#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী পর্বঃ এগারো

0
360

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী পর্বঃ এগারো
#মম_সাহা

সময় নিজের মতন অতিবাহিত হচ্ছে। দর্শিনী গ্রামে এসেছে প্রায় সপ্তাহ খানেক হতে চললো। ছোট বৌদির খারাপ কথা, বিচ্ছেদের যন্ত্রণা, নতুন করে বাঁচার উন্মাদনা নিয়ে কাটছে দিন গুলো।

এখন শীতল রাত নেমেছে প্রকৃতিতে। দর্শিনী জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল রূপোর থালার মতন চাঁদ উঠেছে আকাশে। দর্শিনী সে দিকেই দৃষ্টি স্থাপন করে আছে। তার খাটে ঘুমিয়ে আছে তৃণা। দু’জনে এক সাথেই ঘুমায়। দর্শিনী চাঁদের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বিশাল আকাশে চাঁদ টা যেমন একা, তেমনই একা মাটির বুকে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শিনী। এই একাকীত্ব কারো সামনে প্রকাশ করা যায় না। আর না যায় ভিতরে লুকিয়ে রাখা। আশেপাশে হাজার খানেক মানুষ থাকলেও প্রিয় মানুষের শূণ্যতা বড্ড পোড়ায়। প্রিয় মানুষ ব্যাতীত খুব জোর বেঁচে থাকা যায় কিন্তু ভালো থাকা যায় না। আর দর্শিনী প্রতিনিয়ত ভালো না থাকার অভাবে দুমড়ে মুচড়ে মরছে। আচ্ছা, সে যেমন কষ্ট পাচ্ছে তার একাংশ কষ্টও কী বিপ্রতীপ পায় না? এত বছর এক সাথে ছিলো, একটু কী মায়াও জন্মায় নি? হাহ্,পুরুষ জাতি এত কঠোর কেমন করে হয়!

ভাবনার মাঝেই উঠোনের দক্ষিণ পাশে কারো ছায়া দেখতে পায় দর্শিনী৷ লেবু গাছটার নিচে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা চমকে উঠে সে। এত রাতে তাদের উঠোনে কে দাঁড়িয়ে আছে! ফিসফিস কথার শব্দও পাওয়া যাচ্ছে! দর্শিনী সামান্য ভয় পেলেও সাহস রাখে বুকে। বিছানা কতক্ষণ হাতড়ালো মোবাইলটা খোঁজার জন্য। অতঃপর মনে পড়লো ধৃষ্ট বিকেলে মোবাইলটা দিয়ে গেইম খেলেছে। হয়তো তাদের ঘরে নিয়ে গেছে। দর্শিনী হতাশার শ্বাস ফেললো। কৌতুহল দমানোর জন্য ধীর পায়ে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে।

ঘর থেকে বেরুতেই দর্শিনীর ঘরের দরজা টা একটু শব্দ করে বারি খায়। অন্ধকারে সে শব্দে চমকে উঠে দর্শিনী। ধীর গতিতে দরজাটা আটকিয়ে উঠোনে নামে সে। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে পুরো উঠোন জুড়ে কেউ নেই! দর্শিনী লেবু গাছটার নিচে এগিয়ে গেলো,সে জায়গাটা ফাঁকা। কেবল কয়েকটা জোনাকি পোঁকা উড়ে বেড়াচ্ছে। দর্শিনী ডানে বামে খোঁজ করেও কাউকে না পেয়ে নিরাশ হলো। হঠাৎ তার মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠলো অন্য ভাবনা। গ্রামের মানুষেরা বলে রাত হলে লেবু গাছের নিচে নাকি ভূত, প্রেত থাকে। তবে কী সে এমন কিছুই দেখলো! দর্শিনীর হঠাৎ করে ভয় লাগতে শুরু করলো। সে অনুভব করলো, এ অবস্থায় হুটহাট তার বেরিয়ে পড়া উচিৎ হয় নি। বাচ্চাটার না আবার ক্ষতি হয়ে যায়।

দর্শিনী দ্রুত ঘরের দিকে এগিয়ে যাবে,এমন সময় তার বাহুতে কেউ হাত রাখে। দর্শিনী চমকে উঠে। ভীত হৃদপিণ্ড ছলাৎ করে উঠে। ঘামে ভিজে যায় শরীর। ভীত নয়নে সে পিছে তাকাতেই শরীরের পুরো উত্তেজনা টা শিথিল হয়ে যায়। এতক্ষণের উত্তেজনার জায়গায় ভর করলো বিষ্ময়। দর্শিনী অবাক কণ্ঠে বললো,
“বাবা,তুমি এখানে!”

প্রতাপ সাহা ঠোঁট এলিয়ে হাসলেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে নিবিড় কণ্ঠে শুধালো,
“তুমি এত রাতে এখানে কী করছো,মা?”

