বালির নীচে জলের শব্দ #পর্ব ২৮,২৯

0
370

#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ২৮,২৯

২৮
কাক ডাকা ভোরে শিকদার বাড়ির সকল পুরুষ মানুষ বাইরে বেরিয়েছে। উদ্দেশ্য পরীকে খোঁ’জার। কাল রাত থেকে সে বাড়ি ফিরেনি। এই পর্যন্ত ঝুমকে এই নিয়ে অনেকবার প্রশ্ন করা হয়েছে। কিন্তু সে বারবার একই জবাব দিয়েছে। কিছুই জানে না। জবাবটা মিথ্যা না হলেও পুরোপুরি সত্য নয়। কারণ পরী যে কাল রাতে শামিমের সাথে দেখা করতে যাবে সেটা ঝুম জানত। আর এরকম সে প্রায়ই যায়। সময় মতো ফিরেও আসে। কিন্তু কাল রাতে এমন কি হয়েছে যে আর ফিরে এলো না। ঝুমের স’ন্দেহ গাড় হল। পরী শামিমের সাথে পা’লিয়ে যায়নি তো? কিন্তু পা’লাতে যাবে কেন? যদিও বা তাদের প্রেমের সম্পর্ক কেউ জানত না। তবুও শামিম যথেষ্ট ভালো ছেলে বলে পরিচিত গ্রামে। পরীর সাথে তার বিয়ের প্রস্তাব আসলে কেউ আপত্তি করার কথা না। কারণ তার বাবা মতি মেম্বার খুব সৎ মানুষ। নানা রকম উদ্ভট চিন্তা যখন মস্তিস্কে ঘুরপাক খাচ্ছে তখন সেগুলোকে হাওয়া দিতেই গ্রামের এক মহিলা এসে হাজির হল। রেহানার অশ্রুসিক্ত চোখ জোড়া দেখে বললেন
–কাইন্দনা। অল্প বয়সী মাইয়া। দেখো কোন পোলার সাথে প’লা’ইয়া গেছে গা। খুই’জ্জা আইনা বিয়া দিয়া দেও। মাইয়া মানুষ একটা ভু’ল কইরা ফা’লাইছে। এইসব ব্যাপারে মাই’য়াগো দো’ষ বেশী হয়। ক’ল’ঙ্ক শরিলে লাগলে আর মু’ছা যায়না। খোঁ’জ নিয়া দেখো। আমরা তো আর তোমাগো খা’রাপ চাইনা।

রেহানা কোন প্রতিউত্তর না করলেও নাজমা চুপ করে থাকতে পারলেন না। কঠিন গলায় জবাব দিলেন
–আমাগো বাড়ির মাই’য়ারা এমন নয় চাচি। আপনে এইসব কইবার আসলে এই’হান থেকে চইলা জান। আমাগো এহন এইসব শোনার মন মা’নসিকতা নাই। দেখতাছেন তো আমাগো অ’বস্থা।

নাজমার এমন জবাব শুনে মহিলাটি মুখ বেকিয়ে ফেললেন। গ্রামে মুরুব্বীদের সাথে এমনভাবে কেউ কথা বলে না। যথেষ্ট সম্মান করা হয় তাদেরকে। আর নাজমার কাছে তো এমন আচরন কিছুতেই আশা করা যায়না। নাজমা তার আচরণের জন্য কোনভাবেই অনু’তপ্ত নয়। রেহানা নিঃশব্দে শরীর দুলিয়ে কাঁদছে। মুখে আচল চেপে ধরে আছে। অল্প সময় পরেই সে কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল
–বুবু এতো বেলা হইয়া গেলো কোন খবর আইল না কেন? আমার মাইয়াডা কি ভা’লো আছে?

