#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী পর্বঃ চার+পাঁচ

0
422

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী পর্বঃ চার+পাঁচ
#মম_সাহা

রাতের রাস্তা সোডিয়ামের আলোয় আলোকিত। হলুদ বর্ণা লাইট গুলো দারুণ রঙ সৃষ্টি করে আঁধার রাতে। ভিজে রাস্তায় মাটি থেকে এক নে’শা’লো ঘ্রাণ বের হচ্ছে। মাটি ভিজলে এক নিদারুণ সুগন্ধি ছড়ায়। একটু আগের ঝড়ের কারণে রাস্তায় হাজার খানেক পাতা ও ফুলের ছড়াছড়ি। সেই ভিজে ফুল পাতা ডিঙিয়ে একা রাস্তায় চলছে এক মানবী। যার ঠাঁই মেলে নি শ্বশুর বাড়িতে। যার প্রেমিকের বক্ষ মাঝে অন্য নারীর ঠিকানা। দর্শিনী গত এক ঘন্টা যাবত ধীর গতিতে হেঁটে বড় রাস্তায় উঠেছে। শরীরে জড়ানো সাদা শাড়ি। হাতে, গলায়,কপালে কোনো বিবাহিত চিহ্ন নেই। ঐ বাড়ি ত্যাগ করার সাথে সাথে ত্যাগ করেছে নিজের বৈবাহিক ঠিকানা। এখন সে একদম একা। এই নিস্তব্ধ রাস্তার মতন একা। যার কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই কিন্তু চলতে হবে আজীবন। গান ধরলো মানবী। গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠলো,

“চল রাস্তায় সাজি ট্রামলাইন
আর কবিতায় শুয়ে কাপ্লেট
আহা উত্তাপ কত সুন্দর
তুই থার্মোমিটারে মাপলে
হিয়া টুপটাপ জিয়া নস্টাল
মিঠে কুয়াশায় ভেজা আস্তিন
আমি ভুলে যাই কাকে চাইতাম,
আর তুই কাকে ভালোবাসতিস…”

ক্লান্ত হলো মানবী। ফুটপাতের কিনারার বসে পড়লো। একটু বিশ্রাম দরকার। খিদেও লেগেছে। হঠাৎ তার নজর গেলো বা হাতের ছোট্ট সাদা ব্যাগটার দিকে। ব্যাগটার দিকে তাকাতেই ছ্যাঁত করে উঠে বক্ষ পিঞ্জিরা। মানুষটার আকুতি মিনতি মনে পড়ে। এই একটা মানুষ, যে দর্শিনীকে বিনা শর্তে,বিনা স্বার্থে ভালোবেসেছিল। বিদায় বেলাও মানুষটা অশ্রু বিসর্জন দিয়েছিলো। বাবা ডাকের মর্যাদা দিয়েছে মানুষটা। হ্যাঁ, দর্শিনী যখন বের হতে নেয় তখন তার শ্বশুরই পথ আগলে দাঁড়ায়। দর্শিনীর মনে পড়ে একটু আগের ঘটনা,

দর্শিনী ঘর থেকে কেবল বের হবে সে মুহূর্তে তার শ্বশুর পিছু ডাকে,
“চলে যাচ্ছো? থেকে গেলে হয় না?”

দর্শিনীর পা থেমে যায়। এই আকুতি মাখা কণ্ঠের বিপরীতে বলে উঠে,
“থাকতে তো চেয়েছিলাম আজীবন। আমায় কেউ রাখে নি। যার যতটুকু সময় প্রয়োজন ঠিক ততটুকু সময় আমি থেকে যাই। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে আমিও ফিরে যাই।”

দর্শিনীর বৃদ্ধ শ্বশুর কাঁপা কাঁপা পা নিয়ে এগিয়ে এলো। চোখে তার অশ্রুকণা। দর্শিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“তবে চলে যাও। মনে রেখো তোমার আরেক বাবা সবসময় তোমাকে নিরবে আশীর্বাদ করে যাবে। তোমার বাবা যে অক্ষম। তার জাঁকজমক ভাবে কিছু করার ক্ষমতা নেই। সে কেবল গোপনে তোমায় ভালোবাসবে।”

