#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী পর্বঃ ছয়

0
397

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী পর্বঃ ছয়
#মম_সাহা

বাহিরের লোকের সামনে ঘরের কথা বলতে একদমই ভালো লাগছে না দর্শিনীর। তবুও বলতে হচ্ছে। তা নাহলে মা হয়তো ঘর অব্দি তাকে যেতেই দিবে না। তার বাড়ির ছোট্ট উঠোনে আপাতত তার মা, বাবা,বড় বৌদি, বড় দাদা,ছোট দাদা, ছোট বৌদি আর মৃত্যুঞ্জয় নামের ছেলেটা জায়গা দখল করে দাঁড়িয়ে আছে। মৃত্যুঞ্জয়, তাদের প্রতিবেশী। আজীবন বিদেশ থাকে যারা। দর্শিনী ছোট বেলা থেকেই দেখে আসছে এই প্রতিবেশীরা গ্রামে থাকে না। ভিনদেশী তারা। মৃত্যুঞ্জয় সেই প্রতিবেশীদেরই ছেলে। গত কয়েকবছর যাবত প্রতিবছরে একবার গ্রামে আসে। দর্শিনীর সাথে আগে কখনো তার আলাপচারিতা করা হয় নি। আর আজ দর্শিনীর সংসারের খবর তার সামনেই বলতে হচ্ছে কারণ তার বাড়ির মানুষ এ ছেলে বলতে অজ্ঞান।

দর্শিনী একে একে সব কথা খুলে বলেছে। অতঃপর তার মা সরলা আক্রোশে ফেটে পড়ে বললো,
“তোমায় এত সাধু হতে কে বলেছিলো? একে তো সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম তার উপর স্বামীকে বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছিলে? হিন্দুদের স্ত্রী থাকতে বিয়ে করার নিয়ম আছে আদৌ?”

“মা,আমি অনুমতি না দিলেও সে বিয়েটা করতো। আর আমি সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম বলে কী মানুষ নই? আমার কী খারাপ লাগা, ভালো লাগা থাকতে পারে না?”

দর্শিনীর কণ্ঠে দারুণ তেজ। অনেক হয়েছে সয়ে যাওয়া। টিকে থাকতে হলে লড়াই করে যেতে হবে। সয়ে গেলে আর যাই হোক টিকে থাকা যাবে না।

মৃত্যুঞ্জয় অপলক চেয়ে রইলো প্রিয়দর্শিনীর দিকে। আজ চার বছর যাবত কেবল একটা নামের মোহে পড়ে সেই সুদূর লন্ডন থেকে সে ছুটে আসে প্রতিবছর। নামের অধিকারীনি মানুষটাকে না চিনেই কত রাত নির্ঘুম কেটে গেছে তার। অবশেষে মানুষটার সাথে দেখা হলো এমন এক নির্মম পরিস্থিতিতে!

মৃত্যুঞ্জয়ের মনে পড়ে বছর চারেক আগের কথা। তারা স্ব পরিবারে নিজের বসত ভূমি দেখতে বাংলাদেশ এসেছিল। তখনই আলাপ হয় এই পরিবারটার সাথে। তখন প্রিয়দর্শিনী মামার বাড়িতে ছিলো। মৃত্যুঞ্জয় কেবল তার নামটা শুনেছিলো। এরপর থেকে কিসের যেন একটা টান সে অনুভব করতো গোপনে। এমন দারুণ, রাজকীয় নামের নারীটাকে দেখার দারুণ স্বাধ ছিলো তার মনে৷ কিন্তু সে-বার প্রিয়দর্শিনী মামার বাড়ি থেকে আসার আগেই মৃত্যুঞ্জয় রা দেশ ছেড়ে চলে যায়। পরের বছর মৃত্যুঞ্জয় যখন আবার গ্রামে আসে তখন তার প্রিয়দর্শিনী অন্য কারো হয়ে গিয়েছিলো। তবুও হাল ছাড়ে নি মৃত্যুঞ্জয়। প্রতিবছর ক্যাম্পিং এর নাম করে একবার গ্রামে আসতো প্রিয়দর্শিনীর দেখা পাওয়ার ইচ্ছায়। অবশেষে তার ধ্যান স্বার্থক হলো। সে এই নারীকে সামনা-সামনি দেখবে বলে কখনো ছবি অব্দি দেখে নি। অবশেষে সে নারী তার সামনে!

মৃত্যুঞ্জয়ের এই বোকা বোকা পাগলামোর কথা কেউ জানে না। ভাগ্যিস কেউ জানে না। নাহয় তো সবাই হাসাহাসি করতো। এক নারীর নাম শুনেই মৃত্যুঞ্জয়ের ঘুম হারাম হয়েছে গত চার বছর যাবত। এটা কেমন অদ্ভুত না!

