#এটা গল্প হলেও পারতো
#পর্ব ১
আমি আর অর্ক দুজন দুজন কে ভালোবাসি, আমরা বিয়ে করতে চাই, প্লিজ আপনি ওর জীবন থেকে সরে যান,
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে, কাঁদতে কাঁদতে বলা কথা গুলো যেনো গরম লোহা ঢেলে দিলো অদিতির কানে, ফোন ধরা হাতটা থর থর করে কাঁপছে, শরীরটা দুর্বল লাগছে, এর পরে যে আরও কিছু বলছে মেয়েটা, সেগুলো ও আর শুনতেই পাচ্ছেনা। কয়েক সেকেন্ডের জন্য মাথাটা সম্পূর্ন খালি হয়ে গেছে ওর, ফোনটা কেটে দিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো দিতি।
কেমন যেনো পাগল পাগল লাগছিলো অদিতির। এইতো মাত্র দুদিন হলো ও শ্বশুর বাড়ি এসেছে, অর্ক তো পরশুই ওকে এখানে রেখে সবে ফিরে গেলো! কি হলো একদিনের মধ্যে! সব কিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে ওর। প্রায় ঘন্টা খানেক একই ভাবে শুয়ে থাকার পরে মাথা টা একটু একটু কাজ করতে শুরু করছে এখন, এই ভাবে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা ঠিক নয় এই অবস্থায়, সবে মাত্র মাসখানেক হয়েছে, এই ভাবে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা ওর বাচ্চার জন্যে ক্ষতিকারক হতে পারে।
কথাটা মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই সোজা হয়ে খাটে উঠে বসলো দিতি, নিজেকে একটু শক্ত করলো। একটা অচেনা মেয়ের ফোনে ও অর্ক কে অবিশ্বাস করছে কেনো! আগে তো ওর অর্কর সঙ্গে সব কথা ক্লিয়ার করা উচিত! নাহ! অর্কর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে হবে, জানতে হবে মেয়েটার কথা কতটা বিশ্বাসযোগ্য। এতদিন অর্কর সঙ্গে একসাথে থেকেও ও চিনতে পারলোনা ওকে!
একটু একটু করে মাথাটা ঠান্ডা হচ্ছিলো, প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠে আস্তে আস্তে কিছুটা হলেও বাস্তব বুদ্ধি কাজ করতে শুরু করেছিলো অদিতির। এতক্ষনে খেয়াল হলো মেয়েটার নাম টুকুও জিজ্ঞেস করেনি ও, আরও কিছু বলছিলো মেয়েটা, সেগুলো না শুনেই ও ফোন টা কেটে দিয়েছে তখন। এবার একটু মনে মনে আফসোস হচ্ছে। কেনো যে ফোন টা কেটে দিলো তখন!
অর্কর সঙ্গে কথা বলতে গেলে এগুলো সব কিছু জানতে হবে আগে, মেয়েটার সঙ্গে ওকে আবার কথা বলতে হবে। নিজের মন কে শক্ত করলো দিতি। যদি সত্যি হয় কথাগুলো তাহলে ও কিছুতেই অর্ক কে ছেড়ে দেবে না। কিন্তু মেয়েটার সঙ্গে কথা না বলে অর্কর সঙ্গে কথা বলে কোনো লাভ নেই, বুকের ভেতরের কষ্টটা কে চেপে রেখে কাঁপা কাঁপা হাতে নতুন করে ফোনটা তুলে নিয়ে মেয়েটা কে ডায়াল করতে যাচ্ছিলো সবে,
কি হলো? শরীর খারাপ নাকি? ওই ভাবে বসে আছিস কেনো?
