বালির নীচে জলের শব্দ #পর্ব ৩০,৩১

0
384

#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ৩০,৩১

৩০
শহর ছেড়ে গ্রামের রাস্তায় এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। শহরের মতো এদিকের রাস্তা তেমন প্রশস্ত নয়। তাই বেশ ধির গতিতেই চলতে হচ্ছে। রাস্তা ভাঙ্গা থাকায় মাঝে মাঝেই প্রচণ্ড ঝাকুনি হচ্ছে। এরকমই এক তীব্র ঝাকুনিতে হিমেলের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে তাকাল। পাশেই রুশা মোবাইলে গভীর মনোযোগ দিয়ে কি যেন দেখছে। হিমেল জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। বোঝার চেষ্টা করলো কোথায় আছে। কিন্তু কোনভাবেই বুঝতে পারলো না। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল
–আমরা এখন কোথায়?

রুশা ভ্রু জোড়ায় ভাঁজ ফেলে মোবাইলের স্ক্রিনে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখেই বলল
–তকিপুরের কাছাকাছি চলে এসেছি। আর হয়তো হাফ আওয়ার এর মধ্যেই পৌঁছে যাবো।

হিমেল বিরক্তিতে আবারো চোখ বন্ধ করে ফেললো। সে রুশার উপর খুব বিরক্ত। কোথা থেকে কোন অনামিকা হাওলাদার রহস্যের খোলাসা করতে সাহায্য চেয়ে মেইল পাঠিয়েছে আর অমনি এই মেয়ে দৌড়ে চলে এলো গ্রামে। এখন গ্রামে বসে নাকি রহস্যের কিনারা খুজবে। এই মেয়ের মাথায় কঠিন সমস্যা আছে। নাহলে এমন সিদ্ধান্ত কেউ নেয়? মেইলের কোন সত্যতা যাচাই না করেই চলে এলো এতোদূর। এখন যদি কোনভাবে এখানে এসে জানতে পারে কেউ মজা করেছে। তাহলে হিমেল তাকে এখানেই হাত পা বেঁধে নদীতে ফেলে রেখে চলে যাবে। নিজের উপরে রাগ হচ্ছে এখন। বিদেশে গিয়ে এক আপদ নিয়ে দেশে ফিরল। কেন যে এক আস্ত পাগলকে সাথে নিয়ে আসলো। নিজের উপরে বিরক্তিটা আরও কিছুটা বেড়ে যেতেই গাড়ি থেমে গেলো। চোখ মেলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ড্রাইভার বলল
–এর আগে আর গাড়ি যাবে না ম্যাডাম। রাস্তা একেবারেই খারাপ।

হিমেল জানালা দিয়ে মাথা বের করে সামনে দেখার চেষ্টা করলো। সামনে যতদূর দেখা যাচ্ছে পানি ছাড়া আর কিছুই নেই। হিমেল কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলল
–রাস্তা কোথায়? এ তো সমুদ্র।

রুশা হেসে ফেললো। হিমেল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার দিকে ফেলতেই থেমে বলল
–গাড়ি এখান থেকে আর যাবে না সেটা আমি জানি। আর এখান থেকে যাওয়ার ব্যাবস্থাও করে ফেলেছি। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। আমরা সময় মতোই পৌঁছে যাবো।

হিমেল গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল
–তোমার ব্যাবস্থার উপরে আমার কোন ভরসা নেই রুশা। তাই আমি নিজের ব্যাবস্থা নিজেই করে নেবো।

রুশা মুচকি হেসে বলল
–তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। ঐ যে দেখো চলে এসেছে।

হিমেল পেছনে ঘুরে তাকাল। সেলিম অটো নিয়ে চলে এসেছে তাদেরকে নিয়ে যেতে। রুশা গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারকে বলল
–লাগেজগুলো ওটাতে তুলে দাও। তোমার থাকার ব্যাবস্থা আলাদা করা হয়েছে। তুমি ওখানে গাড়িও রাখতে পারবে।

