#_ফাগুন_প্রেমপর্বঃ ৬৫+৬৬

0
306

#_ফাগুন_প্রেমপর্বঃ ৬৫+৬৬

লেখনীতেঃ Bornali Suhana
💛
💛
চোখের সামনে যাকে দেখছে সে শুধু একজন মানুষ নয় নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে তার মাঝে। ও এগিয়ে যাওয়ার আগেই সেই মানুষটা তাকে জড়িয়ে ধরে। না কোন প্রশ্ন করে, না কেউ কোন উত্তর দেয় চুপচাপ ট্রেনে চেপে বসে দুজন। ট্রেন চলছে তার গতিবেগে আর তাদের গন্তব্য সিলেট।
-একটাবার ভেবে দেখবি?
-সব হিসেব মিলিয়ে নিয়েছি।
-রেজাল্ট কী?
-যে পদক্ষেপ নিয়েছি সেটাই।
-ইভানের কী হবে ভেবেছিস?
-ভালো থাকবে ইনশাআল্লাহ।
-তুই কি মনে করিস তোকে ছাড়া ও ভালো থাকবে?
-কেন নয়?
-ও তোকে ভালোবাসে বর্ণ।
-তুইও তো ভাইয়াকে ভালোবাসতি, তাহলে কি তুই ভালো নেই?
রুমু চুপ হয়ে যায় বর্ণালীর এমন উত্তরে। এই মুহুর্তে ওর কিছুক্ষণ একা থাকা প্রয়োজন। তাই তো রুমু তাকে সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে। নাহলে কোন অঘটন ঘটাতো হয়তো। বর্ণালী রুমুর বাসায় গিয়ে ওর ভাইয়ার কাছ থেকে ফোন আর টাকা নিয়েছে। রুমুর ভাই সাথে সাথেই তাকে কল দেয় তখন সে মাত্র এসে স্টেশনে নেমেছে। বর্ণালীকে দেখতে হাসপাতাল যেতো কিন্তু বর্ণালী বের হয়ে গেছে শুনে আর যায় না। এখানেই অপেক্ষা করে আর পেয়েও যায় তাকে।
ইভান চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বিছানায় হাত দেয়। কিন্তু বিছানা খালি অনুভব করতেই চোখ মেলে তাকায়। বর্ণালী নেই!
“বাসন্তী……” ইভানের চিৎকারে ঈশা, সজিব ধরফরিয়ে উঠে।
-বর্ণালী কোথায়? বর্ণালী, বর্ণালী….!
সবাই খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেয়। ইভান পাগলের মতো হন্তদন্ত হয়ে খুঁজছে। শারমিন বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েছেন৷ তার পাশে ঈশা বসে শান্ত করার চেষ্টা করছে। আকাশে ঠিক মাথার উপর একটা পাখি বারবার এপাশ ওপাশ ঘুরাঘুরি করছে। পাখিটার রঙ বা কতটা বড় তা ধারণা করা সম্ভব হচ্ছে না। এতো উঁচুতে উড়ছে যে আন্দাজ করা কঠিন। পাখিটা যেন গভীর তৃষ্ণার্ত। কিন্তু প্রখর রোদেও ক্লান্ত নয়৷ উড়েই চলেছে। সে তার আপন ঠিকানা খুঁজতে ব্যস্ত। ইভান হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে দূর আকাশ পানে তাকিয়ে আছে। আজ তার অবস্থাটাও ঠিক এমন। কোথায় যাবে, কোথায় খুঁজলে তার বাসন্তীকে পাবে কোন কিছুই বুঝতে পারছে না। মুখ দিয়ে কোন একটা শব্দও আসছে না ওর। সবাই কান্না করছে শুধু ইভান ছাড়া। দাঁড়িয়ে থাকাটা কষ্টকর হচ্ছিলো তার সেজন্য চুপচাপ বসে আছে সিঁড়ির পাশে। মাঝ পিঠে ব্যথা অনুভব করছে।

