#বিষাক্তফুলের_আসক্তিপর্ব-০১

0
878

#বিষাক্তফুলের_আসক্তিপর্ব-০১
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা

বিয়ের আসরে কনে প্রেগনেন্সির রিপোর্ট হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। না না রিপোর্টটা কিন্তু তার নয়। রিপোর্টটা বিয়ের আসরে হাজির হয়ে বরের প্রেমিকা দাবি করা মেয়েটার। আশেপাশের এতো সেলিব্রিটি আর মিডিয়ার হইচই কিছুই কানে যাচ্ছে না মৌয়ের। রিপোর্টে পজিটিভ লেখাটা জ্বলজ্বল করছে চোখের সামনে। একজন ডাক্তার হওয়ার দরুন রিপোর্টটা ফেইক নয় সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না মৌয়ের। জলে টইটম্বুর চোখে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বর বেশের ছোটবেলার প্রিয় বন্ধু, কিশোরী মনের প্রথম মুগ্ধতা, প্রথম প্রেম আর মনের কোণে লুকানো গভীর ভালোবাসার মানুষটার দিকে তাকালো। চিরচেনা মানুষটাকে আজ বড্ড বেশি অচেনা লাগছে।

এসব কী তাজ ?

তাজ রাগী গলায় বললো, আমিও তো সেটাই জানতে চাইছি এসবের মানে কী ?

তাজের বাবা ইকবাল খান রক্তবর্ণ চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে সজোরে থাপ্পড় লাগিয়ে দিলো ছেলের গালে। এতক্ষণের অশান্ত পরিবেশ এক নিমিষেই শান্ত হয়ে গেলো একটা থাপ্পড়ের আওয়াজে।

বর্তমানে দুই বাংলার মানুষের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় মুখ সুপারস্টার তাজওয়ার খান তাজ। চলচ্চিত্র জগতে পদার্পণ করেছে বছর পাঁচেক হয়েছে কিন্তু জনপ্রিয়তা তার তুঙ্গে আর সে দাঁড়িয়ে আছে সফলতার চূড়ায়। ৬ ফুট উচ্চতার ছেলেটা যেমন হ্যান্ডসাম দেখতে, তেমনই তার আকর্ষণীয় পার্সোনালিটি, সাথে আছে মনোমুগ্ধকর গানের গলা আর অভিনয় দক্ষতা। এতেই দুই বাংলার মানুষের মনে জায়গা করেছে গভীরভাবে। হাজারো তরুণীর স্বপ্ন পুরুষ আজ সবার মন ভেঙে বিয়ের পিড়িতে বসেছিলো বাবার অনুরোধে। পাত্রী তারই ছোটবেলার বান্ধবী মৌমিতা রহমান। কাজী কেবলই তাজকে কবুল বলতে বলেছে তখনই মেয়েলি কণ্ঠে সবাই থমকে গেলো।

এই বিয়ে হবে না কাজী সাহেব ?

গলার আওয়াজ অনুসরণ করে সামনে তাকিয়ে নিজের ম্যানেজার মিস মুসকান মাহমুদ তিতিরকে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলো তাজ। তিতির তার নিজের ব্যক্তিগত গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা বলে বিয়ের কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেনি। তাজের প্রফেশনাল লাইফের বড় একটা দ্বায়িত্ব সামলায় তিতির। আজ দু’বছর ধরেই সেই কাজ করে আসছে। সে কেনো হঠাৎ তাজের বিয়ে আটকাচ্ছে কেউ বুঝতে পারছে না।

তাজ ভ্রু কুঁচকে বললো, এসব কী বলছো তুমি তিতির ?

তিতির রোবটের মতো বললো, আপনি এই বিয়ে করতে পারেন না স্যার ?

তাজ এবার রাগী গলায় বললো, But why Titir ?

তিতির পূর্বের ন্যায় বললো, আপনি এভাবে আমাকে ধোঁকা দিতে পারেন না স্যার।

তাজ অবাক আর বিস্মিত গলায় বললো, What are you talking nonsense ?

ইতিমধ্যে পুরো বিয়ের আসরে নানা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে। সবাই নিজেদের মধ্যে নানা রকম কথাবার্তা বলে চলেছে। মৌমিতা আর চুপ করে থাকতে পারলো না এবার।

কাঁপা গলায় বললো, এসবের মানে কী তিতির ? কেনো এসব বলছো তুমি ?