হিমেল চুপচাপ রুশার কাণ্ড দেখছে। পুরো প্ল্যান করে এসেছে এই মেয়ে। কে জানে এবার কি করবে। হতাশ শ্বাস ছাড়তেই সেলিম বলল
–আপনারা উঠে বসুন। আমি এগুলর ব্যাবস্থা করছি।

হিমেল কোন কথা না বলে উঠে বসলো। রুশা ড্রাইভারের সাথে প্রয়োজনীয় কিছু কথা বলে নিয়ে বসে পড়লো গাড়িতে। সেলিম সব অটোতে তুলে নিয়ে সেও উঠে বসলো। পানির মধ্য দিয়েই অটো চলতে শুরু করলো। হিমেল ভ্রু কুচকে রাস্তার দিকে দেখছে। রাস্তা দেখা যাচ্ছে না। সে খুব চিন্তিত। এর মধ্যে যদি রাস্তা ভেবে ড্রাইভার অন্যদিকে চলে যায় তাহলে অটো উল্টে পানিতে পড়ে যাবে। সেলিম হিমেলের চিন্তাটা ধরতে পারলো। বলল
–একটু বৃষ্টি হলেই এই রাস্তাটা পানিতে ডুবে যায়। তবে এখানকার অটো ভ্যানের চালকদের রাস্তাটা মুখস্ত। তাই অসুবিধা হয়না।

হিমেল বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল
–এই রাস্তা ঠিক করা হয়না কেন? এর জন্য তো গ্রামের মানুষের অনেক কষ্ট হয়। চেয়ারম্যান এসবের গুরুত্ব দেয়না কেন?

সেলিম কিছুটা অপ্রস্তুত হয়েই বলল
–আসলে আমিই এই গ্রামের চেয়ারম্যান। আমি চেষ্টা করছি বিষয়টা সমাধান করার। রাস্তার ব্যাপারটা আমরা মন্ত্রনালয়ে জানিয়েছি। তবে এই মুহূর্ত আমি বিদ্যুৎ সংযোগের উপরে গুরুত্ব দিচ্ছি বেশী। সেটা হয়ে গেলেই এটা নিয়ে উঠে পড়ে লেগে যাবো।

হিমেল সেলিমকে আপাদমস্তক দেখে নিলো। এতো কম বয়সী চেয়ারম্যান সে আগে কখনো দেখেনি। হুট করেই বিদ্যুৎ সংযোগের কথা মনে পড়তেই বলল
–গ্রামে কি বিদ্যুৎ নেই?

–না। এখনো সংযোগ হয়নি। তবে কাজ চলছে। শীঘ্রই হয়ে যাবে।

–বিদ্যুৎ নেই মানে? লোকজন থাকে কিভাবে? বিদ্যুৎ ছাড়া তাদের কাজ কর্ম হয় কিভাবে? এখন তো সব কিছু বিদ্যুতের উপরেই নির্ভর করে।

সেলিম হতাশ কণ্ঠে বলল
–আসলে সমস্যা যে শুধু বিদ্যুৎ নিয়ে সেটাও নয়। ভেতরে অনেক সমস্যা আছে। সেসব নিয়ে কথা বলতেই আপনাদের আসতে বলা। এসে পড়েছেন যখন সব জানতে পারবেন। এখনো গ্রামের উন্নতি না হওয়ার পেছনে মুলত গ্রামের মানুষের কু’সংস্কার দায়ী। আর সেটার সুযোগ নিয়েই কিছু অ’সাধু লোকজন অ’নৈতিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। তাদের প্ররোচনায় গ্রাম এগিয়ে যেতে পারছে না। এগিয়ে গেলেই তাদের অসুবিধায় পড়তে হবে। আমার বাবা এই গ্রামের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনিই আমাকে এই দায়িত্ব সপে দেন যাতে আমি নিজের বিদ্যা বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে উন্নতি করতে পারি।

হিমেল মনোযোগ দিলো। কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলো
–কি ধরনের অ’পক’র্ম চলে এখানে?