“তুই এবার শান্ত হ তো,দর্শিনী। ঘরে আয়। সারাটা রাত রাস্তায় ছিলি। ক্লান্ত লাগছে না? চল রুমে।”

বড় বৌদির কথায় প্রাণে পানি এলো যেন দর্শিনীর। মা যেখানে পরের মতন আচরণ করছে সেখানে বড় বৌদি পরের মেয়ে হয়েও মায়ের মতন আচরণ করছে। এটাই হয়তো জীবন সমীকরণের অদ্ভুত হিসেব!

“হ্যাঁ, আমারও মনে হয় আপনাদের ঠান্ডা মাথায় সবটা হ্যান্ডেল করা উচিৎ। আপাতত আপনাদের মাথা গরম। আর মিস প্রিয়দর্শিনীও ক্লান্ত। তাকে আগে যত্ন করেন তারপর যা করার করবেন।”

মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে তাল মেলালো দর্শিনীর দুই ভাই। দর্শিনীর মা আর হম্বিতম্বি করলেন না। কেবল নিষ্পলক চেয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। তার মেয়ের এত বড় সর্বনাশ যে হয়েছে, সে যেন এটা মানতেই পারছে না।

নিধি,দর্শিনীর বড় বৌদি দর্শিনীকে ধরে ঘরের ভেতর নিয়ে গেলেন। সরলা থম মেরে বসে রইলেন। ছোট বউ ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,
“বিবাহিত ননদ-ননস সংসারে থাকলে, সে সংসারে আর লক্ষী থাকে! কী জানি বাবা,এসব কেমন মেয়ে মানুষ? নিজের সংসারই যে মেয়ে মানুষ টিকিয়ে রাখতে পারে না।”

“বৌদি,এটা কী একান্তই মেয়ে মানুষের দোষ? সংসার কী আদৌও একজন টিকিয়ে রাখতে পারে? দু’জনের সংসার একজন আর কতদিনই বা টিকাতে পারে?”

মৃত্যুঞ্জয়ের উত্তরটা ভালো লাগে নি বাড়ির ছোট বউ নিপার। মুখ চোখ বাঁকিয়ে সে বললো,
“আপনি বিলেত ফেরত মানুষ। আপনার ভাবনা অন্যরকম হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের এদেশে যে মেয়ে মানুষ সংসার টিকিয়ে রাখতে পারে না তাদের অলক্ষী বলা হয়।”

“কথা তো এদেশ আর ওদেশের ভাবনার হচ্ছে না। কথা হচ্ছে আসল দোষী কে! এখন আপনার সংসার যদি সুমন ভাই রাখতে না চায় ধরুন, আপনি হাজার চেষ্টা করার পরও সুমন ভাই আরেকটা বউ আনে তাহলে কী দোষটা আদৌও আপনার হবে?”

নিপা আর উত্তর দিলো না। মৃত্যুঞ্জয়ের যুক্তির কাছে সে শেষমেশ চুপ হলো। নিপার স্বামী সুমন মিটমিটিয়ে হাসলো। যাক বাবা,কেউ তার বউকে হার মানাতে পারলো।

সরলা চুপ করে কেবল বউয়ের আক্রোশ দেখলো। সে এই ভয়ের জন্যই তো মেয়েটার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। সে জানতো,সমাজ তার মেয়েকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দিবে না। তার মেয়ের মেরুদন্ডটি খুঁজে ঠাস করে ভেঙে দেওয়ায় হলো সমাজের কাজ। ঠিক এই ভয়েই তো মা হয়েও সে মেয়ের সাথে খারাপ আচরণ করেছিলো।

“রান্না করবেন না,শাশুড়ি? কত বেলা হলো সে খেয়াল আছে? তাড়াতাড়ি রান্না বসান।”

মায়ার কথায় আকাশ থেকে পড়লো মোহনা। অবাক কণ্ঠে বললো,
“আমি রান্না করবো! কী বলো এসব? বাড়িতে রান্না করে বউরা।”

“তো,আপনি এ বাড়ির মেয়ে না বউ-ই। যান রান্না বসান।”

মায়ার কথার যুক্তি শুনে থ বনে রইলো মোহনা। তার জন্য কথা বলার ভাষা ফুরিয়েছে। অবাক নয়নে সে তার নতুন বউকে দেখে যাচ্ছে। খাল কেটে কুমির আনা প্রবাদটা যেন তার জন্যই রচিত। দর্শিনী আর যাই করুক কখনো এমন করে কথা বলে নি মোহনার সাথে। আর এ মেয়ে কিনা আসতে না আসতেই হুকুম তালিম করছে!

