতে রাজি হয়ে গেলো। দুই ভাই রেডি হয়ে চলে গেলো ভার্সিটি। সুসজ্জিত মাঠে ছাত্রছাত্রীর মেলা। একেক জনের সাজসজ্জা একেক রকম। অনুষ্ঠানের সব আয়োজন ইতিমধ্যে শেষ। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে মূল অনুষ্ঠান। হিমেল চারিদিকে দেখে নিয়ে বিরক্তিকর একটা শ্বাস ছাড়ল। গরমের মাঝে এরকম পরিবেশে তার খুব বিরক্ত লাগছে। শ্রাবণের উপরে রাগ লাগছে খুব। অযথাই জেদ করে নিয়ে এলো। অবশ্য শ্রাবণের সব বন্ধুদের হিমেল চেনে। তাই তারা যথেষ্ট সম্মান করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। শার্টের কলারটা পেছনে ঠেলে দিয়ে ঠোঁট গোল করে একটা শ্বাস ছেড়ে সামনে তাকাতেই চোখ আটকে গেলো। পরিচিত মুখটা দেখেই পুরো সময়টাই যেন থমকে গেলো তার। পুরো বাঙ্গালিয়ানায় শাড়ী পরেছে কুমু। সাজসজ্জাও বেশ ভারী। ঠোঁটে গাড় লাল লিপস্টিক। কপালে লাল টিপ কিন্তু একটু বাঁকা। নিখুঁত সাজের মাঝে ঐ একটা খুঁত হিমেলের চোখে কেমন ফুটে উঠলো। মনে হল ওটা ঠিক না করলে যেন চলছেই না। কুমুর ঠিক পাশেই মৌ আর রাফিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো। হিমেল মুচকি হেসে উঠে তাদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। মৌ রাফির হাত ধরে সামনে তাকিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে। হিমেল আলতো করে মাথায় হাত দিতেই বেশ বিরক্ত নিয়ে পেছন ফিরে তাকাল। চোখ মুখ কুচকে কিছু একটা বলার প্রস্তুতি নিলেও হিমেলকে দেখে চেহারা সতেজ হয়ে গেলো। এক গাল হেসে বলল
–হিমেল ভাইয়া তুমি?
রাফি কুমু দুজনেই পেছন ফিরে তাকাল। রাফিও হিমেলকে দেখে হেসে উঠে বলল
–আরে ভাইয়া আপনি এখানে কি করছেন?
হিমেল মৃদু হেসে বলল
–প্রোগ্রাম দেখতে এসেছি।
কুমুর দিকে এক পলক তাকিয়ে আবারো রাফির দিকে ফিরে বলল
–তোমরাও নিশ্চয় প্রোগ্রাম দেখতে এসেছ।
রাফি মৌ দুজনেই মাথা নাড়ল। হিমেল দৃষ্টি ফিরিয়ে কুমুর দিকে তাকাতেই খেয়াল করলো তার বিস্ময়ে ভরা চেহারা। কিছুটা অপ্রস্তুত আর ভীত। আপাদমস্তক তাকে কয়েকবার দেখে নিলো হিমেল। অসস্তিতে কাঁটা দিয়ে উঠলো কুমুর শরীর। ফাঁকা ঢোক গিলে অস্থির দৃষ্টি এদিক সেদিক ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। কিন্তু লাভ হল না খুব একটা। কুমু না তাকিয়েই বুঝতে পারছে হিমেলের গভীর দৃষ্টি তার উপরেই বিচরণ করছে। অস্থিরতা আরও বেড়ে যেতে হাতের পিঠ দিয়ে ঘাম মুছে নিয়ে মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–আমি আসছি।
কোন রকমে সেখান থেকে দ্রুত পায়ে হেটে গিয়ে ফাঁকা একটা জায়গায় দাঁড়ালো। এতক্ষন চেঁচামেচিতে মাথা ধরে আসছিল তার। এখন কিছুটা সস্তি হলেও অস্থিরতা কমছে না। হিমেল এখানে এসেছে সেটা ভেবেই আবারো দ্রুত নিশ্বাস পড়তে লাগলো। গলা শুকিয়ে কাঠ। হিমেলের সামনে সে নাচবে ভাবতেই কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হল। কেঁদে ফেলতে ইচ্ছা হল তার। এরকম পরিস্থিতিতে এর আগে কখনো পড়েনি সে। তাই কিভাবে এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে সেটাও বুঝতে পারছে না। আশেপাশে কোথাও শুভ্রাকে দেখতে না পেয়ে আরও রেগে গেলো। ফোনটা তুলে পাশের দেয়ালে হেলানি দিয়ে শুভ্রার নাম্বারে ডায়াল করলো। একবার রিং হয়ে কেটে গেলো। আরও রেগে গেলো কুমু। হতাশ শ্বাস ছাড়তেই পেছনে কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে চমকে তাকাল। হিমেলকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা ভয় পেলো। আশেপাশে সচেতন দৃষ্টিতে তাকাল। এদিকে কেউ নেই। কেউ দেখে ফেলার ভয়টা কেটে গেলেও হিমেলের অদ্ভুত দৃষ্টি তার ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে। শুকনো ঢোক গিলে থেমে থেমে বলল
–আ…আপনি এখানে কেন?
হিমেল খুব অল্প দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো। দেয়ালের সাথে আটকে গেলো কুমু। হিমেল দূরত্বটা আরও একটু ঘুচিয়ে নিতেই কুমু ভয়ে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলল। কুমু ভয় পাচ্ছে সেটা বুঝেই হিমেল শান্ত কণ্ঠে বলল
–ভয় পাচ্ছ কেন? খেয়ে ফেলবো না তোমাকে।
কুমু পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো। হিমেল তার মাথার পাশে দেয়ালে এক হাত রেখে তাকিয়ে আছে। কুমু কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে খুব দ্রুত কপালের টিপটা ঠিক করে দিলো। হালকা স্পর্শে পুরো শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো কুমুর। হিমেল হাতটা সরিয়ে কপালের টিপটার দিকে তাকিয়ে বলল
–সৃষ্টিকর্তা বোধহয় তোমার সব খুঁত ধরার ক্ষমতা আমার দৃষ্টিকেই দিয়েছে। আর সেসব নিখুঁত করার অধিকারটাও বোধহয় শুধু আমারই।
কুমু সম্মোহিতের মতো হিমেলের দিকে তাকাল। তার সেই মাদক চাহুনি আর সুগন্ধির তীব্র ঘ্রাণ ঘোর লাগিয়ে দিচ্ছে। ভেতরে তুমুল ঝড় শুরু হতেই কেউ একজন বলে উঠলো
–তোমরা দুজন এখানে কি করছ?
চলবে…