বালির নীচে জলের শব্দ #পর্ব ২৪,২৫

0
460

#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ২৪,২৫

২৪
নিস্তব্ধ রাত্রি। জনহীন সরণী। ছাদ জুড়ে থৈথৈ জোৎস্না। বসন্তের মৃদু মন্দ হাওয়া শরীর ছুঁয়ে দিলো তিনজন যুবকের। মধ্যরাতে এই নির্মল জোছনার আলোয় ছাদের রেলিং এর উপরে এক পা তুলে বসে আছে হিমেল। তার আঙ্গুলের ফাঁকে জ্বলন্ত নিকোটিন পুড়ে ধোঁয়া উড়ছে। আকাশের দিকে মিটমিটিয়ে জ্বলে ওঠা তারার দিকে দৃষ্টি স্থির তার। মনে মনে অপেক্ষার প্রহর গুনছে। সৌরভ বেশ জোরেশোরে মশা মেরেই ভীষন বিরক্তিকর কণ্ঠে বললো
— কি রে এখনো তোর সেই শুভাকাঙ্ক্ষীর আশার সময় হয়নি? এদিকে অপেক্ষা করতে করতে মশা তো আমার দেহের অর্ধেক রক্ত সাবাড় করে দিলো।

শ্রাবণ মলিন মুখে বলল
— ফোন দিয়েছিলাম তো। ধরলো না। এতক্ষণ তো চলে আসার কথা ছিলো।

সৌরভ বিরক্তিকর একটা শব্দ করে বলল
— আবার ফোন দে। এতো দেরি করছে কেনো কে জানে?

শ্রাবণ সৌরভের কথা মতো ফোন দেয়ার জন্য আলো জ্বালাতেই হিমেল ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল
— আহ! তোরা এতো অস্থির হচ্ছিস কেন? মেয়ে মানুষ। বললেই তো আর এতো রাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে ছাদে চলে আসা যায় না। সবদিক সামলে তবেই আসতে হবে। একটু সময় লাগবে।

সৌরভ চোখ মুখ খিচে হিমেলের দিকে তাকাল। ভীষন মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো তার। এতো বছরের বন্ধুকে মশা প্রায় খেয়ে ফেলছে সেটা নিয়ে তার কোন আক্ষেপ নেই। কিন্তু একটা মেয়েকে দো তোলা থেকে ছাদে আসতে একটু তাড়া দিচ্ছে বলেই তার বিরক্তির শেষ নেই। হিমেল কে সার্থপর মনে হলো তার। তার সাথে কোন কথা না বলে শ্রাবণ কে বলল
— শ্রাবণ আদৌ কি আসবে সে? তুই সিওর তো?

শ্রাবণ কোন উত্তর দিলো না। কারণ কুমুর বেধে দেয়া নির্ধারিত সময় পার হয়ে আধা ঘন্টা বেশি হয়ে গেছে। এখন তার নিজেরও সন্দেহ হচ্ছে কুমু আসবে কিনা। হিমেল সিগারেটে শেষ টান টা দিয়ে সেটা ছুড়ে ফেলে বলল
— কুমু যখন বলেছে তখন সে আসবেই।

সৌরভ এবার রেগে গেলো। কপালে গাঢ় ভাঁজ ফেলে কঠিন গলায় বলল
— আসবে বললে তো হবেনা। কখন আসবে সেটা জানতে হবে। সারা রাত কি এখানে অপেক্ষা করবো আমরা?

হিমেল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। গম্ভীর গলায় বলল
— তোর যদি এতো সমস্যা হয় তাহলে তুই নিচে যেতে পারিস। কেউ তোকে আটকে রাখেনি। আমি অপেক্ষা করবো কুমুর জন্য। ওর যখন সুবিধা হবে তখন আসবে।