বলতে বলতেই রুমা ঘরে ঢুকে এলেন। সদ্য প্রেগন্যান্ট ছেলের বউ কে ফ্যাকাশে মুখে বসে থাকতে দেখেই অজানা আশঙ্কায় তাঁর মুখ শুকিয়ে গেলো। শাশুড়ি ঘরে ঢুকে এসেছে দেখেই ফোনটা ডায়াল না করেই, নামিয়ে রাখলো দিতি।
হ্যাঁ মা, শরীরটা একটু খারাপ লাগছে, আর একটু শুয়ে থাকি, ঠিক হয়ে যাবে,
অম্লান বদনে মিথ্যে বললো দিতি, যে করেই হোক শাশুড়ি কে এঘর থেকে সরাতে হবে এখন, আর ধৈর্য্য রাখতে পারছে না ও। মেয়েটার কাছ থেকে সব কিছু সঠিক ভাবে না জানা পর্যন্ত শান্তি নেই ওর।
আচ্ছা আচ্ছা রেস্ট নে তুই, শরীরটা একটু ঠিক লাগলে এটা খেয়ে নিস,
কেটে আনা ফলের প্লেটটা সামনে রেখে বেরিয়ে গেলেন রুমা, শাশুড়ি বেরিয়ে যাবার পর ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিলো দিতি, ছিটকিনি তুলে দিয়ে এসে খাটে বসলো। নিজেকে শক্ত করে গুছিয়ে নিলো একটু, প্রশ্ন গুলো কে জমা করলো এক জায়গায়, একটা প্রশ্নও মিস করলে চলবে না।
এমনিতে সুস্থ, সুন্দর দাম্পত্য জীবন ওদের, কতো বন্ধুদের শ্বশুর, শাশুড়ি নিয়ে সমস্যা থাকে, কিন্তু ওর তাও নেই। অর্কর মা ভীষণ ভালো মানুষ, দিতির মা নেই কিন্তু সেই অভাব ও বিয়ের পরে আর বুঝতে পারেনি, নিজের মেয়ের মতন ভালো বাসেন উনি ওকে। পেশায় অধ্যাপক অর্কও যথেষ্ট সভ্য ভদ্র, প্রায় বছর দেড়েক বিয়ে হয়েছে, আজ পর্যন্ত কোনো রকম বেচাল ও দেখেনি। আজ সেই ছেলে কোনো মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে আছে, তাকে বিয়ে করতে চায়! কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না ওর।
মেয়েটা কে হতে পারে? স্কুল বা কলেজের কোনো বান্ধবী? ছোটো বেলার বন্ধু? অর্ক তো কাউকে বাড়িতে ডাকেনা খুব একটা। একমাত্র মাঝে মাঝে ওর স্টুডেন্টরা আসে প্রয়োজনে। তাহলে কি কলেজে? কিন্তু কলেজে এতো লোকের মধ্যে কিভাবে হলো এসব, কেউ জানলো না!
নিজের মনের মধ্যেই যুক্তি তর্কের জাল বুনে চলেছে দিতি, ভাবতে ভাবতেই ফোনটা আবার তুলে নিলো হাতে। নম্বরটা খুঁজে বের করে ডায়াল করতে গিয়ে দেখলো, একটা ল্যান্ডলাইন নম্বর। একটু অবাকই হলো দিতি, বাড়ির ফোন থেকে করেছে! ও তো তাহলে ইচ্ছা করলেই মেয়েটার ঠিকানা খুঁজে বার করে নিতে পারে! এতো বোকামি করলো মেয়েটা! আর কেউ ছিলনা তখন নাকি বাড়িতে! নাকি ও ও চায় দিতি ওর ঠিকানা সহজেই খুঁজে পায় যেনো! এতো সাহস ও কোথা থেকে পেলো!
আর ধৈর্য্য রাখতে না পেরে ডায়াল করে ফেললো দিতি। ফোনের ওপ্রান্তে বাজতে থাকা প্রতিটা রিংয়ের শব্দ যেনো ওর বুকেও হাতুড়ি পিটতে লাগলো।বার দুয়েক বাজার পর একজন পুরুষ কণ্ঠে হ্যালো বললো কেউ, একটু অপ্রস্তুত হলো দিতি, কি বলবে ও এখন! কাকে চাইবে! ও তো নাম টাও জিজ্ঞেস করেনি তখন। ওর মনে হয়েছিলো মেয়েটাই ফোন ধরবে নিশ্চয়ই, অন্য কেউ বাড়িতে না থাকার সুযোগেই নিশ্চয়ই মেয়েটা ওকে ফোন করেছে। অন্য কেউ ধরলে কি বলবে সেটা তো ও একদম ভাবে নি!
একটু আগে এই নম্বর থেকে আমাকে একটি মেয়ে ফোন করেছিলো, আমি নামটা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম। গলা শুনে অল্পবয়সী মনে হয়েছিলো, ওনাকে একটু দেবেন প্লিজ,
একটু থতমত খেয়ে বললো দিতি, এর থেকে বেশি কিছু আর এই মুহূর্তে ওর মাথায় আসছিলো না। ওপ্রান্তে থাকা পুরুষ কণ্ঠ একটু চুপ করে থাকলো, তারপরে গম্ভীর গলা ভেসে এলো,
কি জন্যে ফোন করেছিলো আপনাকে?
একে কি বলা ঠিক হবে! মনে মনে ভাবতে ভাবতেই অধৈর্য্য গলায় ও প্রান্তের কণ্ঠ বললো,
কি হলো? বলুন?
দিতি নিজেকে সংযত করলো, একটু ঠাণ্ডা গলায় বললো,
সে আমাকে কিছু ব্যক্তিগত কথা বলছিলো, যেগুলো আমি শুধু তার সঙ্গেই বলতে চাই!
ব্যক্তিগত কথা! কি রকম ব্যক্তিগত? এটা একটা দোকানের নম্বর ম্যাডাম, এখান থেকে কোনো মেয়ে আপনাকে কোনো ব্যক্তিগত কথা বলতে পারেনা, কারণ আমাদের দোকানে কোনো মহিলা কর্মচারী নেই!
