#ফাগুন_প্রেম__পর্বঃ৩৯+৪০

0
321

#ফাগুন_প্রেম__পর্বঃ৩৯+৪০
#_লিখাঃ Bornali Suhana

💛
সবাই যার যার জায়গায় বসে পরে। মালিহা ভিডিও প্লে করে। পিকনিক, কলেজের সব অনুষ্ঠানের ছবি একসাথে করে ভিডিও বানানো হয়েছে। হুট করেই এমন একটা ছবি আসে যা দেখে সবাই বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। বর্ণালী রুমুর হাতটা শক্ত করে ধরে দাঁড়ায়। ওর হাত-পা থরথর কাঁপছে। হৃদস্পন্দনগুলো দ্রুত চলছে। এসব কি দেখছে ওর চোখ। চোখের কোণে জল জমে গেছে। ইচ্ছে করছে মাটি ফেটে যাক আর ও মাটির নীচে ঢুকে যাক। ইভান একবার বর্ণালীর দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার ছবির দিকে তাকাচ্ছে। রাগে ওর কপালের দু’পাশের নীল রঙের শিরাগুলো দ্রুত উঠানামা করছে। সম্পূর্ণ ঘেমে গেছে মাথার পাশ বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। চোখজোরা লাল হয়ে গেছে। হাত মুঠিবদ্ধ করে দ্রুত স্টেজে উঠে ভিডিও অফ করতে চলে যায়। কিন্তু অফ করার কোন অপশন খুঁজে পাচ্ছেনা। রাগে সব তার টেনে ছিড়ে ফেলে দেয়। মালিহা ওখানেই দাঁড়িয়ে হেসে যাচ্ছে। এমনভাবে ছবিগুলো তুলেছে যে শুধু বর্ণালীর মুখ দেখা যাচ্ছে আর পাশে থাকা ছেলেটার মুখ দেখা যাচ্ছেনা। কিন্তু ছেলেটার ড্রেস দেখে বুঝা যাচ্ছে এই কলেজেরই স্টুডেন্ট। এটাই তো চেয়েছিলো মালিহা। বর্ণালী কাউকে মুখ দেখাতে পারবেনা। নিজের থেকে বয়সে ছোট একজন ছেলের সাথে তাও কলেজের স্টুডেন্টের সাথে এভাবে আপত্তিকর অবস্থায় দেখলে কেউই তাকে আর ভালো চোখে দেখবে না। আর ছেলেটা যে ইভান তা কেউ বুঝবেও না। তৃপ্তিভরে বিশ্বজয়ের একটা হাসি দিয়ে দু’হাত বটে আরাম করে দাঁড়ায় মালিহা। মিথিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-“এখন মালিহা জমিয়ে নাটক দেখবে। না না নাটক না সি….সিনেমা। হাহাহাহা।”
মিথি কোন কিছু না বলে নিজের মুখটা ছোট করে দাঁড়িয়ে থাকে।
আশেপাশের সব লোক কানাঘুষো করছে। স্টুডেন্ট গার্ডিয়ান সবাই বর্ণালীর দিকে বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে আর নানারকম কথাবার্তা বলছে।
-“ছিঃ ছিঃ এমন ম্যাডাম হলে ছাত্রছাত্রীদের কি শিক্ষা দিবেন?”
-“আমাদের সন্তানদের নষ্ট করার জন্যই বুঝি আমরা এখানে পাঠাই?”
-“এটা তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রইলো না এটা যেনো একটা প্রেমখানা হয়ে গেলো।”
-“কি মেয়ে একটুও লজ্জা করলো না এভাবে নিজের ছাত্রের সাথে!! ছিঃ ছিঃ আমার তো বলতেও লজ্জা লাগছে এর করতে লজ্জা লাগলো না?”