–কি চলেনা সেটা বলেন? খু’ন ধ’র্ষ’ণের মতো জ’ঘন্য কাজও এই গ্রামে হয়। আর চো’রাচা’লানের কথা বাদ দিলাম।

হিমেলের ভ্রু জোড়ায় ভাঁজ পড়লো। চিন্তিত হয়ে বলল
–স্ট্রেঞ্জ! এই রিমোট এরিয়ায় এমন জ’ঘন্য কাজ সম্ভব? আচ্ছা এসব কারা করে?

–আমি বাইরে থেকে পড়াশোনা করেছি তাই তেমন কিছুই জানিনা। তবে আমার মনে হয় গ্রামের অনেকেই জানেন। মুখ খুলতে ভ’য় পায়। তাই আপাতত সবকিছু অজানা ধরেই এগোতে হচ্ছে। আর এমন অনুন্নত গ্রাম বলেই প্র’শাস’নের খুব একটা হস্তক্ষেপ পাওয়া যায়না।

রুশা এতক্ষন ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিল। সব কথাই সে শুনেছে। সেলিমকে জিজ্ঞেস করলো
–অনামিকা হাওলাদার কে? ওনার মেইলে বলেছেন যে দুইদিন আগে নাকি একটা খু’ন হয়েছে। মে’রে’ ফেলার আগে মে’য়েটাকে নাকি রে’প করা হয়েছিলো।

সেলিম ঠোঁট জোড়া ভাঁজ করে একটা শ্বাস ছাড়ল। নিচের দিকে তাকিয়ে বলল
–আমার স্ত্রী। উনিই মেইল করেছিলেন আপনাদের। ঠিকই বলেছেন। মেয়েটা অনেক ভ’দ্র ছিল। ওর সাথে এমন ঘটনা আসলেই অপ্র’ত্যা’শিত।

রুশা গভীর দৃষ্টিতে তাকাল সেলিমের দিকে। কিছু একটা আন্দাজ করে ফেললো তৎক্ষণাৎ। কিন্তু নিজের মুখভঙ্গি স্বাভাবিক রেখেই বলল
–মেয়েটার নাম কি ছিল? ওর ডিটেইল টা যদি একটু বলতেন। তাহলে আমার জন্য বুঝতে সুবিধা হতো।

–আসলে ওর বাড়ির লোকজন ঠিক মতো কিছুই বলতে পারছে না। রাতে নাকি একা একা বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। তারপর আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সকালে লা’শ’ পাওয়া যায় শালবনে।

রুশা কিছুক্ষন ভেবে বলল
–রাতে গ্রামের মেয়ে একা বাইরে যাওয়ার দুটো কারণ থাকতে পারে। হয়তো ওয়াশরুমের কোন সুব্যাবস্থা নেই। অথবা কারো সাথে দেখা করতে যেতে পারে।

কথাটা শুনেই সেলিমের ঝুমের কথা মনে পড়ে গেলো। সে বলেছিল শামিমের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। রুশাও একই রকমের আন্দাজ করছে। তাহলে কি সত্যি? তার ভাবনার মাঝেই এসে পৌঁছল তারা। অটো থেকে নামার আগে সেলিম কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল
–একটা কথা আপনাদের একটু বলে দিতে চাই। আমি বলেছি শহর থেকে আমার এক বন্ধু আর তার স্ত্রী আসছে বেড়াতে। তাই আপনাদেরও নিজেদের স্বামী স্ত্রীর পরিচয় দিতে হবে গ্রামবাসীদের কাছে।

হিমেল আঁতকে উঠে বলল
–হোয়াট? স্বামী স্ত্রী মানে?