হিমেল এর কথা শেষ হতেই ছাদ জুড়ে নীরবতা নেমে এলো। শ্রাবণের মন খারাপ তাই খুব একটা কথা বলছে না। সৌরভ বন্ধুর আচরনে তার উপরে অভিমান করেছে। তাই সেও চুপ হয়ে গেলো। প্রায় মিনিট দশেক পর কুমু ছাদে আসলো। দরজা পেরিয়ে ছাদে পা রাখতেই আওয়াজ শুনে তিন জোড়া চোখ তার দিকে স্থির হয়ে গেল। অন্ধকারে প্রথমে বিষয়টা তেমন কিছু মনে না হলেও ধীরে ধীরে আলোটা চোখে সয়ে যেতেই বিব্রত হলো কুমু। দৃষ্টি নত করে ফেললো। মাথার ওড়না টা টেনে ঠিক করে দিলো। শ্রাবণ কিছুটা অস্থির হয়ে বলল
— তুমি অবশেষে এসেছো? আমি তো ভেবেছিলাম আসতে পারবে না।

শ্রাবণের কথায় কিছুটা লজ্জা পেলো কুমু। অনেক বেশি দেরি করে ফেলেছে সেটা সেও জানে। নিচের দিকে তাকিয়েই মিনমিনে সরে বলল
— আসলে সবাই জেগে ছিলো তো তাই আসতে পারছিলাম না।

শ্রাবণ ভেতর থেকে হাসফাস করে উঠলো। শুভ্রার মনে তাকে নিয়ে ঠিক কি অনুভূতি আছে সেটা জানতেই সে কুমুকে এই মাঝরাতে ছাদে দেখা করতে বলেছে। এতক্ষণের সমস্ত অস্থিরতা চেপে রেখে অপেক্ষা করলেও এখন আর পারছে না। জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। অস্থির হয়ে বলল
— তুমি ওখানে কেনো দাড়িয়ে আছো কুমু? এখানে আসো।

পাতানো বেঞ্চটাতে হাত রেখে বলল
— এখানে বসো।

কুমু মাথা তুলে একবার সেদিকে তাকাল তারপর হিমেলের দিকে। কিন্তু হিমেলের স্থির দৃষ্টি তার ভেতর কাপিয়ে তুললো। অস্থির হয়ে উঠতেই দৃষ্টি ফিরিয়ে এগিয়ে গেলো। ভীষন অসস্তি নিয়ে দাড়াতেই সৌরভ আর শ্রাবণ দুজনেই বেঞ্চ টা ফাঁকা করে রেলিংয়ের উপরে বসে পড়লো। কুমু বসে পড়তেই শ্রাবণ বলল
— শুনলাম শুভ্রার বাবা নাকি বিয়ের জন্য ছেলে দেখছে?

কুমু মাথা নাড়লো। শ্রাবণ ভীষন হতাশ কণ্ঠে বললো
— তুমি জানতে কুমু? আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করনি? তুমি তো জানোই শুভ্রার প্রতি আমার অনুভূতি কেমন। তবুও?

কুমু অসহায় দৃষ্টিতে শ্রাবণের দিকে তাকাল। আহত কণ্ঠে বললো
— বিশ্বাস করেন ভাইয়া। আমি নিজেও জানতাম না। জানলে অবশ্যই আপনাকে জানাতাম। শুভ্রার মন খারাপ। তাই গত দুইদিন বাসা থেকে বের হয়নি। আজ আমি নিজে থেকেই সকালে ওকে ফোন দেই। তখনই বলল। আর ওর মন খারাপের কারণ এটাই।

শ্রাবণের নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। দমবন্ধ লাগছে তার। চোখ বন্ধ করে একটা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে কুমুর দিকে তাকাল। ভীষন শান্ত কণ্ঠে বললো
— শুভ্রা কি বিয়েতে রাজী?

কুমু মাথা নাড়িয়ে জানালো শুভ্রা রাজি না। সৌরভ এতক্ষণ চুপ করে কথা শুনছিল। মনে প্রশ্নের উদ্রেক ঘটতেই বলল
— তাহলে শুভ্রা বাসায় বলছে না কেনো সে বিয়ে করবে না। না করে দিলেই তো আর কোন ঝামেলা থাকে না। ও রাজি না থাকলে তো আর ধরেবেধে বিয়ে দেবে না।