-“আরে আপা এসব মেয়েদের কাজই এমন বড়লোকের ছেলে দেখলেই নিজেকে লুটিয়ে দেয়।”
-“হ্যাঁ সবই টাকা খাওয়ার ধান্দা এদের। এসব নিম্নবিত্তরা হুটহাট টাকার মুখ দেখলে লুটেপুটে নিতে চায়।”
এসব কথা শুনে বর্ণালী আর নিজের অবস্থানে দাঁড়াতে পারলো না। ধপ করে ফ্লোরে বসে পরে। গাল পাড় করে গলা বেয়ে টপটপ করে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। রুমু আর সহ্য করতে না পেরে রেগে চিৎকার করে বসে।
-“চুপ করেন আপনারা। একদম চুপ। যা জানেন না তা নিয়ে কথা বাড়াবেন না। আর এই ছবিগুলো কোত্থেকে এলো তা জানার চেষ্টা করেন আগে। এখানে একা কেন বর্ণালীকে দোষারোপ করে যাচ্ছেন? কেমন মানুষ আপনারা? আজ নিজের মেয়ে হলে কি এমন কথাই বলতেন?”
-“আর একটা কথাও না। একটা কথা না মানে একটাও না। কেমন মানুষ আপনারা? এতটুকু বিবেকবোধ নেই আপনাদের? এখানে ওর একা দোষ নাকি যে ওকেই দোষ দিয়ে যাচ্ছেন? এখানে তো একটা ছেলেও আছে সেই ছেলেটাকে কেন আপনারা কিছু বলছেন না?”
এতো মানুষের ভির থেকে কেউ একজন কথাটা বলে। সবার চোখ তার দিকে যেতেই দেখে ইভান অন্য পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ইভান আরেকটু এগিয়ে এসে বলে,
-“আপনারা কোন সমাজের মানুষ? আসলে আমার না সন্দেহ হচ্ছে আদৌ কি আপনারা মানুষ? এখানে কি দেখলেন আপনারা? একা একটা মেয়ের দোষটাই? দোষ করলে সমান দোষ আমিও করেছি হ্যাঁ যে ছেলেটার মুখ দেখা যাচ্ছিলো না সেই ছেলেটা আমি ইভান আহমেদ। আর দোষ কেন বলছি আমি! এখানে তো আমাদের কারো দোষ নয়। প্রেম, ভালোবাসা কখনোই দোষ হতে পারেনা। এটা আজকালের যুগে স্বাভাবিক জিনিস। কিন্তু দোষ হলো এখানে এই ছবিগুলো যে দেখিয়েছে তার। সে আমাদের ব্যাক্তিগত ছবি পাবলিক করেছে এটা তার অপরাধ। এটার বিচার পরে হবে। আচ্ছা আপনারা বলুন তো কখনো আপনারা আপনাদের ছেলে-মেয়ের জীবন সম্পর্কে খবর নিয়েছেন? সে প্রতিদিন কি করছে? কোথায় যাচ্ছে কখনো খবর নিয়েছেন? আরে যাওয়া আসা বাদ দিলাম। কখনো তার মোবাইল বা কম্পিউটার ঘেটে দেখেছেন? রাত জেগে ১৮+ ভিডিও দেখে উত্তেজিত হয়ে প্রেমিকার সাথে ফোন কলে, চ্যাটে সেক্স করছে তা কখনো দেখেছেন?
দিনে ঝোপেঝাড়ে তাদেরও আপত্তিকর অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি রুম ডেট পর্যন্ত করছে। তার খবর আছে?
কি আন্টি রাখেন খবর?