দর্শিনী শাড়ির আঁচল টা দিয়ে মুখ ও গলার ঘামটা মুছলো। নিজেকে একটু সময় দিয়ে ধাতস্থ করলো। উত্তেজনা, ভয় কেটে যেতেই সে বললো,
“এইতো,ঘুম আসছিলো না দেখে উঠোনে হাটছিলাম। তুমি উঠেছো কেনো, বাবা?”

“আমি তো দরজার শব্দ পেয়ে উঠলাম। গ্রামে চোর-ডাকাতের প্রকোপ বেড়েছে। তাই ঘুমালেও ঘুম হয় না। সামান্য শব্দ পেলেই সজাগ হয়ে যাই। তোমার এত রাতে উঠানে নামা উচিৎ হয় নি, মা। রাতের বেলা কত রকমেরই বিপদ হতে পারে। এখন খারাপ ছেলেপেলেরা রাত বিরাতে নেশা করে ঘুরে বেড়ায়। এজন্য উঠোনেও তুমি নিরাপদ না। কী বলেছি বুজেছো, মা?”

“হ্যাঁ বাবা,বুজেছি।”

কথা শেষ করে মুচকি হাসি দিলো দর্শিনী। একটু আগে সে এখানে তবে কাকে দেখেছে? নাকি চোর-ডাকাত দল এসেছিলো! মনের মাঝে একটা দ্বিধা রয়েই গেলো দর্শিনীর।

“তুমি কী এখন ঘুমাবে? নাহয় চলো বাবা-মেয়ে আজ একটু কথা বলি।”

দর্শিনীরও ঘুম আসছিলো না। যাক,অবশেষে তার একাকীত্ব দূর করার একজন মানুষ পেলো। দর্শিনী হাসিমুখে সাথে সাথে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“ঘুম আসছে না। চলো গল্পই করি।”

প্রতাপ সাহা মেয়েকে নিয়ে উঠনোরের কিনারায় মাচাটার উপর গিয়ে বসলেন। মেয়ের মাথায় যত্নের হাত বুলিয়ে বললেন,
“জানো,তুমি যখন জন্মালে তখন আমার কী যে খুশি লেগেছিলো। আমি তোমার মাঝে আমার মাকে খুঁজে নিয়ে ছিলাম। তুমি যা-ই আবদার করতে তা-ই পূরণ করার চেষ্টা করতাম। আমার মনে হতো আমার মা আবদার করছে। তোমার মা হাজার বারণ করলেও আমি শুনতাম না। তোমার প্রতি আমার এত ভালোবাসায় হয়তো তোমার জীবনে সুখ কেড়ে নেওয়ার কারণ।”

বাবা’র শেষ কথাটার অর্থ বোধগম্য হলো না দর্শিনীর। অবাক কণ্ঠে বললো,
“কী বলছো বাবা! তুমি আমার সুখ কেড়ে নেওয়ার কারণ কীভাবে!”

প্রতাপ সাহা মুখ নিচু করে ফেললেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ব্যর্থতা প্রকাশ করলেন। বিষন্ন কণ্ঠে বললেন,
“বিপ্রতীপের সাথে তোমার বিয়েতে তোমার মা অনেক অমত প্রকাশ করে ছিলো। কিন্তু আমি এতটাই মেয়ের আবদার পূরণ করতে সচেষ্ট ছিলাম যে এই অমত আমি শুনিই নি। সেদিন যদি একটা বার তোমার মায়ের কথার গুরুত্ব দিতাম, তবে আজ তোমাকে নির্ঘুম একাকীত্ব পূর্ণ রাত্রি যাপন করতে হতো না।”

“আমার দুঃখের পুরোটা দায়ভার আমার, বাবা। এটার ভার আমি কাউকে দিবো না। ভুল মানুষকে আমি ভালোবেসে ছিলাম। যার খেসারত আজ আমি আমার সুখ বিসর্জন দিয়ে দিচ্ছি। তুমি তো কেবল আদর্শ বাবা হতে চেয়েছো। মেয়ের কোনো অভিযোগ রাখতে চাও নি৷ তাহলে তোমার ভুলটা কী? মেয়েকে রাজ্যের সুখ দিতে চেয়েছো,এখানে তোমার দোষটা কী!”

দর্শিনীর কাঠ কাঠ জবাবে হাসলেন প্রতাপ সাহা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আফসোসের সহিত বললেন,
“বরাবরই স্কুলের অংক শিক্ষক হিসেবে আমার সুনাম ছিলো। সবাই বলতো প্রতাপ সাহার মতন অংকের সমাধান কেউ করতে পারবে না। কিন্তু জীবন অংকের এমন ভুল সমাধান করবো, কে জানতে? অংক কষতে কষতে শেষ অব্দি এসে দেখি পুরো অংকটাই ভুল কষেছি। এই ভুল কী আদৌও শোধরাবার?”