রুশা শুকনো ঢোক গিলে ফেললো। এমনিতেই হিমেলকে এক রকম জোর করে এনেছে। তার উপর আবার এই স্বামী স্ত্রীর নাটকের ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো। হিমেল তাকে আস্ত রাখবে না। হিমেল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রুশার দিকে ফেলতেই সে অসহায়ের মতো তাকাল। হিমেল রাগে ফুঁসছে। তার মন চাচ্ছে এখনই এখান থেকে চলে যেতে। রেগে অটো থেকে নেমে গেলো সে। রুশা শুকনো ঢোক গিলে তার পেছন পেছন চলে গেলো। সেলিম নামতেই মতি মেম্বার এসে দাঁড়ালো। এক গাল হেসে বলল
–আইছেন বাজান। আমি মেহমানদের ব্যবস্থা কইরা দিছি। কোন সমস্যা হইব না।

সেলিম মৃদু হেসে বাড়ির দিকে পা বাড়াতেই আবার থেমে গেলো। ঘুরে থমথমে কণ্ঠে বলল
–মেম্বার চাচা শামিম কোথায়?

শামিমের কথা হুট করেই জিজ্ঞেস করায় মেম্বার কিছুটা হকচকাল। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে মৃদু সরে বলল
–হেয় তো শহরে গেছে বাজান। কইছিলাম না চাকরি পাইছে। অইহানেই নাকি থাইকা যাইবে। এইহানে আর আইতে চায়না।

সেলিম উত্তর না দিয়ে চলে গেলো। মেম্বার স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেলিমের দিকে। সেলিমের প্রশন করার ভঙ্গী মতি মেম্বারের কপালে ভাঁজ ফেলে দিলো। এভাবে প্রশ্ন করার কারণটা ঠিক কি হতে পারে?

চলবে…

#বালির নীচে জলের শব্দ
#পর্ব ৩১

গ্রামে ১১ টা মানেই মধ্যরাত। কুকুর গুলোও ক্লান্ত হয়ে যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। দূরে শুধু কতগুলো শেয়ালের ডাক কানে আসছে। আশেপাশে ঝি ঝি পোকার তীব্র শব্দে মাথা ঝিমঝিম করছে। সেলিম রুশা আর হিমেল অনেকটা সময় ধরে গল্প করছে। রাতের খাওয়া শেষ করে তারা গ্রামের যাবতীয় সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছে। রুশা সবকিছু মনোযোগ দিয়ে শুনছে। রাতে আবার এসব নিয়ে তাকে স্টাডি করতে হবে। প্রতিটা পয়েন্ট মাথায় গেথে নিচ্ছে খুব ভালোভাবে। কোন সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম বিষয় যেন ছাড়া না পড়ে। কথা বলার এক পর্যায়ে সেলিম বলল
–আপনারা এখন শুয়ে পড়ুন। বাকি কথা কাল হবে।

সেলিম নিচ তলায় যাবে। সেখানেই সে থাকে। আর দো তলায় দুটো ঘর রুশা আর হিমেলকে দেয়া হয়েছে। দো তোলার বারান্দায় একটা ছোট্ট গোল টেবিল রাখা আছে। সেখানে বসেই চলছিলো তাদের আলাপন। রুশা ফোনটা তুলে বলল
–এখানে কি নেটওয়ার্ক নেই?

সেলিম উঠে দাঁড়িয়ে বলল
–আছে। তবে কিছু কিছু অপারেটর এখানে ঝামেলা করে মাঝে মাঝে। একটু অপেক্ষা করলেই পেয়ে যাবেন।

সেলিম যেতে যেতে বলল
–গুড নাইট। সকালে দেখা হচ্ছে।

–আপনার স্ত্রীর সাথে দেখা হল না যে?

রুশার কথা শুনে সেলিম থেমে গেলো। পেছন ফিরে কিছুটা অসস্তি নিয়ে বলল
–অনেক আগেই ঘুমিয়েছে। সকালে দেখা করিয়ে দেবো।