নো নো নো আপনারা কেন তার খবর রাখবেন।
আপনাদেরই ছেলের কারণে কত মেয়ে প্রেগন্যান্ট হচ্ছে তখন আপনার ছেলে নিজের গা ঝেড়ে দিচ্ছে। আপনারা নিজে এসব জেনেও ছেলের এসব কান্ডে বাঁধা দিচ্ছেন না। বরং ছেলেকে কিভাবে বাঁচানো যায় তার ভাবনা করছেন। প্রয়োজনে মেয়ের মুখে টাকা দিয়ে একটা নিষ্পাপ প্রাণ পৃথিবীর মুখ দেখার আগেই কেড়ে নিচ্ছেন। আবার এই সমাজেই মাথা উঁচু করে বুক ফুলিয়ে হাঁটছেন। বাহ! অবশ্য এতে আপনাদের তো কিছুই আসে যায় না। উচ্চবিত্তরা এভাবেই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের পায়ের তলায় পিষে যাচ্ছে।
আরে আপনাদের মুখে এসব মানায় না। আগে আয়নায় নিজের মুখ দেখেন। তারপর পরের মুখ দেখতে আসবেন। আজ যদি বর্ণালীর জায়গায় আপনার মেয়ে হতো তখন কেমন লাগতো? তখনো কি এমন কথাই বলতেন? আজ যদি আমার জায়গায় আপনার ছেলে থাকতো তখনো কি এই একই কথা বলতেন? ওহ ওয়েট ওয়েট আমি তো ভুলেই গেছি আমার তো কোন দোষ নেই দোষ তো ওই যে ফ্লোরে বসে কাঁদছে ওই মেয়েটার। ওই মেয়েই তো বড়লোকের ছেলের উপর নিজেকে লুটিয়ে দিচ্ছে। বাহ! বাহ! কি সমাজে আছি আমরা। ধন্য আপনারা! আপনাদের থেকেই তো আমরা শিক্ষা নিচ্ছি। মনে রাখার মতো শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন।”
ইভান একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে আবারো বলে,
-“জানেন, আপনাদের এসব বলে কোন লাভ হবে না। এসব কখনো পরিবর্তন হবে না। সবসময় একটা মেয়েকেই দোষীর কাতারে রাখা হবে। আর ছেলে? ছেলেদের বেলায় ওই যে চিরচেনা একটা কথাই আসবে, ছেলেরা তো এমন একটু আধটু করবেই। আর একটা কথাও না। আর একটা কথাও যদি আমি কারো মুখে শুনি তাহলে বলে দিচ্ছি তার চেহারার নকশা বদলে দিবো।”
প্রিন্সিপাল বর্ণালীর দিকে এগিয়ে যান।
-“মিস বর্ণালী, আপনি কাল সকাল ১০টায় আমার সাথে দেখা করবেন।”
কথাটা বলেই প্রিন্সিপাল কোটের বোতাম লাগাতে লাগাতে গাড়িতে উঠে চলে যান। বর্ণালী হাতের উলটো পাশ দিয়ে চোখ মুছে দৌড়ে কলেজ গেট দিয়ে বেরিয়ে যায়। রুমু, ইভান, রাহাত, শিমুল, আসাদ সবাই ওর পিছনে দৌড় দেয়। ফাহিমা ম্যাডাম এগুতে যেয়েও আগান না। কিন্তু ওর পিছনে গিয়ে কোন লাভ হয় না। কেউ ওর নাগাল পায় না। সিএনজি করেই বাসার দিকে এগিয়ে যায়। ইভান রুমুর দু’হাত ধরে বলে,
-“রুমু প্লিজ তুমি এখনই বর্ণালীর বাসায় যাও। ও সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। ওকে এই মুহুর্তে একা ছাড়া ঠিক হবে না। প্লিজ রুমু।”
-“হ্যাঁ আমি যাচ্ছি। তুমি টেনশন নিও না।”
রুমু আর এক সেকেন্ড না দাঁড়িয়ে সিএনজি করেই ওর পিছু পিছু যায়। বর্ণালীর সিএনজি থেকে নেমে দেখে ওর ব্যাগ সাথে নেই। ব্যাগটা রুমুর কাছেই রয়ে গেছে। তখনই রুমুর সিএনজি এসে থামে। রুমুকে দেখেই বর্ণালী গেটের ভেতর চলে যায়। রুমু পেছনে বারবার ডাকে,
-“বর্ণালী দাঁড়া বলছি। আমার কথা শুন বর্ণ।”
কিন্তু না সে দাঁড়ায় না। একনাগাড়ে কলিংবেল বাজিয়েই যাচ্ছে। রুমু গাড়ি ভাড়া মিটিয়ে দৌড়ে ভেতরে আসে।
শারমিন বেগম হাতের কাজ রেখেই একরকম দৌড়ে আসেন।
-“কে এভাবে মরার বেল বাজাচ্ছে! একটু ধৈর্য্য কি রাখা যায় না! আসছি রে বাবা।”
দরজা খুলে নিজের মেয়েকে দেখে চোখ রাঙিয়ে তাকান শারমিন বেগম।
-“এভাবে কেউ বেল বাজায়? বিরক্ত করে দিলি বর্ণ। আর তোর চোখ-মুখের এই অবস্থা কেন? কি হয়েছে?”