খানিকটা বিদ্রুপের গলায় বললো লোকটা, মনে মনে একটু চমকে উঠলো দিতি। দোকানের নম্বর! কেউ ইচ্ছা করেই দোকান থেকে ফোন করেছে, যাতে দিতি বুঝতে না পারে! কার না মোবাইল আছে আজকের দিনে! মনের মধ্যে চাপা অশান্তি হতে লাগলো ওর, কি কথা বলবে এবার ও অর্কর সঙ্গে! ওর হাতে তো কোনোই প্রমাণ নেই!
দিতির এই কয়েক মুহূর্তের এলোমেলো ভাবনাগুলোর মধ্যেই ফোনটা রেখে দিলো ওপ্রান্তের পুরুষ কণ্ঠ। দিতির মনের মধ্যে অসম্ভব রাগ হতে লাগলো, বোঝাই যাচ্ছে লোকটা কিছু জানে। তাই জন্যেই দিতি কে আর বেশি কথা বলার সুযোগ দিলো না। কিন্তু ও এর শেষ দেখেই ছাড়বে! আবার ফোনটা তুলে ডায়াল করলো দিতি, উল্টোদিকের হ্যালো শুনেই একটু কড়া গলায় বললো,
কথা শেষ হবার আগেই ফোন রেখে দিলেন? আপনার দোকান কোথায়? আমি কি আপনাকে মিথ্যা কথা বলছি? কাকে বাঁচাতে চেষ্টা করছেন? নিজেকে বেশি চালাক ভাবেন তাই না? আমি পুলিশে অভিযোগ জানাবো,
আরে! আরে! দাঁড়ান ম্যাডাম! এতো বেশি প্রশ্ন একসাথে করে ফেললেন তো! কোনটা ছেড়ে কোনটার উত্তর আগে দিই? আর পুলিশে কমপ্লেন করবেন যখন, তখন তাই করুন না। এতো প্রশ্নের উত্তর একদম পুলিশকেই দেবো তাহলে, আপনাকে দিয়ে আর সময় নষ্ট করি কেনো! যতোসব পাগলের দল! কাজের সময় বিরক্ত করে মারে!
বিরক্ত গলায় কথাগুলো বলেই ফোন রেখে দিল লোকটা। দিতি হতভম্ব হয়ে গেলো একদম। লোকটা উল্টে ওকেই পাগল বলে দিলো! এতো সাহস যে পুলিশে কমপ্লেন করতেও বললো! তাহলে কি লোকটা ঠিকই বলেছে, ওখানে কোনো মেয়ে নেই! নাহলে পুলিশে অভিযোগের ভয় দেখানো সত্বেও ও একটুও ভয় পেলো না কেনো! কিন্তু এতো ভুল তো হয়নি ওর! ও তো ইনকামিং নম্বরেই ডায়াল করেছে! লোকটা আদৌ সত্যি বলছে তো? এটা সত্যিই কোনো দোকানের নম্বর কিনা জানা দরকার।
দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো অদিতি, দরজা খুলে বেরিয়ে এলো ড্রইং রুমে। শ্বশুর, শাশুড়ি দুজনেই চা নিয়ে বসে আছেন সোফায়, সামনে খোলা টিভি তে সিরিয়াল চলছে। ওকে দেখেই রিমোট হাতে নিয়ে সাউন্ড কমিয়ে দিলেন সমরেশ, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে দুজনেই তাকালেন ওর দিকে।
মা, বাড়িতে টেলিফোন ডিরেক্টরি আছে? একটু দাও না প্লিজ,
রুমা একটু অবাক হলেন,
ডিরেক্টরি! না রে বাবা, সেসব তো কিছু নেই। আগে থাকতো, এখন আর ওসব কেউ রাখে নাকি! পুরনো দিয়ে যদি হয়, তবে আমার ঘরের ওপরের তাকে একটু খুঁজে দেখতে পারিস। তবে সে কিন্তু বেশ অনেক বছর আগের! সেসব নম্বর কি আর আছে! কে জানে! কিন্তু তুই এখন ওসব দিয়ে কি করবি?
আচ্ছা! তুই তো ডাউনলোড করে নিতে পারিস ওটা! এতো খোঁজাখুঁজির দরকার কি?
পাশ থেকে বলে উঠলেন সমরেশ, দিতি লজ্জায় পড়লো। ইস! এতো সহজ সমাধানটা ওর একটুও মাথায় আসে নি আগে! কি যে হচ্ছে ওর! এই ফোনটা ওর সব বুদ্ধি গুলিয়ে দিচ্ছে, একদম পাগল করে ছাড়বে ওকে!
থ্যাংক ইউ বাবা,
বলতে বলতে দৌড়ে ঘরে ঢুকে গেলো দিতি, পেছন থেকে রুমার স্নেহ মিশ্রিত গলা ভেসে এলো,
আরে! আস্তে! এতো ছোটা ছুটি করিস না এই অবস্থায়! পাগলি মেয়ে একটা!
ক্রমশ
( প্রথম পর্ব কেমন লাগলো? সবাই মতামত দেবেন প্লিজ ❤️)
ছবি অন্তর্জাল