#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী পর্বঃ দুই+তিন
#মম_সাহা
রাত নেমেছে আকাশের বুকে। ভীষণ নিস্তব্ধ রাত। বিষন্ন রাত। যে রাত মন খারাপ গুলো লুকিয়ে রাখে নিজের বুকে। দর্শিনী শুয়ে আছে ছাদের হিমশীতল হয়ে থাকা মেঝেতে। শাড়ির আঁচল বিছিয়ে আছে পাশেই। নিষ্পলক চেয়ে আছে আকাশের পানে। হিসেব মেলাচ্ছে হয়তো। পাওয়া না পাওয়ার হিসেব। যেদিন বিপ্রতীপের সাথে তার প্রথম দেখা হয়েছিলো,তখন ভরা আষাঢ় পরিবেশে। তুমুল বর্ষণের দিনে দেখা। তারপর কত বর্ষণ গেলো। দর্শিনীর চোখ আর অন্য পুরুষকে দেখে নি। এক পুরুষের মায়ায় আটকে যে গেলো, তা আর ফেরানো গেলো না। মা তো ঘোর আপত্তি, বিয়ে এখানে দিবে না। তবে বাবা ছিলেন মেয়ে ভক্ত। মেয়ের তুষ্টিতেই তার সন্তুষ্টি। অবশেষে বিয়েটা হলো আরেক আষাঢ়ে। যা তাসেরঘরের মতন ভেঙে গেলো বছর তিন না পেরুতেই।
“দিদি,তুমি এখানে অমন করে শুয়ে আছো যে!”
এক নারী কণ্ঠে এক আকাশ বিষ্ময় মাখা প্রশ্ন শুনে ধ্যান ভাঙে দর্শিনীর। সে উপলব্ধি করে,চোখে তার অশ্রুকণা। মনে তার ভিষণ প্রলয়ঙ্কারী তান্ডব। উন্মাদনা তার শিরায় শিরায়। দর্শিনী সময় নিলো। নিজেকে ধাতস্থ করলো। রাতের আধাঁরে লুকালো অশ্রুকণা। বেশ স্বাভাবিক ভাবে উঠে মাথা ঘুরিয়ে পিছে তাকালো। পিছে তাকাতেই তার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। দরজায় যেনো কেনো রাজকন্যা দাঁড়িয়ে আছে! কপালে তার মোটা করে সিঁদুর লেপ্টানো। হাতে সাদা শাখা। লাল টুকটুকে শাড়ি তার শরীরে জড়ানো। এ কোনো স্বর্গের অপ্সরা! এ জন্যই বিপ্রতীপের মাথা ঘুরেছে। একমাত্র প্রেমে অন্ধ আর বোকা পুরুষ ছাড়া এ নারীকে কেউ প্রত্যাখ্যান করবে না। আর বিপ্রতীপ বরাবরই চালাক।
দর্শিনীকে চুপ থাকতে দেখে এগিয়ে এলো মায়া। প্রানবন্ত চমৎকার মেয়ে। দস্যিপনা যেনো তার রক্তে। মুখে সেই সকালের মতন হাসি ঝুলিয়ে দর্শিনীর পাশে গিয়ে ধপাস করে বসলো। দর্শিনী ক্ষাণিকটা চমকালো। মেয়েটা এত উড়নচণ্ডী কেনো? পরক্ষণেই সে নিজের কথা ভেবে থম মেরে যায়। সেও কী কম উড়নচণ্ডী ছিলো! সময়ের বিবর্তনে আজ তার চেয়ে বড় নিস্তব্ধতা কারো নেই। এই বিশাল রাতের আকাশেরও নেই।
তন্মধ্যেই মায়া আবার তার ঝলমলে উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“তুমি কী কথা কম বলো,দিদি?”
“না তো। তোমার বুঝি তাই মনে হলো?”