বলেই চলে গেলো। রুশা কিছুটা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। হিমেল কাঠের রেলিঙ্গ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল। বেশ ফুরফুরে হাওয়া বইছে। মধ্য আকাশে মস্ত চাঁদটা যেন কারো অপেক্ষায় ক্লান্ত। কাউকে দেখার প্রয়াশে নিরন্তর আলো ছড়িয়ে অপেক্ষা করছে। বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে চেপে জ্বালিয়ে নিলো। এক টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে আবারো আকাশের দিকে তাকাল। শুভ্র মেঘ নীলের মাঝে নকশা একেছে যেন। অপার্থিব এক দৃশ্য। কিন্তু এসব কিছুই তার মনে ঠেকছে না। এক সময় এসব দৃশ্য দেখার জন্য মাঝরাতে সে ছাদে উঠত। চোখ জুড়িয়ে সেসব দৃশ্য দেখত। কিন্তু এখন এসব ফিকে মনে হয়। কিছুই আর আগের মতো মনে ধরেনা। ভেতরে এক রকম শুন্যতা জেঁকে বসেছে। কারো অপেক্ষায় কাতর হয়ে উঠেছে হৃদয়। কাউকে এক পলক দেখার আশায় ভেতরটা কেমন হাঁসফাঁস করে ওঠে। দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নেয়। রুশা হিমেলের পাশে রেলিঙ্গে হালকা ভর দিয়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ সন্দিহান কণ্ঠে বলল
–এই চেয়ারম্যান কে একটু নজরে রাখতে হবে। কিছু কিছু আচরন সন্দিহান।

হিমেল সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে রুশার দিকে ভ্রু কুচকে তাকাল। বলল
–তোমার এই সন্দেহ বাতিক বন্ধ করো। লোকটা ভালো। আমার কাছে এমন কিছু মনে হয়নি।

রুশা হিমেলের কথাটা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বলল
–আমি ক্রিমিনাল সাইকলজি নিয়ে পড়েছি। মানুষের আচরন দেখেই আন্দাজ করে ফেলতে পারি তার কথার সত্যতা কতটুকু।

হিমেল তাচ্ছিল্য হেসে বলল
–কি বুঝলে? মিথ্যা কথা বলছে?

–সব কথা মিথ্যা না। তবে কিছু একটা লুকাতে চেষ্টা করছে। যেটা আমাদের কাছ থেকে লুকানোর ব্যাপারে তার মনের কাছ থেকেও ঠিকঠাক সিগনাল পাচ্ছে না। গোছানো কথাগুলো কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

হিমেল হতাশ গলায় বলল
–তোমার এইসব অদ্ভুত কথা আমার মাথায় ঢুকছে না। আমাকে একটু একা থাকতে দাও।

রুশা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল। হিমেল একা থাকতে চাওয়া মানেই তার অতীতের স্মৃতি চারন করবে মনে মনে। নিজের কষ্ট কাউকে দেখায় না সে। একা একাই দুঃখ বিলাশ করে। তাকে আর না ঘাটিয়ে রুশা চলে গেলো ঘরে। সে এখন মনোযোগ দিয়ে স্টাডি করবে। কোন একটা ক্লু খুঁজে বের করবে। তারপর সকালে উঠে তার প্রথম কাজ হবে এই চেয়ারম্যান তার কাছ থেকে কি লুকাচ্ছে সেটা খুঁজে বের করা। হিমেল একটা সিগারেট শেষ করে আরেকটা সিগারেট জ্বালালো। বুকটা ভারী হয়ে আসছে। অনেকদিন গলায় সুর আসেনা। আজ কেন জানি মন খুলে গাইতে ইচ্ছা করছে। ইচ্ছাটাকে দমিয়ে রাখল না। গলায় সেই পুরাতন আঙ্গিকে সুর তুলে ফেললো। গাইল গলা ছেড়ে।

আমার ক্লান্ত মন, ঘর খুজেছে যখন
আমি চাইতাম, পেতে চাইতাম
শুধু তোমার টেলিফোন।
ঘর ভরা দুপুর, আমার একলা থাকার সুর
রোদ গাইত, আমি ভাবতাম
তুমি কোথায় কতদুর?
আমার বেসুর গিটার সুর বেঁধেছে
তোমার কাছে এসে
শুধু তোমায় ভালবেসে।
আমার একলা আকাশ চাঁদ চিনেছে
তোমার হাসি হেসে
শুধু তোমায় ভালবেসে।

গানটা থেমে যেতেই নিচের তলায় কেউ ছুটে বেরল ঘর থেকে। দরজায় দাঁড়াতেই দেখা হল সেলিমের সাথে। অস্থির ভাবে শ্বাস পড়ছে। ঘেমে উঠেছে মুখশ্রী। সেলিম ঘাবড়ে গেলো। বলল
–কি হয়েছে? আপনি ঠিক আছেন তো?