দর্শিনী শ্বশুরের পা ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। শেষ বিদায়ের বেলা ভদ্রলোক সাদা ছোট্ট থলেটা এগিয়ে দিয়ে বলেছিলো,
“এটা রাখো, বৌমা। পথিমধ্যে প্রয়োজন পড়বে।”,

এরপর আর দর্শিনী পিছু ফিরে চায় নি। এগিয়ে গিয়েছে নিজের গন্তব্যের দিকে। একবার পিছু ফিরে তাকালে সে দেখতো এক অসহায় বাবার আর্তনাদ। আর দু’তলা বিল্ডিং এ কারো গোপন ছায়া। যে গোপনে বিদায়ের সাক্ষী হয়েছিল।

ট্রাকের হর্ণের তীব্র শব্দে ধ্যান ভাঙে দর্শিনীর। সাঁইসাঁই করে একটা ট্রাক ছুটে গেল বড় রাস্তা দিয়ে। দর্শিনী ছোট্ট শ্বাস ফেললো। আগে এমন ট্রাক দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে হতো ট্রাকের নিচে। এখন আর সে ইচ্ছে হয় না। এখন বরং সব কিছু থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে ইচ্ছে হয়।

রাত বাড়ার সাথে সাথে দর্শিনীর খিদের দাপট বাড়লো। কিন্তু সাথে কোনো খাবার নেই। মনকে অন্য দিকে ঘোরানোর জন্য শ্বশুরের দেওয়া ব্যাগটা খুললো। ব্যাগ খুলে সে অবাক,হতবাক। ব্যাগের মাঝে পুটলি বাঁধা কত গুলো তিলের নাড়ু,দুধের সন্দেশ। ছোট্ট বোতলে করে জল ভরা। দর্শিনী অবাক হয়ে যেনো আকাশ থেকে পড়লো। বাবা তবে আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিলো দর্শিনীর বিদায়ের কথা! দর্শিনীর চোখ ভরে এলো নোনাজলে। মানুষটা শেষ বেলাতেও কতটা নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে গেলো!

নিজের চোখ মুছে খাবার গুলো জাপ্টে ধরলো বুকে। এটাকেই বুঝি বাবা বলে? এ জন্যই পৃথিবীতে বাবাদের স্থান উপরে। কি সুন্দর নিজের ছেলের বউয়ের পছন্দের জিনিস গুলো গুছিয়ে দিয়েছে! দর্শিনী খাবার গুলো খুব যতনে খেলো। এমন তৃপ্তি তাকে কোনো খাবারই যেনো এ জীবনে দিতে পারে নি।

আবার উঠে দাঁড়ালো দর্শিনী, নতুন উদ্যমে। চলতে হবে তাকে অনেকটা পথ। রাত বাড়ছে। সাথে কনকনে হিমশীতল বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে। দর্শিনী পা বাড়ালো রেলস্টেশনের দিকে। বাড়ি ফিরতে হবে তাকে। আপাতত বাবা মায়ের আশ্রয়স্থলে ঠাঁই নিতে হবে। বেঁচে তো থাকতে হবে। বেঁচে থাকার জন্য নাহয় একটু কথা শুনবে।

ঢাকা থেকে সিলেটগামী ট্রেনে চড়ে বসলো দর্শিনী। ভোর হতে হতে সে সিলেট পৌঁছে যাবে। এই মিছে মায়ার শহরে আর পিছুটান রাখবে না। এ শহর সব কেঁড়ে নিলো। এই ইট পাথরের শহর কারো আপন হতে পারে না। কেবল গোগ্রাসে গিলতে থাকে মানুষের সুখ গুলো। দর্শিনী আর গিলতে দিবে না তার সুখ। যতটুকু পেয়েছে তা-ই গুটিয়ে নিয়ে সে চলে যাবে দূরে,বহুদূরে।

“এটা তো আমার সীট, মেডাম। আপনি ভুল জায়গায় বসেছেন।”

ভরা পুরুষালী কণ্ঠে ধ্যান ভাঙে দর্শিনীর। কথাটা বুঝতে না পেরে সে জিজ্ঞেস করলো,
“জ্বি? আমাকে কিছু বলেছেন?”