রুমু পেছন থেকে ব্যাপারটা সামলানোর জন্য বলে,
-“আরে বড় আম্মু ওর প্রকৃতির ডাক পড়েছে। তাড়াতাড়ি সরেন। ওয়াশরুমে যাবে বেচারি।”
-“আরে রুমু তুই এসেছিস?”
-“না আমার আত্মা এসেছে।”
-“পাজি মেয়ে। আচ্ছা আয় ভেতরে আয়।”
শারমিন বেগম দরজা ছাড়তেই বর্ণ ধীর পায় রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সে যেনো মায়ের সামনে মুখ দেখাতে পারছিলো না। পা চলছে না। ইচ্ছে করছে এখানেই বসে যাক। অনেক কষ্ট করে নিজের রুমে আসে। রুমুও পিছু পিছু এসে রুমের দরজা লক করে দেয়। দরজা লক করে পিছনে ফিরতেই দেখে বর্ণালী ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।
-“বর্ণ দরজা খোল। বর্ণ তাড়াতাড়ি দরজা খোল বলছি। দেখ উলটা পালটা কিছু করবি না। বাইরে আয় নাহলে ভালো হবে না। বড় আম্মু বুঝতে পারলে সমস্যা হয়ে যাবে।”
এসব কোন কথাই যেনো ওর কান দিয়ে যাচ্ছে না। চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে। হাত-পা যেনো শরীর ছাড়া হয়ে গেছে। আলতো করে শাওয়ারটা ছেড়ে দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ে। বেখায়ালিভাবে বসাতে মাথা গিয়ে দেয়ালের সাথে লেগে খানিকটা জায়গা ফেটে রক্ত বের হয়ে যায়। ওর শরীরটা যে আর চলছিলো না। মাথা ফেটে রক্ত গাল বেয়ে পানির সাথে মিশে ফ্লোর ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু ওর একটুও ব্যাথা অনুভব হচ্ছেনা। বুকের ব্যাথার কাছে মাথা ফেটে কেন পুরো শরীর কেটেও যদি কেউ লবণ ছিটিয়ে দেয় তাও সেই ব্যাথাটা কষ্ট দেয় না। যতটা না এই বুকের ব্যাথাটা কষ্ট দিচ্ছে। চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কান্না যেনো গলা দিয়ে আসছেনা। গলায় কিছু একটা আটকে গেছে মনে হচ্ছে। কোন একটা ঘোরের মাঝে চলে গেছে। বারবার তাকে বলা কথাগুলো কানের মাঝে বাজছে। ধীরে ধীরে দেয়ালে মাথা ঠেকায়। বারবার দেয়ালের সেই একই জায়গায় মাথা মারছে। আর বিরবির করে বলছে,
-“সব দোষ আমার, সব দোষ আমার, আমি পাপ করেছি সব দোষ আমার।”
মাথার ফেটে যাওয়া অংশ দিয়ে পানির মত গলগল রক্ত বের হচ্ছে। রক্ত পরে লাল হয়ে গেছে পুরো ওয়াশরুমের ফ্লোর। এদিকে রুমু বার বার ওর নাম ধরে ডাকছে আর দরজায় কড়া নাড়ছে। তবুও বর্ণালীর কোন সাড়াশব্দ পায় না। এক পর্যায়ে খুব জোরে জোরেই দরজায় ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দেয়।
💛
#_____চলবে……….