সম্পূর্ণ রাস্তা দুজনে কোন কথাই বলে না। স্টেশনে নেমে সিএনজি খুঁজতে লাগে রুমু। বর্ণালীর এভাবে হাঁটা রুমুর ভেতরটাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। পা রক্তে একাকার। বাসায় এসে কলিংবেল চাপতেই একটা শ্যাম বর্ণের মেয়ে এসে দরজা খুলে দেয়। নিশ্চুপ প্রবেশ করে তারা। অচেনা একটা জায়গায় এসেছে বর্ণালী শুধু সাথের মানুষটা চেনা। একটা বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাটে একটা বেড রুমের সাথে ড্রয়িংরুম, রান্নাঘর, আর বাথরুম সংযুক্ত আছে। রুমু জানালা খুলে দেয়। বর্ণালী জানালার পাশে সোফায় গিয়ে বসে। এখান থেকে পুরো শহর দেখা যাচ্ছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। রুমু ফোন নিয়ে ডাক্তারকে কল করে দেয়। বর্ণালীর পা পরিষ্কার করে আবার ব্যান্ডেজ করতে হবে। রুমু অনেকক্ষণ বর্ণালীর দিকে তাকিয়ে ফোনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর ছোট্ট করে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দেয়।
-মণি শুন,
– হ্যাঁ আপু বলো।
– রান্না করেছো কিছু?
– হ্যাঁ আপু তুমি আসছো শুনে আমি রান্না করে নিয়েছি।
মেয়েটির নাম মণি। মণি নামের মেয়েরা কি সবার চোখের মণি হয়? বর্ণালীর তা জানা নেই। এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। পরে একসময় ওর সাথে কথা বলে জেনে নেয়া যাবে। রুমুর রুমের দরজায় নক পড়তেই দরজা খুলে দেখে ডা. সালমা এসেছেন।
-আসো আপু।
-কি হলো রুমু এতো জরুরী তলব? তোর কি শরীর খারাপ?
-নাহ আপু, আমার না। আমার কলিজার শরীর খারাপ।
-কে?
-ভেতরে আসো আপু।
বাইরে বৃষ্টি নেমেছে, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। সালমা ছাতাটা বারান্দায় রেখে ভেতরে প্রবেশ করে। চোখের চশমাটা ঘোলা হয়ে এসেছে। চশমাটা খুলে মুছে আবার চোখে লাগায়। বর্ণালীকে দেখিয়ে রুমু চেয়ার টেনে দেয় ডা. সালমাকে। বর্ণালী বাইরে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টির পানির যখন রাস্তায় জমে থাকা পানির উপর এসে পড়ে অদ্ভুত এক সুন্দর লাগে। টুপ করে পানি পড়ার সাথে সাথে পানি ছিটকে যায় চারদিকে। এটাকেই বর্ণালী অনেক আনন্দ নিয়ে দেখছে। জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দিচ্ছে। বৃষ্টির পানি বরফ গলা পানির মতো ঠান্ডা। ইচ্ছে করছে বৃষ্টিতে ভিজতে। রুমু তা করতে দিবে না। রুমুকে কীভাবে বোঝায় যে বৃষ্টির পানি স্পর্শ করা সুন্নাত। সালমা বর্ণালীর দিকে বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। বিষন্ন চেহারাতেও কেমন মায়াবী লাগছে।
-নাম কি?
রুমু পাশ থেকেই বললো,
-ওর নাম বর্ণালী। আপু ওর পা দেখো তুমি প্লিজ।
বর্ণালী এখনও বৃষ্টির পানি নিয়ে খেলছে। সালমা বর্ণালীর দিকে তাকিয়ে ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে বিছানার উপর রেখে সোফায় গিয়ে বসে।
-বর্ণালী বাবুর কি বৃষ্টি খুব পছন্দ?
– হ্যাঁ অনেক। আমি যদি বৃষ্টি হতাম!