নাজমা স্থির দৃষ্টিতে তাকাল। রেহানার কথা শুনে তারও মনে ভ’য় তৈরি হল। এই গ্রামের ঘটনা কারো অজানা নয়। যু’বতি মেয়ে হারিয়ে যাওয়া মানেই খারাপ কিছু। ভ’য়ংক’র কিছু। তবুও সে সৃষ্টিকর্তার কাছে মনে প্রাণে প্রার্থনা করছে তাদের মেয়ে যেন স’হি সালামতে ফিরে আসে। নাজমার মাথায় আরও অনেক বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছে। সহি সালামতে ফিরে আসলেই কি সব বি’পদ কেটে যাবে। যুবতি মেয়ে পুরো একটা রাত বাইরে কাটিয়ে আসবে। এরপর কি গ্রামের মানুষ তাকে মে’নে নেবে? বি’য়ে হবে তার? নানা রকম আ’শঙ্কায় যখন নাজমার বুক ভারী হয়ে আসলো ঠিক তখনই পরীর নিখো’জ সংবাদ তুলোর মতো ছড়িয়ে পড়লো সারা গ্রামে। আর হুড়হুড় করে গ্রামের মানুষ ভিড় করলো শিকদার বাড়িতে। কেউ শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে এলো কেউ বা আবার কথার ছলে খোটা দিতে এলো। নানা মানুষের নানা কথায় শিকদার বাড়ির পরিবেশ অ’তিস্ট হয়ে উঠেছে। মেয়ের চি’ন্তায় ভারী হয়ে আসা হৃদয়ে এসব কথার ভার আরও যেন পাহাড় সমান লাগছে রেহানার কাছে। ঠিক সেই সময় খবর এলো। পরীকে পাওয়া গেছে। কিন্তু এমন সুখের খবরটা যে অনা’কাঙ্ক্ষি’ত হতে পারে সেটা হয়তো কারো ধারনা ছিল না। বাবা মিরাজ শিকদারের কোলে চড়েই সেই ছোট্ট বেলার মতো বাড়িতে এলো পরী। পার্থক্য শুধু একটাই। তখন সে ছিল সদ্য জন্ম নেয়া ফুটফুটে পরীর মতো শিশু। আর বর্তমানে এক বী’ভ’ৎ’স লা’শ। বি’ব’স্ত্র, বি’দ’ঘুটে দেখতে। মিরাজ মেয়ের লা’শ’টা এনে বারান্দায় বিছান পাটির উপরে শুয়ে দিলেন একদম রেহানার সামনে। কয়েক মুহূর্ত থম’থমে, নিস্তব্ধ পরিবেশ। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো সেদিকে সবাই। এরপরেই শুরু হল গগন বি’দারি চিৎ’কার। শো’কে’র মা’ত’ম। রেহানা মূ’র্ছা গেলো। নাজমার নিজেরও হাত পা কাঁপছে এমন দৃশ্য দেখে। এমন দৃশ্য কখনো যে দেখতে হবে সেটা ধারনাতেও আসেনি। সে বারবার মনে প্রাণে চেয়েছে পরী ফিরে আসুক। ভালভাবে ফিরে আসুক। মাহিন লা’শে’র পাশেই বসে পড়লো। সে দেখতে চাইছে পরীকে ভালভাবে। বুকে ভে’ঙ্গে কা’ন্না আসছে তার। কিন্তু একজন ছেলে হয়ে চিৎ’কার করে কা’দার শক্তিটা বোধহয় নেই। ঝুমের মুখে কোন কথা নেই। হাত পা জমে আছে তার। চোখের পানিও যেন কৌতুক করছে তার সাথে। রফিক শিকদার ছোট ভাইকে সামলাতে শুরু করেছেন। এক পর্যায়ে তিনি একজনকে বললেন
–চেয়ারম্যান রে খবর দেও। এর শ্যাষ পর্য’ন্ত আমি যামুই। যারা এই কাম করছে তারা শা’স্তি পাইবই।

চেয়ারম্যান কে খবর দিতে গিয়ে জানা গেলো তিনি শহরে গেছেন। আসতে দেরি হবে। কিন্তু কেউ থেমে থাকলো না। চেয়ারম্যানের কানে খবর পৌঁছে দেয়ার ব্যাবস্থা করা হল। কয়েকজন চলে গেলো শহরে। সেলিমের কানে খবর পৌছা মাত্রই সে আর দেরি না করে পু’লি’শ নিয়ে চলে এসেছে। সেলিম হন্তদন্ত করে শিকদার বাড়িতে ঢুকেই দেখল পরিস্থিতি ভ’য়া’বহ। হওয়াটাই স্বাভাবিক। সে নিজেও শোনার পর থেকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কালকেই পরীর সাথে তার কথা হয়েছে। আর রাতের মধ্যেই মেয়েটা খু’ন’ হয়ে গেলো? পরীর লা’শ দেখে সেলিমের আ’ত্মা কেঁপে উঠলো। বী’ভ’ৎস দৃশ্য। ইন্স’পে’ক্টর সেলিমকে উদ্দেশ্য করে বলল
–দেখে যতদূর মনে হচ্ছে এটা রে’প’ ‘কে’স। সিওর হওয়ার জন্য পো’স্ট’ ম’র্টে’ম করতে হবে। আপনাদের যদি অনুমতি থাকে তাহলে আমরা লা’শ শহরে নিয়ে যেতে পারি?