#_ফাগুন_প্রেম_
#_লিখাঃ Bornali Suhana
#_পর্বঃ ৪০
💛
মাথার ফেটে যাওয়া অংশ দিয়ে পানির মত গলগল রক্ত বের হচ্ছে। রক্ত পরে লাল হয়ে গেছে পুরো ওয়াশরুমের ফ্লোর। এদিকে রুমু বার বার ওর নাম ধরে ডাকছে আর দরজায় কড়া নাড়ছে। তবুও বর্ণালীর কোন সাড়াশব্দ পায় না। এক পর্যায়ে খুব জোরে জোরেই দরজায় ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দেয়।
-“বর্ণালী প্লিজ দরজা খোল। বর্ণালী, বর্ণালী, দেখ বর্ণালী এখন দরজা না খুললে আমি বড় আম্মুকে ডাকতে বাধ্য হবো। দরজা খোল জান। আমাকে এভাবে ভয় দেখাস নে প্লিজ।”
দরজা খোলার কোন নাম-গন্ধ নেই। রুমু কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। একবার ভাবছে শারমিন বেগমকে ডাকবে আরেকবার ভাবছে ডাকলে বিষয়টা হয়তো বড় হয়ে যাবে৷ যা করতে হয় ওকেই করতে হবে। কিন্তু সেও কি করবে! কান্না থামছেনা ওর। এভাবে নিজের জানের চেয়ে প্রিয় বান্ধবীর অবস্থা দেখে কখনোই কেউ ঠিক থাকতে পারেনা। গায়ের সর্বোচ্ছ শক্তি দিয়ে দরজা ধাক্কাতে লাগে কিন্তু কোন কাজ হচ্ছেনা। ফোন বের করে সজিবকে কল লাগায়। এখন একমাত্র এই একটা মানুষ যাকে সে সব বলতে পারবে। সজিব কখনোই বর্ণালীকে ভুল বুঝবে না। কল যেতেই সজিব রিসিভ করে।
-“কিরে…..”
-“সজিব তাড়াতাড়ি বাসায় এসো। যেখানে আছো তাড়াতাড়ি বাসায় এসো প্লিজ।”
-“কি হয়েছে রুমু? কার বাসায়? কি বলছিস এসব? ঠিক আছিস তুই?”
-“একটা কথা না বাড়িয়ে তোমার বাসায় এসো প্লিজ সজিব। বর্ণালী নিজেকে ওয়াশরুমে লক করে দিয়েছে। তুমি তাড়াতাড়ি বাসায় এসো।”
-“বর্ণ!!! কি হয়েছে ওর? ও ঠিক আছে? মা কোথায়? রুমু কথা বল?”
-“বড় আম্মুকে আমি কিছুই বলিনি সজিব৷ তুমিও কিছু বলো না। যত দ্রুত সম্ভব বাসায় এসে সোজা বর্ণালীর রুমে আসো।”
-“হ্যাঁ আমি রাস্তায় আছি। আসছি ১০মিনিট। বর্ণালীর যেনো কিচ্ছু না হয় রুমু।”
-“কিচ্ছু হবে না। বাসায় এসো।”
সজিব কল কেটে সিএনজিওয়ালাকে আরো দ্রুত চালাতে বলে। রুমু তখনও দরজা ধাক্কে যাচ্ছে। বর্ণালীর চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসছে। কাঁপা কাঁপা ঠোঁটজোড়া শুধু বিরবির করে একটা কথাই বলছে,
-“সব দোষ আমার, আমি পাপ করেছি। এই পাপের ক্ষমা নেই। সব দোষ আমার।”
রুমু এভাবে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা। কোন উপায় না ভেবে বেলকনি দিয়ে বাইরে বের হয়ে আসে। ওয়াশরুমের জানালার গ্লাস দিয়ে উঁকি দিতে চেষ্টা করে কিন্তু পারছেনা। এক দৌড়ে গিয়ে বেলকনি থেকে চেয়ার এনে জানালা দিয়ে তাকাতেই আত্মা কেঁপে উঠে ওর। কান্নার আওয়াজ বেড়ে যায়।
-“ব…বর্ণ এ তুই কি করলি!”
