#ফ্ল্যাট_নাম্বার_নয়_ছয়পর্বঃ ২১

0
372

#ফ্ল্যাট_নাম্বার_নয়_ছয়পর্বঃ ২১

#Lamyea_Chowdhury
নক্ষত্র তড়িঘড়ি করে ক্যাম্পাস ত্যাগ করল। বিপাশাকে তো সে কোনোদিন কিছু বলেনি!তাহলে বিপাশা বুঝল কি করে? প্রহর কি কিছু বলেছে? না, না প্রহর কি করে বলবে? নক্ষত্রের মনের খবর প্রহরেরই তো অজানা। নক্ষত্র ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। সে চায় কেউ’ই তার মনের খবর না জানুক। সব ভালোবাসা প্রকাশ করতে নেই। কিছু কিছু ভালোবাসা দমিয়ে রাখতে হয়। নতুবা, সেই ভালোবাসা গোলাবারুদ হয়ে আশপাশ ছারখার করে দেয়। নক্ষত্র খুব ভালো করেই জানে তার এই বাল্যপ্রেম সম্পর্কে জানাজানি হলে চারিদিকে দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে শুরু করবে। তার মা এবং ফুফুর মধ্যকার দ্বন্দ্ব আরো বেড়ে যাবে। মাঝখান থেকে শায়েরীকে সেই কষ্ট ভোগ করতে করতে অঙ্গার হতে হবে। নক্ষত্রের সাথে বিয়ে হলে শায়েরী কখনো সুখী হতে পারবে না। তাই তো যেদিন থেকে সে বুঝতে পেরেছে শায়েরীর জন্য তার বুকের বাম পাশের হৃদযন্ত্রের বেহাল দশা, চোখে তার তীব্র নেশা সেদিন থেকেই নিজেকে শায়েরীর কাছ থেকে গুটিয়ে নিয়েছে। তখন বয়সটা ছিল খুব কম। ভেবেছিল অল্প বয়সের চাহিদা কিংবা ভুল। কিন্তু, যতই বয়স বাড়তে লাগলো ততই সেই ভুল অদম্য এবং বলিষ্ঠ শূল হয়ে নক্ষত্রের হৃদয় খুঁড়ে খুঁড়ে শায়েরীর নাম পাকাপোক্তভাবে খোদাই করে দিতে লাগলো। চূড়ান্ত সিলমোহর হিসেবে যে ঘটনাটা দায়ী ছিল, আজও সেই ঘটনায় নক্ষত্রের শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, ঠোঁট শুকিয়ে যায়, দেহ, মন দুটোই বিবশ হয়ে পড়ে। বুকের মাঝে কিছু একটা শাঁ শাঁ করে তীব্র তৃষ্ণা জাগায়। শায়েরীকে নিজের করে পাবার তৃষ্ণা, পুরোপুরিভাবে নিজেকে, নিজের বাক্সবন্দী করে রাখা আড়ালকৃত ভালোবাসাকে শায়েরীর সামনে মেলে ধরার তৃষ্ণা! একছুটে গিয়ে শায়েরীকে বলে দিতে ইচ্ছে করে, তুমি শুধুমাত্র আমার বউ হবে শায়েরী, শুধুমাত্র আমার বউ হবে। তোমাকে আমি মন ভরে দেখবো। তুমি শুধু আমার জন্য মিষ্টি করে হাসবে। আমার জন্য রাঁধবে, আমার জন্য সাজবে। এমনকি কাঁদবেও আমার জন্যই। নক্ষত্রের সেদিনকার দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই সে শিউরে উঠল। জোর করে অন্যদিকে মন ঘুরাতে মায়ের অফিসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। তার কঠোর এবং বজ্রকঠিন মায়ের মুখখানা দেখলেই শায়েরীকে নিয়ে সকল ভাবনা দপ করে নিভে যাবে।

