অবেলার পুষ্প পর্ব-৭

0
298

#বড়গল্প
#অবেলার_পুষ্প
#পর্ব_৭

ষষ্ঠ পর্বের পরে…

আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে শাকিল আর ওর মা দুজনেই তাকালেন দেওয়ালে সাজানো সারিবদ্ধ ছবিগুলোর এক কোনায় আলগোছে উঁকি মেরে থাকা একটা ছবির দিকে।

আজ সকালে এসে যখন এখানে বসেছিলাম, তখন এই ছবিটা আমার নজরে পড়েনি। এখন খেয়াল করতেই চমকে উঠলাম। ছবিতে আমি আর আর আমার সৎভাই। আমার বয়স বড়জোর আট নয় বছর। বড়ভাই তখন তরুণ যুবা।

হতবিহবল হয়ে ছবিটির দিকে তাকিয়ে আছি আমি। মনের মধ্যে নানারকম হিসাব নিকাশ শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। আমার এখানে এভাবে হুট করে আসা, এই বাড়িতে পা দেওয়ার পর থেকেই চেনা চেনা একটা অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হওয়া, সবকিছুর মাঝে পরিচিত অথচ খুঁজে না পাওয়া অপরিচিত একটি সুর বাজতে থাকা… আমাকে যেন কিছু একটা মনে করিয়ে দিতে চাইছিল। এমনকি আমার বন্ধু রায়হানকে ফোনে না পাওয়ার মাঝেও আমার মনটা অন্যরকম একটা সম্ভাবনার আলোতে দুলছিল। রায়হান কি জেনেশুনেই আমাকে এই বাড়িতে পাঠিয়েছে? আমার সাথে তো ওর এমন করার কথা নয়! নিশ্চয়ই কিছু একটা ভেবেচিন্তেই সে আমাকে এখানে পাঠিয়েছে! কিন্তু কী সেই বিশেষ কারণ যে আমাকে একা পাঠানো এত জরুরি হয়ে পড়েছিল? ও নিজেও তো আমার সঙ্গে আসতে পারতো! নিজের বিয়ের কথা বলেই বা আমাকে পাঠানোর কী দরকার ছিল!

শত শত প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে চলছিলাম। কিন্তু কোনো উত্তরেই ঠিক যেন সন্তুষ্ট হতে পারছিলাম না।
এখন এই ছবিটার দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে গেল আমার কাছে।
এই ছবিটা যদি রায়হান দেখে থাকে, তাহলে তো অনেক রহস্যই খোলাসা হয়ে যায়। কারণ আমার কাছে রায়হান এই ছবি দেখেছে। আমার আপনজনবিহীন জীবনে এই ছবিটাই ছিল একসময় একমাত্র সম্ভব। মা-বাবার সাথে আমার খুব বেশি ছবি নেই। দুটো হলুদ হয়ে যাওয়া ছবির একটিতে দুই তিন বছরের আমি মায়ের কোলে। আরেকটি ছবিতে মা-বাবার সাথে বসে আছি তাদের মধ্যমণি হয়ে। সেটাতেও আমার বয়স দুই তিন বছরের বেশি না। আর দুটো ছবিই স্টুডিওতে গিয়ে তোলা।

শুধু আমার সৎভাইয়ের সাথে স্টুডিওর বাইরে কিছু ছবি তুলেছিলাম, সৌখীন বড়ভাইয়ের কেনা সাধের ইয়াশিকা ক্যামেরাতে। এখানে যে ছবিটা আছে, এটি সেগুলোরই একটি। কিন্তু কথা হচ্ছে এই ছবিটি এখানে কী করছে? এদের পারিবারিক ছবির সংগ্রহে আমি আর আমার ভাইয়ের স্থান কেন হয়েছে? তবে কী…!

শাকিল আর তার মায়ের চোখও ততক্ষণে ছবিটার দিকে পড়েছে। শাকিল ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে আবার আমার দিকে তাকাল। তারপর পরিষ্কার ভাবেই বলল, ‘আপনি কি এদেরকে চেনেন?’

আমার মনে কৌতুক জন্মাল। মজা করার জন্যই বললাম, ‘হ্যাঁ চেনা চেনাই তো লাগছে! কিন্তু আপনাদের পূর্বপুরুষদের মাঝে এই দুইজন কী করছে বুঝতে পারছি না! তারাও কি আপনাদের পূর্বপুরুষ?’

‘হ্যাঁ… না মানে পূর্বপুরুষ না। এরা আমার চাচাত ভাই। কিন্তু… আপনি এদের কীভাবে চিনলেন? আশ্চর্য তো!’

