দরিয়া পর্ব- ৫,৬

0
207

দরিয়া
পর্ব- ৫,৬
আমিরাহ্ রিমঝিম

রোকসানা আসে তার সময়-সুবিধা বুঝে। আফিয়া যেহেতু অবসরেই থাকে সবসময় তাই ওর অসুবিধা হয় না। রোকসানা এলে পড়া বুঝিয়ে দেয়, গল্প করে, মালতীও ওদের গল্পে অংশ নেয় মাঝে মাঝে। কোনো কোনো দিন পড়া শেষে দুইজন হাটতে বেড়োয় সমুদ্রপাড়ে। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো সময় ভেসে যায়।

সেদিন রোকসানার আসতে আসতে বিকেল হয়ে গেলো। এক দেড় ঘন্টার মতো পড়ার পর বসলো গল্পের আসর। গল্প করতে করতে যখন মাগরিবের আজান দিয়ে দিলো তখন হুশ হলো দুজনের। মাগরিবের নামাজের পর আফিয়া বললো, “ তোমার তো দেরি হয়ে গেলো, এখন তাহলে যাও তুমি।”

রোকসানা থমকে গেলো। এই সন্ধ্যারাতে যে আফিয়া ওকে এভাবে বাড়ি ফিরে যেতে বলবে এটা তার কল্পনাতেও আসে নি। মাত্রই সে ভেবেছিলো আফিয়াকে বলবে যে আজকে এখানেই থাকতে চায়। এর আগেও আফিয়াদের বাসায় রাতে থেকেছে সে, তাই আজকে থাকলে তাদের বাড়িতে চিন্তা করবে না। কিন্তু এখন কিভাবে বলবে কথাটা?

রোকসানা ধীরপায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো বাইরে এখনো যথেষ্ট আলো আছে। কিন্তু বাড়ি যেতে যেতেই তো অন্ধকার নেমে আসবে। রোকসানার মনে এখনো দ্বিধা কাজ করছে। আফিয়াকে কি বলবে আজকে থেকে যাওয়ার কথা?

আফিয়ার বাবা কিছুটা অসুস্থবোধ করায় নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছেন। কেয়ারটেকার ভাইয়া রত্না আপুকে নিয়ে গিয়েছেন কোনো এক অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে। তুরাগ বাসাতেই ছিলো, মাগরিবের আজানের পর মসজিদে গিয়েছে নামাজ পড়তে, এখনো ফেরেনি।

রোকসানা ভাবলো তুরাগ আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে, তুরাগ ফিরলে তাকে অনুরোধ করবে বাসায় পৌঁছে দিতে। যদিও সেদিনের ঘটনার পর তুরাগের সাথে যাওয়াটা বেশ বিব্রতকর, তবে এখন এটাই সবচেয়ে ভালো উপায় বলে মনে হচ্ছে।

আফিয়া এগিয়ে গিয়ে রোকসানার জন্য দরজা খুলে দিয়ে দাড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা দেখে রোকসানা আবার থমকালো। এখন তো এখানে বসে অপেক্ষাও করা যাবে না। ধীরে ধীরে দরজার বাইরে এসে দাড়ালো। আফিয়া তখনো দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। ভেবেছিলো দরজার বাইরে দাড়িয়েই তুরাগের জন্য অপেক্ষা করবে। কিন্তু আফিয়া তো দরজা আটকাচ্ছে না। শেষমেশ হাটতে হাটতে বাড়ির সীমানার বাইরে এসে দাড়ালো। তুরাগের জন্য কি অপেক্ষা করবে? নাকি চলে যাবে? তুরাগ যদি এখন না ফিরে? অনেক রাত করে ফেরে যদি? এতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে?

কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে বুকে সাহস নিয়ে সামনে এগোতে থাকে। এখান থেকে বাড়ি যাওয়ার দুইটা রাস্তা আছে। একটা সোজা রাস্তা, যেখান দিয়ে আসতে সময় কম লাগে। বেশিরভাগ সেই রাস্তা দিয়েই আফিয়াদের বাসায় আসে সে। তবে সেই রাস্তায় এখন যাওয়া যাবে না। রাতের বেলা রাস্তাটা একদমই নিরাপদ নয়। অন্য রাস্তা দিয়ে যেতে হবে। সেই রাস্তায় অনেক ঘুরানো-পেচানো। কতক্ষণ যে লাগবে যেতে। বাসায় গিয়ে নির্ঘাত মার খাবে আজকে।