রাতের আধার ভেদ করে দর্শিনীর কণ্ঠ মায়ার কাছে যেন দারুণ শোনালো। ষোড়শী কিশোরী খিলখিল করে হেসে বললো,
“হ্যাঁ, তাই মনে হয়েছিলো। তোমার কণ্ঠ কিন্তু দারুণ। আর তুমি দারুণ গানও জানো। আমাকে শুনাবে?”
দর্শিনীর ভ্রু কুঁচকে এলো। সে যে গান জানে সেই কথা নতুন বউ জানলো কেমন করে! দর্শিনী পাহাড়সম বিস্ময় নিয়ে বললো,
“তুমি জানো কীভাবে আমি গান জানি?”
মায়া কৌতুক হেসে গেয়ে উঠলো,
“তোর আমার প্রেমে ছিলো রে বন্ধু, ছিলো পুরোটাই পাপ।”
দর্শিনী হোঁচট খেলো মনে মনে। এ গান তো বিপ্রতীপকে শুনিয়ে ছিলো বিকেলের দিকে। তবে মেয়েটা জানলো কীভাবে? বিপ্রতীপ বলেছে! নাহ্,নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মতন ছেলে তো সে না। তবে? মেয়েটা কী তখন শুনে ফেলেছে কথা গুলো?
“কী ভাবছো, দিদি?”
দর্শিনীর আবারও ভাবনার রাজ্যে ভাঁটা পড়লো। থতমত খেয়ে বললো,
“না কিছুই ভাবছি না। তুমি অনেক চতুর কিন্তু।”
“তাই নাকি? কেনো এমনটা মনে হলো?”
“তোমার কথা বার্তা শুনে মনে হলো আর কি।”
“ওহ্,তাই বুঝি? আমি তো তত চতুর ছিলাম না। নাকি তোমার সতীন হয়েছি বলে চতুর বললে?”
এবার যেন দর্শিনীর মাথা ঘুরে উঠলো। মেয়েটা বেশ হেয়ালি করে কথা বলে। কিন্তু মেয়েটা এ কথা জানলো কীভাবে? শশুর বাড়ির সবাই তো বেশ সতর্কতা অবলম্বন করে ছিলো এ ব্যাপারে। তবুও জেনে গেলো?
দর্শিনী ভাবনা বাদ দিয়ে নিজেই জিজ্ঞেস করলো,
“কী বলছো এসব? আমি তোমার সতীন হতে যাবো কেনো? আমি তোমার কেউ না।”
“আচ্ছা মানলাম। তা দিদি,সামনের ছাদে একটা ছেলে যে এত রাতেও ড্যাবড্যাব করে আমাদের দেখছে সেটা কী জানো?”
দর্শিনী ভড়কে আশেপাশে তাকালো। হ্যাঁ দক্ষিণ দিকের বাড়ির ছাদে একজন দাঁড়িয়ে আছে। এটা নতুন ছেলেটা না? পাড়ায় নতুন এসেছে এ ছেলে। গত পরশুই তো এলো। ছেলেটার দৃষ্টি দর্শিনীর আগেই ভালো লাগতো না। কেমন করে এ বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। অদ্ভুত!
দর্শিনী উঠে দাঁড়ালো। সাথে মায়াকেও টেনে তুললো। ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
“চলো। ছাদ থেকে নিচে যেতে হবে। আজ তো কাল রাত্রি। কাল ফুলসজ্জা। নতুন বউ এত রাতে ছাদে থাকে না।”
“পুরাতন বউরা বুঝি থাকতে পারে?”