শাকিলের মাও তখন জিজ্ঞাসুমুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি একটা অন্যরকম থ্রিল অনুভব করছি। যে কথা এদের কাছে বলতে যাচ্ছি, শোনার পরে কেমন প্রতিক্রিয়া হবে বুঝতে পারছি না। কিন্তু নিজের মুখে নিজের পরিচয় দেওয়ার আগে এদের কাছ থেকে আরেকটু কিছু শুনতে মন চাইছে। বুঝতে পারছি একটা কোনো গল্প আছে এখানে। সেই গল্পটা আগে সংগ্রহ করে নেওয়া যাক। নিজের পরিচয় দেওয়ার জন্য বাকি বেলা পড়ে আছে।

আমি দুজনের আগ্রহেই খানিকটা পানি ঢেলে দিয়ে খুব ঠাণ্ডামাথায় বললাম, ‘আমি তো চিনি এদেরকে। কিন্তু কিছু মনে করবেন না। এদের দুজনের গল্প শুনতে ইচ্ছে করছে। আপনার এই দুজন চাচাত ভাই কি বেঁচে আছে? তারা কোথায়? দেখা সাক্ষাত হয় না আপনাদের?

শাকিল আমার উল্টো প্রশ্ন শুনে একটু অবাক হলো বুঝতে পারলাম। ভ্রুদুটো আরেকটু যেন বেশি কুঁচকে গেল। কিন্তু মনের বিরক্তি মনেই চেপে রেখে শাকিল বলল, ‘হয়ত আপনি এদের দুজনকে চেনেন, কিন্তু বলতে চাইছেন না। যাহোক, ইচ্ছে না করলে না বলবেন। আমাদের কাছে তো লুকানোর কিছু নেই। আপনি যখন চেনেন এদেরকে, তাহলে তো একদিক দিয়ে ভালোই হলো। বিষয়টা আপনারও জানা থাকল। এই দুজনের খোঁজখবর করার চেষ্টা আমরা একেবারে কম করিনি। কিন্তু সেই যে একদিন এসে এই ‘চৌধুরী ভিলা’ থেকে ঘুরে গেল তারপর আর একদিনও কেউ এলো না! যোগাযোগের যোগসূত্র রেখে যায়নি তারা। আমাদের আর কীই বা করার ছিল?’

আমি বললাম, ‘তারা এখানে এসেছিল? কবে?’

এবারে উত্তর দিলেন ভদ্রমহিলা, অর্থাৎ সম্পর্ক মোতাবেক যিনি আমার চাচী। চাচী বললেন, ‘ফাহাদ আর ওর ছোটভাই ম্যালাদিন আগে এসেছিল বাবা। আমার শাকিল নিজেও তখন এই ছোটজনের বয়সী হবে। শাকিলের বাবা আর আমি ওদের বসিয়ে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেছিলাম মনে আছে। কিন্তু ফাহাদ এসেছিল নিজের অংশ বুঝে নিতে। ওর তখন গল্পগুজবে আগ্রহ ছিল না তেমন একটা। চাচা চাচীর প্রতি তো টান গড়ে ওঠার সময়ই পায়নি! আমার শ্বশুর তার আগের বছরই মারা গেছেন। অবশ্য শ্বশুর বেঁচে থাকতে তো এমনিতেই আসতে পারেনি। সেজন্যই তার মৃত্যুর পরেই ওরা এসেছিল।’

‘কেন? দাদা…মানে শাকিলের দাদা বেঁচে থাকতে কেন আসতে পারেননি?’

‘বাবা…সেটাই তো গল্প! জানি না তুমি এদেরকে কীভাবে চেনো। তবে কীভাবে চেনো জানতে পারলে হয়ত আমাদের জন্য ভালো হতো। গল্পটা বলতে সুবিধা হতো আর কী! কারণ গল্প করতে বসেছি ঠিকই, কিন্তু কিছু গল্প হয়ত পরিবারের একান্ত নিজস্ব অধ্যায়।’

আমি বুঝতে পারছি আমার চাচী গল্প বলার জন্য ভেতরে ভেতরে ছটফট করছেন, কিন্তু ছেলের উপস্থিতিতে কিছুটা হলেও আড়াল বজায় রাখতে হচ্ছে তাকে। আমি শাকিলের দিকে তাকালাম। ওর চোখেমুখে এবারে একটু যেন অন্য ছায়া ঘনাতে দেখলাম। সেখানে পরিষ্কার সন্দেহ আর অসন্তোষ। এবারেও স্পষ্টসুরে শাকিল আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘একটা কথা বলবেন? আপনাকে কি কেউ এখানে পাঠিয়েছে? এসব গল্পের মধ্য দিয়ে কি কাউকে কোনো কিছু জানাতে চাইছেন আপনি? আমার এই বড় চাচাত ভাই আপনাকে পাঠিয়েছে তাই না? উনি নিজে এলেই তো পারতেন! শুধু শুধু প্রতিনিধি পাঠানোর কী দরকার ছিল ওর?’