বিহঙ্গিনী টিভি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মায়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। মেয়েটা তার মায়ের সাথে এমন আচরণ করছে দেখেও তার খারাপ লাগছে না। বরং মনে হচ্ছে উচিত কাজ হচ্ছে।

মায়া ধুপধাপ পায়ে সোফার দিকে এগিয়ে গিয়ে শ্বশুর নিমাই সরকারের পাশে আয়েশ করে বসলো। পা নাচাতে নাচাতে শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি কণ্ঠে বললো,
“বাবা,চা খান আপনি?”

নিমাই সরকার এতক্ষণ নতুন বউয়ের কার্যকলাপ চুপ থেকে দেখছিলেন। তাকে প্রশ্ন করার সাথে সাথে সে উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ, খাই।”
“খাবেন এখন?”
“হলে খারাপ হয় না।”

মায়া এবার পা নাচাতে নাচাতে শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বললো,
“যান, শাশুড়ী। ননদিনী, বাবা আর আমার জন্য চা করে আনেন। আপনি আর আপনার ছেলে খেলে আপনাদের জন্যও আনবেন। সমস্যা নেই।”

মোহনা ছেলে বউয়ের কার্যকলাপে নিস্তব্ধ। প্রথমবার ছেলে পছন্দ করে একটা অলক্ষী এনেছিলো, আর এবার একটা বাঁ’দ’র এনেছে।

হাওয়ার বেগে গ্রামে খবর ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রামের মেয়ের সংসার ভেঙেছে। অনেকে স্বান্তনা দিতে এসেছে, কেউবা উন্মুখতা নিয়ে পুরো ঘটনা জানতে এসেছে৷ কেউবা দুই বউয়ের কানে মন্ত্রণা দিয়ে গেছে। সারাদিনের এসব ঘটনায় আরও তিতা তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে দর্শিনী। তাই বিকেল হতেই বড় ভাইয়ের ছেলে ধৃষ্টকে নিয়ে বেরিয়ে গেছে গ্রামের পথে। উদ্দেশ্য একটু হাঁটাও হবে আর ভালো একটা ডাক্তারের খোঁজও করতে হবে। এই সময় একজন ডাক্তারের সান্নিধ্যে থাকতে পারলে সব থেকে ভালো হবে।

গ্রামের সরু পথ ধরে হাঁটছে দর্শিনী। লম্বা চুল গুলো কোমরের নিচ অব্দি দুলছে। হালকা ঘিয়ে রাঙা শাড়ি শরীরে জড়ানো। একদম সাদামাটা সাজ। কিন্তু তাকে কোনো অপ্সরা থেকে কম লাগছে না।

দর্শিনী হাঁটতে হাঁটতে আট বছরের ধৃষ্ট-কে প্রশ্ন করলো,
“বাবা,তুমি এখানের কোনো ভালো ডাক্তারকে চেনো?”

ধৃষ্ট তখন পিসির হাতের মুঠোয় নিজের হাত রাখতে ব্যস্ত। পিসির কথায় সে উপর নীচ মাথা নাড়িয়ে বললো,
“হ্যাঁ, পিসি,আমি তো চিনি। সবচেয়ে ভালো ডাক্তারের বাড়িতে তোমায় নিয়ে যাবো। কিন্তু কেনো যাবে তুমি? তুমি কী অসুস্থ?”

ধৃষ্টের কথায় মুচকি হাসি দিলো দর্শিনী। আদুরে কণ্ঠে বললো,
“না বাবা,আমি অসুস্থ না। ডাক্তারের সাথে আমার একটা গোপন কথা আছে তো তাই।”

ধৃষ্ট “আচ্ছা” বলে ছুট লাগালো। গ্রামের সরু পথ ডেঙিয়ে ছোট্ট পুকুরটার সাথে বড় দালানের ভেতর গেলো ধৃষ্ট। ধৃষ্টের পিছে পিছে দর্শিনীও বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো। ধৃষ্টকে পিছু ডেকে বললো,
“বাবা,যাচ্ছো কোথায়?”

“কেনো পিসি,তুমি না ভালো ডাক্তারের কাছে যাবে বলেছিলে? এটা ভালো ডাক্তারের বাড়ি।”

দর্শিনী সামান্য ভ্রু কুঁচকালো। এ বাড়িটা তো বেশিরভাগ সময়ই খালি থাকে তাহলে এখানে ডাক্তার আসবে কোথা থেকে? নিজের মনের মাঝে দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে একটা ঘরের সামনে হাজির হলো দর্শিনী। দরজা ঠেলে ভেতরে পা রাখতেই দর্শিনী অবাক, হতবাক। বিষ্ময়ে বলে উঠলো,
“আপনি এখানে!”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here