সৌরভের কথাটা সবারই যুক্তিসঙ্গত মনে হলো। শুভ্রা চাইলেই বিয়ে ভেংগে দিতে পারে। শ্রাবণ সম্মতি দিয়ে কুমুকে জিজ্ঞেস করলো শুভ্রা কেনো তার বাবাকে না বলছে না। কুমু কিছুটা সময় নিয়ে বলল
— পরিস্থিতি আসলে তেমন না শ্রাবণ ভাইয়া। শুভ্রা বাড়ির বড়ো মেয়ে। তার দায়িত্বটা সবার থেকে একটু বেশীই। এমন একটা পরিস্থিতিতে সে জানতে পেরেছে তখন তার আসলে কিছুই করার ছিল না। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের ঘাড়ে যখন দায়িত্ত্ব পড়ে তখন নিজের ইচ্ছার ভারটা বোঝা মনে হয়। সেই বোঝা থেকে নিস্তার পেতেই দায়িত্বকে বেছে নেয়। শুভ্রার বাবা যা বেতন পান সেটা দিয়ে শহরে থেকে সংসার চালানো বেশ কষ্টসাধ্য। আর তাদের এই কষ্ট লাঘব করতেই তার বড়ো মামা কিছুটা সাহায্য করেন। আর শুভ্রার বিয়ের জন্য তিনি নিজেই ছেলে নিয়ে আসেন। সেখানে শুভ্রার বাবা না করতে পারেনি। আর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতেই হয়তো শুভ্রাও বিষয়টাকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। তবে এই বিয়েতে শুভ্রার কোন মত নেই। ওর সাথে যখন কথা হয়েছিলো তখন খুব কাদছিলো।

হিমেল গভীর মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছিল। কুমুর কথা শুনে মনে ভয় তৈরি হলো। এরকম পরিস্থতিতে হয়তো সে নিজেও হার মেনে দায়িত্ব বোধকে বেছে নেবে। কিন্তু হিমেল কিভাবে মেনে নেবে সেটা। এই অবস্থায় নিজেকে ভীষন অসহায় মনে হচ্ছে। আর যাই হোক সে কুমুকে হারাতে পারবে না। এদিকে শ্রাবণের অবস্থাটাও বুঝতে পারছে। এটার একটা সমাধান করতেই হবে। সে থাকতে শ্রাবণ এভাবে কষ্ট পাবে সেটা কোনভাবেই কাম্য নয়। হিমেল বলল
— শুভ্রার সাথে কথা বলাটা এই মুহূর্তে খুব দরকার। ওর সাথে কথা বললেও অন্তত বোঝা যেতো সে কি চায়। তারপর একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারতাম।

কুমু তাচ্ছিল্য হাসলো। মুখে হাসি রেখেই বলল
— আপনার কি মনে হয় এই পরিস্থিতিতে শুভ্রাকে জিজ্ঞেস করলেই সে নিজের মনের কথা বলে দেবে? অসম্ভব! এই মুহূর্তে ওর কাছে নিজের পরিবারের সুখটাই আগে। আমি যতদূর শুভ্রাকে চিনি সে সেটাকে বিসর্জন দিয়ে কখনোই নিজের সুখের কথা ভাববে না। প্রয়োজনে সারাজীবন কষ্ট পাবে। তবুও নিজের পরিবারকে অসম্মান করবে না।

সৌরভ উদাস কণ্ঠে বলল
— এটা কেমন কথা বললে? একজনকে মনে রেখে আরেকজনের সাথে সংসার কিভাবে করবে? এটাও কি সম্ভব?

কুমু হাসলো। সৌরভের দিকে তাকিয়ে বলল
— সম্ভব ভাইয়া। মেয়েরা সব পারে। নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে অন্যকে সুখী করতে মোটেই ভয় পায়না।

কুমুর কথাটা হিমেলের বুকের ভেতরে গিয়ে বিধলো। চিনচিন করে উঠলো ভেতরে। শ্রাবণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকাল। শেষ সুযোগটাও হয়তো হাতছাড়া হয়ে গেলো। হিমেল খুব গোপনে লুকানো নিশ্বাস টা ছেড়ে শ্রাবণের ঘাড়ে হাত রেখে বলল
— ভাবিস না। কিছু একটা ব্যাবস্থা হয়ে যাবে।