আমি শাকিলের গলার উষ্মা বেশ ভালোভাবেই টের পেলাম। মনে মনে অন্যরকম একটা মজা পাচ্ছি। দেখাই যাক না, এই গল্প আমাকে কোথায় নিয়ে যায়! এই বিশাল বাড়ির একচ্ছত্র আধিপত্য দখল করে বসে এরা কি সত্যি সত্যিই অন্তর্দহনে পুড়ে মরছে নাকি ভেতরের গল্পটা অন্যরকম?

শাকিলের কথা শুনে আমার চাচী এবারে বিব্রত মুখে ছেলের দিকে তাকালেন। সেই দৃষ্টিতে ছেলেকে নিরস্ত করার একটা চেষ্টা দেখতে পেলাম। মুখেও মৃদু ভৎসনা করে বললেন, ‘আহ শাকিল! চুপ কর। ভালোভাবে না জেনেশুনে এভাবে কথা বলছিস কেন?’
তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘বাবা… জানি না তুমি কিছু না জেনেই এসেছ নাকি কেউ তোমাকে পাঠিয়েছে! তবে কেউ পাঠিয়ে থাকলে তাকে খোলাখুলি আমাদের সাথে কথা বলতে বললে ভালো হয় বাবা। আমরা কাউকে ঠকাইনি। আমার শ্বশুর বেঁচে থাকতে কী করেছেন, সেটা তার ব্যাপার। সেখানে আমাদের কথা বলার জো ছিল না। তার সম্পদ তিনি যেভাবে খুশি বণ্টন করেছেন। আমাদের আপত্তি তিনি কানে তুলবেন কেন? কিন্তু তার মৃত্যুর পরে আমি অথবা আমার স্বামী আমরা কেউই তার ভাইয়ের ছেলেদের বঞ্চিত করিনি। আর তাছাড়া আমরা ওদেরকে এখানে থাকতেও বলেছি। ওরা না থাকতে চাইলে আমরা কী করতে পারতাম!’

আমি চুপ করে শুনে চলেছি। এবারে একটু মাঝপথে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি বললেন, আপনি আপনার স্বামীর ভাইয়ের ছেলেদের বঞ্চিত করেননি। কিন্তু কীভাবে তাদের অধিকার দিয়েছিলেন সেটা একটু বলবেন কি দয়া করে?’

শাকিল এবারে ক্ষুব্ধ বিদ্বেষে ফেটে পড়ল যেন। মনের সাথে ওর একটা বোঝাপড়া বুঝি অনেকক্ষণ ধরেই চলছিল। আর সেটাকে দমিয়ে রাখতে পারল না। একেবারে জলোচ্ছ্বাসের মতো ধেয়ে এলো। ক্রুদ্ধ গলায় শাকিল বলল, ‘সেটা কি আমরা আপনাকে জানাব? এই যে শুনুন… ভদ্রতাবশত অনেক খাতিরদারি করেছি আপনাকে। আপনি কে… কেন এসেছেন মানে কী মতলবে এসেছেন এসব ভালোভাবে খুলে না বললে আমরা আর একটি শব্দও উচ্চারণ করব না! ফাহাদ ভাই যদি আপনাকে পাঠিয়ে থাকে… ওহ না না শুধু ফাহাদ ভাইই বা বলছি কেন, ছবির এই ছোটজনও তো আপনাকে পাঠাতে পারে তাই না? যদি দুজনের কারও তরফ থেকে আপনি এসে থাকেন, তাহলে দয়া করে তাদেরকে সামনে আসতে বলবেন। উনাদের যদি মনে হয় আমরা তাদের বঞ্চিত করে সব জোরজবরদস্তি ভোগদখল করছি তাহলে এসে কড়ায়গণ্ডায় হিসাব নিয়ে যাক!’

কথা শেষ করে মায়ের দিকে ফিরে বলল, ‘এবারে বুঝলে তো কাউকে দেখলেই গল্পের ঝাঁপি খুলে বসতে হয় না! তুমি তো সরলমনে একেবারে চৌদ্দগুষ্টির গল্প শুরু করেছিলে! এখন থামলে কেন?’