দর্শিনী জবাব দেয় না। এ মেয়ের সাথে কথায় পারা যাবে না তা সে ভালোই বুজেছে। তাই গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলো ছাদ থেকে। মায়া দাঁড়ালো। পাশের ছাদে থাকা মানবটার দিকে তাকিয়ে রহস্য মাখা হাসি দিলো। পরক্ষণেই নিচে চলে গেলো।
–
বাড়িতে রমরমা আয়োজন। আজ বৌভাতের অনুষ্ঠান। ছেলের দ্বিতীয় বিয়েতে যতটা জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন করা হয়েছে, প্রথম বিয়েতে তার একাংশও বোধহয় করা হয় নি। দর্শিনী কেবল ড্যাবড্যাব করে সে আয়োজন দেখছে। মিটমিটিয়ে হাসছে। ভাগ্য তার বেলাতেই দারুণ খেলেছে।
“এই বউ,তুমি ঘরে গিয়ে বসতে পারো না? বন্ধ্যা মেয়েমানুষ শুভ জিনিসে থাকে না। তাছাড়া তোমার কী একটু কষ্টও লাগে না?নিজের স্বামীর বিয়ে দেখছো আবার হাসছো!”
দর্শিনী নিজের কাকী শাশুরির কথায় ফিরে তাকালো। সোফায় আরেকটু কোণ ঘেঁষে বসে বললো,
“আমার স্বামীর তো কষ্ট লাগে নি। তবে আমার কেনো লাগবে!”
দর্শিনীর প্রশ্নে ভদ্রমহিলা হতবাক। ছিঃ ছিঃ করে বলে উঠলো,
“একে তো নিজের সংসার টিকিয়ে রাখতে পারো নি। আবার বড় বড় কথা বলো? তুমি কেমন মেয়ে মানুষ?”
“যে সংসার কভু আমার হয় নি,তা টিকানোর কথাও বা আসছে কোথা থেকে?”
মহিলা এবার দমে গেলো। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই বাঙালি নারীরা নত স্বীকার করতে কখনো চায় না। সেই বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কাকী শাশুড়িও চুপ রইলেন না বরং আরও কিছু কথা শুনিয়ে দিলেন। দর্শিনী কেবল চুপ করে সামনে থাকা টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। তার যেনো রাজ্যের কাজ টিভিতে।
কাকী শাশুড়ি চলে যেতেই দর্শিনী ঘরে চলে গেলো। সেখানে থাকলে কেবল এক গাদা কথাই শুনতে হবে। এর চেয়ে ঘরে থাকা ভালো। আর তো কয়েকটা দিনই এ বাড়িতে আছে। তারপর মুক্তি দিবে সবাইকে। সাথে সে নিজেও মুক্ত হবে মিছে বন্ধন থেকে।
দর্শিনী খাটের সাথে থাকা জানালার গ্রীল ধরে বসে আছে। আজকাল তার মরতে ইচ্ছে হয় না। বরং মনে হয় এই পৃথিবীতে যত বেঁচে থাকবে তত মানুষের খোলশ বদলানোর খেলা দেখতে পাবে।
ভাবনার মাঝেই দর্শিনীর চোখ পাশের বিল্ডিং এ গেলো। একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে সামনের বিল্ডিং এর সাদা টাইলস করা বারান্দাটায়। দর্শিনী চেনে ছেলেটাকে। পাড়ায় নতুন এসেছে যে,এটা সেই ছেলে। ছেলেটা এই বিল্ডিং এই তাকিয়ে আছে কেমন করে। দর্শিনী সাথে সাথে জানালা বন্ধ করে দিলো। এ কোন আ’প’দ এসে জুটলো? সকাল নেই, সন্ধ্যা নেই সবসময়ই তাকিয়ে থাকে! অদ্ভুত!
দর্শিনী অনুভব করলো তার পাশে কেউ হুড়মুড় করে বসেছে। দর্শিনী পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো মায়া। মেয়েটা আজও লাল জামদানী পড়েছে। ছোট্ট একটা মেয়ে কিন্তু কী দারুণ তার দেহ গঠন। দর্শিনী নিজেই বার বার চোখ জুড়িয়ে নেয় মেয়েটাকে দেখে।
মায়া খাটে সোজা হয়ে বসে চঞ্চল মনে বলে উঠলো,
“কী করো?”
