#এটা_গল্প_হলেও_পারতো
২য় পর্ব
ইমন জানে বার বছর হয়ে গেছে । এই বার বছর ওর জীবনের উপর দিয়ে ওর মনের উপর দিয়ে কত বর্ষা, কত কালবৈশাখী ,কত কি গেছে !
আজ সে একটা ব্যাঙ্ক এর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। ভার্সিটিতে পড়ুয়া কমল, শান্ত ইমন আর নেই। ওর জীবনের সকল কোমলতা, সকল আনন্দ নিয়ে একজন মানুষ চলে গেছে !
মিনু খালাম্মা আর খালাতো ভাই সানির শ্বাশুড়ি কি বলে গেল জানে না ইমন কিন্তু বুঝতে পারছে বিয়েটা ভেঙ্গে যাওয়ার কারণ শুনে মা অনেক আপসেট হয়ে গেছে!
ইমন এসব নিয়ে এখন আর মাথা ঘামায় না ! সে জানে তাকে অনেক কিছুর মুখোমুখি হতে হবে ! পারিবারিক ভাবে, সামাজিক ভাবে । জীবনের এই পর্যায়ে এসে সে ঘাবড়ে যাওয়া, ভয় পেয়ে কুঁকড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় থাকে না।
সে এখন প্রস্তুত ! যে ঝড় আসবে ,সেই ঝড় সামলাতে প্রস্তুত !
নিজের জন্য চা বানিয়ে নিয়ে ছাদে উঠে এলো ইমন।
চিলেকোঠা টা সে সুন্দর করে বানিয়ে নিয়েছে । বাগানটাও অনেক সুন্দর করে সাজিয়েছে সে ! এখানে এসে সে যে সুখ পায় তা বাসার অন্য কোথাও পায় না !
চিলেকোঠায় বসে বৃষ্টি দেখতে ইমনের ভালোই লাগছে । আগের চেয়ে বৃষ্টি অনেক কমে গেছে !
আলো নিভিয়ে বসে আছে ইমন ! হঠাৎ ওর মেঝ ফুপু এসে ঢুকলো চিলেকোঠায় ! ইমন অনেক অবাক হলো ফুপুকে ঐ মুহুর্তে ওখানে দেখে !
: অন্ধকারে বসে আছিস যে এখানে ?
: তুমি না দেশের বাহিরে গিয়েছিলে , কবে এলে ?
: আসছি গত সপ্তাহে !
ফুপু এসে ইমনের পাশে বসলো !
তোর অফিস কেমন চলছে ?
চলছে ভালো !
তারপর ?
তারপর তো তুমি বলবে ,কি বলতে এসেছো এত রাতে ?
ইমন !
আমি শুনছি ফুপু তুমি বলতে পারো !
তোর কি হয়েছে বলোতো ?
আমার কি হয়েছে আবার ! দিব্যি আছি!
তুই তোর বিয়েটা ভেঙ্গে দিল কেন ?
ইমন চুপ করে রইলো , বাহিরে বৃষ্টি আবার বেড়ে গেছে সে বৃষ্টির দিকে তাকালো !
শুধু এই বিয়েটা না গত তিন চার বছর ধরে যেসব বিয়ে মোটামুটি ঠিক হয়ে যায় তুই ছেলের পক্ষে র কাছে এমন একটা কিছু করিস যে তারা বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে বাধ্য হয় !
ইমন এবারও চুপ করে আছে !
এবারের আগে যে বিয়েটা ঠিকঠাক হলো তোর অফিসের কলিগ, সেই বিয়েটা যখন ভেঙে গেল তখনই শুভ ছেলের সঙ্গে দেখা করে কথা বলেছিল ঐ ছেলে কিছু ঠিক ভাবে না বললেও এবার কিন্তু আত্মীয়র মধ্যে হচ্ছিল বিয়েটা ! শুভ কিন্তু তোর লেখা উড়ো চিঠিটা যাচাই করেছে তুই অস্বীকার করতে পারবি ?