প্রতিটা গ্লাস খুলে নিচে ফেলতে গিয়ে নিজের হাত কেটে ফেলে। সেদিকে কোন খেয়ালই নেই ওর। কান্না করছে তো করছেই। গ্লাস খুলে নিচে রেখে অনেক কষ্ট করে জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে যায় সে। ভেতরে ঢুকেই শাওয়ার বন্ধ করে বর্ণালীকে জড়িয়ে ধরে। বর্ণালী তখনো বিরবির করে এই একই কথা বলছে।
-“বর্ণ এটা কি করলি তুই? কি করলি বর্ণ?”
-“স….সব দ…দোষ আমার রে রুমু। আ….আমি পা…পাপ করেছি আমাকে শা…..শাস্তি দে।”
কথা বলতে পারছেনা তাও বারবার এই কথাই বলছে৷
রুমু উঠে দরজা খুলে দিয়ে বর্ণালীকে তুলে দাঁড় করিয়ে মাথা ওর কাঁধের মাঝে নেয়। ওর এমন অবস্থা দেখে থরথর করে কাঁপছে মেয়েটা। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে দ্রুত ফাস্ট এইড বক্স এনে মাথার পাশ ওয়াশ করতে লেগে যায়। ওর হাত প্রচন্ড কাঁপছে। চোখ দিয়ে জল পড়ছে। সেই জল মুছছে তো আবার ওয়াশ করছে। বর্ণালী মুখ খিচে নিয়েছে। মুখ দিয়ে গুঙিয়ে আওয়াজ বের করছে। হয়তো প্রচন্ড ব্যাথায় এমন হচ্ছে ওর। রুমু আলতো করে মাথার পাশটা ড্রেসিং করে দেয়। তারপর আলমিরা থেকে ড্রেস বের করে চেঞ্জ করিয়ে দেয়। সম্পূর্ণ ভিজে গেছে। এই অবস্থায় থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে। ঠিক বর্ণালীর বুকের উপর মাথা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রুমু।
-“তোর একবারও মনে হলো না যে তুই আমাদের কতটা কষ্ট দিবি? শুধু নিজের কষ্টটাই দেখলি? কেন এমন করলি? কতটা রক্ত ঝড়িয়েছিস নিজের? কিভাবে পারলি তুই? কিভাবে?”
দরজায় খট করে আওয়াজ হতেই রুমু দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে। সজিবকে দেখেই জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। সজিবও অবস্থা বুঝতে পেরে রুমুকে জড়িয়ে ধরে করে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। রুমু অনেকটা ভিজে গেছে। সজিব ওর মাথায় হাত দিয়ে বলে,
-“রুমু চুপ কর। এভাবে কাঁদলে আমি কিভাবে বুঝবো কি হয়েছে?”
রুমু সজিবের বুক থেকে মাথা তুলে বলে,
-“দে…..দেখো না বর্ণালী কথা বলছে না। এভাবে শুয়ে আছে। ওর অনেক কষ্ট হচ্ছে সজিব। প্লিজ ডাক্তারকে ডাকো।”
সজিব বিছানার দিকে এগিয়ে যায়। বর্ণালীর এমন অবস্থা দেখে সজিব পাগলের মতো ওকে তুলে নিজের বুকের মাঝে ওর মাথা নেয়।
-“বর্ণ কি হয়েছে তোর? ভাইয়াকে বল? দেখ এভাবে চুপ করে থাকবিনা। প্লিজ বোন কথা বল।”
-“সজিব ডাক্তার ডাকো প্লিজ।”
বর্ণালী তখনই চোখ পিটপিট করে তাকায়। সজিবের হাত শক্ত করে ধরে বলে,
-“নাহ।”
-“কি না বর্ণ?”