দর্শিনীর সামনে থাকা ছেলেটা ভ্রু কুঁচকালো। এবার পূর্ণদৃষ্টি দিলো দর্শিনীর দিকে। শুভ্র রাঙা শাড়ি পরিহিতা রমনীকে তার দারুণ লাগলো। তাই কণ্ঠে ধীর গতি রেখে স্বাভাবিক ভাবে বললো,
“হ্যাঁ, আপনাকেই বলেছি। এটা তো আমার বসার জায়গা। জানালার সাথে সীট আমার। পাশেরটা বোধহয় আপনার। আপনি ভুল জায়গায় বসেছেন।”

দর্শিনী টিকিট মিলিয়ে দেখলো ছেলেটা ভুল বলে নি। তাই সে সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো। ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
“দুঃখীত। আমি খেয়াল করি নি। বসুন আপনি।”
“ধন্যবাদ।”

খুব সংক্ষেপে শেষ হলো তাদের কথা। দর্শিনী জানালার পাশে সীট ছেড়ে ছেলেটার ডানপাশে বসলো। মনে মনে কতক্ষণ নিজেকে গালাগালি করলো ভুল করার জন্য। ইতিমধ্যে ট্রেণ চলতে শুরু করেছে। দর্শিনীর মনে পড়লো বাবাকে সে জানায় নি আসার কথা। বাবাকে ফোন দিতে হবে। কিন্তু সে তো ঐ বাড়ি থেকে ফোন আনে নি। পাশের ছেলেটা তখন ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত। দর্শিনীর লজ্জা লাগছে ফোন চাইতে। কতক্ষণ নিজের মাঝে যু’দ্ধ চালিয়ে ধাতস্থ করলো সে ফোন চাইবে না। হুট করেই উঠবে বাবার বাড়ি।

“হ্যালো,আমি মৃত্যুঞ্জয়। আপনার কী আমার ফোনটা প্রয়োজন, মেডাম?”

দর্শিনী চমকে উঠলো। ছেলেটা কীভাবে বুঝলো তার যে ফোন প্রয়োজন? গায়ে পড়া স্বভাব নাকি ছেলেটার? দেখে তো তা মনে হয় নি। তবে,যেচে জিজ্ঞেস করেছে বলেই উল্টেপাল্টা চরিত্র ঝুলিয়ে দিবো! দর্শিনী নিজের মনেই কতক্ষণ বকবক করলো।

মৃত্যুঞ্জয় দর্শিনীর ব্যবহারে খানিক অবাক হলো। মেয়েটা কথায় কথায় ভাবনার রাজ্যে চলে যায় কেনো? মেয়েটা ফোনের দিকে অমন করে তাকিয়ে ছিলো বিধায়ই তো সে জিজ্ঞেস করেছে। নাকি যেচে জিজ্ঞেস করা উচিত হয় নি?

দর্শিনী নিজের মাঝে কতক্ষণ দ্বিধা দ্বন্দে থেকে অবশেষে রিনরিনে কণ্ঠে বললো,
“আমি প্রিয়দর্শিনী। ধন্যবাদ। আমার ফোনের প্রয়োজন নেই।”

মৃত্যুঞ্জয় যেনো আর কিছু শুনলো না। তার কানে বার বার একটা নামই বাজলো “প্রিয়দর্শিনী”। বক্ষ পিঞ্জিরা ছলাৎ করে উঠলো। না পাওয়া বস্তু পেয়ে গেলে যেমন আনন্দিত হয় হৃদয় আঙিনা তেমন আনন্দিত হলো তার হৃদয়। বহু দিনের স্বাধ যে এভাবে মিটবে কে জানতো? এবার কেবল সকাল হওয়ার অপেক্ষা। নতুন সকাল। নতুন আরম্ভ।

দর্শিনী চুপ করে তার মাথা টা এলিয়ে দিলো সীটে। কাল তার পরিবার তাকে দেখলে কেমন রিয়াকশন দিবে সেটাই ভাবনার বিষয়।

_

ভরা প্লাটফর্মের হৈচৈ ঘুম ছুটে যায় দর্শিনীর। চোখ মেলতেই দেখে তার গন্তব্যে এসে পড়েছে। হুড়মুড় করে উঠে বসে সে। তার পাশের সীট শূণ্য। ছেলেটা নেমে গেছে! কখন? সামান্য টেরও পেলো না দর্শিনী! কী ঘুম ঘুমিয়েছে সে!