“আকাশ দেখি।”
“আকাশ দেখো! কেনো?তোমার কী মন খারাপ?”
দর্শিনী ভ্রু কুঁচকালো। অদ্ভুত হেসে বললো,
“আকাশ দেখার সাথে মন খারাপের কী সম্পর্ক?”
“সম্পর্ক আছে। মন খারাপ যখন হয় তখন আকাশ পরিমাণ হয়। কোনো কিছুতেই ভালো হয় না। তুমি যদি আকাশের দিকে তাকাও তবে আর মন খারাপ থাকবে না। তুমি জানবে পৃথিবীতে তুমি একা না, ঐ আকাশও বিশালতা থাকা স্বত্তেও একা। সবার ভাগ্য কী আর পোষ মানে!”
দর্শিনী মুগ্ধ এতটুকু একটা মেয়ের কথায়। যেখানে এ মেয়েটার উপর রাগ আসার কথা সেখানে মুগ্ধতা কাজ করছে। মেয়ে হয়েই তার এ অবস্থা। বিপ্রতীপের তাহলে দোষ কী?
“জানো আমাদের বিয়েটা পারিবারিক ভাবে সম্বন্ধ করে হয় নি।”
মায়ার এহেন বাক্যে হতবাক দর্শিনী। সে তো জানে দুই পরিবার মিলেই দেখে শুনে বিয়েটা ঠিক করেছে। তবে? মেয়েটা এত উদ্ভট কথা কেনো বলে! দর্শিনী অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“তবে?”
মায়া বাঁকা হেসে ফিসফিস বললো,
“আমাদের প্রেমের বিয়ে।”
#চলবে
#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা
পর্বঃ তিন
“তোমাদের প্রেমের বিয়ে! কীভাবে?”
দর্শিনীর কণ্ঠে রাজ্যের বিষ্ময়। তার জানামতে বিপ্রতীপ এতটাও খারাপ না যে সংসারে থাকাকালীন পরকীয়াতে জড়াবে। তবে! মেয়েটা এই কথাটা কেনো বললো? তবে কী বিপ্রতীপকে দর্শিনী ঠিক চিনতে পারে নি! দর্শিনীর হৃদয়ে দ্বিধা,বিষ্ময় মিলে মিশে একাকার। তার অন্তর আত্মা কাঁপছে। বিপ্রতীপের এই চরিত্রটা যে সে সহ্য করতে পারবে না। তবুও মনকে শক্ত করলো। বিপ্রতীপ তো আর তার নেই। তাহলে সহ্য করার কথা আসছে কোথা থেকে?
দর্শিনীর ভাবনার মাঝেই মায়া কৌতুক হেসে ফিসফিসিয়ে বললো,
“হ্যাঁ, প্রেমের বিয়ে। আজ থেকে এক মাস আগে আমাদের শুদ্ধ প্রণয় শুরু হয়েছিলো। তুমি কী ভেবেছো,আমি উনার সম্পর্কে খোঁজ নেই নি? তুমি যে উনার প্রথম বউ তা আমি খুব ভালো করেই জানি। কিন্তু এমন ভাব ধরেছি যেন কিছুই জানিনা। শ্বশুর বাড়ির মানুষ গুলো কিন্তু ভালো অভিনয় জানে।”
“তুমিও কম জানোনা। বিবাহিত পুরুষের সংসার ভেঙে সুখে থাকতে পারবে?”
দর্শিনীর কণ্ঠে তীক্ষ্ণতা। মায়া মিষ্টি হেসে উত্তর দেওয়ার আগেই বিহঙ্গিনী তাদের রুমে হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করলো। রুমে ঢুকেই অবিশ্বাস্যকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে, আকাশসম বিষ্ময় নিয়ে বললো,
“নতুন বউ,তুমি এখানে কেনো!”