— আর কি হবে ভাইয়া? এভাবে সান্ত্বনা দেয়ার দরকার নাই। আমি সবটা বুঝতে পারছি।

শ্রাবণের কণ্ঠে অসহায়ত্ব। এলোমেলো লাগছে নিজেকে হিমেলের। চোখের সামনে ভাইকে ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হতে দেখে মেনে নিবে কিভাবে? এই যন্ত্রণা যে ভয়ানক! পৃথিবীর সমস্ত যন্ত্রণা থেকেও বিশ্রী এই ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণা। হিমেল কিছুটা সময় নিয়ে ভেবে বলল
— শুভ্রা যদি শ্রাবণকে পছন্দ করে তাহলে আমি কালকেই এই বিষয়ে মায়ের সাথে কথা বলবো। একমাত্র মাই পারবে এই বিষয়টা সমাধান করতে।

শ্রাবণ শুকনো ঢোক গিলে বলল
— তোমার কি মাথা খারাপ? শেষ পর্যন্ত আমাকে বাড়ি ছাড়া করতে চাও?

হিমেল শ্রাবণের কথার গুরুত্ব দিলো না। কুমুর দিকে তাকিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলো
— কুমু শুভ্রা কি কখনো তোমাকে এমন কিছু বলেছে যা থেকে মনে হয় সে শ্রাবণকে পছন্দ করে?

কুমু মিনমিনে সরে বলল
— শুভ্রা শ্রাবণ ভাইয়াকে পছন্দ করে। এতদিনে যেকোন কারণেই হোক বলতে পারেনি। কিন্তু আমি জানি।

হিমেল রেলিং থেকে নেমে গেলো। শ্রাবণের ঘাড়ে হাত রেখে বলল
— তুই নিশ্চিন্তে ঘুমা। একদম টেনশন করবি না। কাল সকালে উঠেই অমি মায়ের সাথে কথা বলবো। আর আমার সাথে থাকবে সৌরভ আর কুমু।

নিজের নামটা শুনে এক প্রকার ঝটকা খেলো কুমু। বিস্মিত কণ্ঠে বলল
— আমি?

চলবে…

#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ২৫

ভোর চারটায় এসে থমকে গেলো ঘড়ির কাঁটা। এক অশনি বার্তা নিয়ে বেজে উঠলো ফোন। ফয়েজ সাহেব গভীর ঘুমের মাঝে থাকায় প্রথম দফায় শুনতে পেলেন না। পরের বার আবারো ফোন বেজে উঠতেই তিনি ঘুমু ঘুমু চোখে তাকালেন। কুমুর ছোট মামার ফোন পেয়ে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ফোনটা ধরতেই তার চিন্তাটা বাস্তবে রুপ পেলো। জানতে পারলেন কুমুর নানা মারা গেছেন আধ ঘণ্টা আগে। পুরো বাড়ি সজাগ হয়ে গেলো। ঘুম থেকে উঠেই এমন একটা খবর শুনে কুমু আর রাফি যেন স্তব্ধ হয়ে গেলো। মৌ সবার সাথে জেগে উঠলেও বিষয়টা কি হচ্ছে সেট বুঝতে পারলো না। তাই ফ্যলফ্যাল করে সবার দিকে তাকিয়ে থাকলো। বাবার মৃত্যুর খবর শুনে কুমুর মা জ্ঞান হারালেন। তাকে সামলাতে কুমুর বেশ বেগ পেতে হল। ফয়েজ সাহেব দেরি না করে বাইরে গেলেন ভ্যান বা রিক্সা কিছু একটা নিয়ে আসতে। যত দ্রুত সম্ভব তাদের রওনা হতে হবে। মায়ের জ্ঞান ফিরতেই কুমু রাফিকে মায়ের দায়িত্ব দিয়ে চলে গেলো সবকিছু গুছিয়ে ফেলতে। অল্প কিছু কাপড় নিতে হবে। আর বাড়িটাও ভালো করে গুছিয়ে ফেলতে হবে। কে জানে কয়দিন থাকতে হবে তাদের। তার গোছানো শেষ হতেই ফয়েজ সাহেব এসে গেলেন। সবাইকে তাড়া দিয়ে বের হতে বললেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে সবাই বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে গেলো। কথা ছিল শ্রাবণ আর শুভ্রার ব্যাপারে শান্তি বেগমের সাথে সকালে কথা বলার। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হল না। তবে কুমু মন থেকে চায় তাদের বিষয়টা সমাধান হয়ে যাক। তারা ভালো থাকুক। সে কিছু করতে না পারলেও দোয়া করবে তাদের সুখের জন্য।