আমি তখনো সকৌতুকে মজা দেখছি। বেশ বুঝতে পারছি, শাকিল আর রানু দুজনেই একটু রগচটা ধাঁচেরই হয়েছে। অল্পতেই দুই ভাইবোন রেগে যায়। হয়ত বংশের ধাঁচ। ভদ্রমহিলা নিজের শ্বশুরের নানারকম গল্প করছিলেন। নিজের ভাইবোনকে বঞ্চিত করা, পছন্দের মেয়েকে বিয়ে না করার দরুণ ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া… এসব তো রগচটা মানুষজনই করে থাকে! কাজেই বংশের ধাঁচ যাবে কোথায়?

কথাটা ভাবতেই নিজের কথাও মনে এলো। আমিও তো ঘটনাচক্রে এই বংশেরই একজন! তাহলে এই ধাঁচ তো আমারও ষোলআনা থাকার কথা! হয়ত আমি আমার মায়ের ধাঁচ পেয়েছি। তাই বেঁচে গেছি এই সর্বগ্রাসী রাগের কবল থেকে!

তবে খুব বেশি সময় আর এদের অন্ধকারে বসিয়ে রাখতে মন চাইল না। তাই মজাটাকে এখানেই থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আমাকে কেউ পাঠায়নি। আর আমিও পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক এখানে আসিনি। তবে এসবের পেছনে আমার বন্ধুটির হাত আছে কী না বুঝতে পারছি না! সেই তো নিজের বিয়ের কথা বলে আমাকে এই ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলো!
আর এখানে এসে এই ছবিটি দেখে বুঝতে পারলাম, আমি নিজেও এই বাড়ির একজন বংশধর! মানে এই ছবিতে যে ছোটজনকে দেখা যাচ্ছে, আমিই সেই জন। আমার নাম মাহমুদ। আর হ্যাঁ আমার সৎভাইয়ের নাম ফাহাদ।
এখানে আসার পর থেকেই খুব চেনা চেনা লাগছিল সবকিছু। বুঝতে পারলাম একদিন ভাইয়া আমাকে নিয়ে এসেছিল এই বাড়িতে। কিন্তু খুব ছোট ছিলাম আমি। তাই জানি না ভাইয়ার সাথে কার কী কথাবার্তা হয়েছে। তবে যা কিছুই হয়ে থাকুক না কেন, বিশ্বাস রাখতে পারেন সেইসবে আমার কোনোরকম ইন্টারেস্ট নেই। আমি এখানে কোনো কিছুই আদায় করতে আসিনি। বরং ফাঁকতালে আপনাদের সাথে দেখা হয়ে গেল! এটা তো আমার প্রত্যাশারও বাইরে ছিল!’

আমার মনে হলো, ঘরের মধ্যে বুঝি বাজ পড়েছে। মা ছেলে অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর একসময় সম্বিত ফিরতে আমার চাচী উঠে এসে আমাকে আলিঙ্গনের ভঙ্গিতে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘বাবা… তুমি এ কী বলছ! আমি তো ভাবতেও পারছি না! তুমি সত্যিই কিছু না জেনেশুনে এখানে এভাবে চলে এসেছ! এতদিন পরে মনে পড়ল আমাদের কথা! …’

চাচী হয়ত আবেগে আরও অনেককিছুই বলতেন। কিন্তু আমার সন্দেহপ্রবণ চাচাতো ভাই শাকিল গলার স্বর আগের চেয়ে কিছুটা নমনীয় করে প্রশ্ন করল, ‘কিন্তু আপনার বন্ধুটি আপনাকে এখানে পাঠবে কেন? সে কে? তার কি কোনো ছবি আছে আপনার কাছে?’

এই ব্যাপারটা কেন এখন অব্দি আমার মাথায় আসেনি সেটা ভেবে নিজেকে তিরস্কার করলাম। তাই তো, আমার মোবাইলেই তো রায়হানের বেশ কয়েকটা ছবি আছে! আমাদের অফিসের পিকনিকে, কিংবা লাঞ্চের ব্রেকে দুই বন্ধু বেশ কিছু ছবি তুলেছি একসাথে!

মনে হতেই শশব্যস্ত হয়ে ছবি খুঁজতে বসে গেলাম। (ক্রমশ)

আগের পর্বের লিংক- https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=404751148320915&id=100063580982892

#ফাহ্‌মিদা_বারী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here