রমণীটি শাড়ির আঁচলে নিজের মুখ মুছে হাঁসফাঁস করে উঠে বলল
–কে গান গাইছে?

সেলিম স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–শহর থেকে যারা এসেছেন। ওনারাই উপরে গান বাজনা করছেন। কেন? ডিস্টার্ব হচ্ছে আপনার?

অস্থিরতাটা কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারলো না মেয়েটি। অস্থির শ্বাস ফেলে বলল
–ওনারা কোথা থেকে এসেছেন? ওনাদের পরিচয় কি?

সেলিম কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল
–আপনি নিজেই মেইল করে ডেকেছেন তাদেরকে। আর এখন নাম পরিচয় আমাকে জিজ্ঞেস করছেন? আপনি জানেন না? কাকে ডেকেছেন? আচ্ছা আদৌ এরা ঠিক মানুষ তো?

মেয়েটি হতবিহবল হয়ে তাকাল। মাথার ভেতরে যন্ত্রণাটা বেড়ে যাচ্ছে। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল
–আমি তো এন জি ওতে মেইল করেছিলাম। ওনারা কাকে পাঠিয়েছেন আমি নাম ঠিকানা এখনো জানিনা। ওনাদের ফিরতি মেইলটা চেক করা হয়নি। চেক করলেই জানতে পারবো।

–ঠিক আছে। চেক করে সিওর হয়ে নেবেন। আমাকেও জানিয়ে দেবেন। এখন শুয়ে পড়ুন। অনেক রাত হয়েছে।

মেয়েটি মাথা নাড়িয়ে ঘরের দিকে গেলো। সেলিমও নিজের ঘরে চলে গেলো। ঘরে গেলেও মেয়েটি স্থির হয়ে থাকতে পারলো না। বুকটা ভারী হয়ে আসছে। চোখ গুলো জ্বালা করছে। কেমন ছন্নছাড়া মনে হচ্ছে সবকিছু। ঘরে কিছুতেই থাকতে পারলো না। বের হয়ে চলে গেলো দো তলায়। পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এদিক সেদিক তাকাল। কাউকে দেখতে পেলো না। পুরোটা ফাঁকা। আরও একটু এগিয়ে গিয়ে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো। আকাশের দিকে দৃষ্টি স্থির করতেই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো পানি। ফুপিয়ে কেঁদে উঠতেই রুশার কানে আওয়াজ আসলো। কান খাড়া করে ফেললো সে। তার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কেউ কাঁদছে। কিছুটা সময় নিয়ে নিঃশব্দে দরজা খুলল। সামনেই একটা মেয়েকে আকাশের দিকে উদাসীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে অনেকটা অবাক হল। হা করে থেকেই কেটে গেলো কিছু সময়। কৌতূহল মস্তিস্কে ভিড় করতেই চাপা সরে বলল
–কে?

চমকে তাকাল মেয়েটি। ভয়ে মুখখানা শুকিয়ে গেছে। চোখে পানি চিকচিক করছে। শুকনো ঢোক গিলে চোখের পানিটা মুছে নিতেই রুশা আবারো বলল
–কে আপনি?

–অনামিকা। অনামিকা হাওলাদার।

গলা অস্বাভাবিক কেঁপে উঠলো মেয়েটির। কয়েক মুহূর্ত নীরবে কেটে গেলো। রুশার জহুরি দৃষ্টির আগে টিকতে না পেরে অনামিকা মৃদু সরে বলল
–আমি আসছি।

রুশা বাধ সাধল। বলল
–আপনিই তো মেইল করেছিলেন? আপনার সাথে একটু পরিচিত হই। ঘরে আসুন।

অনামিকা ভদ্রতা দেখাতে গিয়ে ঘরে গেলো। রুশা বিছানায় বসতে দিলো। অনামিকার আচরণে অস্থিরতা। রুশা পাশে বসে বলল
–আপনি সেলিম সাহেবের স্ত্রী তাই না?