সেলিম চেয়ারম্যান হলেও পরিবারের অনুমতি ছাড়া এই সিদ্ধান্ত সে নিতে পারবে না। তাই এগিয়ে গিয়ে রফিক শিকদারকে বলল
–চাচা আপনার সাথে একটু জরুরী কথা ছিল।

রফিক সেলিমের সাথে ইন্স’পেক্ট’রের কাছে এলো। ইন্স’পেক্ট’র রফিককে সব বুঝিয়ে বললেন। তিনি কিছুটা সময় নিয়ে ভাবলেন। মিরাজের অবস্থা অনুযায়ী এই কথা তাকে কিভাবে বলবে। তবে যা করার সেটা দ্রুত করতে হবে। সে মনে প্রাণে চায় খু’নি’ ধ’রা পড়ুক। তাই মিরাজকে গিয়ে সবটা বললেন। মিরাজ প্রথমে রাজি হল না। ভাইয়ের হাত ধরে অসহায়ের মতো বলল
–ভাইজান ওরা আমার মেয়েরে নিয়ে কাঁ’টা ছে’ড়া করবো। আমি কেমনে মানে নেই। আমার মেয়েটা খুব ক’ষ্ট পাইবো যে।

কিন্তু রফিক কিছুতেই মিরাজের কথা মেনে নিতে পারলো না। তিনি এই আবেগে সায় দিয়ে কে’স’টা কিছুতেই ব’ন্ধ করে দিতে চান না। তাই অনেকটা সময় নিয়ে ভাইকে বোঝালেন। তার সাথে সেলিমও অংশ নিলো। সবার কথা শুনে মিরাজ নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ফেললো। কারণ সেও চায় তার মেয়ের এই প’রি’নতি যে করেছে সে শা’স্তি’ পাক। কিন্তু রেহানাকে কিভাবে বোঝাবে ব্যাপারটা। রফিক সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে বললেন
–ছোট বউরে সামলানোর ভার তোর ভাবীরে দিছি। হেয় সামলে নিবো। তুই চিন্তা করস না। আমি দেখতাছি।

কিছু জটি’লতা কাটিয়ে লা’শ’ শহরে নেয়ার ব্যাবস্থা করা হল। আর ইন্স’পেক্ট’র পরিবারের লোকজন আর যারা প্রথমে লা’শ দেখেছেন তাদের কিছু স্টে’টমে’ন্ট’ রেক’র্ড করে নিলেন। তাদের স্টে’ট’মেন্ট অনুযায়ী রাত থেকে যখন পরীকে খুঁ’জে পাওয়া যাচ্ছে না তখন ভোর হতেই মিরাজ আর রফিক আশে পাশের বাড়ির কয়জনকে নিয়ে বের হয়ে যায়। সব সম্ভাব্য জায়গায় খুঁ’জে বেড়ায় কিন্তু কোথাও পায়না। ঠিক সেই সময় তাদের কানে আসে। একজন মহিলা নাকি শাল বাগানে লা’শ’ দেখতে পায়। কম বয়’সী মেয়ের। বিবরণ শুনে সবার স’ন্দে’হ হয়। তবে প্রথমেই কেউ মানতে চায়না যে পরীর লা’শ’ পাওয়া যেতে পারে। এটা সবার কাছে অবি’শ্বাস্য ছিল। কিন্তু তবুও সেখানে যায় তারা। কিন্তু গিয়েই পরীর বি’ব’স্ত্র লা’শ’ দেখতে পেয়ে সবাই আঁ’তকে ওঠে।