-“ডাক্তার ডেকো না ভাইয়া।”
-“কিন্তু তোর এই অবস্থা।”
-“পি…..প্লিজ ভাইয়া।”
সজিব চোখের জল মুছে রুমুর দিকে অসহায়ভাবে তাকায়।
-“আ….আমি দেখছি কি করা যায় তুমি টেনশন নিও না।”
রুমু ফোন বের করে ফ্যামিলি ডাক্তারকে কল করে আসতে বলে। এভাবে বসে থাকলে হবে না। বর্ণালীর কথা শুনলে হয়তো কোন অঘটন ঘটে যাবে। আর তা রুমু কখনোই হতে দিবে না।
👇
ধীরে ধীরে সবাই কলেজ থেকে বেরিয়ে যায়। ইভান ক্লাসের সামনে সিঁড়িতে বসে আছে। রাহাত, মালিহা আর মিথি ওর পাশেই নিশ্চুপ হয়ে আছে। শিমুল আর আসাদ খাবারগুলো পাশের এতিমখানায় দিতে যায়। এতো খাবার রয়ে গেছে যে নষ্ট হতো। কেউ খাবার খেতেই পারেনি নষ্ট তো হতোই। মালিহা আর নিশ্চুপ হয়ে থাকতে পারলো না।
-“ইভান তুই এভাবে মুড অফ করে বসে আছিস কেন?”
ইভান এখনো নিশ্চুপ হয়ে আছে কোন কথা বলছে না।
-“কিরে কথা বল? আর ওইসব ছবিগুলো…”
-“ছবিগুলো কোত্থেকে এলো মালিহা?”
খুব শান্ত গলায় কথাটা বলে ইভান। মালিহা বুঝেও কোন কিছু না বোঝার ভান করে বলে,
-“মানে?”
-“মানে ছবিগুলো কোত্থেকে এলো?”
-“কিসব বলছিস? আমি কিভাবে জানবো?”
ইভান হাত শক্ত করে মুঠিবদ্ধ করে দেয়ালে ঘুসি মেরে উঠে দাঁড়ায়।
-“ছবিগুলো কোত্থেকে এলো ড্যাম ইট। জবাব দে আমায়। কেন এমন করলি তুই?”
ইভানের চিৎকার শুনে সবাই ভয়ে কেঁপে উঠে। রাহাত এসে ইভানকে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
-“ছাড় আমায় রাহাত। জবাব দে মালিহা। কেন এমন করলি? বর্ণালী কি এমন ক্ষতি করেছে তোর?”
মালিহা আর বসে না থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ইভানের মুখের সামনে এসে বলে,
-“ও আমার ক্ষতি করেছে তাই আমি ওর সাথে এমন করেছি। আজ নয় ওর ক্ষতি আমি বারবার করবো। ওর সাহস কি করে হয় তোর কাছে যাওয়ার?”
মালিহা ইভানের কলার ধরে পাগলের মতো কথা বলতে শুরু করে,
-“তুই কেন আমায় বুঝিস না? আমাকে কি তোর চোখে লাগেনা? আমি কি তোকে আকর্ষণ করিনা। আমার মাঝে কিসের কমতি আছে? তাও কেন তুই তোর থেকে বড় ওই মিডলক্লাস বেহেঞ্জি টাইপের মেয়ের পিছু পড়ে আছিস?”
ইভান মালিহার হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দূরে ঠেলে দেয়।
-“আজ যদি তুই মেয়ে না হয়ে ছেলে হতি না তাহলে বুঝতি ইভান কি জিনিস। ইভান মেয়েদের গায়ে হাত দেয় না নাহলে এতোক্ষণে তোর গালে কয়টা পড়তো তা তুই জানিস না। মিথি ওকে আমার সামনে থেকে নিয়ে যা।”
-“হ্যাঁ ও যাবে কিন্তু তার আগে ওর প্রাপ্যটা নিয়ে যাক ইভান।”
মিথি কথাটা বলেই মালিহার গালে ঠাস করে দুইটা চড় বসিয়ে দেয়। রাগে মালিহার চোখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছে।
-“মিথি তোর এতো বড় সাহস?”