দর্শিনী উঠে দাঁড়ালো। নিজের ব্যাগটা নিয়ে স্টেশনে নামলো। চারপাশে কুয়াশায় ঘেরা। কাল রাতে বৃষ্টি হয়েছে বিধায় কুয়াশায় ভরে গেছে প্রকৃতি। দর্শিনী নিজের ব্যাগটা নামিয়ে শরীর সামান্য ঝাড়া দিলো। ক্লান্তি ভাব ছুটে গেছে শরীর থেকে। হঠাৎ সে অনুভব করলো তার শরীরে কেউ কিছু জড়িয়ে দিচ্ছে। দর্শিনী চমকে তাকাতেই দেখে চাদর। দর্শিনী অবাক হয়ে যায়। পিছে ঘুরতেই সেই অবাক ভাব আকাশ ছুঁয়ে যায়। বিষ্মিত কণ্ঠে বলে,
“তুমি!”

#চলবে
#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ পাঁচ

চালতা ফুল শিশির জলে ভিজে সিক্ত। ভোরের রেলস্টেশনে মানুষের গমগমে ভাব। হৈচৈ ভরা চারপাশে। প্রিয়দর্শিনী অবাক চোখে বাবাকে দেখছে। কত দিন পর! বাবাকে দেখেছিলো প্রায় বছর ঘনিয়ে এলো বলে। আবার এতদিন পর বাবার এমন আদুরে সান্নিধ্য পাবে সে ভাবতেই পারে নি। বাবার দেওয়া চাদরখানা খুব আবেশে জড়িয়ে ধরে নিবিড় কণ্ঠে শুধালো,
“বাবা,তুমি এখানে?”

প্রতাপ সাহা খানিক হাসলেন। পাঞ্জাবির হাতাটা খানিক গুটিয়ে সে প্রশ্নের বিপরীতে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
“মা,তুমি এখানে?”

প্রিয়দর্শিনী বাবার প্রশ্ন করার নমুনা দেখে হেসে উঠলো। কত গুলো দিন পর এমন খিলখিলিয়ে হাসলো সে! বাবা একদম বদলায় নি। আগের মতনই আছে। দর্শিনী হাসি থামালো। হাসতে হাসতে চোখের কোণে জল জমেছে। প্রতাপ মেয়ের চোখের কোণে জল মুছে দিয়ে ছোট্ট কণ্ঠে বললো,
“জল বুঝি এত ঝড়েছে এই নেত্র যুগল দিয়ে! হাসির সময়ও সে বাঁধ মানছে না? কিসের এত কান্না তোমার,মা?”

প্রিয়দর্শিনীর মুখের সবটুকু হাসি এবার উবে গেলো হাওয়ায়। মুখে নামলো অমাবস্যা। আধার মুখখানা নিয়ে রিনরিনে কণ্ঠে বললো,
“কান্না যার ললাটে লেখা, তার কান্না করার কারণের অভাব হয় না, বাবা। তা তোমার প্রশ্নেরই উত্তর আমি আগে দেই, আমি এখানে এসেছি তোমাদের বাড়ি যাবো বলে। নিবে না আমায়?”

প্রতাপ সাহা মেয়ের কথা শুনে উচ্চস্বরে হেসে উঠে। শরীর দুলিয়ে হেসে বলে,
“আমাদের বাড়ি কী তোমার বাড়ি না, মা? তুমি নিজের বাড়ি যাবে। আমি নেওয়ার কে? চলো তবে নিজ স্থানে। এই অধম তোমায় পথ দেখিয়ে দিবে।”

দর্শিনী আবার হেসে উঠলো। বাবা টা বরাবরই এমন। এত ভালো। কিন্তু বাবা কীভাবে জানলো দর্শিনীর আসার খবর? দর্শিনীর মনে প্রশ্নের সমাহার। প্রশ্ন করবে কী করবে না ভেবে তার বিরাট দ্বন্দ্ব শুরু হলো মনে। প্রতাপ সাহা বোধহয় বুঝলেন মেয়ের মনোদ্বিধা। মেয়ের মাথায় ভরসার হাত রেখে বললেন,
“আমি কীভাবে জানলাম তুমি এখানে আসবে,সেটাই ভাবছো, মা?”