-বৃষ্টি! এতো ইচ্ছে থাকতে বাবুর বৃষ্টি হবার ইচ্ছে কেন হলো?
-এই যে বৃষ্টি কত সুন্দর পুরো পৃথিবীতে স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দেয়। আমিও কারো জীবনে স্নিগ্ধতা ছড়াতে পারতাম।
-কার জীবনে স্নিগ্ধতা ছড়াতে চাও?
-ইভ……আহ!
বর্ণালী ব্যথায় চিৎকার দিয়ে ওঠে। রুমু সাথে সাথে ওর হাত ধরে পাশে বসে।
-কি হলো? ব্যথা পেলি?
-নাহ! ওই একটু। উনি কে?
-এতোক্ষণ তার সাথে কথা বললি আর এখন জিজ্ঞেস করছিস উনি কে?
-কথা বলেছি নাকি!
বর্ণালী ঘোরের মাঝে ছিলো। কিছুই বুঝতে পারেনি কার সাথে কথা বলছে না বলছে। ডা. সালমা কখন ওর ব্যান্ডেজ পরিবর্তন করে দিয়েছেন তাও বলতে পারেনা। তাকে কথায় ভুলিয়ে কীভাবে করে দিলো বুঝতেই পারলো না। ডা. সালমার ঠোঁটে প্রশস্ত হাসি। তার হাসির মানে খুঁজে বের করা কঠিন। এটা কি কোন সুখের নাকি কোন কষ্টের কেবলমাত্র সেই জানে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো তার ঠোঁটের হাসির সাথে চোখজোড়াও হাসে। এই হাসিটা তার সৌন্দর্য মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে দেয়।
-আপু চা খাবে?
-জানিসই তো আমি চা খাই না।
বর্ণালী আচমকাই বললো,
-আমি অনেক মজার চা বানাতে পারি। খাবেন?
-নাহ সরি আমি চা খাবোনা।
সালমার কথা শুনে বর্ণালীর কেন জানি কিছুটা মন খারাপ হলো কিন্তু কিছুক্ষণেই বিষন্নতা কাটিয়ে চেহারায় রৌদ্রময় ভাব চলে আসে।
-কিন্তু পান করতে পারি হিহি। তবে চিনি কম দিও আমি মিষ্টি কম খাই।
সালমার কথায় কেমন বাচ্চামো ভাব ফুটে ওঠে। একজন ডাক্তার এতোটা ফ্রেন্ডলি কীভাবে হয়! বর্ণালী চা বানানোর জন্য উঠে দাঁড়ায়। রুমু এগিয়ে এসে তাকে ধরতে চাইলে বর্ণালী তাকে থামিয়ে বললো,
-রুমু, আমার কারো সাহায্য ছাড়াই চলার অভ্যাস করতে হবে। সবসময় সবাই আমার আশেপাশে থাকবে না। তাই নিজের দায়িত্ব আমার নিজেকেই নিতে দে৷
রুমু তাকে ছেড়ে সরে দাঁড়ায়। বর্ণালী খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে রান্নাঘরে যায়। সালমা অবাক-খুশি হয়ে তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। রুমু নিঃশব্দে কাঁদছে। কিন্তু সালমা হাসছে। ওর ডাক্তারি জীবনে অনেক রোগীকেই এমন অবস্থায় ভেঙে পড়তে দেখেছে। অথচ বর্ণালী সবার চেয়ে ভিন্ন। রুমু রান্নাঘরে যায় বর্ণালীকে সাহায্য করতে। নতুন জায়গা কোন কিছুই খুঁজে পাবে না।
-ডাক্তার আপুর নাম কিরে?
-সালমা।
-তুই তাকে কীভাবে চিনিস?
