দরিয়া
পর্ব – ৭
আমিরাহ্ রিমঝিম
এক হাতে ক্রাচ আর অন্য হাতে মালতীকে ধরে ধীরে ধীরে সিড়ি বেয়ে ছাদে উঠছে আফিয়া। ছাদের আর বিদ্যুতের সংযোগ খারাপ হয়ে গিয়েছে। ছাদের কাছাকাছি তাই সিড়িতেও অন্ধকার। কেয়ারটেকার ভাইয়ার কাছ থেকে টর্চ চেয়ে আনা হয়েছে। মালতীর কষ্ট হচ্ছে এভাবে এক হাতে টর্চ নিয়ে অন্য হাতে আফিয়াকে ধরে সিড়ি বেয়ে উঠতে সাহায্য করতে।
ছাদে উঠে দুজনেই হাফ ছেড়ে দাঁড়ায়। ছাদজুড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার, আকাশে আজ চাঁদটাও নেই। চাঁদহীন আকাশে শোভা পাচ্ছে অগুনতি তারা। সমুদ্রের মৃদু গর্জন শোনা যাচ্ছে এখান থেকেও। শরীর শীতল করা বাতাস বইছে, সে বাতাসে আফিয়ার মন যদি একটু ভালো হয়।
“তুমি কি বসবে আফিয়া? তাহলে চেয়ার নিয়ে আসি। লাইটটা ধরো।”
“ তোমার লাইট লাগবেনা আপু? সিড়িতে তো অন্ধকার।”
“অত বেশি অন্ধকার না। তুমি লাইট নিয়ে কিছুক্ষণ দাড়াও। ভয় পাবে না তো আবার?”
আফিয়া মাথা নেড়ে না বোঝালো। মালতী আফিয়ার হাতে লাইট ধরিয়ে দিয়ে সিড়ির দিকে আগালো। আফিয়া লাইট ধরে রাখলো সেদিকে।
মালতী চলে যেতে আফিয়া একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ওর আসলে খারাপ লাগছে খুবই। মস্তিষ্কের কোনো একটা জায়গায় ওর মনে হচ্ছে রোকসানার জীবনটা এরকম হয়ে যাওয়ার জন্য আফিয়াও কিছুটা দায়ী। কিন্তু ব্যাপারটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না আফিয়া। মনকে বার বার বুঝ দেয়, ওর কোনো দোষ নেই। সব দোষতো ওই জঘন্য লোকটার, যে কিনা সম্ভবত ওর তুরাগ ভাইয়া। আফিয়ার তো কোনো দোষ নেই। কি করেছে ও? হ্যাঁ, হয়তো সেদিন সন্ধ্যায় রোকসানাকে যেতে বলাটা ভুল হয়েছে, কিন্তু আফিয়া তো নিজের বান্ধবীর খারাপ চায়নি। ওই ঘটনার পরও সাহায্যই তো করতে চেয়েছিলো। না না, কোনোই দোষ নেই ওর।
নিজেই নিজেকে বুঝ দিতে থাকে ও। বেচারি আফিয়া। ব্যবস্থা যে পরিস্থিতি বুঝে নিতে হয় সেই বোধ হয়নি ওর।
হঠাৎ আফিয়ার মনে হয় ছাদে আরো কেউ আছে। এবার ওর মনে ভয় ঢুকে যায়। সাবধানে মাথা এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখতে পায় ওর থেকে বেশ খানিকটা দূরে ছাদের মেঝে থেকে কিছুটা উপরে একটা ক্ষীণ লাল আলো নড়াচড়া করছে। আফিয়া তড়িৎগতিতে সেদিকে আলো ফেলতেই তুরাগ চোখ কুচকে ফেলে।
“আরে, চোখে লাইট ফেলছো কেন? লাইট সরাও।” তুরাগ চেচিয়ে বলে।
আফিয়া যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। ছাদের রেলিংয়ের উপর বসে সিগারেট খাচ্ছে তুরাগ। আর এদিকে ও কি ভীষণ ভয়টাই না পেয়েছিলো।
ক্ষানিকক্ষন পর মন কিছুটা শান্ত হয়ে আসলে আফিয়ার খেয়াল হয় ওর সামনে তুরাগ রয়েছে। চট করেই মেজাজটা খারাপ হয়ে যায় ওর। হাতের টর্চটা আরো মুষ্টিবদ্ধ করে সেদিকে আগায়।
আফিয়া তুরাগের সামনে এসে দাড়ালে তুরাগ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায়।
“ আপনি সিগারেট খাচ্ছেন এখানে বসে?”
“কেন? কি সমস্যা?”
“লজ্জা করে না আপনার? এতো খারাপ কাজ করেও এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন? ”
তুরাগ আফিয়ার কথায় প্রতুত্তর করে না। উত্তর না পেয়ে আফিয়া আরো ক্ষেপে যায়।
“ কথা বলছেন না কেন এখন, হ্যাঁ? একেতো ব্যবসার সমস্ত কিছু হাতিয়ে নিতে আমাকে বিয়ে করতে চেয়ে বসে আছেন। এখন আবার আমার বান্ধবীর সাথে এমন করলেন। খারাপ লোক!”