প্রশ্নটা করেই সে ভীত দৃষ্টিতে তাকালো দর্শিনীর পানে। সত্যি টা যদি নতুন বউ জেনে যায়, সে ভয়ে। দর্শিনী চোখ দিয়ে আশ্বাস দিলো- নতুন বউ কিছু জানেনা। বিহঙ্গিনী ধাতস্থ হলো। চিন্তামুক্ত হয়ে ছোট্ট শ্বাস ফেললো।
মায়া ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার চঞ্চল, উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বললো,
“এই দিদি টা অনেক ভালো, ননদিনী। তাই দিদির সাথে কথা বলতে এলুম।”
“তোমায় খুঁজছে সবাই। আজ তোমাদের ফুলসজ্জা। মহিলা এসেছে সাজাতে। চলো আমার সাথে।”
বিহঙ্গিনী কোনো মতে কথাটা যেনো উগড়ে দিলো। যেভাবে হন্তদন্ত হয়ে এসেছিলো, সেভাবে হন্তদন্ত হয়ে চলেও গেলো। হয়তো চক্ষু লজ্জার জন্য।
দর্শিনী ঠেস মেরে বলে উঠলো,
“যাও,যাও। আজ নতুন রাত তোমাদের। এ ঘরে তোমায় মানাচ্ছে না। যে ঘরে মানাবে,সে ঘরে যাও। একজন বিবাহিত পুরুষকে ফাঁসিয়ে কতটুকু শান্তিতে থাকো সেটাও আমি দেখবো।”
মায়া মেয়েটা বয়সে যতটা ছোট বুদ্ধির দিক দিয়ে ঠিক ততটাই বড়। দর্শিনীর ঠেস মারা কথা বুঝতে তার কয়েক সেকেন্ডও ব্যয় করতে হয় নি। সেও আলতো হেসে বললো,
“তা আমি ফাঁসিয়েছি তোমায় কে বললো? নিজের স্বামীকে এখনো শুদ্ধ পুরুষ ভাবো! সে ততটাও ভালো না।”
মায়া আর দাঁড়ালো না। ধীর গতিতে গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। দর্শিনী নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইলো কেবল। তার মাথায় মায়ার বলা শেষ বাক্য গুলো কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে। মায়া কী বুঝাতে চাইলো? বিপ্রতীপই তাহলে বাহিরে নজর দিয়েছিলো প্রথম! আর সে কিনা বোকার মতন অন্ধবিশ্বাস করে গেলো! মানুষ এভাবে খোলশ বদলানোর খেলায় জিতে যাবে, কে জানতো?
দর্শিনী ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ালো। বাম দিকের দেয়ালে টাঙানো তার আর বিপ্রতীপের হাসিমাখা ছবিখানা হাতে নিলো। এখন বিষণ্ণ সন্ধ্যা। বিষাদ বিলাস করার সময়। একটু পর রাত নামবে আকাশের বুকে। বিপ্রতীপের বক্ষ মাঝে থাকবে অন্য নারী! এ ব্যাথা বুঝি মানা যায়? কোনো নারী এ রাত মেনে নিবে?
দর্শিনী বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। আজ বৃষ্টি হবে। আকাশ কেমন থম মেরে আছে। আকাশেরও বুঝি মন খারাপ? দর্শিনী বিষাদ মাখা হাসি হাসলো নিজের উপর। ভালোবেসেই তো বিয়ে করেছিলো। তবে,আজ এ দিন কেনো এলো জীবনে?
নারী জীবন কী অদ্ভুত! আজ নারী বলেই কী স্বামীর বাসর দেখতে হবে? দর্শীনি দেখবে না সে বাসর। মানবে না নারী জীবনের শর্ত। নারী হৃদয়ে কী ব্যাথা লাগে না? মানুষ কেনো ভুলে যায় নারীরও হৃদয় থাকতে পারে?