হঠাৎ রোকসানা খেয়াল করে অভ্যাসবশত সেই সোজা রাস্তা ধরেই কিছুদূর চলে এসেছে। পুরো রাস্তায় কোনো মানুষ দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার হয়ে আসছে প্রায়। রোকসানার ভয় করতে থাকে। ফিরে যাবে কিনা ভাবতে থাকে। আবার ভাবে এসেই যখন পড়েছে এই রাস্তায়, বাকিটুকু যেতে কতক্ষণ লাগবে? ওড়নার কোনা হাতে মুঠোয় শক্ত করে ধরে বাড়ির দিকে দৌড়ায় রোকসানা।

রোকসানা দৃষ্টির আড়াল হলে মুচকি হেসে দরজা আটকিয়ে দিলো আফিয়া। মনে মনে সে খুব খুশি। রোকসানার জন্য এতোক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে বিদায় জানিয়ে সে অনেক ভালো কাজ করে ফেলেছে। মনটা ভীষণ ভালো লাগছে তাই।

মালতী মাত্র নামাজ পড়ে ঘর থেকে বেড়িয়েছে। ড্রইংরুমে আফিয়াকে একা দেখে তার ভ্রু কুচকে গেলো।
“রোকসানা কোথায় আফিয়া?”
“মাত্র বের হলো।”
“মাত্র বের হলো মানে? এই অন্ধকারে ও একা একা বাড়ি যাবে কিভাবে ? তুমি যেতে দিলে কেন ওকে?”
“অন্ধকার কোথায়? বাইরে তো যথেষ্ট আলো আছে। সেজন্যই ওকে এখনই বের হতে বললাম, নাহলে পরে তো রাত নেমে যাবে।”

মালতী হতবাক হয়ে গেলো আফিয়ার কথায়। আফিয়া নিজে রোকসানাকে যেতে বলেছে? এই সন্ধ্যারাতে?
“তুমি কি পাগল আফিয়া? এইটুকু আলো শেষ হতে কতক্ষণ লাগবে? মেয়েটা ভালোয় ভালোয় বাড়ি পৌছাতে পারলেই হয় এখন।”

মালতীর কথায় ব্যাপারটা আফিয়ার মাথায় আসে। তাইতো! রোকসানা এই অন্ধকারে ফিরবে কিভাবে? ব্যাপারটা তো ও ভাবেই নি। চিন্তিত মনে বাবাকে নামাজের জন্য ডেকে নিজের ঘরে চলে গেলো। জানালার কাছে গিয়ে বসতেই দেখলো তুরাগ ফিরছে। তুরাগ ঘরে ঢুকে মালতীর সাথে কিছু কথা বললো বোধহয়, আফিয়া শুধু এইটুকু বুঝতে পারলো রোকসানাকে নিয়ে কোনো কথা হচ্ছে। এক মিনিট পরেই আবার তুরাগকে বেরিয়ে যেতে দেখলো। সেদিকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আফিয়া।

আফিয়া অনেকক্ষণ ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ঘুম আসছেনা কিছুতেই। আজকে কি ও অনেক বড় কোনো ভুল করে ফেললো? রোকসানা ঠিকভাবে বাসায় গেছে তো? আর তুরাগই বা তখন ওভাবে ছুটে বেড়িয়ে গেলো কেন? আবার রাতের খাবারের সময় তো টেবিলেই দেখলো তাকে, তাহলে ফিরলো কখন? আজ রোকসানাকে এভাবে যেতে দেয়ায় সবার কাছেই বকা খেয়েছে আফিয়া। ওর বাবা, মালতী, তুরাগ কেউই বাকি নেই। কেয়ারটেকার আর রত্না যদি থাকতো তবে হয়তো তারাও বকতো। তবে নিজের মন খারাপ ছাপিয়ে রোকসানার চিন্তাই আজকে প্রাধান্য পাচ্ছে ওর কাছে। রোকসানার কিছু হয়ে যায়নি তো আবার? এবার নিজেই নিজের উপর বিরক্ত হয়ে যায় আফিয়া। অতিরিক্ত ভাবছে ও। রোকসানা হয়তো এতোক্ষনে বাড়ি গিয়ে খেয়েদেয়ে দুই তিন ঘন্টা ঘুমিয়েও ফেলেছে, আর এদিকে আফিয়া অস্থির হচ্ছে। তবে আফিয়া ঠিক করেছে এমনটা ও আর কখনোই করবে না।