তিতির বরাবরের মতোই যান্ত্রিক গলায় বললো, স্যারের সাথে আমার এক বছরের সম্পর্ক। আমি স্যারের সন্তানের মা হতে চলেছি। এই বিয়ে হলে আমি আমাদের সন্তানকে কার পরিচয়ে বড় করে তুলবো ?

তিতিরের কথা শুনে সবার মাথায় বাজ পড়ার মতো অবস্থা। মৌ দুই কদম পিছিয়ে গেলো তিতিরের কথা শুনে। বাকি সবাই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তিতিরের কথা বুঝতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে সবার।

তাজ হতবিহ্বল হয়ে চেঁচিয়ে বললো, What ?

তিতির নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ যেনো অনুভূতিহীন কোনো জড়পদার্থ সে। একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে নিজের ব্যাগ থেকে প্রেগনেন্সি রিপোর্ট বের করে তাজের দিকে এগিয়ে দিলে মৌ খপ করে নিয়ে যায় সেটা। তারপরেই উপরিউক্ত ঘটনা ঘটে গেছে।

ইকবাল খান রাগে দাঁত খিঁচিয়ে বললো, এজন্যই আমি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি এতটা ঘৃণা করি। এজন্যই আমি বারবার নিষেধ করেছিলাম। বলেছিলাম তোমাকে এই নোংরা জগতে পা রেখো না। কিন্তু তুমি আমার কথা একবারের জন্যেও গুরুত্ব দাওনি। নর্দমায় নামলে গায়ে সেই নর্দমা আবর্জনা লাগবে এটা অস্বাভাবিক আর কী ? তুমি আমার ছেলে এটা ভাবতেই লজ্জায়, ঘৃণায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে আমার।

তাজ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নিজের বাবার দিকে। এটা তারই বাবা তো ? যে বাবা কখনো তার গায়ে ফুলের টোকা দেয়নি সেই বাবা আজ সারাদেশের মানুষের সামনে তাকে থাপ্পড় মারলো। নিউজ চ্যানেলগুলো সরাসরি সম্প্রচার করছে এই অনুষ্ঠানের সব নিউজ। তাজ নিজের বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারছে না। কী হচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না এই মুহুর্তে, মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। পাঁচ বছর ধরে একটু একটু করে কুড়ানো সম্মান, ভালোবাসা সবই আজ মাটির সাথে মিশে গেছে এক নিমিষেই।

তাজ ভাঙা গলায় বললো, সবকিছু মিথ্যা। She is lying.

মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছে তিতির। মৌ পাথরের মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। মৌকে আগলে ধরে রেখেছে তার মা।

তাজ এবার চিৎকার করে বললো, সব মিথ্যা। ওর বলা প্রত্যেকটা শব্দ মিথ্যা।

তিতির মনে মনে বললো, আমাকে মাফ করবেন স্যার। আমার যে কিছুই করার নেই আজ। সময় আমাকে স্বার্থপর হতে বাধ্য করছে।

তিতির নিজের ব্যাগ থেকে আরো কিছু প্রমাণ বের করে সামনের টেবিলে রাখলো। আপাতত যেখানে তাজ আর মৌয়ের বিয়ের চকচকে সাদা কাগজের কাবিনখানা রয়েছে। শুধু সাইন করা হয়ে উঠেনি কারো। তিতিরের প্রমাণগুলোর মধ্যে অনেকগুলো ছবি, যেখানে হাসোজ্জল কিছু ছবি তিতির আর তাজের। দেখে কারো বুঝতে অসুবিধা হবে না তারা সুখী কাপল, কারণ ছবিগুলো তেমন পোজে তোলা, একটা মোবাইল, যাতে আছে কিছু কল রেকর্ড আর ভিডিও ক্লিপ। মৌ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছবিগুলোর দিকে। কেউ আর বাকি প্রমাণ যাচাই করে দেখার আগ্রহ দেখালো না। দেখার মতো মানসিক অবস্থাও নেই কারো এখন। তাজ তাকিয়ে আছে তিতিরের দিকে আর তিতির নিজের দৃষ্টি মাটিতেই আবদ্ধ রেখেছে। তিতিরের যে আজ তাজের চোখে চোখ রাখার সাহস নেই, যদিও আগেও কোনোদিন ছিলো না। তবে আজকের পর আর কোনোদিনই হয়তো সেই সাহস আর হয়ে উঠবে না। আর তাজ তিতিরকে চিনতে পারছে না আজ। তার সমানে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার মাঝে গত দুই বছরের চেনা তিতিরকে খোঁজে পাচ্ছে না। এদিকে পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। তাজ আর ইকবাল খানের সব গার্ড মিলেও প্রেস মিডিয়া কন্ট্রোল করতে পারছে না৷ তারা নানারকম প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে তিতির আর তাজের দিকে। ইতিমধ্যে নিজেদের মনগড়া কাহিনী বানিয়ে প্রচার করাও হয়ে গেছে।