-আসলে ফেইসবুকে আপুর সাথে পরিচয়। আপুই আমাকে এখানে চাকরি ও থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
-আপুকে আমার অনেক ভালো লেগেছে।
– হ্যাঁ আপু অনেক ভালো মনের মানুষ।
বর্ণালী চা নিয়ে এসে দেখে সালমা ফোনে কথা বলছে।
-সরি তো বাবুনি আমি তোমার কল দেখিনি আসলে রোগী দেখতে এসেছি আর বাইরে অনেক বৃষ্টি তাই শুনিনি। জানো বাবুনি মেয়েটা না একদম বাচ্চা একটা মেয়ে। কি ফুটফুটে সুন্দর!
বর্ণালী চা এনে সালমার সামনে রাখে।
-বাবুনি আমি পরে কথা বলছি। নিজের খেয়াল রেখো তুমি।
কতদিন পর চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে।
-চা কি ঠান্ডা হয়ে গেছে?
-নাহ আমি আসলে কুসুম গরম চা খাই।
বর্ণালী, সালমা, মণি ও রুমুর বেশ আড্ডা জমে উঠেছে। কথার ফাঁকে রুমুর ফোনে অনেকবার কল আসে। কিন্তু রুমু আড়ালে গিয়ে কল রিসিভ করে। ব্যাপারটা বর্ণালীর কাছে স্বাভাবিক লাগলো না।
ডা. সালমা যাবার পর থেকে বর্ণালীর একটা মুহুর্তও ভালো লাগেনি। রাতটা যেন যাচ্ছেই না। রুমু তাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছে৷ গুটিসুটি মেরে তার পাশেই শুয়ে আছে।
-রুমু শুন না,
– হ্যাঁ জান বল।
-সালমা আপু কি এখন ঘুমাচ্ছে?
রুমু হেসে ওর ফোন থেকে কল লাগিয়ে বর্ণালীর কাছে দেয়।
-হ্যালো রুমু বলো।
-আমি বর্ণালী বলছি আপু।
– ওহ বাবুটা?
-আপু তুমি আমায় বাবু ডাকছো কেন?
-তুমি একদম বাবুর মতোই।
-কিন্তু বাবু তো ছেলে বাবুদের বলে আর আমি তো মেয়ে।
-ওকে তুমি তাহলে সোনামণি আমার।
-আচ্ছা তাহলে তোমায় আমি কি বলে ডাকবো?
-তোমার যা ইচ্ছে।
-সোনাম্মি ডাকি?
– হ্যাঁ অবশ্যই।
রাত বাড়ছে, বৃষ্টির শব্দও বাড়ছে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। ইভান বেলকনিতে ফ্লোরে বসে আছে। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে। চোখজোড়া লাল হয়ে আছে। এক প্যাকেট সিগারেট শেষ করে দিয়েছে। নতুন প্যাকেট খুলতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু আরেকটা সিগারেটের খুব বেশি প্রয়োজন এই মুহুর্তে। বাতাসের তোড়ে জানালার পাখা এদিক-ওদিক নড়ছে। বৃষ্টির ফোঁটা এসে ইভানকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। ঠান্ডা লাগছে কিন্তু উঠে রুমে যেতে মন চাচ্ছে না। বৃষ্টির মাঝে যেন সে তার বাসন্তীর উপস্থিতি অনুভব করছে। বর্ণালী আলতো করে জানালা খুলে দিয়েছে। চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির গন্ধ নিতে চেষ্টা করছে। প্রথম বৃষ্টির গন্ধটা কেমন যেন হৃদয়কে স্পন্দিত করে।
💛
💛
#_____চলবে……..