দর্শিনী সাথে সাথে উপর-নীচ মাথা নাড়ালো। যার অর্থ “হ্যাঁ”। প্রতাপ মেয়ের বাচ্চাসুলভ আচরণ দেখে হাসি মুখে বললেন,
“আমাকে মৃত্যুঞ্জয় বলেছে।”

দর্শিনী ভ্রু কুঁচকালো। নাম টা বেশ পরিচিত মনে হলো। কোথাও একটা শুনেছে। ভেবে কূল কিনারা মিললো না। এ নাম সে কোথায় শুনেছে? কতক্ষণ ভেবে কূল না পেয়ে নিজেই বাবাকে জিজ্ঞেস করলো,
“কে এই মৃত্যুঞ্জয়?”

প্রতাপ সাহা যেন এমন প্রশ্নের আশা করেন নি। কাল রাতে মেয়েটা যার পাশে বসে ছিলো আর আজ তার নামটাই মনে করতে পারছে না? মেয়েটার মস্তিষ্ক তবে কত কিছু সহ্য করছে যে সামান্য জিনিসটাও এখন মনে রাখতে পারছে না!

ছোট্ট শ্বাস ফেললো প্রতাপ। মেয়ের ব্যাগটা হাতে নিয়ে একটা ভ্যান ডাক দিলো। সকাল বেলা এখানে ভ্যান ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না। দর্শিনী উত্তরের আশা না করেই ভ্যানে গিয়ে বসলেন। প্রতাপ ভ্যান চালক ছেলেটাকে ডেকে হাসিমাখা কণ্ঠে বললেন,
“রাসেল,অনেকদিন পর আমার মেয়ে গ্রামে আসছে। বাজারের দিক দিয়ে যাবি। বড় মাছ নিতে হবে। আমার মেয়ের মাংস পছন্দ। মাংস নিতে হবে। সাবধানে চালিয়ে যাবি কিন্তু।”

ভ্যান চালক ছেলেটা হেসে মাথা দুলিয়ে বললো,
“আইচ্ছা, কাকা। আপনে বহেন। দিদিরে তো আমি দেইখাই চিনছি। শহর থেইকা আইছে। দিদি,দুলাভাই আইলো না?”

প্রিয়দর্শিনী যেন এই ভয়েই ছিলো। এই প্রশ্নটাই না তাকে কেউ করে বসে। ঠিক ভয়টাই পেয়েছিলো। এখন কী উত্তর দিবে সে? বাবা হয়তো খেয়াল করে নি এখনো তাকে ঠিকমতন তাই জিজ্ঞেস করে নি। কিন্তু এখন!

“তোর দুলাভাই দিয়ে কী কাজ? আমার মেয়ে আসছে সেটাই অনেক। যা চালানো শুরু কর।”

প্রতাপের উত্তরে হাফ ছেড়ে বাঁচলো দর্শিনী। বাবা কেমন বাঁচিয়ে দিলো তাকে। কিন্তু কত আর বাঁচাবে? কতক্ষণ বাঁচাতে পারবে? বাবা নিজেও তো জানেনা কতকিছু।

ভ্যান চলতে শুরু করলো। দর্শিনী বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। বাবার মুখে তৃপ্তির হাসি। এতদিন পর মেয়েকে দেখেছে। কতক্ষণ থাকবে এ তৃপ্তি? সব সত্যি জানার পরও বাবা এভাবে হাসবে তো? মনের মাঝে বিরাট প্রশ্নের পাহাড়। দর্শিনী নিজের মাঝে সকল প্রশ্ন আটকে না রেখে ধীর কণ্ঠে বাবাকে বললো,
“বাবা,তুমি জিজ্ঞেস করলে না তোমার জামাইয়ের কথা?”