নশ্বর এই পৃথিবীতে ভালোবেসে সেই ভালোবাসা মনের গহীনে লুকিয়ে রাখার চেয়ে তীব্র কষ্টের আর কিছুই নেই। সে চায় শায়েরীকে আড়াল থেকে ভালোবেসে যেতে। ভালোবাসা প্রকাশ করবার চেয়ে ভালোবাসা লুকিয়ে রাখা বেশি কঠিন। নক্ষত্র তার এই বাল্যপ্রেম লুকিয়ে রাখতে রাখতেই শক্ত সামর্থ্য যুবক হয়ে উঠেছে কিন্তু, প্রতি রাতে তার অবচেতন মন আল্লাহর কাছে শিশুর মতন ফরিয়াদ করে বলে, আল্লাহ্ আমার ভাগ্যে তুমি শায়েরীকে লিখে দাও। আমার তাকে চাই। ভালো থাকতে হলেও তাকে চাই, আবার মন্দ থাকতে হলেও তাকেই চাই। একটা চমৎকার এবং অলৌকিক ঘটনার জন্য অদৃশ্য কান্নারা সব বুকের মাঝে দীর্ঘশ্বাস হয়ে আটকে থাকে। নক্ষত্র সেই কষ্টের দলা বুকে করে শায়েরীকে স্বপ্নে কাছে পাবার তীব্র স্পৃহা আর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে নিশ্চুপ ঘুমিয়ে পড়ে। প্রতিরাতে সে ঠিকঠিক শায়েরীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেও। স্বপ্নে শায়েরী একটা আটপৌরে শাড়ি পরে সংসারের নানান কাজে তুমুল ব্যস্ত মানুষ। তার দম ফেলবার সুযোগটা পর্যন্ত নেই। কখনো সে রুটি বেলতে ব্যস্ত, কখনো বা বিছানা থেকে মশারি তুলতে। বাস্তব জগতের শায়েরীর মত স্বপ্নের শায়েরীর বিস্তর তফাৎ। বাস্তবিক শায়েরী যত বেশি সহিষ্ণু, স্বপ্নের শায়েরী তত বেশি অগ্নিশর্মা। রাগে গজগজ করতে করতে কখনো সে নক্ষত্রের দিকে বেলনা ছুঁড়ে মারে, কখনোবা এটাসেটা বলে গালাগাল করে। কিন্তু, নক্ষত্রের সেই গালাগাল শুনতেই বেশি ভালো লাগে। মনে হয়, এরচেয়ে শ্রুতিমধুর, হৃদয় নিঙরানো কথা যেন সে তার জীবনেও শুনেনি। কেননা, শায়েরী তখন আর নক্ষত্র ভাই বলে না। শুধু নক্ষত্র বলেই চেঁচামেচি করে। নক্ষত্রের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। হাত খোঁপা করা, ঘর্মাক্ত অবস্হায় কাজ করতে করতে হাঁপাতে থাকা সেই শায়েরীকে নক্ষত্রের খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়। নক্ষত্র আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর শায়েরী নামক বিশাল যন্ত্রণাকে ভুলতে মায়ের কাছে যায়। কিন্তু, তার মা তাসলিমা তখন জরুরি মিটিং এ ব্যস্ত থাকায় সে বাবার কেবিনে গিয়ে বসলো। নক্ষত্রের বাবা সামজিদ হোসেন ঠাণ্ডা প্রকৃতির মানুষ। কারো সাথে বেশি একটা কথা বলেন না, কেউ কিছু বললেও প্রয়োজন ছাড়া খুব বেশিকিছু বলেন না। সবসময় সকল ধরনের ঝামেলা থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। কারো সাতে পাঁচে না থাকা সামজিদ হোসেনের সাথে তাঁর ছেলেমেয়েরও কেমন নিস্তরঙ্গ, নিস্তেজ সম্পর্ক। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে ছেলেমেয়ে দুটো বাবার কাছে ধারে খুব একটা ঘেঁষে না। তাই নক্ষত্রকে তাঁর কেবিনে দেখে ভিতরে ভিতরে তিনি খানিক ভড়কে গেলেন। কিন্তু, চেহারায় তা প্রকাশ করলেন না। বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠেই বললেন, “কি খবর আব্বু?”
নক্ষত্র ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল, “ভালো বাবা। তুমি কি খুব বেশি ব্যস্ত?”
সামজিদ হোসেন হাতের ফাইলটা বন্ধ করতে করতে বললেন, “ব্যস্ততা তো থাকবেই। তুমি তোমার খবর বলো। তোমার পড়াশুনার কি হালচাল?”
নক্ষত্র চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, “এই তো সামনেই ফাইনাল ইয়ারে উঠব।”
সামজিদ হোসেন মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “বেশ! বেশ! বড় হয়ে যাচ্ছ।”
নক্ষত্রের হঠাৎ করে তার বাবাকে খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু, ইচ্ছেপূরণ না করে সে নিজ জায়গায় স্হির বসে রইল। সামজিদ হোসেন ফাইল নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর হাতের ফাইলটা ড্রয়ারে রেখে পা বাড়ালেন কফি মেইকারের দিকে। সামজিদ হোসেন কফিপ্রিয় মানুষ। যখন তখন তার কফি খেতে ইচ্ছে জাগে। তিনি আবার নিজের কাজ নিজে করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তাই সুবিধার জন্য কেবিনেই কফিমেকার রেখে দিয়েছেন। নিজের জন্য আর ছেলের জন্য কফি তৈরী করতে করতে বললেন, “তা পাশ করার পর কি করবে ভেবেছো?”
নক্ষত্র হাতের নখ খুটতে খুটতে বলল, “এখনও কিছু ভাবিনি। দেখি মা কি বলে! মা যেটা বলবে সেটাই করব।”
সামজিদ হোসেনের কফি তৈরী করা হয়ে গেছে। তিনি মগে কফি ঢালতে ঢালতে বললেন, “তোমরা তোমাদের মাকে বেশি ভয় পাও নাকি আমাকে বেশি ভয় পাও বলোতো?”
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here