হঠাৎ দর্শিনীর হৃদয় বিদ্রোহ ঘোষণা করলো। মানলো না কোনোরূপ অজুহাত। ছুটে এলো রুমে। গুছাতে হবে নিজের শেষ বিদায়ের জন্য। শুনেছি জীবিত নারী একমাত্র মৃত হলেই শ্বশুর বাড়ি ত্যাগ করে। তবে কী আজ দর্শিনীও মৃত! নাহ্। দর্শিনী বাঁচার জন্য, নতুন করে জীবিত হওয়ার জন্য বাড়ি ছাড়বে। কেবল রাত বাড়ার অপেক্ষা।
দর্শিনী ঘরের বাহিরে গেলো। লুকিয়ে নতুন বউয়ের ঘরে উঁকি দিলো। খুব গোপনে রক্তক্ষরণ হলো হৃদয় মাঝে। দেখলো না কেউ। শুনলো না কেউ হাহাকার। হৃদয় ভাঙার যে শব্দ হয় না। নিজেকে এমন গোপন ভাবে র’ক্তা’ক্ত করতেই তো এসেছিলো এখানে। ফুলের খাট দেখলে যে হৃদয়ে কোমলতা জাগবে না,তা দর্শিনীর ঢের জানা আছে। তাই তো একটু ঘৃণা কুড়াতে এলো। নাহয় মায়া,মোহ,প্রেম যে কাটবে না। কিন্তু ঘৃণা কী আর কুড়াতে পারলো? কুড়ালো তো এক রাশ ব্যাথা।
দর্শিনী রুমে ছুটবে তার আগেই মোহনার রাশভারি কণ্ঠ ভেসে এলো,
“এখানে কী করছো?”
দর্শিনী চমকে গেলো। এমন করে ধরা পড়ে যাবে, কে জানতো? তবুও নিজেকে স্থির করলো। নিজেকে ধাতস্থ করে সুন্দর করে বললো,
“মা, ফুলসজ্জার ঘর দেখতে আসছিলাম।”
মোহনা যেনো বেজার হলো। মুখ কালো করে বললো,
“এটা দেখার কী আছে? নাকি নিজের সর্বনাশ দেখতে ভালো লাগে? কী অদ্ভুত মেয়েমানুষ তুমি! আমরা হলে এ লজ্জায় মারা-ই যেতাম। তোমার লজ্জা নেই বাপু?”
দর্শিনী খিলখিল করে হেসে উঠলো। ঠাট্টার স্বরে বললো,
“কিসের লজ্জা,মা?”
মোহনা যেনো বোকা বনে গেলো। নতুন বউ আসার পর সে যেনো বোকা-ই বনে যাচ্ছে। বউ আনলো না অলক্ষী ভেবে পাচ্ছে না সে। দর্শিনীর প্রশ্নের আর উত্তর দেয় নি মোহনা। গটগট পায়ে চলে গেলো সেখান থেকে। দর্শিনীও তার ঘরে চলে গেলো। সে যেনো ধরা পরে যাবে, যাবে করেও বেঁচে গেছে। লক্ষ কোটি ধন্যবাদ জানিয়েছে সৃষ্টিকর্তাকে এর জন্য সে।
দর্শিনীর ফোন হঠাৎ বেজে উঠলো। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে বাবা নামের লেখাটা। দর্শিনী নিজেকে শক্ত করে ফোনটা রিসিভ করলো। কোমল কণ্ঠে বললো,
“বাবা,কেমন আছো?”
“এইতো মা,ভালো। তুই কেমন আছিস?”