প্রতাপ সাহা নিজের চশমার ঘোলাটে কাচটা স্বচ্ছ করায় মনোনিবেশ করে ছিলো এতক্ষণ। মেয়ের প্রশ্ন শুনে সে হাসলো। চশমা টা পরিষ্কার করে নিজের কর্ণদ্বয়ে ঝুলিয়ে বললো,
“আমার প্রশ্নের সকল উত্তর আমি তোমাকে দেখার পরই পেয়ে গেছি। হিন্দু মেয়ে বউ স্বামী বেঁচে থাকাকালীন সাদা শাড়ি পড়ে না। শাখা, সিঁদুর বিহীন চলে না। তোমার শরীরে বিবাহিতের একটা চিহ্নও নেই। তাই আমি ধরে নিয়েছি আমার জামাই বোধহয় বেঁচে থেকেও আমার মেয়ের কাছে ম’রে গেছে। তাহলে সে জামাইয়ের খোঁজ নিয়ে কী করবো? আর এটা রাস্তা। এখানে সকল কথা বলা সাজে না। বাড়িতে আগে যাই। তারপর তোমার সকল ব্যাথার আত্মকাহিনী শুনবো। কেমন?”

দর্শিনীর চোখে অশ্রুতে পরিপূর্ণ। জলে টইটুম্বুর চক্ষু যুগল নিয়ে বাবার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“বৌদিরা আমায় মেনে নিবে তো,বাবা?”
“মেনে নেওয়ার কথা আসছে কোথা থেকে? তুমি আমার মেয়ে। আর আমার মেয়ে তার বাড়িতে থাকতে এসেছে। কেউ মানুক আর না মানুক আমার মেয়ে তার বাড়িতেই থাকবে।”

প্রতাপ সাহার কণ্ঠে গাম্ভীর্যের ভাবটা আঁচ করতে পেরেছে দর্শিনী। মন থেকে বড় একটা চিন্তা নেমে গেলো। বাবা তাকে ধাতস্থ হওয়ার সময় দিয়েছে। এবার দেখার পালা মা,দাদারা,বৌদিরা কী বলে।


সরকার বাড়িতে হৈচৈ। বড় বউ বাড়ির সোনা গয়না নিয়ে নাকি পালিয়েছে। বিপ্রতীপ কোনোরকমে ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে টলতে টলতে দর্শিনীর ঘরে হাজির হয়েছে। পুরো ঘর ফাঁকা। কোথাও কেউ নেই। মোহনা ঘরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে ন্যাকা কান্না কাঁদছে।

বিপ্রতীপের ঘুম কেটে গেলো দর্শিনী বিহীন ঘর দেখে। হৃদয় কোণে মোচড় দিয়ে উঠলো প্রেম পায়রা। হঠাৎ অনুভব হলো চারদিকে সব শূণ্য, খাঁ খাঁ মরুভূমি। বিপ্রতীপ বসে পড়লো বিছানায়। মাথাটা তার কেমন ভার ভার লাগছে। কাল শরবত খাওয়ার পর কখন ঘুমিয়েছে হুঁশ নেই। এখনো সেই নেশা কাটছে না। শরবত না যেন এলকোহল।

মোহনা হায় হায় করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“আমার কী সর্ব’নাশ হলো,বাবা। তোর বউ সব স্বর্ণ নিয়ে ভাগছে। এ কী কাল নাগিনী পুষে ছিলাম দেখ।”

বিপ্রতীপ কতক্ষণ চুপ করে রইলো। তার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না প্রিয়দর্শিনী তাকে ছেড়ে যেতে পারে। কতক্ষণ সে থম মেরে বসে রইল। নিজেকে ধাতস্থ করলো। তার মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনে ছড়িয়ে পড়লো প্রিয়দর্শিনীর বিদায়ের কথা খানা। শরীর রোমাঞ্চিত হলো। হঠাৎ মনে হলো দর্শিনী বিহীন সব পানসে,সব।

ঘরে হুড়মুড় করে প্রবেশ করলো মায়া। অবাক কণ্ঠে বললো,
“কার বউ পালিয়েছে বললেন? ঐ দিদিটা আপনার ছেলের বউ ছিলো!”