#ফাগুন_প্রেম
পর্ব: ৬৬
লেখনীতে: Bornali Suhana
💛
💛
বৃষ্টির মাঝে যেন সে তার বাসন্তীর উপস্থিতি অনুভব করছে। বর্ণালী আলতো করে জানালা খুলে দিয়েছে। চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির গন্ধ নিতে চেষ্টা করছে। প্রথম বৃষ্টির গন্ধটা কেমন যেন হৃদয়কে স্পন্দিত করে। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ফোঁটা স্পর্শ করতেই বর্ণালীর চোখজোড়া অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। বাইরের বৃষ্টি পরিবেশকে সতেজ করছে আর ভেতরের বৃষ্টি হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করছে। এই রক্তক্ষরণে গভীর আঘাত পাচ্ছে, হয়তো এ আঘাত দীর্ঘ মেয়াদি। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বাইরে তাকিয়ে থাকে। দৃষ্টি খুব দূর যাচ্ছেনা। বাইরের ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছুই দেখা যাবার মতো নয়। বর্ণালী নিজের ভবিষ্যতটাও দেখতে পাচ্ছে। এইতো বাইরের অন্ধকারের মতোই। কিছুই দেখা যায় না। কোন পথ নেই, নেই কোন আশার আলো। মেঘের গর্জনের সাথে বিজলি চমকায়। বিজলির আলো সম্পূর্ণ বাহিরকে আলোকিত করে দেয়। আশ্চর্যান্বিত ব্যাপার বর্ণালী অন্ধকারে ছড়িয়ে পড়া আলোকেই দেখছে এই প্রথম ও বিজলির চমকানোতে ভয় পায় না। এই আলোর ঝলকানিতে যদি ঘুটঘুটে অন্ধকারও আলোকিত করতে পারে তাহলে আমার ভবিষ্যৎ কেন আলোকিত হবে না! কিন্তু এই আলোর ঝলক কীভাবে এসে জীবনটাকে আলোকিত করবে!
প্রশ্নটা মনের ভেতরেই দাফন দেয় বর্ণালী। রুমুর চোখে-মুখে সম্পূর্ণ চিন্তার ছাপ ফুটে ওঠেছে। তাকে নিয়ে কি পরিমাণ চিন্তায় আছে তা বর্ণালী ভালোই আঁচ করতে পারছে। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে৷ এতো ভালোবাসে কেন এই পাগলীটা তাকে! আলতো করে উঠে রুমুর কপালে চুমু এঁকে দেয়। জানালার পাশে সোফায় বসে বৃষ্টির স্বাদ গ্রহণ করতে লাগে।

বৃষ্টি থেমে পুব আকাশে সকালের রক্তিম সূর্য উঁকি দিয়েছে। পৃথিবীকে আলোকিত করতেই তার আগমন। আলোর রেখা এসে বর্ণালীর চোখে লাগতেই ঘুম ভেঙে যায়। চোখ পিটপিট করে তাকানোর চেষ্টা করছে ও। কিন্তু ব্যথায় মাথা তুলতে পারছে না। রাতে ঘুম না হওয়ার কারণেই এই মাথা ব্যথার আক্রমণ। ফজরের আজানটা তো কানে লেগেছিলো। একটু পর উঠে নামাজ পড়বে ভেবেছিলো কিন্তু কীভাবে যে ঘুমিয়ে গেলো। আধবোজা চোখে বিছানায় তাকায় কিন্তু বিছানায় রুমু নেই। এতো সকালে কোথায় গেলো! উঠে সোজা হয়ে বসে। পাশে তাকাতেই দেখে ইভান ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখজোড়া ফুলে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। মনে হচ্ছে পুরো রাত ঘুমায়নি, অনেক কান্না করেছে। কিন্তু আসলেই কি এ ইভান! নাকি কোন স্বপ্ন! না না ইভান কোত্থেকে আসবে? ও তো জানেনা আমি এখানে। চোখ বন্ধ করে আবারো চোখ খুলে তাকায় কিন্তু ইভান যেভাবে তাকিয়ে ছিলো এখনও ঠিক সেভাবেই তাকিয়ে আছে। বর্ণালী কাঁপা কাঁপা হাতে ইভানের গালে হাত দেয়। হ্যাঁ ও ইভানকে অনুভব করতে পারছে। কোমল, উষ্ণ হাতের স্পর্শ পেতেই ইভান চোখ বন্ধ করে নেয়। চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। ইভানের গাল অনেক ঠান্ডা। কম্পিত কণ্ঠে বর্ণালী “ইভান” বলে হাত সরিয়ে নেয়। ইভানের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বসে। রুমু ৩কাপ চা নিয়ে আসে। ২কাপ ওদের সামনে রেখে এক কাপ হাতে তুলে চলে যেতে নিলেই বর্ণালী বললো,
-রুমু তাকে চলে যেতে বল।
রুমু কিছু বলতে যাবে তখন ইভান বললো,
-রুমু তাকে বলে দাও আমি এখান থেকে ফিরে যাবার জন্য আসিনি।
শুনো ভাই-বইনেরা তোমরা দুজন দুজনের সাথে কথা বলো। আমার কাজ আছে আমি যাই। বর্ণালী মণিকে কোথাও না দেখে জিজ্ঞেস করলো,
-মণি কোথায় রুমু?