———–
সূর্যের উত্তাপ বেলার সাথে সাথে বেড়েই চলেছে। রাস্তা জুড়ে ক্লান্ত মানুষের ঢল। সবার চেহারা রোদে ঝলসে গেছে। কিছু জরুরী কাজ শেষে হিমেল বাড়ি ফিরেছে। রোদে পোড়া ঘর্মাক্ত চেহারাটায় ক্লান্তি মেখে আছে। উস্ক খুস্ক চুল। বিদ্ধস্ত অবস্থায় সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। হুট করেই দো তলায় এসে থেমে গেলো পা। দরজার দিকে কাতর নয়নে তাকাল। বড় একটা তালা ঝুলানো। আজ চারদিন ধরে এই তালাটা ঝুলছে। কুমুরা ঠিক কোথায় গেছে কেউ জানে না। হুট করে এভাবে কাউকে কিছুই না জানিয়ে কোথায় চলে গেলো? কোন খবর না পেয়ে একদিকে যেমন ভেতরটা খা খা করছে অন্যদিকে তেমন চিন্তাও হচ্ছে ভীষণ। সব ঠিক আছে তো। ঠোঁট গোল করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বাকি সিঁড়িটা পেরিয়ে দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো। পুরো দরজাটা খোলা। হিমেল জুতোগুলো এক পাশে খুলে রেখে ভেতরে ঢুকতেই দেখল সোফায় বসে সবাই আলোচনায় মত্ত। সেদিকে এক পলক দেখে নিঃশব্দে নিজের ঘরে চলে গেলো। ঘর্মাক্ত কাপড় ছেড়ে সোজা গেলো গোসলে। ক্লান্তি কাটাতে অনেকটা সময় নিয়ে গোসল সেরে বেরিয়ে দেখল শ্রাবণ তার বিছানায় বসে ফোন চাপছে। বেশ উতফুল্য মেজাজ তার। গুন গুন করে গানও গাইছে। হিমেল মৃদু হাসল। চুল মুছতে মুছতে বলল
–তুই এখানে কি করছিস?

শ্রাবণ মুচকি হেসে বলল
–অবশেষে তোমার গোসল শেষ। আমি তো ভেবেছিলাম আজ মনে হয় বাথরুমে থাকার প্ল্যান করেছো।

হিমেল কপাট রাগ দেখিয়ে বলল
–আমার এতো বড় ঘর থাকতে আমি বাথরুমে থাকার প্ল্যান করবো কেন? অপ্রাসঙ্গিক কথা বার্তা না বলে এখান থেকে যা।

শ্রাবণ হেসে ফেলে বলল
–তুমি তো সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছ। কি ব্যাপার মন মেজাজ খারাপ কেন? কোন বিশেষ কারণ আছে নাকি?

শ্রাবণের কথা শুনে হিমেল নিজেও খেয়াল করলো আজকাল তার ঠাণ্ডা মেজাজ আর নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। যখন তখন অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। এর অবশ্য বিশেষ কোন কারণ নেই। নাকি আছে সে বুঝতে পারছে না। ক্লান্ত গলায় বলল
–আমি ভীষণ টায়ার্ড।

শ্রাবণ মৃদু হেসে বলল
–বাইরে তোমাকে সবাই ডাকছে। কিসব জরুরী কথা বলছে। আমি অবশ্য সেসবের মধ্যে থাকছি না। নিজের বিয়ের আলোচনা নিজে উপস্থিত থেকে কিভাবে শুনি বল? লজ্জা বলেও তো একটা ব্যাপার থাকে।