পরীর লা’শ’ পু’লি’শের গাড়িতে তোলা হয়। শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হয় পরী। রেহানা জ্ঞা’ন ফিরতেই আবার মূ’র্ছা যাচ্ছেন। মিরাজ বা’ক্রুদ্ধ হয়ে গেছেন। সেলিমের উপরে দায়িত্ব পড়েছে পরিবারের পক্ষ থেকে থা’না’য় কাউকে নিয়ে গিয়ে একটা কে’স’ ফা’ই’ল করার। সেলিম রফিককে নিয়ে শহরে যাবে। তার আগে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো কারো খোঁজে। কিন্তু খুঁজে না পেয়ে মাটির দো তলার দিকে তাকাল। মাঝের ঘরের দরজাটা বন্ধ। সবাই নিজ নিজ শো’কে’ ব্যস্ত। তাই সকলের চোখের আড়াল হয়ে চলে গেলো দো তলায়। মাঝের ঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে একটা শ্বাস ছেড়ে মৃদু আওয়াজ করে ডাকল
–ঝুম।

দরজা খুলে গেলো। সেলিম স’স্তির নিশ্বাস ফেললো। আশে পাশে ভালো করে দেখে নিলো কেউ দেখছে কিনা। কেউ দেখেছে না নিশ্চিত হতেই দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে পড়লো। দরজাটা ভিড়ে দিয়ে এগিয়ে গেলো। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে ঝুম। থেমে থেমে তার শরীর কেঁ’পে উঠছে। সেলিম বুঝল সে নিঃশব্দে কাঁ’দছে। এগিয়ে গিয়ে পেছনে দাঁড়িয়ে আদুরে কণ্ঠে বলল
–ভে’ঙ্গে পড়লে চলবে না ঝুম। এখন শ’ক্ত থাকতে হবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।

ঝুম ঘুরে তাকাল সেলিমের দিকে। তার চেহারা দেখেই সেলিমের বুকের ভেতরটা কেমন চি’ন’চিন করে উঠলো। এলোমেলো চুল। চোখ গুলো লা’ল টকটকে। হতাশ শ্বা’স ছেড়ে ছোট্ট করে বলল
–নিজের খেয়াল রাখো। আমি শহরে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি আসবো।

–আমারে একলা রাইখা পরী কেন চইলা গেলো? এহন আমি কার লগে কথা কমু?

খুব ক’ষ্ট করে কথাটা বলেই কান্নায় ভে’ঙ্গে পড়লো ঝুম। সেলিম দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ঝুমকে এমন অবস্থায় দেখে তার খুব খা’রাপ লাগছে। বুকের ভেতরে চি’নচি’নে ব্যা’থা শুরু হল। নি’ষি’দ্ধ ইচ্ছা জেগে উঠলো। সেটাকে প্রশ্রয় দিয়েই নিঃ’সং’কোচে বুকে টেনে নিলো ঝুমকে। ঝুমও আবেগের ব’শ’বর্তী হয়ে দুই হাতে খা’মচে ধরল সেলিমের শার্ট। এখন তার হি’তাহি’ত জ্ঞা’ন নেই। অন্য সময় হলে সেলিমের এই আচরণে সে বি’ব্র’ত হতো। কিন্তু এখন সেসব বোঝার মতো অবস্থায় ম’স্তিস্ক নেই। সেলিম মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
–শান্ত হও ঝুম। কথা দিচ্ছি যারা পরীর এমন অ’ব’স্থা করছে তাদের সবার শা’স্তি’র ব্যাবস্থা করবো। কেউ ছাড় পাবে না।

সেলিমের কথা কানে যেতেই ঝুমের মস্তিস্ক সচল হল। আবেগি ঝুম কঠিন হয় উঠলো। আলগা হয়ে গেলো হাতের বাধন। এক ঝটকায় সেলিমের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তার চোখে দৃষ্টি স্থপন করলো। হিং’স্র’ রুপ নিয়ে বলে উঠলো
–কেডা এমন করছে আমি জানি।

চলবে…

#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ২৯

নিস্তব্ধ ঘরটাতে ছোট রকমের একটা বিস্ফোরণ ঘটাল ঝুমের কথাটা। সেলিম অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো কয়েক সেকেন্ড। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলল
–তোমার মানসিক অবস্থা ঠিক নাই ঝুম। রেস্ট নাও। আমি আসছি। শহর থেকে এসে আরেকবার দেখা করে যাবো।