-ওর ৮টায় প্রাইভেট তাই উঠেই চলে গেছে।
রুমু আর দাঁড়ায় না। ফোন হাতে নিয়েই রুম থেকে বাইরে চলে যায়। ইভান এখনও বর্ণালীর দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু বর্ণালী তার দিকে তাকাচ্ছে না।
-তুমি কি ভেবেছিলে আমি তোমায় খুঁজে বের করতে পারবো না? আমাকে কি তোমার ওইসব মুভির নায়কের মতো মনে হয় নাকি যে পুরো শহর তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাবো না। ২০বছর অপেক্ষা করবো। ২০বছর অপেক্ষার পর আমাদের দেখা হবে। তখনও দু’জন অবিবাহিত থাকবো। আবার দু’জনে নতুন করে সুখের সংসার সাজাবো। এসব ভেবেছিলে?
বর্ণালী চুপচাপ বসে আছে। কোন কথা বলছে না।
-এই বাসন্তী কেন ছেড়ে এলে আমায়? কী ভেবেছিলে তোমায় ছাড়া আমি থাকতে পারবো? আচ্ছা তুমি কি আমায় ছাড়া থাকতে পারবে? বলো।
বর্ণালী অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। ইভানের চোখের দিকে তাকানোর সাধ্য ওর নেই। ইভান নিচে ওর পায়ের কাছে বসে পড়ে।
-তোমাকে ছাড়া একা থাকার মানে বুঝো? তোমাকে ছাড়া থাকা মানে আমার কাছে, বন্ধ কোন রুমে সীমিত অক্সিজেনের ভেতর থাকা। ধীরে ধীরে অক্সিজেন কমে আসবে, আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগবে। একটা সময় আমার নিশ্বাস থেমে যাবে। অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যু হবে তোমার বসন্তপথিকের……।
বর্ণালী খপ করে ইভানের ঠোঁটের উপর হাত দিয়ে চেপে ধরে। ওর চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছে। চোখজোড়া এক করলেই তা গাল বেয়ে পড়বে। ইভান বর্ণালীর পা কোলে তুলে। ও অন্যদিকে তাকিয়ে চোখের জল মুছে নেয়। ইভান ব্যান্ডেজের উপর আলতো করে চুমু এঁকে দেয়। বর্ণালী তার কোলের উপর থেকে পা ছিটকে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সম্পূর্ণ শরীর কাঁপছে।
-তুমি ফিরে যাও ইভান।
-আচ্ছা! কেন যাবো?