দর্শিনী “ভালো আছি” বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। কণ্ঠনালীয় কোথাও যেনো একটা বাঁধা সৃষ্টি হলো। তবুও সে টুকটাক কথা বলে ফোন রেখে দিলো। টেবিলের ড্রয়ারে থেকে খাতা,কলম বের করলো। একটা দারুণ চিঠি লিখতে বসবে। যে চিঠির কোণায় কোণায় ভরা থাকবে বিষাদ। কাল যখন বাড়ির মানুষ গুলো জানবে দর্শিনী বাড়িতে নেই, তখন যেনো বিষাদ মাখা চিঠিখানা পায়। বিষাদে টইটম্বুর হবে এই বাড়ির প্রতিটা ইট, পাথরও। সবাই জানবে, এক হৃদয় ভাঙা নারীর আর্তনাদ।
দর্শিনী লেখা শুরু করলো,
প্রিয় মায়া,
এ বাড়িতে আর কাউকে চিঠি না লিখে তোমায় লিখছি বলে অবাক হচ্ছো? তাও আবার প্রিয় সম্বোধন করেছি! আসলে এ বাড়ির মানুষ গুলো কখনোই আমায় আপন ভাবে নি৷ কীভাবে তাদের চিঠি লিখে যাই বলো? তাই তোমাকেই লিখলাম। তোমায় যতটুকু দেখেছি আমার দারুণ লেগেছে। আশারাখি তোমার এই চাঞ্চল্যের অস্তিত্বে ভরে যাক এ বাড়ি। এ বাড়ির মানুষ গুলোকে আমি যে বড্ড ভালোবাসি। বিয়ের পর জেনেছি আমার মা দুইটা। একটা জন্মদাত্রী আরেকজন যে আমায় এখন লালন পালন করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সে মা আমায় মেয়ে ভাবতে পারে নি। তবে হ্যাঁ, আমি একটা বাবা পেয়েছি। বাবাকে দেখে রেখো। তোমার ননদিনী কিন্তু আমি বলতে অজ্ঞান ছিলো। কিন্তু দেখো,সেও চক্ষু লজ্জার কারণে আমার সাথে কথা বলতে পারে না। কী লাভ আর এ বাড়ি আকড়ে ধরে পড়ে থেকে? যেখানে আমার পরিণতি বিদায়ের খাতায় গিয়ে ঠেকলো। এ বাড়ির মাটি জানে, এ বাড়ির ধূলো জানে আমি তাদের কত ভালোবেসেছি। কিন্তু ইট, পাথরের এ বাড়ি আমার হয়নি কভু। কেবল পর-ই করে গেলো। তুমিই নাহয় তার আপন হয়ে থেকো। আমি তবে নিলাম বিদায়। ভালো থেকো আমার সাত জন্মের সই।
ইতি
তোমার সই।
গোটা গোটা অক্ষরে লেখা চিঠিখানা শেষ হলো। চিঠিখানায় যুক্ত হলো দর্শিনীর অশ্রুকণা। আজই শেষ কান্না। এরপর আর সে কাঁদবে না। এরপর আর সে পিছু ফিরবে না। পিছুটান যে তার জন্য না।
–
পুরো বাড়ি বিভীষিকাময় আধারে পরিপূর্ণ। দর্শিনীর হাতে ব্যাগ চোখে অশ্রু। ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে সদর দরজার দিকে। এ বাড়ির মায়া তাকে বার বার আঁকড়ে ধরছে। তবুও তাকে যে যেতে হবে। কার মায়াতে আটকে থাকবে? যে মানুষ আজ অন্য নারীতে মত্ত, তার মায়াতে? না থাকুক এমন বেশরম মায়া। যে মায়া ছোট করবে আত্মমর্যাদা, সে মায়া থেকে কী লাভ!
দর্শিনী ধীরে ধীরে দরজা খুলে কেবল বাহিরে পা রেখেছে,তখনই একটা রাশভারি কণ্ঠ ভেসে এলো,
“চলে যাচ্ছো? থেকে গেলে হয় না?”
কণ্ঠে তার রাজ্যের আকুতি। যে আকুতি থামিয়ে দিলো দর্শিনীর পা। ডুকরে কেঁদে উঠলো হৃদয় আঙিনা।
#চলবে
[এবার থেকে আসল কাহিনী শুরু হবে। সবাই ধৈর্য ধরা শুরু করো।]