সেলিম ঝুমের কথাটা এক বিন্দুও বিশ্বাস করেনি সেটা তার কথায় স্পষ্ট। ঝুম রেগে গেলো। কিছুটা গলা তুলে বলল
–আমার কথা আপনের বিশ্বাস হয়না? আমার কি মাথা খারাপ আছে যে আপনের লগে মজা করুম। আমি সত্যই জানি কেডা এমন করছে। আমি আরও অনেক কিছু জানি যা আর কেউ জানে না।

সেলিম স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো ঝুমের দিকে। বুঝতে চেষ্টা করলো সত্যি বলছে নাকি মন গড়া কোন কথা। কিছুক্ষন তাকিয়ে ঝুমের অভিব্যক্তি ঠিকঠাক ধরতে পারলো না। একটা শ্বাস ছেড়ে শান্ত কণ্ঠে বলল
–কি জানো তুমি?

ঝুম সেলিমের চোখে নিজের কঠিন দৃষ্টি স্থির করলো। নিস্পলক তাকিয়ে বলল
–মেম্বারের পোলা শামিমের লগে পরীর প্রেম আছিলো। রাইতে বড় দীঘির পাড় দুজন চুপ করে দেখা করবার জাইত। কাইল রাইতেও গেছিলো।

সেলিম বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকাল। বিচলিত হয়ে বলল
–শামিমের সাথে কাল রাতে পরী দেখা করতে গেছিল? তুমি জানতে?

–আমারে কইয়া গেছিল। আমি অনেক রাত পর্যন্ত দরজা খুইলা রাখছিলাম। সময় মতো হেয় আইয়া পড়ে। তাই দরজা খুইলাই ঘুমাইয়া গেছিলাম। মাঝরাতে ঘুম থেইকা উইঠা দেখি তহন পরী আসেনি। আমার খুব চিন্তা হইল। আমি গোটা বাড়ি খুইজ্জা পাইনি। তহনি আম্মারে কইছি। আম্মায় সবাইরে জানাইছে।

থেমে গিয়ে মাথাটা নিচু করে ফেললো সে। মনের মাঝে অপরাধ বোধ নিয়ে বলল
–আমি একটা মিছা কথা কইছি। কইছি ঘুম যাওয়ার আগে পরী আছিল। আমি ঘুমাইয়া যাওয়ার পর কি হইছে কইতে পারি না। সবাই হেইটাই বিশ্বাস করছে। তাই আমারে কিছু কয়নি।

সেলিম কথা গুলো শান্তভাবে শুনল। কিন্তু কোনভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না। শামিমের মতো ছেলেকে অবিশ্বাস করার মতো কোন কারণ নেই। ছোট বেলা থেকে একই সাথে খেলাধুলা করেছে গ্রামের মাঠে। বয়সের ব্যাবধান তাদের অল্প। শামিমকে ভালো মতো চেনে সেলিম। তার মতো ছেলে এমন কাজ করতে পারেই না। অসম্ভব! সেলিম পরীকে জিজ্ঞেস করলো
–কতদিন ধরে তাদের সম্পর্ক?

–১ বছর।

সেলিমের কপালে গাড় ভাঁজ পড়ে গেলো। ১ বছরের সম্পর্কে তারা প্রায় রাতেই দেখা করে। তাহলে কাল রাতে এমন কি হয়েছিলো? ঝুমের কথার সাথে বাস্তবতার কোন মিল নেই। ঝুম কি সত্যি বলছে নাকি আবেগে সেটা কিছুতেই ধরতে পারছে না সেলিম। সে এই গ্রামের চেয়ারম্যান। একটা অল্প বয়সী মেয়ের কথার উপর ভিত্তি করে কোনভাবেই শামিম কে সন্দেহ করা চলে না। এটা অন্তত তাকে মানায় না। কারণ তার দায়িত্তের জায়গাটা যে অনেক বড়। অনেক কঠিন। একটা শ্বাস ছেড়ে সমস্ত এলোমেলো চিন্তা মাথা থেকে বের করে দিলো। আপাতত কে’সটা ফাইল করা মুখ্য বিষয়। পরিস্থিতি শান্ত হলে নাহয় এসব নিয়ে ভাবা যাবে। আর তাছাড়া পু’লি’শ তো দায়িত্ব নিয়েছেই। তারাই খুঁজে বের করবে আসল অ’প’রাধী। তার এখন এসব ভেবে সময় নষ্ট করার কোন ইচ্ছা নাই। সে তার ভাবনা গুলো ঝুমকে বুঝতে দিলো না। ঠোঁট গোল করে একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–এই কথা আর কে জানে?