-আমি তোমার যোগ্য নই ইভান। প্লিজ তুমি ফিরে যাও।
-বিয়ে করা বউকে এখানে রেখে কীভাবে একা ফিরে যাই? আর কে বলেছে তুমি আমার অযোগ্য? বরং আমিই তোমার যোগ্য নই, আমার পরিবার তোমার যোগ্য নয়।
-দয়া দেখাতে এসো না ইভান। আর ওইটা বিয়ে ছিলো না তো বউ বলে অধিকার দেখাতে এসো না।
ইভান বর্ণালীর হাত ধরে বললো,
-দয়া? আর বিয়ে ছিলো না মানে? তিনবার আলহামদুলিল্লাহ কবুল বলে আমি তোমায় আমার স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছি আর তুমিও আমায় তোমার স্বামী হিসেবে মেনে নিয়েছো।
ইভানের হাত ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে সরে যায় বর্ণালী। ইভানের সামনে নিজেকে শক্ত করতে হবে।
-এসব বলে কোন লাভ নেই আমি তোমার স্ত্রী নই। চলে যাও এখান থেকে।
-হ্যাঁ একদম ঠিক বলেছো তুমি আমার স্ত্রী নও। আসলে আমাদের বিয়ে তো হয়েছে কিন্তু বাসর তো হলোই না। তাহলে কীভাবে আমরা স্বামী-স্ত্রী হলাম? ভাববার বিষয় তো! আচ্ছা, শুভ কাজে দেরি কিসের? আজ তোমাকে আমি স্ত্রীর অধিকার দেবো আর তোমার থেকে স্বামীর অধিকার নিবো।
বর্ণালীর ভয়ে থরথর কাঁপছে। এসব কি বলছে এই ছেলে! কিছুই ওর মাথায় ঢুকছে না।
-চলো, আজকে আমরা বাসরদিন করবো।
ইভান বর্ণালীর হাত ধরে টেনে নিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
-ইভান ছাড়ো, কি করছো এসব? আমার কষ্ট হচ্ছে।
-এখনও তো কিছু শুরুই করিনি।
আর কিছু বলার আগেই ইভান বর্ণালীকে কোলে তুলে নেয়। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে দুষ্টুমির হাসি দেয়। ওর গালে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
-আজকের পর তুমি আমার সম্পূর্ণরুপে স্ত্রী হয়ে যাবে।
বর্ণালীর গালে চুমু এঁকে গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয়। বর্ণালী ইভানের শার্টের কলার চেপে ধরে। ইভান ওর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো,
-ভালোবাসি বাসন্তী।
-ইভান থামো প্লিজ আমি তোমাকে এভাবে পেতে চাই না। আমাদের বিয়ে আমরা নিজেরা করেছি ইসলামিক নিয়মে হয় নি। এটা পাপ হবে ইভান।
ইভান মুখ তুলে মুখ চেপে হাসে। বর্ণালীর কপালে চুমু এঁকে তাকে কোলে তুলে নেয়।
-কি! কি করছো ইভান?
-ইসলামিক নিয়মে বিয়ে করার ব্যবস্থা করছি।
-ইভান তোমার পরিবার আমায় মেনে নিবে না। আমি সারাজীবন তোমার উপর বোঝা হয়ে থাকতে পারবো না।
-কে বলেছে তুমি আমার বোঝা? তুমি তো একদম পুতুলের মতো হালকা এভাবে কোলে নিয়ে সারাজীবন পাড় করে দিতে পারবো। আর বাকি রইলো পরিবার মানবে না? মা আমায় এখানে পাঠিয়েছে তার ছেলের বউকে নিয়ে যেতে। এখন চুপচাপ কোলে বসে থাকো, সাপের মতো মুচড়ো-মুচড়ি কম করো। এই শক্তিগুলো বাসর রাতের জন্য বাঁচিয়ে রাখো কাজে লাগবে।
ইভান বর্ণালীর কোমড় চেপে ধরে চোখ মারে। তার ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমির হাসি লেগে আছে। দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে আসে। বর্ণালী এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। লোকে দেখলে কি বলবে! রুমু বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরের কোলাহলে ভরপুর শহরকে দেখছিলো। ইভান ও বর্ণালীকে এভাবে একসাথে দেখে ওর ঠোঁটের কোণে প্রশস্ত হাসি ফুটে উঠে।
💛
💛
#_____চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here