ইকবাল খান পরিস্থিতি সামলাতে বললো, তাজের বিয়ে হবে আর সেটা আজ আর এখনই। তবে মৌমিতার সাথে নয় তিতিরের সাথে।

ইকবাল খানের এক কথায় সকলেই তাকালো তার দিকে, একমাত্র তিতির ছাড়া। তাজ তাকিয়ে আছে নিজের বাবার দিকে। মৌমিতা আর এতোটা সহ্য করতে পারলো না সেন্সলেস হয়ে নেতিয়ে পড়লো।

২.
সুপারস্টার তাজওয়ার খান তাজের স্ত্রী হয়ে খুব আনন্দ হচ্ছে মিস তিতির উপস সরি মিসেস তিতির, উপফে মিসেস তাজওয়ার খান তাজ।

তাজের রুমের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছিলো তিতির। ভাবছিলো কী থেকে কী করে ফেললো আজ সে ? তখনই তাজের মাতাল কণ্ঠে কেঁপে উঠলো তিতির। ভয়ে হাত-পা জমে আসছে তার। তার জানা মতে তাজ কখনো ড্রিংস করে না, তবে আজ ?

তাজ তিতিরের কাঁধ ধরে এক ঝটকায় নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো।

গাল চেপে ধরে বললো, কেনো করলে এমন ? কী ক্ষতি করেছিলাম আমি তোমার ?

তাজ এতো শক্ত করে গাল ধরেছে তিতিরের মনে হচ্ছে দাঁত ও ভেঙে ভেতরে ঢুকে যাবে। তবু তিতির একটা আওয়াজও করলো না। চোখ বন্ধ করে ব্যাথা সহ্য করতে লাগলো।

তাজ আবার বললো, সোনার চামচে খেয়ে বড় হয়েছে এই তাজওয়ার খান তাজ। খান গ্রুপ অব কোম্পানির একমাত্র উত্তরাধিকারী। এই সবকিছু ফেলে নিজের স্বপ্ন পুরণের পিছনে ছুটেছে এই তাজ। পাঁচ বছরে নিজের বাবার পরিচয়ের বাইরে আলাদা একটা পরিচয় তৈরি করেছে একটু একটু করে। স্বপ্ন পূরণের স্বাদ যখন উপভোগ করার সময় এসেছে ঠিক তখনই এক মিনিটে তুই সব মাটির সাথে মিশিয়ে ফেললি। যে তাজ বলতে মেয়েটা পাগল ছিলো তারাই আজ তাকে ছি ছি করছে। একটা অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য যারা হুমড়ি খেয়ে পড়তো তারাই ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে আজ।

তাজ এবার তিতিরের গলা টিপে ধরে বললো, সবকিছু হয়েছে শুধুমাত্র তোর জন্য। আমার বাবা-মাও আমাকে ভুল বুঝেছে শুধুমাত্র তোর জন্য।

দম বন্ধ হয়ে আসছে তিতিরের। তবে কী আজই তার জীবনের শেষ দিন ? কিন্তু তার তো এখনই মরলে চলবে না। যার জন্য সে এতোটা স্বার্থপর হয়ে তাজকে ধ্বংস করে দিলো, তিতির মরে গেলে তার কী হবে ? এই পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম মানুষগুলো তো শিয়াল শকুনের মতো ছিঁড়ে খাবে অবুঝ প্রাণটাকে। না না তিতিরকে বাঁচতে হবে, নিজের জন্য নয় সেই প্রাণটার জন্য হলেও আজ নিজের প্রাণ বাঁচাতে হবে।

চলবে,,,,?

নতুন গল্প কেমন হয়েছে জানাতে ভুলবেন না। আশা করি বরাবরের মতো পাশে থাকবেন সবাই। যাদের ভালো না লাগে এড়িয়ে যাবেন তবে দয়া করে বাজে মন্তব্য করবেন না। সবার সব জিনিস ভালো লাগবে এমন কোনো কথা নেই। কারো পছন্দ নাই হতে পারে তার মানে এই না আপনি বাজে মন্তব্য করবেন। যাদের ভালো লাগে তারা পাশে থাকবেন। হ্যাপি রিডিং, আল্লাহ হাফেজ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here