হিমেল হেসে ফেললো। শ্রাবণ ফোনের দিকে তাকিয়েই কথাটা বলেছে। হিমেল তার চেহারার দিকে তাকাল। শুভ্রার পরিবারের হা সূচক জবাব আসার পর থেকে সে ভীষণ খুশী। তার চঞ্চল আচরন আর চেহারার উচ্ছলতা ভেতরের আনন্দটা প্রকাশ করছে। ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার আনন্দ বোধহয় এমনই হয়। তোয়ালেটা চেয়ারের উপরে মেলে দিয়ে বলল
–যা আসছি।

শ্রাবণ বের হয়ে গেলো। হিমেল কিছুটা সময় নিলো তারপর ভেজা চুলগুলো ঠিক করেই বের হয়ে গেলো ঘর থেকে। শ্রাবণ আর শুভ্রার বিয়ের তোড়জোড় চলছে বাড়িতে। তাদের বিষয়টা নিয়ে হিমেল যতটা জটিলতার আশংকা করেছিলো ততটা জটিল হয়নি। শান্তি বেগমকে মানাতে অবশ্য কিছুটা হয়রান হতে হয়েছে। পুরো দুইদিন সময় নিয়ে হিমেল আর সৌরভ তাকে রাজি করিয়েছে। তারপর তিনি নিজ দায়িত্তেই শুভ্রার বাড়িতে প্রস্তাব পাঠান। প্রথমে শুভ্রার বাড়িতে সময় চেয়ে বসায় সবাই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলো। তারা যদি না বলে দেয় তখন কি করবে? কিন্তু পরেরদিনই তাদের জবাব আসে। শ্রাবনদের বাড়ি আর শুভ্রাদের কাছাকাছি হওয়ায় আর তারা একই ভার্সিটিতে পড়ার দরুন শুভ্রার পরিবার অমত করে নি। খোঁজ নিয়ে দেখেছে ছেলেটা বেশ ভালো। পরিবারেরও নাম ডাক আছে। শ্রাবণের বাবা সনামধন্য পদে সরকারি চাকরি করেছেন। এখন তিনি রিটায়ার পারসন। তবে এখন নিজের ব্যবসা সামলান। সব ভেবেই তারা রাজি হয়ে জান। আর এখন দুই বাড়িতেই চলছে বিয়ে নিয়ে আলোচনা। হিমেল দাঁড়াতেই শান্তি বেগম বললেন
–তোর কি বিকেলে কোন কাজ আছে?

হিমেল সোফায় বসে পড়ে বলল
–কেন মা?

–আজ আমরা সন্ধ্যায় শুভ্রাকে আংটি পরাতে যাবো। তুই কোন কাজ রাখিস না আজ। শুভ্রার বাবা ফোন করে বারবার বলছিলেন আমরা সবাই যেন আসি। না গেলে মন খারাপ করবে।

হিমেল একটু ভেবে বলল
–আমার সন্ধ্যা পর্যন্ত কোন কাজ নেই। তবে রাতের দিকে একটু কাজ আছে। আমি যাবো। তবে বেশীক্ষণ থাকতে পারবো না।

সৌরভ প্রতিবাদ করে বলল
–তুই আজকের দিনে কেন কাজ রেখেছিস? ক্যান্সেল করে দে এখনই। ওখানে গেলে রাতে না খেয়ে চলে আসাটা কেমন দেখায়। ওনারা মন খারাপ করবেন।

হিমেল হতাশ শ্বাস ছেড়ে বলল
–আমি কি ইচ্ছা করে কাজ রেখেছি নাকি। আজ আর্ট কাউন্সিলের মিটিং আছে। সেখানে আমাকে উপস্থিত থাকতেই হবে। এক্সিবিশন নিয়ে কিছু জরুরী আলোচনা হবে। জানই তো তিনদিন পর আমাকে এক্সিবিশনে উপস্থিত থাকতে লন্ডন যেতে হবে ১ মাসের জন্য। আর আমি কি জানতাম নাকি যে আজকেই তোমরা প্রোগ্রাম করবে।