বাবার এমন অসহায়ত্ব দর্শিনীর সহ্য হলো না। সে জড়িয়ে ধরলো বাবাকে। প্রতাপ সাহার চোখে অশ্রুকণা। কণ্ঠস্বর কাঁপছে। মেয়েটার জীবন এভাবে ধ্বংস হচ্ছে, তা কোন বাবা-ই সহ্য করতে পারবে?

দর্শিনী বাবার অসহায়ত্ব বুঝলো। বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে তৃপ্তিদায়ক স্বরে বললো,
“তুমি একজন অসাধারণ শিক্ষক সাথে একজন আদর্শ বাবা। বাবাদের কোনো ভুল নেই। বাবারা সবসময় সঠিক। তোমার অংক কখনোই ভুল হয় নি আর হবেও না। আমার ভাগ্য টা খারাপ সেটার দায়ভার তোমার না। তবে এই খারাপ হওয়ার পিছনেও হয়তো ভালো কিছু আছে। তুমিই তো বলতে, প্রতিটা কাজের ভালো খারাপ দুটো দিক আছে। আমরা খারাপ দিকটা দেখছি অথচ ভালো দিকটা হয়তো চোখেই লাগছে না। তুমি মন খারাপ করো না, বাবা। মুদ্রার এপিঠ দেখে মন খারাপ করছো,এখনো তো ওপিঠ দেখা বাকি আছে তাই না?”

প্রতাপ সাহা হাসলেন। মেয়েটা তার কত বুঝদার হয়ে গেলো! হাসিমুখ বজায় রেখেই সে বললো,
“ওপিঠও খুব শীগ্রই দেখবো, মা। জীবন যদি তোমাকে আরেকটা সুযোগ দেয় তবে অতীত ধরে রেখে সে সুযোগ হাতছাড়া করো না। তোমাকেও কেউ একজন অনেক ভালোবাসবে। তাকে ফিরিয়ে দিও না তুমি। আরেকবার জীবনকে সুযোগ দিও। জীবন একটাই,বাঁচার মতন বাঁচতে হবে। বিষাদ নিয়ে কী ভালো থাকা যায়? মৃত্যুর আগে আমি আরেকবার তোমার অংক মিলিয়ে দিয়ে যেতে চাই। আরেকবার আমি তোমাকে হাসতে দেখতে চাই। তুমি আমায় সে সুযোগ দিও, মা।”

দর্শিনী আর কোনো কথা বললো না। কেবল ছোট্ট শ্বাস ফেললো। আদৌও সে আবার বন্ধনে জড়াতে পারবে! বন্ধনে যে তার বড্ড ভয়।

_

গ্রামের সকাল বরাবরই মিষ্টি হয়। দর্শিনী দাঁড়িয়ে আছে বড় মাঠের এক কোণায়। দীর্ঘ এতক্ষণ পরিশ্রম করে সে ক্লান্ত। আজকাল অল্পতেই ক্লান্তি লাগে তার। দর্শিনী জাম গাছটার ছায়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। তৃণা মেডিকেল কলেজের ছাত্রী বিধায় গ্রামে মৃত্যুঞ্জয় আর দৃষ্টান্তের ক্যাম্পিং-এ সেও সাহায্য করছে। দর্শিনীও তাদের সাথে টুকটাক কাজ করছে কারণ দর্শিনীও মেডিকেল কলেজের ছাত্রী ছিলো। কিন্তু ডাক্তার হওয়ার আগেই প্রণয়ে জড়িয়ে তার সুন্দর ভবিষ্যৎ সে নষ্ট করেছে। মাঝে মাঝে নিজেই ভেবে অবাক হয় যে নিজের পায়ে নিজে কীভাবে কুড়াল মেরেছে সে!

গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ তৃণার দিকে দৃষ্টি যায় তার। তৃণা কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মৃত্যুঞ্জয়দের দিকে! দর্শিনী অবাক হয়। এমন দৃষ্টির মানে তার কাছে অজানা নয়। তবে কী মেয়েটা মৃত্যুঞ্জয়কে পছন্দ করে?

#চলবে

[প্রিয় পাঠকমহল,আমি গল্প একদিন পর পর দিচ্ছি,কেনো দিচ্ছি সেটাও জানিয়ে দিয়েছি, তারপরও আপনারা অধৈর্য হলে আমার কি করার আছে বলুন? পরীক্ষা শেষ হলে রোজ গল্প দিবো। আর আপাতত গল্পটা ধীর গতিতে আগাচ্ছে। আসি চাচ্ছি আগে আপনারা পুরোটা জিনিস অনুভব করুন। তারপর আসবে কাহিনী। যাই হোক,ভালোবাসা। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here