শুভ কি গোয়ান্দাগিরি শুরু করে দিল ডাক্তারি ছেড়ে ?
ভাই হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করছে , নিজের বোনের বিয়ে একের পর এক ভেঙ্গে গেলে যে কোন ভাই গোয়েন্দা হয়ে যাওয়ার কথা !
ফুপু আমি আসলে বিয়েটা এখন করতে চাইছি না !
বুঝলাম ,তো কবে করতে পারবি ?
আমি বলব !
উঁহু তোর ছোট দুটো ভাই বোন আছে ওদের বিয়ের বয়স হয়ে গেছে ইমন!
আমি কাউকে বাধা দিচ্ছি না ফুপু আমি তো শুভ কে অলরেডি বলেছি , যার সঙ্গে ওর সম্পর্ক আছে নির্দ্বিধায় বিয়ে করে ফেলতে পারে ! এমনকি তোমরা প্রিয়ম এর জন্যেও ছেলে দেখতে পারো !
বাহ্ দারুন বলেছিস বড় বোন কে রেখে ছোট দুই ভাই বোন বিয়ে করে ফেলবে !
এখন কি এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় ফুপু ?
ঘামায় ইমন আমাদের ফ্যামিলি তে ঘামায় ! তুই সত্যি করে বল তুই আসলে চাইছিস টা কি ?
ইমন চুপ করে গেল !
কথা বল?
ফুপু আমি একটু শান্তিতে থাকতে চাইছি !
সেটা কিভাবে ?
বিয়ে, সংসারের ঝামেলায় পড়তে চাইছি না !
ইমনের মেঝ ফুপু নাজনীন ইমনের হাত ধরলেন !
সত্যি করে বলতো কি হয়েছে তোর ?
ফুপু আমি সত্যি করে বলছি আমি বিয়ে সংসার এসব ঝামেলাতে পড়তে চাইছি না !
এটা কেমন কথা ? ইমন তোর কি পছন্দের কেউ আছে ?
ফুপু পছন্দের কেউ থাকলে বলতাম না কতবার তো জিজ্ঞেস করেছো তোমরা !
তাহলে এটা কেমন কথা বিয়ে করবি না !
পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে বিয়ে সাদি করে না নিজের মত থাকে আমি তাদের মত থাকতে চাই !
নাজনীন ফুপু চুপ করে আছেন!
তোমরা শুভ আর প্রিয়ম এর জন্য বিয়ের চেষ্টা করো এটাই সবচেয়ে ভালো হবে !
আর তুই ? এভাবেই থাকবি ?
হুম !
ঠিক আছে থাক কিন্তু কারণ টা ব্যাখ্যা করে বলতে হবে !
কোন কারণ নেই !
সব কাজের কোন না কোন কারণ থাকে ইমন !
ফুপু প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো !
শোন ইমন বোঝার কিছু নেই তুই চিন্তা করতে থাক , আমি আগামী সপ্তাহে এসে ব্যাখ্যা সহ কারণ শুনে যাব !
নাজনীন ফুপু চিলেকোঠা থেকে গজগজ করতে করতে নিচে নেমে গেলেন!
ইমন চুপচাপ বসে বাহিরের বৃষ্টি দেখছে।
নিচে বাসায় যে তোলপাড় চলছে সেখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না !
রবিবার ইমনের খুব ব্যস্তায় কাটে । ব্যাঙ্ক থেকে আসতে আসতে রাত আটটা বেজে যায়। আজ অফিসের গাড়ি গলির মোড়ে নামিয়ে দিয়ে গেল বাসার সামনের রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। হেঁটে সে গেটের ভেতরে ঢুকলো !
গাড়ির আওয়াজ ছিল না বলেই মা টের পায়নি হয়তো ! ফোনে ফুপুর সঙ্গে ইমনের প্রসঙ্গে ই কথা বলছে ইমন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ই টের পেল!