বাসায় শুনশান নীরবতা। সবাই ঘুমাচ্ছে। আফিয়ার চোখ মাত্রই লেগে এসেছিলো, কান্নাকাটি আর কথার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো। হঠাৎ ঘুম ভাঙায় প্রথমে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না ও। তারপর ধীরে ধীরে মনে হলো ওর বাবা কথা বলছেন কেয়ারটেকারের সাথে, রত্না আপুর কন্ঠও শোনা যাচ্ছে। তারমানে উনারা ফিরেছেন। কিন্তু কাঁদছে কে? কন্ঠটা কি রোকসানার মতো লাগছে? চট করেই আফিয়ার চোখ থেকে ঘুম ছুটে যায়। খারাপ কিছুর আশংকায় বুক ধড়ফড় করতে থাকে। যথাসম্ভব দ্রুত উঠে ক্রাচ হাতে নিয়ে ড্রইংরুমের দিকে এগোয়।

রোকসানা একটা চাদর পেচিয়ে সোফায় বসে কাঁদছে, ওর দৃষ্টি উদ্ভ্রান্ত, চেহারার বিশ্রী অবস্থা। মালতী তাকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করছে, রত্না তার হাতের মুখের ক্ষতে ওষুধ দিয়ে দিচ্ছে। তুরাগ গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে। কেয়ারটেকার আফিয়ার বাবার সাথে কথা বলছে।

রত্নাকে নিয়ে আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিলো তাদের। বাড়ির কাছাকাছি আসার পথে রাস্তার পাশ থেকে গোঙানির আওয়াজ পায় দুজন। সেদিকে আলো ফেলতেই রোকসানার চেহারা দেখতে পায়।

সব শুনে আফিয়ার বাবা মলিন মুখে বলেন “পুলিশে কেস করতে হবে। কিন্তু সবার আগে রোকসানাকে হসপিটালে নিতে হবে, ট্রিটমেন্ট করাতে হবে। আর ওর বাসাতেও তো খবর দিতে হবে।”

এ কথা শুনে রোকসানা আঁতকে উঠে। সোফা থেকে উঠে আফিয়ার বাবার পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে বসে কাঁদতে কাঁদতে বলে “ চাচা পায়ে পড়ি আপনার পুলিশ ডাকবেন না, এলাকায় জানাজানি হয়ে যাবে। হাসপাতালে যাওয়ার দরকার নেই আমার। শুধু আজকে রাতটা এখানে থাকতে দিন।”

রোকসানার কান্ডে সবাই বেশ চমকে যায়। মালতী দ্রুত ওকে টেনে তোলে। উঠে দাড়াতেই অজ্ঞান হয়ে হয়ে যায় রোকসানা। মালতী আর রত্না দুজন মিলে ওকে ধরে মালতীর ঘরে নিয়ে যায়। তুরাগ থমথমে চেহারায় আফিয়ার বাবাকে বলে “চাচা, রোকসানা যেহেতু হসপিটালে যেতে চাচ্ছে না, আমি দেখি কোনো ডাক্তার ওকে বাসায় এসে দেখে যেতে রাজি হয় কিনা।”
আফিয়ার বাবা মাথা নেড়ে সম্মতি দিলে তুরাগ বেড়িয়ে গেলো।

এদিকে নিজের ঘরের দরজার সামনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আফিয়া। ওর মাথায় বাজ পড়েছে যেন।

চলবে

দরিয়া
পর্ব – ৬
আমিরাহ্ রিমঝিম

চার দিন পেরিয়ে যায়। রোকসানা আর আফিয়ার কাছে পড়তে আসে না, সাগরপাড়েও যায় না। একদমই গুটিয়ে গেছে সে। মাঝে একবার কেয়ারটেকার ভাইকে দিয়ে খবর নিয়েছিলো আফিয়া, রোকসানা ঠিক আছে।

এই কয়দিনে আফিয়ার মনে তুরাগের উপর দৃঢ় সন্দেহ তৈরী হয়েছে। সেদিন রোকসানা যাওয়ার কিছুক্ষণ পর তুরাগও বেড়িয়ে যায়, আবার রাতের খাবারের আগে ফিরেও আসে। কোথায় গিয়েছিলো সে? তাছাড়া একদিন যে তাকিয়ে ছিলো রোকসানার দিকে।