তুরাগ ভ্রু কুচকে বললো, “ কিসব উল্টাপাল্টা কথা বলছো?”
আফিয়া চেচাঁতে লাগলো, “ উল্টাপাল্টা কথা বলছি আমি? সত্য কথা শুনতে ভালো লাগে না? আপনি একটা লোভী, অসভ্য লোক। সেদিন আপনি রোকসানার পেছন পেছন জাননি? আপনিই রোকসানার সাথে অসভ্যতামি করেছেন, জানি আমি। আপনি একটা জঘন্য লোক, আপনি…”
তুরাগ আর শুনতে পারলো না। চিৎকার করে বললো,“ চুপ, আর একটা কথাও তুমি বলবেনা বেয়াদব মেয়ে।”
তুরাগের এক ধমকে আফিয়া থেমে যায়। তুরাগ রেলিং থেকে উঠে দাঁড়ায়, চেচিয়ে বলতে থাকে, “ শুধু আমাকে পছন্দ করোনা বলে এরকম জঘন্য অপবাদ দিচ্ছো আমাকে, হ্যাঁ? আমাকে তো খারাপ বলো, নিজে কি তুমি? মানছি আমি সিগারেট খাওয়া ভালো না, কিন্তু তোমার ব্যবহার তো সিগারেট খাওয়ার চেয়েও খারাপ। শোনো, সেদিন আমি রোকসানার পেছনে পেছনে গিয়েছিলাম কারণ তোমার মতো একটা ব্রেইনলেস মেয়ে তার বান্ধবীকে সন্ধ্যাবেলা বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। আমি গিয়েছিলাম ওকে বাসায় এগিয়ে দিতে কিন্তু অনেকদূর গিয়েও পাইনি। যদি কাউকে এ ঘটনার জন্য দায়ী করতে হয় না তাহলে নিজেকেই করো। আর রইলো বাকি বিয়ের কথা। তোমাকে বিয়ের জন্য কি মরে যাচ্ছি আমি, হ্যাঁ? মরে যাচ্ছি? নিজেকে ভাবো টা কি তুমি? ব্যবসা এখন কে সামলাচ্ছে? তুমি সামলাতে পারবে ব্যবসা? ইউজলেস ব্রেইনলেস কোথাকার। ”
তুরাগ আবার রেলিঙে বসে সিগারেট টানতে থাকে। আফিয়ার দিকে একবার তাকিয়ে ধমকে বলে, “এখন যাও এখান থেকে, আমার চোখের সামনে থেকে সরো।”
প্রচন্ড রাগে ফুসছে আফিয়া। কি যে করবে দিশা পাচ্ছেনা ও, মাথা যেন টগবগ করছে। অতিরিক্ত রাগে জ্ঞানশূন্য হয়ে সর্বশক্তি দিয়ে হাতের টর্চটা ছুড়ে মারলো তুরাগের দিকে। মারার ঠিক আগ মূহুর্তে আফিয়ার খেয়াল হলো সে কি করছে, কিন্তু ততক্ষণে টর্চ হাত ছুটে বেড়িয়ে গেছে।
পরের ঘটনাগুলো ঘটলো খুব দ্রুত, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। আফিয়ার চোখের সামনে টর্চটা গিয়ে আঘাত করলো তুরাগের গলায়। আঘাত পেয়ে নিজের ব্যালেন্স হারিয়ে তুরাগ ছাদ থেকে পরে গেলো। এর মূহুর্তেরও কম সময় পরে কংক্রিটের উপর মাথা ফাটার আওয়াজ এলো।
স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো আফিয়া। কি হয়েছে এখনো বুঝে উঠতে পারছে না ও। মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে যেন। তখন ছাদে এলো মালতী। মালতীকে দেখে ও একটাই কথা বলতে পারলো, “ আপু, আমাকে ঘরে নিয়ে চলো।”
…………………………………………………………………………
চোখের পানিতে নিকাব ভিজে গেছে আফিয়ার। আর নিতে পারছে না ও। সেই ১৫ বছর আগের দৃশ্যগুলো যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে, অস্থির লাগছে ভীষণ। মাথার ভেতরটা যেন দপদপ করছে।
বেঞ্চে গিয়ে বসার জন্য এগোয় আফিয়া। কিন্তু এতক্ষন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকাতে পা আর ক্রাচ অনেকখানি বালুতে দেবে গেছে। আফিয়া এগোতে গিয়ে বালুতে পা আর ক্রাচ বেধে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, ইমা ওকে ধরার জন্য ছুটে আসার আগেই ভেজা বালুতে মুখ থুবড়ে পরে যায় আফিয়া। সমুদ্রের ঢেউ ওর মাথার উপর দিয়ে গিয়ে সৈকত স্পর্শ করে।
চলবে