ঝুম ছলছল চোখে তাকাল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল
–আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। আমি কাউরে কইনি।

সেলিম সস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল
–আমি না বলা পর্যন্ত কাউকে বলবে না কেমন? আমাকে যেতে হবে। নিজের খেয়াল রেখো। একদম চিন্তা করবে না। আমি ফিরে এসে দেখা করবো।

————
চেয়ারম্যান বাড়ি গ্রামের সবথেকে পুরাতন বাড়ি। উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত এই চেয়ারম্যান পদের কারণেই লোক মুখে এই নাম প্রচলিত। ধীরে ধীরে এই নামেই সবাই বাড়িটাকে চেনে। বিশাল বাড়ির এক পাশে কাচারি ঘর। যেখানে চেয়ারম্যান তার যাবতীয় কাজকর্ম করেন। আর মূল বাড়ির ভেতরে থাকে পরিবারের সদস্যরা। বাড়ির পেছনের দিকটা অতিথিদের জন্য বরাদ্দ। বেশ কয়েকটা ঘর আছে সেদিকে। চেয়ারম্যানের কাছে শহর থেকে অনেক লোকের আনাগোনা চলেই। তাদের থাকার জন্যই ওদিকে ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাই মূল বাড়ি থেকে ঐ দিকটায় দেয়াল তুলে দিয়ে আলাদা করে দেয়া হয়েছে। অতিথিদের সেবায় সম্পূর্ণ আলাদা লোকজন আছে। তারাও মূল বাড়ির ভেতরে আসে না। ওদিকে শুধু সেলিম থাকে। তার নিরিবিলি পছন্দ বলেই ওদিকটায় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শহরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সেলিম। শার্ট টা গায়ে জড়িয়ে বোতাম লাগানোর জন্য আয়নার দিকে তাকাল। শেষ বোতামটা লাগাতেই চোখে পড়লো দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা রমণীর দিকে। আয়না থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে এবার সরাসরি তার দিকে তাকাল। রমণীটি চোখ নামিয়ে নিলো। সেলিম স্বাভাবিক ভাবে বলল
–কোন সমস্যা?

রমণীটি মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–আপনি শহরে যাচ্ছেন। আমাকে নিয়ে যাবেন? আমার কিছু দরকার ছিল।

সেলিম কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলো। দায় সারা ভাবে বলল
–সাথে নিয়ে যেতে পারবো না। আমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। তবে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সমস্যা হবে না।

রমণীটি মাথা নেড়ে চলে গেলো। সেলিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বের হয়ে চলে গেলো নিজের গন্তব্যে।

————
রাত প্রায় ৩ টা বাজে। শান্তি নীড়ের দো তলায় এখনো আলো জ্বলছে। দক্ষিনের জানালার পাশে বসে ল্যাপটপে জরুরী কাজ করছে রুশা। বিছানাটা এমন ভাবে পাতানো জানালাটা একদম মাঝ বরাবর পড়ে। বাইরে ভরা জ্যোৎস্না। আকাশটা বেশ পরিষ্কার। ফুরফুরে হাওয়া। পুরো বিছানায় চিপস আর কোক ছড়ানো। ভ্রু জোড়ায় গভীর ভাঁজ তার। হাতের আঙ্গুল গুলো কি বোর্ডের উপরে উম্মাদের মতো চলছে। যেন থেমে গেলে অনর্থ হয়ে যাবে। এক পর্যায়ে কিছুটা বিরতি নিয়ে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে চিপসের খোলা প্যাকেট থেকে কয়েকটা চিপস দুই আঙ্গুলে তুলে নিয়ে মুখে পূরে দিলো। কিছুক্ষন চিবিয়ে কোকের বোতলের ঢাকনা খুলে ঢেলে দিলো গলায়। বেশ অনেকটা পড়ে যাওয়ায় ঝাঁঝালো অনুভূতি হতেই চোখ বন্ধ করে গিলে ফেললো। ঠোঁট গোল করে একটা শ্বাস ছেড়ে ক্লান্ত চোখ জোড়া আবারো ল্যাপটপের উজ্জ্বল স্ক্রিনে নিবদ্ধ করলো। প্রচণ্ড ক্লান্ত সে। আবার কাল সকালে অফিসে যেতে হবে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে সারাদিনের মেইল বক্সটা একবার চেক করা দরকার। মেইল বক্স ওপেন করতেই নতুন একটা মেইল চোখ পড়লো। সেটা ওপেন করে পুরো মেইলটা পড়েই সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো। উড়ে গেলো ঘুম। স্থির দৃষ্টিতে সেদিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ফোনটা নিয়ে একটা বিশেষ নাম্বারে ডায়াল করলো। অনেকক্ষণ রিং হওয়ার পর ওপাশে ফোনটা রিসিভ হতেই ব্যস্ত কণ্ঠে বলল
–ঘুমিয়ে পড়েছ? ডিস্টার্ব করার জন্য রিয়েলি সরি। তবে একটা জরুরী কাজ আছে। একটু ছাদে আসনা। প্লিজ!