আফিয়ার বার বার মনে হচ্ছে তুরাগই এই ঘটনার জন্য দায়ী। যদিও এই কথা ওর বাবাকে বলাতে ধমক খেতে হয়েছে। আর মালতী আপু একথা শুনে জানিয়েছে যে রোকসানা বলেছিলো ওই জঘন্য লোকটা অপরিচিত কেউ। আফিয়া তবু নিশ্চিত হতে পারছে না। রোকসানা হয়তো ভয়ে তুরাগের বিরুদ্ধে কিছু বলছে না। আর ওর বাবা তো ওর কথা বিশ্বাসই করছে না। তবে রোকসানার পরিবার নিশ্চয়ই চুপ করে বসে থাকবে না।

সকাল সকাল অনেক বায়না করে মালতী আর কেয়ারটেকার ভাইয়াকে রাজি করলো ওকে রোকসানাদের বাসায় নিয়ে যেতে। কেয়ারটেকার ওদের দুজনকে রোকসানাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে কোথাও একটা গেলো। বাইরে থেকে দেখতে সব ঠিকঠাকই মনে হচ্ছে।

— আফিয়া?
—হ্যাঁ আপু?
— রোকসানার ব্যাপারটা হয়তো ওর বাসা ছাড়া বাইরের কেউ জানে না, হতে পারে বাসার লোকজনও জানে না। তাই আগ বাড়িয়ে এ বিষয় নিয়ে কারো সাথে আলাপ করতে যেও না। বান্ধবীর খোঁজ নিতে এসেছো, অযথা ঝামেলা করো না কোনো।

মালতীর কথায় আফিয়া হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেও মনে মনে বিষয়টায় সম্মত হতে পারলো না।

বাড়ির উঠানে গিয়ে এক প্রতিবেশিকে দেখতে পেলো, আর একজন মহিলা বিশাল উড়না গায়ে জড়িয়ে রান্নাঘরে কাজ করছে। প্রতিবেশিকে রোকসানার কথা জিজ্ঞাসা করতেই রান্নাঘরের ওই মহিলার দিকে দেখিয়ে দিলেন।

—ঠিক আছো রোকসানা?
রোকসানা ভাত বসানোর জন্য চাল ধুচ্ছিলো। মালতীর কথা শুনে ওদের দিকে তাকালো, অতি ক্ষীণ একটি হাসির রেখা মুখে ফুটে উঠেই আবার মিলিয়ে গেলো। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মলিন কন্ঠে বসতে বললো দুজনকে, তারপর ভাত বসাতে ব্যস্ত হয়ে গেলো।

প্রতিবেশি মহিলাটি রান্নাঘরের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো, “ দেখেছিস রোকসানা, তোর বান্ধবী দেখতে চলে এসেছে তোকে।”
মালতী আর আফিয়ার দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করলো, “ আহারে, সেদিন না বলে আপনাদের বাসায় থাকাতে হানিফের মা মেয়েটাকে কি মারটাই না মারলো। মার খেয়ে অসুস্থই হয়ে গেলো মেয়েটা। আমরা কেউ তো দেখি নি মারতে, কিন্তু পরে গিয়ে দেখি হাতে মুখে দাগ হয়ে আছে। জিজ্ঞাসা করাতে হানিফের মা বললো মার দিয়েছে মেয়েকে।”

আফিয়া প্রচন্ড চমকে গেলো। এমনিতেই মেয়েটার এই অবস্থা তার উপর ওর মা ওকে এভাবে মেরেছে? রোকসানার কি দোষ ছিলো? তবে মালতী ঠিকই বুঝতে পারলো মেয়ের হাত-মুখের ক্ষতের দাগের ঘটনা মা মারের কথা বলে চাপা দিয়েছেন।

রোকসানার মা এসে আফিয়া আর মালতীকে ঘরে নিয়ে গেলেন। রোকসানার এক চাচী ছিলো সেখানে। রোকসানার মা ওদের সাথে টুকটাক আলাপ করে কাজ করতে গেলেন। মালতীও গেলো উনাকে সাহায্য করতে।