-“হ্যাঁ আমার সাহস এতোটাই। আমার না ঘৃণা হচ্ছে যে তুই আমার বান্ধবী। আসলেই আজকে আবারো প্রমাণিত হলো একজন মেয়েই আরেকজন মেয়ের চরম শত্রু হয়। ছেলেরা তো নামে বদনাম। হ্যাঁ তবে কিছু সংখ্যক ছাড়া। ছেলেরা যদি বাইরে ৪০% মেয়ের সাথে খারাপ কাজ করে সেখানে এই মেয়েরাই ঘরে-বাইরে ৬০% মেয়েরদের সাথে খারাপ কাজ করে। কিন্তু তুই কিভাবে পারলি?
আমি না বিশ্বাস করতে পারিনি মালিহা তুই এতোটা নীচে নামবি। হ্যাঁ আমারও ভুল আছে। আমি তোর কথায় কথায় কাজ করেছি। শুধুমাত্র বন্ধুত্তটা টিকিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু সত্যি কথা কি জানিস? তুই আমার কেন কারো বন্ধু হবার যোগ্য না।”
মালিহাকে কথাগুলো বলে মিথি ইভানের কাছে এসে বলে,
-“আমাকে ক্ষমা করে দে ইভান। আমি চাইলে এসব কিছু থামাতে পারতাম। আমি আমার বন্ধুত্ত রক্ষার জন্য এমন করেছি। কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছিলাম বন্ধুত্তের যে মর্যাদা দিতে জানেনা তাকে হারানোর ভয় করার কোন মানেই হয় না। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিস।”
ইভান আর কোন কিছু না বলেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায় ওখান থেকে। আর সে এখানে দাঁড়িয়ে থেকে ওর মুখ দেখতে পারবে না। ফোন বের করে রুমুকে বারবার কল দিয়েই যাচ্ছে।
👇
শারমিন বেগম এই নিয়ে কয়েক গ্লাস পানি খেয়েছেন। শরীরটা ঠিক ভালো ঠেকছে না। বুকের মাঝে কেমন একটা অশান্তি করছে। মনে হচ্ছে প্রেসারটা আবার হাই হলো নাকি কো অঘটন ঘটলো। মেয়ে তো ঘরেই আছে। ছেলেটাও ভালোভাবে ফিরে এসেছে। শুধু তার স্বামী হাবিব হাসান বাসার বাইরে। তার কথা ভেবেই এখন তিনি পেরেশান হচ্ছেন। না জানি সে ঠিক আছে কিনা।
কলিংবেল বাজতেই চমকে উঠেন। গভীর ভাবনায় থাকলে এমনটাই হয়। বসা থেকে উঠে ধীর পায় দরজার দিকে এগিয়ে যান। কিন্তু দরজা খুলে ডাক্তারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শারমিন বেগমের কলিজার পানি শুকিয়ে যায়।
-“ডাক্তার সাহেব আপনি?”
-“জ্বি রুমু আছে?”
-“হ্যাঁ কিন্তু কি হয়েছে?”
রুমু পেছন থেকে এসে বলে,
-“বড় আম্মু আগে ভেতরে আসতে দাও।”
-“কি হয়েছে আমায় বলবি তো।”
-“আসলে বড় আম্মু বর্ণ…….”
-“বর্ণ? কি হয়েছে আমার মেয়ের?”
জিজ্ঞেস করেই উত্তরের অপেক্ষা না করে এক দৌড়ে শারমিন বেগম মেয়ের রুমের দিকে যান। মেয়ের এই অবস্থা দেখে তার মাথাটা ঘুরে আসে। অল্পের জন্য পড়েই যাচ্ছিলেন কিন্তু রুমু পেছন থেকে এসে ধরে ফেলে। রুমুকে ছাড়িয়ে বিছানার উপর বসেই মেয়ের মাথা কোলে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন। ভেতর ফেটে যেনো কান্না আসছে। তার কান্না দেখে সজিব ও রুমুর কান্নার বেগটাও বেড়ে গেলো।
💛
______চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here