মোহনা যেন নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারলো। থতমত খেয়ে গেলো সে। আমতা-আমতা করে বললো,
“না, না। তুমি ভুল শুনেছো মা।”

“আমি কিছু ভুল শুনি নি। আপনাদের সব আত্মীয় স্বজন বলছে দর্শিনী দিদি আপনার ছেলের প্রথম পক্ষের বউ।”

মায়ার কথা শুনে মোহনার মাথায় হাত। হৈ হৈ করে ছুটলেন কোন আত্মীয় এমন অলুক্ষণে কাজ করেছে তা জানতে। মায়া এগিয়ে এলো বিপ্রতীপের দিকে। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,
“কী মশাই,কষ্ট হচ্ছে?”

বিপ্রতীপের ঘোর কাটে। কোনরকমে উঠে দাঁড়িয়ে মায়ার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“প্রিয়দর্শিনী আমায় ছাড়া থাকতে পারবে? আমায় ছেড়ে চলে গেলো? কত পাষণ্ড!”

“বাহ্ রে দাদাই,তুই বিয়ে করতে পারিস আর মেয়েটা আত্মমর্যাদা নিয়ে চলে যেতে পারবে না?”

বিহঙ্গিনীর কথায় ধ্যান ভাঙলো বিপ্রতীপের। সে কী সর্বনাশ করতে যাচ্ছিলো? মায়ার সামনে দর্শিনীর বিরহ দেখাচ্ছিলো?

দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো বিপ্রতীপ। তার পিছু ছুটলো মায়া। বিহঙ্গিনী চুপ করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো দর্শিনীর ঘরখানায়। চোখ থেকে নিরলস অশ্রু বিসর্জন দিয়ে মনে মনে বললো,
“তবে বিদায় নিলি হতভাগিনী! একটা বার আমাকেও বললি না? এতটা পর করে দিলি?”

বিহঙ্গিনীর মনের কথা মন অব্দিই থেকে গেলো। জানলো না কেউ,শুনলো না কেউ। যাক,একজন মানুষ অন্তত মেয়েটার বিদায়ে কেঁদেছে।

মায়া সবার অগোচরে ছাদে চলে গেলো। পাশের বাড়ির ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রহস্য মাখা হাসি দিলো। সে নিজের প্ল্যান অনুযায়ী একটু একটু এগিয়ে যাচ্ছে। অসৎ পুরুষ নিঃস্ব হোক। নিঃসঙ্গ হোক।


“জামাই থাকতে তোমার এমন বিধবা সাজ কেনো,দর্শিনী?”

নিজের মায়ের কথায় অন্তর আত্মা কেঁপে উঠলো দর্শিনীর। নিজেকে সে যতই শক্ত করুক, বিধবা শব্দটা যে কোনো নারীই শুনতে পারে না।

“আহা সরলা,মেয়েটা বাড়ির উঠোনে পা রাখতে পারলো না আর তুমি এমন প্রশ্নবিদ্ধ করছো?”

প্রতাপের কথায় সরলার গলার স্বর আরেকটু উঁচুতে উঠলো। চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
“তুমি চুপ করো। এ মেয়ের কী সাজ তুমি দেখো নি? এমন স্বাসী সংসার ফেলে বিধবা সেজে বাপের বাড়ির মাটি খামচাতে এসেছে নাকি সে?”

দর্শিনীর অপমানে শরীর রি রি করে উঠলো। সে জানতো মা এমন আচরণই করবে। বরাবরই মা কেমন যেন। তাই বলে এ সময়ও মা যে এমন করবে দর্শিনী ভাবতে পারে নি।

“এই মেয়ে,এই, কথা বলছো না কেনো? তুমি এ বাড়িতে এ বেশভূষা ধরে এসেছো কেনো?”

“মা, ঐ বাড়ি আমি ছেড়ে এসেছি।”

দর্শিনী উত্তর দিতে দেরি কিন্তু তার গালে সপাটে চড় পড়তে দেরি হলো না। দর্শিনী ছিটকে পড়লো মাটিতে। কারো পায়ের সামনে। মানুষটাকে দেখে দর্শিনী যেন আকাশ থেকে পড়লো।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here