ওপাশ থেকে ঘুমু ঘুমু কণ্ঠস্বর বলে উঠলো
–এতো রাতে ছাদে কেন? কাল কথা বলি?

রুশা ব্যস্ত হয়ে পড়লো। অস্থির কণ্ঠে বলল
–না না। এখনই। প্লিজ। না করো না। অনেক জরুরী।

ফোনটা কেটে গেলো। রুশা হতাশ শ্বাস ছাড়ল। কোন উত্তর দিলো না। ছাদে আসবে কিনা কে জানে। টেনশন হলে রুশা দাঁত দিয়ে নক কাটে। এখনো তাই করতে শুরু করেছে। ঠিক ১০ মিনিট বাদে ফোন বেজে উঠলো তীব্র শব্দে। চমকে ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে গম্ভীর আওয়াজ কানে এলো
–আমি ছাদে।

রুশা এক দৌড়ে চলে গেলো ছাদে। উত্তেজনায় দরজা বন্ধ করতে ভুলেই গেলো। ছাদে উঠেই হাপাতে হাপাতে এক পাশে বসার জায়গাটায় বসে পড়লো। বুক ভরে শ্বাস টেনে বলল
–ঘুমিয়ে পড়েছিলে?

হিমেল সরু চোখে তাকাল। কণ্ঠে কিছুটা কৌতুক মিশিয়ে বলল
–মোটেই না। অপেক্ষা করছিলাম। এই মাঝরাতে ছাদে এসে ভরা জ্যোৎস্নার আলোয় তোমার সাথে প্রেম করবো। কি রোম্যান্টিক ওয়েদার বলো।

রুশা নিজের কাজে একটু লজ্জা পেলো। সে বুঝতে পারলো হিমেল রাগ করেই বলছে এমন কথা। সে এই মুহূর্তে রুশার উপরে খুবই বিরক্ত। রুশা মুখটা ভার করে বলল
–সরি।

হিমেল বিরক্ত হয়ে বলল
–নাটক না করে কি বলতে ডেকেছ তাড়াতাড়ি বলো। আমার ঘুম পাচ্ছে।

রুশা মোবাইলটা হিমেলের সামনে দিয়ে বলল
–মেইলটা পড়ে দেখো।

হিমেল ফোনটা হাতে নিয়ে মেইলটা মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। রুশা বলল
–অনামিকা হাওলাদার নামে একজন পাঠিয়েছে। বিষয়টা আমার কাছে অন্যরকম মনে হচ্ছে।

মেইলটা পড়ে হিমেল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। বলল
–তোমার এসব উদ্ভট চিন্তা ভাবনা নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখো। আমার মাথায় ঢোকানোর চেষ্টা করবে না ভুলেও। তোমার এসব উল্টা পাল্টা কাজে সাহায্য করা ছাড়াও আমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। আমাকে একদম বিরক্ত করবে না বলে দিলাম।

রুশা অসহায়ের মতো হাত জোর করে বলল
–প্লিজ হিমেল। শেষবার। আর কখনো জেদ করবো না। তোমার সাহায্য ছাড়া আমি কোনভাবেই পারবো না।

হিমেল না বলেও লাভ হল না। রুশার জেদের আগে কোনভাবেই টিকতে পারলো না। তাই অগত্যা রাজি হয়ে গেলো তার কথায়।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here