কিছু না বলে আস্তে করে নিজের ঘরে ঢুকে গেল সে।
আজকাল বিয়ের প্রসঙ্গে কথা বলতে একদম ইচ্ছে করে না!
খুব অশান্তি হয়েছে ফাইনালি সবাই যখন জেনে গেছে গত তিন চার বছর ইমনের যত গুলো বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েও ভেঙে গেছে এর জন্য ইমনের হাত ই ছিল !
কেন , কিসের জন্য এই কাজ করছে ইমন তা সে কাউকেই ব্যাখ্যা করেনি এখনো!
ফ্রেশ হয়ে নিজের রুমে একটা বই খুলে বসলো। সপ্তাহ খানেক আগেও অফিস থেকে ফিরে ইমন মায়ের সঙ্গে বসে গল্প করতো ! এখন পরিস্থিতি অন্যরকম মা বাবা অভিমান করে আছে ! ইমন তাই নিজের মত থাকার চেষ্টা করছে!
বই এ ঠিক মত মনোযোগ দিতে পারছে না ! উঠে গিয়ে তার ঘরে থাকা বইয়ের শো কেসের সামনে দাঁড়ালো আবার !
উপরের তাকে আটটা বইয়ের দিকে চোখ পড়লো ! এই বই গুলো তার খুব প্রিয় ! বই গুলোর গুনগত মানের জন্য না ! বই গুলো পাঠিয়েছিল আবির!
ইমনের যখন আবির কে খুব মনে পড়ে কোন একটা বই নিয়ে বুকের উপর জড়িয়ে শুয়ে থাকে !
তার কাছে মনে হয় আবির কে জড়িয়ে ধরে আছে !
আবির দেখতে দারুন ছিল ! উজ্জল শ্যামলা , পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির মত লম্বা , হালকা গড়নের একটা মানুষ। ইমনের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল আবিরের চোখ! চোখে এক ধরনের গভীরতা ছিল মনে হতো কত রহস্য সেই চোখের ভেতরে।
বই হাতে নিয়ে ইমনের মনে হচ্ছে আবিরের হাত ধরে বসে আছে সে!
এই বই গুলো আবির তার এক বন্ধুর সঙ্গে পাঠিয়েছিল ইমনের জন্মদিন উপলক্ষে ! অনেক গিফটের সঙ্গে এই আটটা বই ছিল!
বইয়ের মত প্রতিটা গিফট আজো আছে ইমনের কাছে !
জন্মদিনের পর দিন ফোন দিয়ে বলল,
: ইমন আমি আজও তোমাকে স্বপ্ন দেখেছি ।
: তুমি ঘুমানোর আগে আমাকে নিয়ে চিন্তা করছিলে তাই স্বপ্ন দেখেছো!
: বুঝলে দেশে আসার সময় টা যত এগিয়ে আসছে আমার তোমাকে দেখার ইচ্ছে টা এতটা তীব্র হচ্ছে ইমন আমি তোমাকে কি বলব !
: আমিও তোমার জন্য অপেক্ষা করছি !
: একটা ব্যাপার তোমার কাছে বলতে লজ্জা পাচ্ছি কিন্তু বলার লোভ ও সামলাতে পারছি না আমি যতবার তোমাকে স্বপ্ন দেখেছি আমি দেখেছি আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে ! তুমি স্ত্রী হিসেবে ই আমার পাশে আছো!
: ইমন লজ্জা পেলো আবিরের কথায় , অপর প্রান্তে চুপচাপ শুনছিল ওর কথা গুলো শুধু !
: বিয়েটা হয়ে গেলেই বুঝলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হবে তোমাকে এখানে আনার চেষ্টা করব ! আমার খুব ইচ্ছে তোমাকে আমার ইউনিভার্সিটির সব কিছু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাই !
: ঠিক আছে!
: আমি চোখ বন্ধ করলেই দেখি আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি সব জায়গায় !
: এখন কি জেগে জেগেও স্বপ্ন দেখো নাকি তুমি , ইমন হাসছে !
: হুঁ ইমন, তুমি বুঝবে না তোমাকে দেখার কি এক তৃষ্ণা !
ইমনের আবিরের ঐ কথা গুলোতে খুব লজ্জা লাগতো কিন্তু এত ভালো লাগতো শুধু শুনতে ইচ্ছে করতো।
সেই যুগের কার্ড ফোনে পাঁচ সাত মিনিটের বেশি কথা হতো না !
ইমন এর অপেক্ষা করতে খুব ভালো লাগতো আবিরের জন্য !
সেই সব দিন আজও মনে পড়লে কত ভালো লাগে!
তিন চার দিন পর অফিস থেকে ফিরে ইমন দেখে মেঝ ফুপু নাজনীন ওদের বাসায় । বোঝা যাচ্ছে আবার ফুপু তাকে বোঝানোর জন্য কিংবা ব্যাখ্যা চাইতে এসেছে। ইমন ঠিক করছে এভাবে লুকোচুরি আর না ।
ফ্রেশ হয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখে ফুপু ওর রুমে অলরেডি বসে আছে !
কেমন চলছে তোর অফিস ?
ভালো !
কোন ব্রাঞ্চ এ এখন তুই ?
আগে যেটাতে ছিলাম , কারওয়ান বাজার !
ও আচ্ছা তাই তো !
ইমনের ফুপুর পাশে গিয়ে বসলো ! তুমি কিছু বলবে ?
কি বলবো বল ?
যা বলতে এসেছো ?
ইমন তুই জানিস আমি তোকে কতটা ভালবাসি, আমাদের বংশের সবচেয়ে বড় মেয়ে তুই। ছোট থেকে কোলে পিঠে নিয়ে বড় করেছি , তোর জন্য যে মায়া তা অন্য একটার জন্যেও নেই !
আমি জানি ফুপু !
প্লিজ মা আমার, তুই তোর জীবনটা নিয়ে কি শুরু করেছিস তোর বাবা মা আমরা কেউ সহ্য করতে পারছি না রে !
কিছু শুরু করিনি ফুপু আমি শুধু বিয়ে করতে চাইছি না ! আর বিয়েই একটা মানুষের জীবনের সব কিছু নাকি ?
কেন চাইছিস না সেটা বলবি তো ?
ইমন আবার চুপ করে রইলো !
আজ তোর কাছ থেকে শুনব আমি কারন টা কি ?
ফুপু অনেক বছর আগে এই তোমরা আমাকেই এক জনের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলে !
হুম সে তো অনেক বছর আগের কাহিনী ! তাছাড়া ঐ ছেলের সঙ্গে কথা বার্তা এগিয়েছিল বিয়ে তো আর হয়নি !
হুম বিয়ে হয়নি ফুপু পাঁচ টা মাস আমি তো ওকে নিয়েই কাটিয়ে দিলাম !
কি আবোল তাবোল বলছিস ইমন ! ঐ ছেলে তো মরে ভূত হয়ে গেছে তার কথা এত বছর পর এখানে আসছে কেন ?
না মরে ভূত হয়ে যায় নি ! ইমন ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠল !
নাজনীন ফুপু ইমনের চিৎকার শুনে থতমত খেয়ে গেলেন! তিনি কোন দিন ইমনের এই রূপ দেখেননি। ইমন এর ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে। শরীর কাঁপছে ! চোখ দিয়ে পানি পড়ছে !
নাজনীন ইমন কে জড়িয়ে ধরলো !
কি বলছিস এসব মারা যায়নি ?
ফুপু আবির মারা যায় নি ! আবির মারা যায়নি!
( চলবে )