অনামিকা চমকিত দৃষ্টিতে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল
–জি।

রুশা দুর্বোধ্য হাসল। তার চোখে মুখে অস্থির রহস্য খেলে গেলো। অনামিকা নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ তুলে তাকাল। বলল
–কে গান গাইছিল?

–আমার হাসবেন্ড। হিমেল। খুব ভালো গান গায়।

ভেতরটা কেঁপে উঠলো অনামিকার। তীব্র ব্যাথায় হৃদপিণ্ডটা ছটফট করে উঠলো। দম বন্ধ হয়ে আসছে। ঘেমে একাকার হতেই রুশা বলল
–আপনার খারাপ লাগছে?

পানির গ্লাস সামনে ধরে বলল
–পানি খান।

চোখের পানি ফেলে মেয়েটি বলল
–আমি নিজের ঘরে যাবো।

বলেই চলে গেলো। রুশা অবাক হল। এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ কি হতে পারে? কিছু সময় ভেবে বাঁকা হাসল। তার জহুরির চোখ যে কোন ভুল করেনি। তবে চেয়ারম্যানের রহস্য এতো তাড়াতাড়ি যে খোলাসা হয়ে যাবে সেটা ভাবতে পারেনি। সকাল অব্দি অপেক্ষা করতে হল না তাকে।

———–
রাতে অনেক দেরিতে ঘুমানোর কারণে রুশার ঘুম ভাংতে দেরি হয়ে গেলো। ঘুম থেকে উঠেই হিমেলকে খুঁজে বেড়াতে লাগলো সে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য তাকে দেয়ার আছে। কিন্তু কোথাও হিমেলের কোন খবর না পেয়ে ছুটে গেলো বাইরে। এদিক সেদিক ঘুরতে গিয়ে চোখে পড়লো সেলিমকে। গাছের আড়ালে এক মেয়ের সাথে কথা বলছে। অল্প সময়ের মধ্যেই দুজনকে জহুরি চোখে পরখ করে নিলো। দুজনের কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে এতটুকু আন্দাজ করা সম্ভব যে তাদের মাঝে কোন সম্পর্ক আছে। আর মেয়েটা এই গ্রামেরই। সেলিম কথা শেষ করে চলে গেলো সেখান থেকে। রুশা দ্রুত এগিয়ে গিয়ে মেয়েটাকে ডাকল। পেছন ফিরে রুশাকে দেখে মেয়েটি বেশ অবাক হল। বুঝে গেলো চেয়ারম্যান বাড়ির অতিথি। এগিয়ে এসে রুশাকে সালাম দিলো। রুশা সালামের জবাব দিয়ে বলল
–তোমার নাম কি?

–ঝুম।

–বাহ! তোমার বাড়ি কোথায়?

–অইহানে।

আঙ্গুল তাক করে দেখায়ে দিলো ঝুম। রুশা আঙ্গুল তাক করে দেখে নিয়ে ঝুম কে আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করে বলল
–সেলিম সাহেবের স্ত্রীকে দেখেছো? ওনাকে খুঁজে পাচ্ছি না। একটু দরকার ছিল।

ঝুম হা করে তাকাল। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে খিলখিল করে হেসে উঠলো। হাসি থামিয়ে বলল
–কি কইতাছেন আপনে? হের তো বিয়াই হয়নি। বউ আসবো কেমনে?

রুশার ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসি। তার আন্দাজ মতো সমস্ত সমীকরণ মিলে গেলো। তবুও বলল
–বিয়ে হয়নি ওনার? কিন্তু…

ঝুম সম্পূর্ণ কথা শুনল না। তার আগেই গলার চেনটা তুলে ধরে বলল
–এইডা দেখেন। হের লগে আমার বিয়া ঠিক হইয়া আছে। রশিদ কাকা সারলেই আমাগো বিয়া।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here