আফিয়ার ভালো লাগছিলো না। একে তো রোকসানার এই অবস্থা, তার উপর ওর মা মেরেছে ওকে, আবার কাজও করাচ্ছে। এমন কেন করছেন ইনারা? রোকসানার এই ঘটনায় কোনো স্টেপও নেননি। এমনটা তো হতে দেয়া যায় না। বুঝাতে হবে উনাদের। রোকসানার ব্যাপার বাড়ির কেউ না জানলেও বাড়ির লোকদের তো জানার কথা। তাদের সাথে আলোচনা করতে তো সমস্যা নেই।

এসব ভেবে রোকসানার চাচীকে প্রশ্ন করলো,
“ আপনারা রোকসানার ঘটনায় কোনো স্টেপ নিচ্ছেন না কেন? পুলিশে কেন খবর দেননি? রোকসানা নয় শুধু শুধুই ভয় পাচ্ছে, আপনারাও কি ভয় পাচ্ছেন?”
রোকসানার চাচী ভ্রু কুচকে পালটা প্রশ্ন করলো, “ পুলিশে কেন খবর দিবো?”
“আশ্চর্য, আপনাদের মেয়ের উপর যে এরকম জঘন্য অত্যাচার করলো তাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেবেন?”

প্রশ্নটা করেই আফিয়ার মনে হলো উনি হয়তো কিছু জানেন না এ ব্যাপারে। এদিকে রোকসানার চাচী রহস্যের গন্ধ পেলেন আফিয়ার কথায়। ঘুরিয়ে পেচিয়ে উনি ঠিকই আফিয়ার পেট থেকে সব কথা বের করে নিলেন। তারপর উঠে চলে গেলেন কিছু না বলে।

আফিয়া আর মালতী চলে আসার আগেই চারিদিক থেকে নানান বাক্যবাণ এসে ঘিরে ধরলো রোকসানা আর তার পরিবারকে।

একা একাই সাগরপাড়ে চলে এসেছে আফিয়া। দুচোখে বইছে নোনাজলের ধারা। ও ভুলটা করলো কোথায়? ও কি জানতো সবার ক্ষেত্রে যে চাচা-চাচী মানে নিজের আপনজন হয়না? সে তো নিজের চাচীর কাছে মায়ের মতোই স্নেহ পেয়েছে। আর ও তো রোকসানার ভালোর জন্যই ওদের বাসার কারো সাথে কথা বলতে চেয়েছিলো। ও কি জানতো এর ফলে রোকসানাকে এরকম বিশ্রী অবস্থায় পড়তে হবে?

এই ঘটনা জানার পর বাসায় সবাই বিস্তর রেগে আছে আফিয়ার উপর। সবচেয়ে বেশি রেগে আছে মালতী। আফিয়ার কিছু ভালো লাগছেনা। সমুদ্রের পাড়ে এসেও মন খারাপ কাটাতে পারছেনা।

একটু দূরে দুইটা বড় মাছ ধরার নৌকা রাখা। তার এক নৌকায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে কেউ। আফিয়া কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর সেদিকে এগিয়ে গেল।

বালুর উপর ক্রাচ নিয়ে হাটা বেশ কষ্টকর। আফিয়া তবু অনেকক্ষণ ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে নৌকাগুলোর কাছে দাড়ালো।
“হানিফ ভাইয়া?”
হানিফ ঘাড় ঘুরিয়ে আফিয়াকে দেখতে পেয়েই মুখ ফিরিয়ে নিলো।
“ভাইয়া আপনারা পুলিশে খবর দিন। এই কাজ যেই করে থাকুক তার শাস্তি পাওয়া উচিত।”
“চলে যান।”
“আরে আমিতো ভালোর জন্যই….”
“অনেক ভালো করে ফেলেছেন, আর করবেন না”
কথাটা বলে আর একটা মুহূর্ত বিলম্ব না করে হানিফ চলে গেল সেখান থেকে।

একা একা সৈকতে যাওয়ার জন্য বাসায় ফেরার পর আরেক দফা বকা খায় আফিয়া। তবে ওর মাথায় তখন অন্যকিছু চলছে। কেউই রোকসানাকে কষ্ট দেয়ার ব্যাপারটায় স্টেপ নিচ্ছে না যখন, তাহলে সে নিজেই পুলিশে খবর দেবে। ওর ধারণা এই ঘটনার পেছনে তুরাগই দায়ী। এর তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে।

পরেরদিন সকালে খাবার টেবিলে বসে আফিয়া খবর পায় রোকসানার পুরো পরিবার এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছে। কোথায় গিয়েছে কেউ বলতে পারছে না।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here