হিমেলের কথার পৃষ্টে কেউ কথা বাড়াল না। কারণ সবাই জানে এই আর্ট এক্সিবিশন এর জন্য হিমেল কতোটা কষ্ট করেছে। এখনো ব্যস্ত সময় পার করছে সে। এই এক্সিবিশন নিয়ে সে খুব আশাবাদী। শান্তি বেগম ছেলে মেয়েদের দুপুরের খাবার খেয়ে নিতে বললেন। কারণ বিকেলের দিকেই তারা শুভ্রাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। তার আগে অবশ্য কিছু প্রস্তুতি আছে। তাই কিছুটা সময় প্রয়োজন। উপহার হিসেবে শান্তি বেগম ঐ বাড়ির সদস্যদের জন্য কিছু নিয়ে যেতে চান। সেসব ঠিকঠাক গুছিয়ে নিতেই বিকেলটা পার হয়ে গেলো। তারা যখন শুভ্রাদের বাড়িতে পৌঁছল তখন সন্ধ্যে নামার মুহূর্ত। সূর্যটা ডুবে গিয়ে আকাশে ধূসর রঙ ধরেছে। তারা ও বাড়ি পৌছতেই পাশের মসজিদে মাগরিবের আজান শুরু হল। নামাজ শেষ করেই সবাই বসে পড়লো আলোচনায়। হিমেল বারবার ঘড়ি দেখছে। তাকে ৮ টার আগে বের হতে হবে। শান্তি বেগম ছেলের অবস্থা বুঝতে পেরে শুভ্রার বাবাকে অনুরধ করলেন আংটি পরার পর্বটা তাড়াতাড়ি শেষ করে নিতে। হিমেলের তাড়া আছে সেটাও বুঝে বললেন। তিনি সবদিক বুঝেই দ্রুত আচার অনুষ্ঠান শেষ করে ফেললেন। হিমেল তাড়া দেখিয়ে না খেয়েই সেখান থেকে বের হয়ে গেলো। খেতে গেলে সে সময় মতো মিটিং এ থাকতে পারবে না। হিমেল চলে গেলেও তারা নানা রকম পারিবারিক আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বিয়ের দিন তারিখ একেবারেই ঠিক করে ফেললো সবাই মিলে। হিমেলের লন্ডন থেকে ফিরতে প্রায় ১ মাস লাগবে। তাই বিয়ের তারিখটাও ১ মাস পরেই ঠিক করে ফেলা হল। এতে কাররই কোন আপত্তি নেই।

———–
দীর্ঘ একটা ঘন ছায়া পড়ে থাকে
গোটা ছাদ জুড়ে
কোথাও কোন শব্দ নেই
নিস্তব্ধতা
মোমের আলোর মতো চারিদিকে……
(সংগৃহীত)

মনে মনে কবিতার পঙক্তিটি আওড়াল হিমেল। মাঝরাতে ভরা জ্যোৎস্নার নীচে এতো বড় ছাদে নিজেকে ভীষণ একা মনে হচ্ছে তার। কুমুকে মিস করছে। আগামীকাল তার ফ্লাইট। তারপর এক মাসের জন্য লন্ডন চলে যাবে। তার আগে কি দেখা হবে না কুমুর সাথে? একবার প্রিয় মানুষটাকে দেখার জন্য চোখ দুটো অস্থির হয়ে আছে। একই বাড়িতে থাকার দরুন প্রতিদিন কুমুর সাথে দেখা হওয়াটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। মন মস্তিস্ক এই অভ্যাস কিছুতেই পরিত্যাগ করতে পারছে না। বুক জুড়ে ছেয়ে আছে হাহাকার। দীর্ঘশ্বাস টা হাওয়ায় মিলিয়ে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল
–এই ভালোবাসার অসহ্য যন্ত্রণা আমাকে শেষ করে দিচ্ছে। আমি আর পারছিনা। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে আমার তোমাকে প্রয়োজন। এই নির্ঘুম ক্লান্ত চোখ জোড়ায় প্রশান্তির ঘুম এনে দেয়ার জন্য হলেও তোমাকে প্রয়োজন। শুধু আর একবার আমার এই চোখ দুটোকে সুযোগ দাও তোমাকে দেখার। আর কখনো দৃষ্টির আড়াল হতে দেবো না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here